সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ১৮ই এপ্রিল ২০২৪, ৫ই বৈশাখ ১৪৩১

বাংলার বারভূঁইয়া : পাহলোয়ানের মাতাঙ্গ রাজ্য : মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার


প্রকাশিত:
১০ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:৫৩

আপডেট:
১৮ এপ্রিল ২০২৪ ১০:৪১

ছবিঃ ঈসা খা’র প্রাসাদ

 

বারভূঁইয়াদের পরিচিতি

সাধারণত ‘বারভূঁইয়া’ বলতে সম্রাট আকবর ও সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্ব কালীন বাংলার বড় বড় ভূঁইয়া বা জমিদারকে বুঝানো হয়। যদিও তাঁদের সংখ্যা বার জনের কথা বলা হয়ে থাকে কিন্তু প্রকৃত অর্থে তা সঠিক নয়। বিভিন্ন ঐতিহাসিক বর্ণনায় ভূঁইয়াদের পরিচিতি ও সংখ্যাগত বিষয়ে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। সমসাময়িক লেখকরা বারভূঁইয়া শব্দটি লৌকিক ব্যবহার থেকে গ্রহণ করেছেন এবং এতে জমিদারদের একটি অনির্দিষ্ট সংখ্যা বুঝানো হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।

বারভূঁইয়াদের উৎপত্তি হয় বাংলায় আফগান শাসনামলে। শের শাহের মৃত্যুর পর পুত্র ইসলাম শাহের সময়ে সোলেমান খান বিদ্রোহ করেন। ইসলাম শাহের মৃত্যুর পর দিল্লীতে যে বিশৃঙ্খলা দেখা তার প্রভাব পড়ে বাংলাতেও। আফগান অমাত্য ও সেনাপতিরা স্বাধীনচেতা ছিলেন। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি তাঁরা অনুগত হলেও আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তাঁরা স্বাধীনতা পছন্দ করতেন। আফগানদের রাজনৈতিক কাঠামোতে এতে বাধা ছিল না। সে সুবাদেই ভূঁইয়াদের আবির্ভাব ঘটে।

আফগানদের অনুসরণ করে এখানকার জমিদারগণও স্বাধীনতা চর্চায় উৎসাহ বোধ করেন। ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর বঙ্গদেশ তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করলেও এ অঞ্চলের তৎকালীন আফগানদের ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট করতে পারেননি। মোগল বিজয়ের প্রাক্কালে এ অঞ্চলের জমিদারগণ তাঁদের নিজ নিজ এলাকা স্বাধীনভাবে শাসন করতেন। বেকায়দায় পড়লে তাঁরা মোগলদের বশ্যতা স্বীকার করলেও মোগল সৈন্যরা ফিরে যাবার পর পুনরায় স্বাধীনভাবে কর্তৃত্ব করতেন।

সে সময়ে বাংলার স্বাধীনতার জন্য যেসকল বীর যোদ্ধা মোগলদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ট ছিলেন ঈশা খান। তিনি সরাইলের জমিদার হিসেবে জীবন শুরু করলেও কালক্রমে অসাধারণ প্রজ্ঞা, সাহস, রণদক্ষতা ও কৌশলের সাহায্যে ২২ পরগণার মালিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ভাটির ভূঁইয়াদের নেতৃত্ব লাভ করেন। মোগলদের প্রতিরোধ করার জন্য তখন যে সকল জমিদারগণ সম্মিলিত সামরিক প্রয়াশ চালান তাঁরা সবাই বারভূঁইয়ার অন্তর্গত। সে সময়ে ঈশা খানের বিশ্বস্থ সেনাপতি ছিলেন পাহলোয়ান।

ড. এম. এ. রহিমের মতে, সম্রাট আকবরের সময়ে বাংলাদেশ নামমাত্র মোগল সাম্রাজ্যভুক্ত হলেও এখানকার বড় বড় জমিদাররা মোগল শাসন মেনে নেননি। তাঁরা সম্মিলিত ভাবে বাংলায় মোগল শাসন প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে নিজেদের স্বাধীনতা রক্ষা করেছিলেন। এই জমিদাররাই বারভূঁইয়া নামে খ্যাত। তাঁদের আমলের বাংলাদেশ বারভূঁইয়ার মূলক নামে অভিহিত হয়। তিনি সম্রাট আকবর ও সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালের দলিলপত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে সে যুগের জমিদারদের কর্তৃত্বাধীন এলাকাসহ ৩৫ জনের একটি তালিকা উপস্থাপন করেছেন।

সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ড. আবদুল করিম-এর অভিমত: ‘মোগল বিজয়ের প্রাক্কালে অনেক ভূঁঞা বা জমিদার বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাধীন ভাবে শাসন করতেন। তাদের কেউ কেউ রাজা আবার কেউ মসনদ-ই-আলী উপাধি নিতেন। বেকায়দায় পড়লে তারা মোগলদের বশ্যতা স্বীকার করলেও মোগল সৈন্যরা ফিরে যাওয়ার পরে তারা পুনরায় স্বাধীন ভাবে চলাফেরা করতেন। আধুনিক ঐতিহাসিকেরা মনে করেন যে, হয় এরা সকলেই বারভূঁঞার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন বা এদের মধ্যে যারা মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন তারাই বারভূঁঞার মধ্যে ছিলেন। তারা বলেন যে, বার সংখ্যাটি বহু অর্থেই হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে ভূঁঞাদের সংখ্যা বার জনের বেশী ছিল। কিন্তু সমসাময়িক মোগল ইতিহাস আকবরনামা এবং মির্জা নাথানের বাহারীস্তান-ই-গায়বী আলোচনা করলে দেখা যায় যে, তারা যখনই বারভূঁঞার কথা বলেন সঙ্গে সঙ্গে ভাটির কথাও বলেন, অর্থাৎ তারা বলেন যে, বারভূঁঞা মানে ভাটির বারভূঁঞা।’

তিনি বলেন, ‘পশ্চিমে ইছামতী নদী, দক্ষিণে গঙ্গা (পদ্মা) নদী,  পূর্বে ত্রিপুরা রাজ্য এবং উত্তরে বৃহত্তর ময়মনসিংহ সহ উত্তর-পূর্বে সিলেটের বাণিয়াচংগ। গঙ্গা (পদ্মা), ব্র‎হ্মপুত্র এবং মেঘনা এ তিন বৃহৎ নদী ও তাদের শাখা প্রশাখা বিধৌত এবং বেষ্টিত (বৃহত্তর) ঢাকা, ময়মনসিংহ, ত্রিপুরা ও সিলেটের নিম্নাঞ্চল নিয়ে ভাটি গঠিত।’ তিনি সম্রাট আকবর ও সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলের ভূঁইয়াদের পৃথক দুটি তালিকা পেশ করেন। তাতে সম্রাট আকবরের আমলে ১৩ জন এবং সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে ১৩ জন এই ২৬ জন ভূঁইয়ার নাম রয়েছে।

ড. এম. আই. বোরা বলেন, বাংলার শেষ কররানী সুলতান দাউদের পতনের পর ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে যেসব সরদার শক্তিশালী হয়ে উঠে, তারাই বারভূঁইয়া নামে খ্যাত। তাঁদের সংখ্যাগত মতভিন্নতার কথা বলে তিনি বাহারীস্তান-ই-গায়বী গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে ইসলাম খাঁ কর্তৃক পরিচালিত অভিযানের সময়কার ১৫ জনের একটি তালিকা দিয়েছেন। ড. এম. এ. রহিমের তালিকায় ২৪ ক্রমিকে, ড. আবদুল করিম প্রদত্ত সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলের তালিকায় ১২ ক্রমিকে এবং ড. এম আই বোরার তালিকায় ৯ ক্রমিকে মাতাঙ্গের পাহলোয়ানের নাম রয়েছে।

সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে ভূঁইয়াদের নেতা ছিলেন ঈশা খান। ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পর নেতৃত্বে আসেন তদীয় পুত্র মুসা খান। অপরদিকে ১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আকবর পরলোক গমন করলে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন তৎপুত্র জাহাঙ্গীর। তাঁর সময়েই বারভূঁইয়ার সর্বশেষ প্রতিরোধ এবং বিলুপ্তি ঘটে। সে সময়কালে সিলেট অঞ্চলের জমিদারদের মধ্যে আনোয়ার খাঁন ও পাহলোয়ানের জমিদারী ছিল হবিগঞ্জ অঞ্চলে। আনোয়ার খান বানিয়াচঙ্গের এবং পাহলোয়ান মাতাঙ্গের জমিদার ছিলেন। মোগলদের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ যুদ্ধে সকল ভূঁইয়াদের মধ্যে আনোয়ার খাঁন ও পাহলোয়ানের শক্তিশালী অবস্থান ছিল। তাঁদের বীরত্ব গাঁথার বাস্তব ও নির্ভরযোগ্য তথ্য বিবৃত হয়েছে মির্জা নাথানের ‘বাহারীস্তান--গায়বী’ গ্রন্থে। মাতাঙ্গের পাহলোয়ান নামটি সকল বর্ণনায়ই উল্লেখ থাকলেও মাতাঙ্গের অবস্থান এবং পাহলোয়ানের পরিচিতি সম্পর্কে সকল লেখকগণই নির্বাক।

১৫৮১ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরার রাজা অমর মাণিক্যের সাথে তরফের অধিপতি সৈয়দ মুসার জিকুয়া নামক স্থানে এক যুদ্ধ হয়। তাতে ঈশা খান সেনাপতি হিসেবে ত্রিপুরার পক্ষে যুদ্ধ করেন। পাহলোয়ান তদধীন একজন সেনানায়ক ছিলেন। এ যুদ্ধে তরফ রাজ্যের পতন ঘটে। যুদ্ধের পর অমর মাণিক্য ঈশা খানকে আপন অধিকৃত রাজ্যাংশ, উত্তর চট্টগ্রামের শাসন ও প্রতিরক্ষার দায়িত্ব দিয়ে সেনাপতি পদে নিযুক্ত করেন। ঈশা খানের বিশ্বাসভাজন সেনানায়ক পাহলোয়ান ছিলেন তরফ এলাকার সন্তান। তাই তিনি তরফে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে পাহলোয়ানকে রেখে নিজে চট্টগ্রাম চলে যান।

মাতাঙ্গের পাহলোয়ান সম্পর্কে মোগল সেনাপতি মির্জা নাথান অকপটে স্বীকার করেন যে, পাহলোয়ান ছিলেন জমিদারদের মধ্যে সবচেয়ে সাহসী ও বীর যোদ্ধা। এই বীর যোদ্ধা সম্পর্কে ইতিহাস নিরব।

 

মাতাঙ্গে পাহলোয়ানের প্রতিরোধ

১৬১১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে লক্ষা নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে ভূঁইয়াদের সাথে নৌযুদ্ধে কত্রাবু ও কদমরসুলসহ কয়েকটি দুর্গ মোগলদের অধিকারে চলে যায়। অতঃপর সোনারগাঁওও মোগলদের দখলে চলে গেলে শামসউদ্দীন বাগদাদী, বাহাদুর গাজী ও মজলিশ কুতুব তাদের জমিদারী জায়গীর স্বরূপ পাওয়ার শর্তে ইসলাম খানের নিকট আত্মসমর্পণ করেন। অনন্যোপায় হয়ে মুসা খাঁও আত্মসমর্পণ করলে অপরাপর জমিদারও মোগলদের বশ্যতা স্বীকার করেন। অনন্ত মাণিক্য বীরদর্পে মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে একসময় আরাকানে পলায়ন করতে বাধ্য হন। এ অবস্থায় খাজা ওসমান, আনোয়ার খাঁ, বায়েজিদ কররানী ও পাহলোয়ান সর্বশেষ পর্যায়ে পুনরায় মৈত্রী সূত্রে আবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেন।

টুক থেকে রাজা রায় ও ইসলাম কুলিকে বন্দী করে বানিয়াচঙ্গ নিয়ে এসে আনোয়ার খাঁন মোগল বাহিনীর বিরুদ্ধে কঠিন সমরের প্রস্তুতি নেন। উভয় পক্ষের মরণপন যুদ্ধের এক পর্যায়ে আনোয়ার খাঁন বেকায়দায় পড়ে খাজা ওসমানের সহযোগিতা প্রত্যাশায় সন্ধির অজুহাতে কালক্ষেপনের চেষ্ঠ করেন। কিন্তু ওসমান তখন নিরূপায় হয়ে বোকাইনগর দুর্গ পরিত্যাগ করে নানা স্থান ঘুরে লাউড় পাহাড় হয়ে সিলেটে চলে যান। এ অবস্থায় আনোয়ার খাঁন আত্মসমর্পন করলে তাঁকে বন্দি করা হয়।

বোকাইনগর হতে খাজা ওসমানের পলায়ন এবং আনোয়ার খাঁনের আত্মসমর্পণের পর সুবাদার ইসলাম খান তাঁর ভাটি অভিযানের সফলতার স্বাদ গ্রহণ করেন। কিন্তু তিনি এতেও সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাঁর লক্ষ্য ছিল খাজা ওসমান ও শ্রীহট্টের বায়েজিদ কররাণীকে পদানত করে সুদূর আসাম পর্যন্ত নিজ কর্তৃত্বে নেয়া। তাই তিনি ভূঁইয়াদের অপর শক্তিশালী নেতা পাহলোয়ানকে দমন করার জন্য মাতাঙ্গ আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি হাজী শামস উদ্দীন বাগদাদী ও তার তিন ভাই মির্জা সাকী, বাকী ও পাট্টানীর নেতৃত্বে এক শক্তিশালী বাহিনী প্রেরণ করেন।

সোনারগাঁও পতনের পরই পাহলোয়ান স্বীয় রাজ্যে এসে মোগলদের সম্ভাব্য আক্রমণের আশঙ্কায় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। বানিয়াচঙ্গ জয়ের পর খাজা ওসমানকে আক্রমণ করার পূর্বে মোগলদের বিবেচনায় পাহলোয়ানের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা অপরিহার্য ছিল। তাই উভয় দিক হতে মাতাঙ্গ আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। মাতাঙ্গের স্বাধীনতা রক্ষায় নিজের শেষ রক্তবিন্দু বিসর্জন দিয়েও শেষ রক্ষা করতে অসমর্থ হন পাহলোয়ান।

বাহারীস্তান-ই-গায়বীতে পাহলোয়ানের বিরুদ্ধে পরিচালিত এ অভিযানের বর্ণনা নিম্নরূপ : ‘ইসলাম খাঁ আনোয়ার খাঁকে কয়েদ করেন। বোকাই নগরে কাজের সন্তোষজনক ব্যবস্থা করে হাজী শাম্স উদ্দীন বাগদাদী ও তাঁর তিন ভাই মির্জা সাকী, বাকী ও পাট্টানীর নেতৃত্বে মাতাঙ্গের জমিদার পাহলোয়ানের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী বাহিনী প্রেরণ করেন। পূর্বোক্ত হাজীকে পাহলোয়ানের রাজধানী ও তরফ দুর্গের মাঝখানে একটি সুদৃঢ় দুর্গ তৈরি করার নির্দেশ দেন। সেখানে ওসমানের পুত্র মোমরিজ ও ভাই মালহী অবস্থান করছিলেন। এমনি করে দুটি অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেন। হাজী এক শুভ মুহূর্তে বিশ্বস্ত সৈন্যদের নিয়ে রওনা হয়ে যান। কয়েক মঞ্জিল পার হয়ে কয়েক দিনের মধ্যে পূর্বোক্ত গন্তব্য স্থলে পৌঁছেন। সেখানে একটি উচ্চ দুর্গ তৈরি ও পরিখা খনন করে যুদ্ধের জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত হয়ে থাকেন। পালা করে তিনি দুদিকের নিকটবর্তী গ্রামগুলি লুট করতে থাকেন। ওসমানের পুত্র খাজা মোমরিজ ও ভ্রাতা খাজা মালহীর কাছে এ সংবাদ পৌঁছুলে তাঁরা তাঁদের সকল যোদ্ধা ও অনুগামীদের ডেকে এক সভার অনুষ্ঠান করেন। তাঁরা হাজী শাম্স উদ্দীনের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর জন্য একমত হন। খাজা মোমরিজ ও খাজা মালহী তরফ দুর্গে ছোট সৈন্য দল রেখে দুপুর বেলা রওনা হয়ে ছয় প্রহরে তাঁরা সেখানে পৌঁছে পরদিন ভোরে হাজী শাম্স উদ্দীনের দুর্গ আক্রমণ করেন। যুদ্ধ বেধে যায় এবং ভীষণভাবে তা চলতে থাকে। সে যুদ্ধ মানুষের মনে কিয়ামত দিনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। দুর্গ থেকে তীর, বন্দুক ও কামানের গোলা এমনভাবে বর্ষিত হতে থাকে যে তা বৃষ্টির মুষলধারা ও শিলাবৃষ্টিকে ছাড়িয়ে যায়। আফগানগণ দ্রæত ঐক্যবদ্ধ হয়। বাজ নামক একটি হাতী সামনে রেখে দুর্গের ফটকের দিকে  তারা ধাবিত হয়। যুদ্ধের প্রচন্ডতার ফলে হাতীর সম্মুখস্থ মাহুত ও পশ্চাতে অবস্থিত তার সহকারী দুজনই আহত হয়ে হাতীর উপরই লুটিয়ে পড়ে মারা যায়। কাল বিলম্ব না করে হাতীটি ফটক ভেঙ্গে ফেলে দুর্গের ভিতর ঢুকে পড়ে । হাজী নিজে তাঁর কয়েকজন বিশ্বস্থ সৈন্য সহ পরিখা থেকে বেরিয়ে দুর্গের ফটক ঘেরাও করেন এবং হাতীর চারটি পা কেটে টুকরা টুকরা করে ফেলেন। যেসব আফগান হাতীর পায়ে ঝুলে দুর্গে প্রবেশ করেছিলো তারা হাতাহাতি যুদ্ধে লিপ্ত হয়। সর্বশক্তি নিয়ে আফগানগণ তিন বার দুর্গে প্রবেশ করে এবং প্রতিবারই শাহী ফৌজ হাতাহাতি যুদ্ধ করে তাদেরকে দুর্গ থেকে তাড়িয়ে দেয়। চতুর্থ বারের আক্রমণ সহ্য করতে না পেরে তারা পালিয়ে যায়। মোগলেরা সম্রাটের সৌভাগ্যের জোরে জয়লাভ করে। আফগানরা পরাজিত হয়ে সঙ্কটজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। হাজী বিজয় দুন্দুভী বাজিয়ে পাহলোয়ানের বিরুদ্ধে এগিয়ে যান এই ভেবে যে, যখন এই বিজয় লাভ হয়েছে তখন শত্রæরা ভয় পেয়ে আত্মসমর্পণ করবে। কিন্তু পাহলোয়ান ছিলেন জমিদারদের মধ্যে সবচেয়ে সাহসী ও বীর যোদ্ধা। তার অনুগত ভাইদের একদল সৈন্য থাকায় হাজী শাম্স উদ্দীন ও শাহী ফৌজের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য এগিয়ে আসেন। পাহলোয়ানের রাজধানী মাতাঙ্গের সন্নিকটে এক ভীষণ যুদ্ধ হয়। সরদারেরা একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়তে থাকেন কিন্তু কোনো ফল হচ্ছিল না। তখন পাহলোয়ান একটি বর্শা হাতে নেন এবং হাজী একটি তীর পাহলোয়ানের বুকের প্রতি লক্ষ্য করে ছুঁড়েন। পাহলোয়ান ক্ষিপ্রগতিতে হাজীর উপর বর্শা নিক্ষেপ করেন। বর্শা তার বুকে লাগে। দুজন সরদারই একে অন্যের হাতে নিহত হলেন। এমন সময় হাজী শাম্স উদ্দীনের পালকপুত্র কোরবান আলী সাহসের সঙ্গে তার পিতার বিশৃঙ্খল সৈন্যদের একত্রিত করে যুদ্ধক্ষেত্রে ধাবিত হয় এবং জয়লাভ করে। পাহলোয়ানের পক্ষের যে-ই যুদ্ধক্ষেত্রে এসেছে সে-ই তরবারির আঘাতে  মৃত্যুবরণ করেছে। অন্যেরা পালিয়ে যায়। বিজয় দুন্দুভি বেজে উঠে, এক নাকাড়া বাজিয়ে তারা তাদের শিবিরে ফিরে আসে। কোরবান আলী মির্জা সাকী এবং বাকীর সহযোগিতায় যুদ্ধ জয় এবং হাজী শাম্স উদ্দীনের মুত্যুসংবাদ ইসলাম খাঁকে লিখে জানান।’

বাংলার সুবাদার ইসলাম খান কর্তৃক ভাটি অঞ্চলের জমিদার বা বারভূঁইয়াদের বিরুদ্ধে অভিযান ইতিহাসের একটি উল্লে¬খযোগ্য অধ্যায়। ইসলাম খান তাঁর রণকৌশলে বারভূঁইয়াদের তখনকার নেতা মুসা খাঁসহ সকল জমিদারকেই বশ্যতা স্বীকার করাতে সক্ষম হলেও পাহলোয়ানই ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি কোনো পর্যায়েই বশ্যতা স্বীকার করেননি। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সে বীরই সহযোগী দলছুট অপর ভূঁইয়ার হাতে প্রাণ বিসর্জন দিলেন। স্বীয় অধিকারভুক্ত অঞ্চলের স্বাধীনতা রক্ষায় বীরের ন্যায় মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণকে তিনি বশ্যতা বা আত্মসমর্পণের নামে বহিরাগত শক্তির কাছে মাথা নত করার চাইতে উত্তম জ্ঞান করলেন। সীমিত রাজনৈতিক অবস্থান থেকে মনের অসীম তেজস্বীতায় স্বীয় নামের স্বার্থকতা আনয়নে তাঁর ভূমিকা অবিস্মরণীয়। তাঁর এ আত্মনিবেদন এ অঞ্চলের বীরত্ব গাঁথায় উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো প্রজ্জ্বলিত হবার কথা থাকলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা ইতিহাসের অকথিত অধ্যায় হিসেবে বিস্মৃতির অন্ধকার গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে।

 

মাতাঙ্গ রাজ্যের অবস্থান

১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে হযরত শাহজালাল র. কর্তৃক সিলেট বিজয়ের সময়ে তাঁর অন্যতম সহচর ও সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দিন র.-এর নেতৃত্বে ত্রিপুরার করদরাজ্য রাজপুর বা তুঙ্গাচল মুসলমানদের অধিকারভুক্ত হলে তার নতুন নামকরণ হয় তরফ। তখন উক্ত তরফের সীমা ছিল উত্তরে বরাক নদী, পূর্বে ভানুগাছের পাহাড়, দক্ষিণে বেজোড়া পরগণা, পশ্চিমে লাখাই। পরবর্তীতে এর সীমা দক্ষিণে সরাইল-সতর খন্ডল ও পশ্চিমে জোয়ানশাহী পরগণা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

এই বিস্তীর্ণ এলাকাটি মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল এবং এর শাসকদের সাথে মোগল দরবারের সম্পর্ক থাকার যথেষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও আইন-ই-আকবরীতে এর উল্লেখ না থাকার বিষয়টি রহস্যজনক। তরফ অঞ্চলটি পাহাড়াঞ্চল হিসেবে বিবেচিত হলেও রঘুনন্দন পাহাড়ের পশ্চিমাংশ ছিল সমভূমি বিশিষ্ট জনপদÑ যা বেজোড়া বাজু পরগণা হিসেবে পরিচিতি পায়। আইন-ই-আকবরীতে পরগণা হিসেবে তরফের পরিবর্তে বেজোড়া বাজু’র উল্লেখ রয়েছে। জানা যায়, তরফের শাসক সৈয়দ মিকাইলের পুত্র সৈয়দ মুসার রাজ্য লাভের সমসাময়িক কালেই বেজোড়া নামকরণ হয়েছিল। তখন দিল্লীর দরবারে আসীন ছিলেন সম্রাট আকবর। এর নামকরণের সাথে জড়িয়ে আছে, তরফের শাসক সৈয়দ মুসার অগ্রজ সৈয়দ আব্বাস ও দিল্লী দরবারের জনৈক ওমরাহ তনয়ার কথিত বিয়োগান্তক ঘটনা। ধারণা করা হয়, এটি ষোড়শ শতকের শেষ দিকে সংঘটিত হয়েছিল। এ ঘটনা সংঘটনের পূর্বে বেজোড়ার নাম কি ছিল তথ্যাভাবে বলা না গেলেও বেজোড়ার পরিবর্তে অন্য কোনো নাম যে ছিল তাতে কারো সন্দেহ নেই।

সম্রাট আকবরের রাজস্ব সচিব রাজা টোডরমল ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে দিওয়ান-ই আশরাফ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর তাঁর রাজস্ব হিসাব প্রস্তুতের কাজ শুরু করেন। ত্রিপুরা বাহিনী কর্র্তৃক তরফ বিজয়ের কাল ছিল ১৫৮১ খ্রি.। তরফ বিজয়ের অল্পদিন পরেই ঈশা খাঁ মোগলদের কাছে পরাজিত হয়ে ত্রিপুরা গমনের প্রেক্ষিতে সরাইল ও রঘুনন্দন পাহাড়ের পশ্চিমাংশ মোগলদের করতলগত হওয়ায় তরফের এ অংশ ‘বেজোড়া বাজু’ উল্লেখে সংশ্লিষ্ট রাজস্ব হিসাবে সরকার সিলেটের অন্তর্ভুক্ত হয়।

১৬০৭ খ্রিস্টাব্দে ইসলাম খাঁ বাংলার সুবাদার নিয়োগপ্রাপ্ত হন। তাঁর প্রচেষ্ঠায় মোগল বাহিনী ১৬১২ খ্রিস্টাব্দে  ভূইয়াদের দমন অভিযানে সাফল্য লাভ করে। এ সময়েই মাতাঙ্গ রাজ্য আলোচনায় আসে। আইন-ই-আকবরীতে সিলেট সরকারের অধীন মহাল তালিকায় তরফ ও মাতাঙ্গের উল্লেখ না থাকায় সে সময়ে তরফ ও মাতাঙ্গের প্রশাসনিক পরিচিতি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। তবে তখন তরফ, মাতাঙ্গ বা বেজোড়া যে একই প্রশাসনিক এলাকাভুক্ত ছিল তাতে সন্দেহ নেই। বাহারীস্তান-ই-গায়বীতে ‘পাহলোয়ানের রাজধানী মাতাঙ্গ’ কথাটির উল্লেখ থাকায় সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসে রাজধানীর নাম মাতাঙ্গ হলে রাজ্যের নাম কি ছিল? সংশ্লিষ্ট গ্রন্থের টীকায় বলা হয়েছে, মাতাঙ্গ’র অবস্থান তরফের নিকটেই কোথাও ছিল। এ কারণে বিভিন্ন বর্ণনায় অনুমানের ভিত্তিতে পাহলোয়ানের রাজ্যের নামই ‘মাতাঙ্গ’ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। 

বাহারীস্তান--গায়বীর টীকায় (পৃ. ২৯৪) তরফের নিকটেই কোথাও মাতাঙ্গের অবস্থান বলা হয়েছে। ড. এম ইসলাম বোরাসহ সকল ঐতিহাসিকের বর্ণনায়ই এ অনুমান সমর্থিত। ড. এম. এ. রহিম সিলেট জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমে তরফের নিকটবর্তী কোথাও মাতাঙ্গের অবস্থান ছিল এবং পাহলোয়ান এর জমিদার ছিলেন বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। ড. আবদুল করিম বলেন, ‘সরাইলের উত্তরে এবং তরফের দক্ষিণে মাতাঙ্গ নামে একটি ক্ষুদ্র পরগণায় পাহলোয়ান নামে একজন ভূঞা ছিলেন’। এসব অভিমত এবং স্থানীয় পরিবেশ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে মাতাঙ্গ যে বেজোড়া এলাকায়ই বিদ্যমান ছিল তা সহজেই অনুমেয়। তাই সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে যে ‘মাতাঙ্গ’ বেজোড়ারই পূর্বনাম ছিল।

প্রসঙ্গত বলা আবশ্যক যে, পাহলোয়ানকে কেউ মাতাঙ্গের জমিদার কেউবা শাসক বলেছেন। আবার মাতাঙ্গকেও কেউ রাজ্য কেউবা পরগণা বলেছেন। মির্জা নাথান মাতাঙ্গকে পাহলোয়ানের রাজধানী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। প্রশ্ন আসতেই পারে যে, মাতাঙ্গ কোনো রাজ্য ছিল নাকি কোনো রাজ্যের রাজধানী ছিল কিংবা কেবলই একটি পরগণা ছিল? এর উত্তরে বলা যায়, শের শাহের আমলেই বাংলাকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রশাসনিক ইউনিটে বিভক্ত করা হয়। আফগান অমাত্য ও সেনাপতিরা কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্ধারিত রাজস্ব প্রদান করে তাঁদের অধিকারভুক্ত পরগণা বা জায়গীরসমূহ স্বাধীন ভাবে শাসন করতে অভ্যস্ত ছিলেন। তাঁদের দ্বারা প্রভাবিত হন এ দেশীয় জমিদারগণও। মোগলদের বিরুদ্ধে ঈশা খানের প্রতিরোধ যুদ্ধকালে স্থানীয় জমিদাররা কেন্দ্রীয় সরকারকে রাজস্ব প্রদান না করে পুরোপুরি স্বাধীনভাবে নিজ নিজ এলাকা শাসন করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। সে কারণে প্রতিটি পরগণা বা জমিদারী এলাকাই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে পরিণত হয়। তরফ অঞ্চল তেমনি একটি প্রশাসনিক ইউনিটই ছিল। পাহলোয়ানের জন্মস্থান হিসেবে মাতাঙ্গ ছিল এর কেন্দ্রস্থল বা রাজধানী।  

আইন--আকবরী’তে যে স্থানটিকে ‘বেজোড়া বাজু’ বলা হয়েছে, প্রায় সমসাময়িক কালের যুদ্ধকথার বর্ণনায় বাহারীস্তান--গায়বী’তে ‘মাতাঙ্গ’ বলা হয়েছে। এর কারণ হতে পারে, নতূন নামকরণ হিসেবে টোডরমলের রাজস্ব হিসাবে মহালটির নাম বেজোড়া উল্লেখ করা হলেও তখন পর্যন্ত বোধ হয় স্থানীয় ভাবে এর পূর্বনাম ‘মাতাঙ্গ’ই প্রচলিত ছিল। তাছাড়া মোগল রাজস্ব হিসাবে এ স্থান একটি মহাল হিসেবে গণ্য থাকলেও এর জমিদার পাহলোয়ান যে কোনো সময়েই মোগলদের বশ্যতা স্বীকার করেননি তা প্রমাণের জন্য বাহারীস্তান--গায়বীই শ্রেষ্ট দলিল।

মাতাঙ্গকে কেউ কেউ হবিগঞ্জ সদর উপজেলাধীন নূরপুর ইউনিয়নের ‘সুতাং’ কিংবা চুনারুঘাট উপজেলাধীন পাইকপাড়া ইউনিয়নের ‘সতং’ এর সাথে অভিন্ন মনে করার প্রয়াশ পেয়েছেন। সুতাং একটি নদীর নাম। এ নামে সেখানে কোনো স্থানের অস্তিত্ব নেই। অপরদিকে সতং নামে সেখানে একটি মৌজা ও গ্রাম বিদ্যমান। আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের শায়েস্তাগঞ্জ-বাল্লা রেল লাইনে সতং নামে একটি রেলষ্টেশনও ছিল। কিন্তু পরিবেশগত কোনো উপযোগিতা বা মাতাঙ্গের অবস্থান সম্পর্কিত কোনো ঐতিহাসিক অনুমানেই সেসব স্থানকে আকর্ষন না করায় সুতাং কিংবা সতংকে মাতাঙ্গ মনে করার সুযোগ নেই।

সার্বিক বিষয় বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অতীতে তরফের সাথে মোগল দরবারের সম্পর্ক ছিল। ১৫৮১ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরা বাহিনীর কাছে তরফ রাজ্যের পতন ঘটলে অমর মাণিক্য এ অঞ্চলের দায়িত্ব দেন ঈশা খানকে। ঈশা খান কর্তৃক সেখানকার শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন পাহলোয়ান। তখন থেকে পাহলোয়ান স্বীয় জন্মস্থান মাতাঙ্গ থেকে তাঁর শাসন কর্তৃত্ব পরিচালনা করতেন বলেই হয়তো কেউ কেউ রাজ্যের নাম তরফের পরিবর্তে মাতাঙ্গ বলে থাকবেন। লক্ষনীয় বিষয় হলো, জিকুয়ার যুদ্ধ পরবর্তী কালে ইতিহাসে তরফ নামে কোনো রাজ্যের উল্লেখ পাওয়া যায় না। বাহারীস্তান-ই-গায়বী গ্রন্থেও তরফ রাজ্য বা এর শাসকের কোনো উল্লেখ নেই। খাজা ওসমান, আনোয়ার খান ও পাহলোয়ানের মধ্যে মৈত্রীসূত্রতার অংশ হিসেবে ১৬১২ খ্রিস্টাব্দে তরফ অঞ্চলে মোগলদের শেষ যুদ্ধে মিত্র শক্তির সম্মিলিত প্রয়াশ লক্ষ্য করা যায়। তখন মাতাঙ্গ ও তরফ দুর্গে মোগল বাহিনী কর্তৃক একযোগে যে আক্রমণ সংঘটিত হয় তাতে মাতাঙ্গের প্রতিরোধে ছিলেন পাহলোয়ান এবং তরফ দুর্গের প্রতিরোধে ছিলেন ওসমানের পুত্র মোমরিজ ও ভাই মালহী। তখন পর্যন্ত তরফ যে পাহলোয়ানের অধীন ছিল তাতে সন্দেহের অবকাশ থাকে না।  

১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে রাজা টোডরমল সম্রাট আকবরের রাজস্ব সচিব হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর বাংলার যে রাজস্ব হিসাব প্রস্তুত করেন তাতে যে স্থানটিকে বেজোড়া মহাল হিসেবে লিপীবদ্ধ করেছেন সে স্থানটির পূর্বনাম ছিল মাতাঙ্গ। পাহলোয়ান তখন একাধারে তরফের শাসক এবং ঈশা খান ও পরবর্তীতে তৎপুত্র মুসা খানের প্রধান সেনাপতি হিসেবে মোগল-প্রতিরোধ যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। মাতাঙ্গে সংঘটিত সর্বশেষ যুদ্ধে তিনি বীরের বেশে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৫৮১ থেকে ১৬১২ খ্রি. পর্যন্ত এই ৩১ বছর ছিল তরফ ও মাতাঙ্গে তাঁর শাসনকাল। বাহারীস্তান-ই-গায়বী মতে তিনি কখনও মোগলদের বশ্যতা স্বীকার করেননি। তাই নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, আইন-ই-আকবরীতে বেজোড়া মহালের উল্লেখ থাকলেও প্রকৃতপক্ষে ১৬১২ খ্রিস্টাব্দের পূর্ববর্তী সে সময়ে তরফ, মাতাঙ্গ বা বেজোড়া অঞ্চল মোগলদের অধিকারভুক্ত ছিল না। সেখানকার একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল পাহলোয়ানের।  

পরিশেষে বলা যায়, ঐতিহাসিক বিভিন্ন্ বর্ণনার মর্মার্থ, পরিবেশগত উপযোগিতা এবং সার্বিক পর্যালোচনার নিরিখে সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হয় যে, বেজোড়ার পূর্বনামই মাতাঙ্গ ছিল। স্থানটি প্রাচীন তরফ রাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের সমভূমিজাত জনপদ এবং মোগল রাজস্ব হিসাবে বেজোড়া বাজু নামে একটি মহাল হিসেবে লিপীবদ্ধ ছিল। ঈশা খাঁনের সময়কালে পাহলোয়ান তরফ রাজ্যের শাসক হওয়ার পর মাতাঙ্গ বা বেজোড়া রাজধানী হিসেবে গণ্য হয়। পাশাপাশি তরফ নামটির পরিবর্তে তাঁর কর্তৃত্বাধীন রাজ্যের¦ নামটিও লোকমুখে মাতাঙ্গ হিসেবে পরিচিতি পায়। প্রাচীন সেই বেজোড়া পরগণা এবং এর দক্ষিণে ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী কাশিমনগর পরগণা নিয়েই বর্তমান মাধবপুর উপজেলা। কাশিমনগর পরগণা তখন ত্রিপুরাধীন রোশনাবাদের অন্তর্গত ছিল। সুতরাং প্রাচীন মাতাঙ্গ রাজ্য যে বেজোড়া পরগণা তথা বর্তমান হবিগঞ্জ জেলাধীন মাধবপুর উপজেলার ধর্মঘর, চৌমুহনী ও বহরা ইউনিয়ন ব্যতীত সমগ্র মাধবপুর উপজেলা এলাকায় বিস্তৃত ছিল তাতে সন্দেহের অবকাশ থাকে না।

 

তথ্যসূত্র:

১.  ডক্টর এম এ রহিম, বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস দ্বিতীয় খÐ, বাংলা একাডেমি ১৯৮২।

২. ড. আবদুল করিম, বাংলার ইতিহাস (১২০০ Ñ ১৮৫৭), বড়াল প্রকাশনী ১৯৯৯।

৩. কে. আলী, ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস মধ্য ও আধুনিক যুগ, আলী পাবলিকেশনস ১৯৮৯।

৪.  মির্জা নাথান, বাহারীস্তান-ই-গায়বী ১ম খÐ, অনুঃ খালেকদাদ চৌধুরী, বাংলা একাডেমি ১৯৭৮।

৫. মুহম্মদ সায়েদুর রহমান, হবিগঞ্জ জেলার ইতিহাস, উৎস প্রকাশন ২০১০।

৬. ড. এম আবদুল কাদের, সোনারগাঁয়ের ইতিহাস : উৎস ও উপাপদান, রহমান গ্রæপ ১৯৯৩।

৭. ড.এম.এ.রহিম, বাংলাদেশের ইতিহাস, নওরোজ কিতাবিস্থান ১৯৮১।

৮. অচ্যুৎচরণ চৌধুরী তত্ত¡নিধি, শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত পূর্বাংশ, উৎস প্রকাশন  ২০০২।

৯. S.N.H Rizvi, East Pakistan District Gezetteers-Sylhet, 1970.

১০. Abul Fazl Allami, THE AIN-I-AKBARI Vol ii, Translated by H. Blochman. Dhaka.

 

মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার
হবিগঞ্জ জেলার ইতিহাস, হাওরের ইতিবৃত্ত, প্রসঙ্গ: মুক্তিযুদ্ধে হবিগঞ্জ, মুক্তিযুদ্ধে মাধবপুর প্রভৃতি গ্রন্থ প্রণেতা। সমন্বয়ক (হবিগঞ্জ জেলা): এনসাইক্লোপিডিয়া অব বাংলাদেশ ওয়ার অব লিবারেশন, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top