সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

পুণ্যলোকের পাড় থেকে : ফারুক নওয়াজ


প্রকাশিত:
১৯ ডিসেম্বর ২০২০ ২২:০৮

আপডেট:
২০ ডিসেম্বর ২০২০ ২০:৩৯

 

ভোরের আবহটা এখানে অন্যরকম। শীত-গ্রীষ্ম এবং বসন্তের মিশেল।

পুবদিকে সোজা নীল মার্বেল পাথরে বাঁধানো পথ চলে গেছে। এ পথের শেষ প্রান্তে ক্রুশচিহ্ন আঁকা বিশাল তোরণ। হিব্রæভাষায় সেখানে লেখা আছে ‘হ্যাভেন’।

দক্ষিণের পথটা শ্বেতপাথর বিছানো। এ পথের শেষপ্রান্তে আর এক আকাশ ছোঁয়া তোরণ। তোরণের দু‘পাশে উঁচু স্তম্ভে বিশালাকৃতির দুটি পদ্মফুল শোভাবর্ধণ করছে। এটি স্বর্গ। সংস্কৃত বর্ণমালায় বড় করে লেখা।

আর পশ্চিমের সবুজ মখমলের পথটার শেষপ্রান্তে মিনার সমৃদ্ধ তোরণে আরবীতে লেখা ‘ফেরদৌস’। স্বভাবতই সেটা বেহেস্ত বা জান্নাত।

 

এই হ্যাভেন স্বর্গ আর জান্নাত থেকে তিনটি  রাস্তা এসে একটা সংযোগ সড়কে মিলেছে। এই জায়গাটার নাম সম্প্রী্তি-চত্বর।

ভারি চমৎকার জায়গাটি। তার পাশেই চোখজুড়ানো বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে উদ্যান। উদ্যানের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে একটা অপরুপ নদী। তিনদিক দিয়ে তিনটি পাহাড় থেকে নেমে আসা তিনটি জলধারা একসঙ্গে মিশে জন্ম নিয়েছে নদীটা। পুবের পাহাড় থেকে নেমেছে নীলকাচের মতো ঢেউতোলা জলধারা। দক্ষিণের পাহাড় থেকে হালকা হলুদ মধুরঙের স্রোতধারা, আর পশ্চিমের পাহাড় থেকে নেমে আসা দুধসাাদা তরঙ্গায়িত পানির স্বচ্ছধারার সম্মিলনে সৃষ্ট এ নদীটা এক অনাবিল রঙসৌন্দর্যে চোখ ধাঁধিয়ে তুলেছে।

এই ত্রিধারাসৃষ্ট নদীটি বেহেস্তবাসীদের কাছে ‘আবেজান্নাত’ নামে পরিচিত। এ নাম জান্নাতবাসীদের দেয়া। স্বর্গবাসীরা এর নাম দিয়েছে মন্দাকিনী। হ্যাভেনববাসীরা অবশ্য এটাকে বলে বøুসী।

 

শান্ত ছোট ছোট ঢেউ। সেখানে নীলপদ্ম, সাদা রাজহংসী আর অসংখ্য রঙিন ফেনা টলমল করে দুলছে। উদ্যানে নদীর পাড় ঘেঁষে অসংখ্য গাছ, ঠিক ছাতার মতো দাঁড়িয়ে আছে সারি বেঁধে। এক এক গাছে এক এক রঙের পাতা। নানা রঙের ফল। গাছগুলোতে নানা রঙের পাখি কলকাকলিতে মুখর করে রেখেছে। উদ্যানের মাঝে মাঝে গোলাকৃতির অসংখ্য ফুল বাগান। নানা রঙের ফুল ফুটে আছে সেখানে। মর্মর পাথরের বেঞ্চ, বসার জন্য পেতে রাখা হয়েছে। সবুজ মখমলের মতো ঘাসের গালিচা। ইচ্ছে করলে এমন সতেজসবুজ দূর্বার চাদরে গা এলিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ আরাম করে নেওয়া যায়।

হ্যাভেনমুখো রাস্তা দিয়ে এসে একজন এই উদ্যানের মর্মর পাথরের বেঞ্চে বসলেন। বসে উর্ধ্বে চোখ তুলে আবৃত্তি করতে থাকেন

‘হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পরধন লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষা বৃত্তি কুক্ষণে আচরি...

গায়ে পা অবাধি ওভার কোট। গলায় গলবন্ধ। মোটা গোঁফে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ইনি বাঙালি মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত।

তিনি একইভাবে চোখ শূন্যে তুলে একনাগাড়ে আবৃত্তি করে চলেছেন

‘কাটাইনু বহুদিন সুখ পরিহরি!
অনিদ্রায়, নিরাহারে সঁপি কায় মন
মজিনু বিফল তপে অবরণ্যে বরি...

এদিকে দক্ষিণের স্বর্গপথ ধরে আরো একজন ঋষিসদৃশ মানুষ ধীরপায়ে আবৃত্তি করতে করতে এই উদ্যানের দিকেই আসছেন।

তাঁর কণ্ঠস্বরে কেঁপে কেঁপে উঠছে
আজিকার কোনো ফুল,
বিহঙ্গের কোনো গান,
আজিকার কোনো রক্তরাগ
অনুরাগে সিক্ত করি পারিব না পাঠাইতে
তোমাদের করে
আজি হতে শতবর্ষ পরে...।

হঠাৎ অনতিদূরে আবৃত্তিরত মহাকবিকে দেখামাত্র তাঁর কণ্ঠস্বর থেমে গেল। মৃদু হেসে মনে মনে বললেন, ‘হ্যাভেনের’ সুখকর পারিবেশে থেকেও সেই কাদামাটি এদোডোবার জন্মভূমির কথা এখনও ভুলতে পারেননি উনি। লোকটা অদ্ভুত বটে। স্বভাষা, স্বধর্ম ত্যাগ করে খ্যাতিমান ইংরেজি ভাষার কবি হবেন বলে গেলেন সেই সাদা পাদ্রিদের রাজ্যে। হায় ললাট লিখন! জমিদার পিতার সম্পদের অধিকারও হারালেন শেষে। শেষমেষ কী করুণভাবেই না অল্প বয়সে ভূলোক ত্যাগ করতে হলো। এখন এই স্বপ্নের হ্যাভেনে এসেও সেই খেদ গেল না দেখছি। সেই আক্ষেপ রেখো মা দাসেরে মনে...। কে যে ওকে বোঝাবে তাঁর জননী জন্মভূমি দাসেরে ঠিকই মনে রেখেছে? সে এখন অমর মহাকবি। তাঁর অজজন্মগ্রাম সাগরদাড়িও এখন তীর্থভূমিতে পরিণত হয়েছে।

ঋষিবত লোকটা, মানে শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভাবলেন, মহাকবিকে গিয়ে বলবেন যে, ‘আপনার জন্মভূমি এবং জাতি আপনাকে সবসময় স্মরণ করে চলেছে।’ কিন্তু গেলেন না। হাজার হলেও তাঁর চেয়ে অন্তত ২৭ বছরের বড়ো তিনি। হয়তো উল্টো প্রশ্ন করেই বসবেন ‘তা তুমি তো সেদিনের মানুষ হে! তুমি কী করে বুঝলে দেশ আমাকে মনে রেখেছে?’ ঝামেলায় না জড়িয়ে তাই রবীন্দ্রনাথ মন্দাকিনীর তীরে বকুল গাছের নিচে পাথরের আসনে বসলেন। মন্দাকিনীকে দেখে তাঁর প্রিয় পদ্মা নদীর কথা মনে পড়ল। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হাত নেড়ে নেড়ে তিনি আওড়াতে থাকেন

হে পদ্মা আমার,
তোমায় আমায় দেখা শতশত বার।
একদিন জনহীন তোমার পুলিনে,
গোধূলির শুভলগ্নে হেমন্তের দিনে...

চোখ বুজে আবৃত্তি করছেন। আবেগটা একটু উচ্চকিত হতেই কে একজন হেঁকে ওঠেন ভারি আমুদে কণ্ঠে, ‘গুরুদেব এই স্বর্গেও বুঝি মনটা কাঁদে? মন্দাকিনীর মতো দুধসাগরের তীরে বসেও; সেই ঘোলাজলের পদ্মার কথা মনে পড়ে গেল বুঝি...?

গুরুদেবের পদ্মাস্তূতিতে ছেদ পড়ল। তিনি পাশ ফিরে দেখেন জান্নাত থেকে হো হো করতে করতে আসছেন খ্যাপা দুর্বাসা কাজী নজরুল।

‘কীরে পাগল কেমন আছিস?’ রবি ঠাকুরের স্নেহভেজা সম্বোাধনে গদগদ হয়ে কাছে এসে গুরুর পায়ের ধুলো কপালে ঠেকিয়ে বললেন, ‘গুরুদেব! পাগল যেখানে যায় সেখানেই ভালো থাকে হা হা হা...।’

‘তা কী মনে করে এই সময় এলি? তুই তো এসময় জান্নাতের ছাত্রছাত্রীদের গজলে তালিম দিস শুনেছি।’ ‘তা ঠিক, তবে আজ ওদেরকে ছুটি দিলাম। বললাম, আজ আমি গুরুদেবকে দেখতে যাবো।’

‘তা আয় বস্। তা তোদের বেহেস্ত সম্পর্কে আমি বড়োই অনভিজ্ঞ রে! আমার কবিতাতেও এ বিষয়ে কোনো টু শব্দ করি নি। অথচ তুই কিন্তু আমাদের স্বর্গ-নরক একেবারে তোলপাড় করে ছেড়েছিস।’

গুরুদেবের পাশে বসলেন নজরুল। বসে সেই চিরচেনা হো হো হাসি। হাসলেন বারকয়েক। হাসতে হাসতেই বললেন, ‘আমি ব্যালেন্স করে চলেছি গুরুদেব! বোঝেনই তো প্রমীলার স্বর্গ, আর আমার জান্নাত। দুটোর মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে আনতে বরাবর আমার আগ্রহ তুঙ্গে ছিল হা হা হা...।’

‘আচ্ছা শুনেছিস তো ব্যাপারটা?’

‘কোন ব্যপারটা গুরু?’

‘ওই যে সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি উপাধির ব্যাপারটা। ওটা  তো পেয়ে গেল শেখ মুজিবুর রহমান। ওটা আমারও হলো না, তোর কপালেও জুটল না কিন্তু...।’ মৃদু হাসলেন গুরুদেব।

‘এ নিয়ে কি গুরুদেবের আক্ষেপ হচ্ছে বুঝি? হা হা হা।’

‘নারে তা নয়, ব্যাপারটায় আমিও খুশি। আসলে মুজিবের অবদান আমাদেরও ধন্য করেছে। সে সত্যিই শ্রেষ্ঠদের শ্রেষ্ঠ।’

‘আচ্ছা গুরুদেব এখন আপনার কথা বলি, আপনি সারাজীবনে তো অনেক লিখেছেন। তা কতো হবে অন্তত?’

‘ধর পৃথিবীতে থেকেছি মোট ৮০ বছর ৩ মাস।এ জীবনে ৬৫ টা মতো বই লিখেছি। তারমধ্যে উপন্যাস ১৩ টা। নাটক-কাব্যনাটক মিলিয়ে ৫০ টা। আর গান ধর, প্রায় আড়াই হাজার মতো হবে।’

‘তারমধ্যে তো আবার অভিনয়ও করেছেন। সুরও করেছেন। আবার অভিভাষণ, চিঠিপত্রএগুলোও তো আপনার মহান কীর্তির স্বাক্ষর বহন করে চলেছে গুরুদেব।’

‘তা ঠিকই বলেছিস তবে...’

‘তবে আবার কী! মাত্র ৫২ বছর বয়সে গীতাঞ্জলি লিখে নোবেল পেয়ে জাতিকে মহাধন্য করেছেন। এরচেয়ে বড়ো আর কি হতে পারে।’

‘তুইও কিন্তু কম করিস নি। তোর সাহিত্যকর্মের বয়স মাত্র একুশ-বাইশ বছর। এরপর তো একেবারে চুপ মেরে থাকলি শেষঅবধি। এই সময়টুকুতেই কিন্তু ব্রিটিশরাজ্য কাঁপিয়ে দিলি। গানে-সুরে তুই অমরত্ব পেয়ে গেলিরে পাগল!’

‘হা হা হা...! গুরুদেব ওইসব তো জীবন-জীবিকার টানে। পেট চালাতে হিজ মাস্টার্স ভয়েজে ঢুকলাম। তারপর আব্বাসউদ্দিনের উস্কানিতে কত যে গান লিখেছি। কীর্তন লিখেছি কোম্পানীর তাগিদে। তাদের বাণিজ্যে গতি আনতে। আর গজল শুরু করলাম ওই আব্বাসের কারণেই। অন্যগুলো আমি নিজে থেকেই লিখেছি অবশ্য। এই গান-গান করে কবিতার ক্ষেত্রটি  আমার সেভাবে বিস্তৃতি পেল না এই যা দুঃখ!’

‘কী যাতা বকছিস! তোর বিদ্রোহী তো হুইটম্যানকেও পেছনে ফেলেছে। আর দারিদ্র্য, মানুষ, সিন্ধু, গুবাকতরুর সারি এসব কবিতা তো তোকে মহান করেছে পাগল!’

‘গুরুদেব ওই যে কে আসছে দেখেন...।’

‘আরে, ও তো শেখ মুজিব! গায়ে সেই চিরচেনা কালো হাতকাটা কোট। যাকে বাঙালিরা বলে মুজিবকোট। পাজামা-পাঞ্জাবি, চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। ব্যাকব্রাশ করা চুল। কী সৌম্যমূর্তি! শুনেছি মানে, অন্নদাশঙ্কর রায়ের কাছে শোনা কিউবার নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো নাকি তার সম্পর্কে বলেছে, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি।’ সত্যিই রে ওর দ্বারা যা সম্ভব হলো তা কিন্তুু...।’

‘তা ঠিক বলেছেন গুরুদেব। নেতাজি সুভাষ বোসও চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু বিধিবাম হলো!’

‘ওর মধ্যে দুটো জিনিস ছিল। এক, মহাত্মা গান্ধীর অহিংস গুণ এবং সুভাষ বোসের আপসহীন সাহসিকতা। আর দেশপ্রেম, সততায় তো সে নিঃসন্দেহে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ।’

‘তা সে এদিকেই তো  আসছে দেখছি। গুরুদেব, ওর কাছে আমি কিন্তু প্রচণ্ডভাবে ঋণি। আমাকে কলকাতা থেকে নিয়ে গেল নিজের সদ্য স্বাধীন দেশে। আমি তখন নানা কারণে বিপর্যস্তপ্রায়। ইন্দিরা গান্ধী পর্যন্ত বুঝতে পারেনি যে সে আমাকে তার দেশে একেবারের জন্য নিয়ে যাচ্ছে। নিয়ে গিয়ে তো এলাহী কাণ্ড। শ্রেষ্ঠ সম্মান সে আমাকে দিয়েছিল। অভিজাত এলাকায় বিশাল বাড়ি। দেখভালের লোক, সেইসঙ্গে সার্বক্ষণিক চিকিৎসার ব্যবস্থা। শুধু আমায় নয়, আমার গোটা পরিবারকেই সে অভাবনীয় মর্যাদা দিয়েছে। তার দেশের নাগরিকত্ব পর্যন্ত দিল। পেলাম জাতীয় কবির সম্মান। দেশের যুদ্ধসংগীতও করল আমার চল চল চল গানটা।’

‘আরে, আমার সোনার বাংলা গানটাও তো সে তার দেশের জাতীয় সংগীত করেছে। এ জন্য তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।’  ‘কিন্তু গুরুদেব, আমার দুঃখটা সেখানেই তখনও আমি বেঁচে থাকলাম অথচ নিজের দেশের বিশ্বাসঘাতকরাই ওকে শেষ করে দিলো। বড়ো দুর্ভাগা জাতি আমরা। গুরুদেব আপনি তো অনেক আগেই আক্ষেপ বাণী দিয়েছেন হে মোর দুর্ভাগা দেশ...। তারপরও তো  বলেছেন, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করো নি...। আমি এখন তার বাংলাদেশে নেই, কিন্তু সেখানে আমার থাকার সেই বাড়িটা এখন ‘কবিভবন’ নামে পরিচিত। সেখানে ‘নজরুল ইনিস্টিটিউট’ও গড়ে উঠেছে।’

কাজী নজরুলের কথা শেষ না হতেই শেখ মুজিব কাছে এসে গম্ভীর অথচ বিনম্র হেসে আদাব দিলেন কবিগুরু এবং জাতীয় কবিকে।

‘বসো হে শ্রেষ্ঠতর! তোমার কথাই এতক্ষণ আলোচনা হচ্ছিল।’

কবিগুরুর এমন সম্ভাষণে কেমন সংকোচবোধ করলেন শেখ মুজিব। বললেন, ‘কবিগুরু আপনি বাঙালি জাতির বিবেক। আপনি বাঙালির নিত্যপ্রেরণার উৎসপুরুষ।’ এরপর বিদ্রোহী কবি নজরুলের দিকে তাকিয়ে বললেন ‘আর আপনিও প্রতিনিয়ত অন্তরে সাহস সঞ্চার করে চলেছেন বাঙালির সংকটে, বন্ধুর পথচলায়।’

‘সবই বুঝলাম, তবে তুমি যা করেছ কেউ কি তা পেরেছে? শোনো, আমি পরাধীন জাতিকে শান্তির আমোঘ বাণী শুনিয়েছি। দুঃখের আঁধারে প্রদীপ জ্বালিয়ে বলেছি এ আঁধার ভাঙতে হবে। আর নজরুল, সেতো  দুঃখকে পায়ে ঠেলে সাহসে জ্বলে ওঠার প্রেরণা যুগিয়েছে। আমরা তো কবিমাত্র। কবির পক্ষে আর কিইবা করার থাকে। এ কথা সত্য যে, পরাধীন জাতির ভাষাও পরাধীন। জাতির সেই পরাধীন ভাষা হয়তো আমি উন্মুক্ত অহমিকায় ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলাম নোবেল পেয়ে। কিন্তু পরাধীন জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছো তুমি।’

‘গুরুদেব! তবে কি আপনি যে কবিতাটি লিখেছিলেন, মানে জনগণমন অধিনায়ক আসে ভারত ভাগ্য বিধাতা...এটা কি শেখ মুজিবকে উদ্দেশ করেই লেখা?’

নজরুলের কথায় হাসেন কবিগুরু। হেসে বলেন, ‘হয়তো তাই হবে। ভারত ছেড়ে তো ইংরেজরা চলেই গেল। মাঝখান থেকে দুভাগে ভেঙে দিয়ে গেল দেশটাকে। বাংলাকেও ভেঙে দিলো। মুজিব একটি জাতির জন্মদাতা। আর সে রাষ্ট্র বাঙালির একক একটি জাতিরাষ্ট্র। দেশটা না ভাঙলে মুজিবই হয়তো হতো গোটা দেশের স্বাধীনতার মহানায়ক। আমি আরো বলেছিলাম, ‘তোমার পতাকা যারে দাও, তারে বহিবারে দাও শকতি!’ সেই শক্তিধর পতাকাবাহক তো এই শেখ মুজিবই। আমি বলব, হাজার বছরের পরাধীন নিষ্পেষিত একটি জাতিকে যে স্বাধীনতা এনে দেয় সেই-ই তো জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান। কবি তা পারে না। যে পারে, সেই-ই মহান।’

 

‘গুরুদেব- শেখ মুজিব কিন্তু কবিও। ওদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমেরিকার নিউজউইক পত্রিকা তাকে Poet of  politics মানে, রাজনীতির কবি উপাধি দিয়েছিল।’

‘ওরা একেবারে ঠিক বলেছিলো। তার ৭ই মার্চের ভাষণ তো  এক অমর কবিতা। এমন আবেগমথিত কবিতা আর লেখা হয়েছে কি!’

 

বঙ্গবন্ধু রবিঠাকুরের মুখে সামনাসামনি এতো প্রসংশায় বিব্রতবোধ করেন। মাথার চুলে হাত বুলোতে বুলোতে বলেন, ‘আমাকে লজ্জা দেবেন না কবিগুরু। আমি নিছক একজন মানুষ। খুব সাধারণ। আমি শুধু ভালোবাসি আমার মানুষকে আর জন্মভূমিকে। এছাড়া আমি আর কিছুই নই।’

মুজিবের কথায় নজরুল মুখ খুললেন, ‘তবে, একটা ব্যাপার কিন্তু আশ্চর্যভাবে মিলে গেছে গুরুদেব! মুজিব সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। তারপর আপনি। এরপর তিন নম্বরে আমি। অন্যদিকে মুজিবের জন্ম মার্চ মাসে, আপনার এপ্রিল মাসে। আর আমার মে মাসে। এক্ষেত্রে সাল যাই হোক মাসের দিক থেকে মুজিব আগে, তারপর আপনি, শেষে আমি। তৃতীয়, আশ্চর্য হলো আমাদের তিনজনেরই দেহত্যাগের মাস কিন্তু আগস্ট। ব্যাপরটা সত্যিই বিস্ময়কর। গুরুদেব ভূলোক ত্যাগ করেছেন বোধয় ৭ আগস্ট, মুজিব ১৫ আগস্ট, আর আমি ২৯ আগস্ট ফ্যান্টাস্টিক!!

 

হঠাৎ নজরুল কেমন স্থির হয়ে কানপেতে গভীরভাবে কী যেন শুনতে থাকেন। রবীন্দ্রনাথের দিকে তাকান। রবীন্দ্রনাথও যেন কিছু একটা শুনতে পাচ্ছেন। নজরুল বললেন, ‘গুরুদেব কিছু কি শুনছেন? মর্ত্য থেকে ভেসে আসছে গানটা।’

‘তাই তো! এ তো মুজিবের কথাই বলছে, তাই না!’

‘হ্যাঁ, গুরুদেব শুনুন কী আবেগ যদি রাত পেহালেই শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই...।’

কবিগুরু আবারো গভীর মনোযোগের সঙ্গে ভেসে আসা সুরটা শোনার চেষ্টা করছেন । যেন মেঘে কম্পন তুলে সে সুর এসে মন্দাকিনীর জলে ডেউ তুলছে। নজরুল শূন্যে তাকিয়ে বললেন, পৃথিবী থেকে ভেসে আসছে। পুব দিক থেকে ওই দিকেই তো মুজিবের স্বাধীন বাংলাদেশ।’

কবিগুরু বললেন, ‘এটা কোন মাস যেন।’

‘কেন আগস্ট! আজ তো ১৫ আগস্ট। এ রাতেই তো মুজিব....।’

‘নারে পাগলা। মুজিব কখনোই মরে না। ও আছে সমগ্র জাতির হৃদয়ের মনিকোঠায়।’

মুজিব গম্ভীর। তার কানেও আসছে সুরটা। তবু মুখে মৃদু হাসি এনে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কবিগুরু আপনিও তো চির অমর। চির অমর জাতীয় কবি আপিনিও।’

‘আমরা কেউই মরি নি মুজিব। আমরা কি মরতে পারি? এজন্যই তো একই মাসে আমরা পৃথিবী ছেড়েছি।’ কবিগুরু বললেন।

‘এবং পরপর মাসেই আমরা জন্মেছি গুরুদেব হা হা হা.. .।’ নজরুলের সেই হাসি।

কবিগুরু হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন, ‘আমার ফেরার সময় হলো রে পাগল! আমাকে স্বর্গ ডাকছে যে। এতক্ষণে হয়তো বিহারীলাল চক্রবর্তী এসে আমার অপেক্ষায় আছেন।’

‘আরে ওইতো নতুন ছেলেটা মানে, ঢাকার হুমায়ূন আহমেদ, সঙ্গে কলকাতার সুনীল, শক্তিও আছে দেখছি।’ নজরুল কবিগুরুকে ওদের দিকে আঙুল উচিয়ে দেখালেন।

কবিগুরু বললেন, ‘তাহলে তো আমাকে সরতেই হয়। এরা এ যুগের সব লেখক। হাসিতে আলাপে হইহট্টোতে গুলবাগিচা একেবারে মাতিয়ে তুলবে।’ এই বলে কবিগুরু স্বর্গের দিকে হাঁটা ধরলেন।

নজরুল পেছন থেকে কবিগুরুকে  সশব্দে নমস্কার জানিয়ে মুজিবের দিকে ফিরে তাকালেন, ‘চলো এবার যাওয়া যাক। আমি থাকি দক্ষিণের চিলেকোঠায়। বুঝলে তো, কবিরা আবার দখিনা বাতাসে কবিতার ভাবনা খুঁজে পায়। আর তুমিতো থাকো পুবের বাড়িটায় তাইনা? ওখান থেকে বাংলাদেশটা ভালোই দেখা যায় কিন্তু।’ নজরুল হাঁটতে থাকেন। 

শেখ মুজিব যেতে যেতে থমকে দাঁড়ান। মর্ত্য, মানে তার প্রিয় বাংলাদেশ থেকে ভেসে আসছে যদি রাত পোহালেই শোনা যেত, বঙ্গবন্ধু মরে নাই...। পকেট থেকে সাদা রুমালটি বের করে চোখ মোছেন বাঙালি জাতির জনক। হতভাগ্য জাতির প্রতি ভালোবাসায় তার চোখ ছলছল করে ওঠে।

 

ফারুক নওয়াজ

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top