সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

আমার কবিতা ভাবনা : ড. শাহনাজ পারভীন


প্রকাশিত:
৭ জানুয়ারী ২০২১ ২১:২২

আপডেট:
৭ জানুয়ারী ২০২১ ২২:৪৬

ছবিঃ  ড. শাহনাজ পারভীন

 

কেন লিখি, এ প্রশ্নের মুখোমুখি আজীবন, আমি আর আমরা সবাই। আমরা সবাই বলতে লিখিয়ে বন্ধুরা সব। যে কোন কথা প্রসঙ্গেই অনিবার্য প্রশ্নটা এসে যায় যেন? প্রশ্নটা শুনবার পরই ভাবতে বসি, নাকি প্রশ্নটা শুনবার আগেই ভাবনায় চলে আসে সে হিসেব মেলে না এখন। তবে ভাবছি দীর্ঘদিন, সে কথাটা মানি। পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ হচ্ছে নিজস্ব ভাবনার সাথে লেখাটা এগিয়ে নেয়া। শত চেষ্টা এবং সাধনায় লেখাটা তৈরি করা খুব সহজ বিষয় নয়। এ প্রসঙ্গে আঁদ্রে জিদ বলেছিলেন, ‘লিখি, কারণ, না লিখলে হাত ব্যথা করে।’ গার্সিয়া মার্কেজ বলেছিলেন, ‘লিখি, যাতে আমার বন্ধুরা আমাকে আরো একটু বেশি ভালবাসে।’ এর চেয়ে একটু গভীর ভাবে উত্তর দিয়েছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেছিলেন, লেখা ছাড়া অন্য কোন উপায়ে যেসব কথা জানানো যায় না সেই কথাগুলি জানাবার জন্য লিখি।’ আমাদের যাপিত জীবনে এমন অনেক ঘটে যাওয়া ঘটনা যা আমাদের মনোভূমিকে চিন্তামগ্ন করে বার বার মনোজগতকে ওলোট পালোট করে, খুব সহজেই তা থেকে আমরা মুক্তি পাই না। কখনো কখনো মনে হয়, এ ঘটনাটা অন্য আরো কারো জানানো দরকার, সেটাকে বাঁচিয়ে রেখে অন্য সকলকেও জানান দিতেই আমরা লেখার অক্ষরকেই বেছে নেই। অথবা যে ঘটনাটা মনের অজান্তেই একটা সু² ঢেউ তুলল সেটাই হয়ত অনুরণিত হয়ে হাজার প্রাণের দ্বারে দ্বারে কষাঘাত করুক-এই ভাবনা থেকেও লিখি। যদি ফারসী কবি ফেরদৌসী রচিত মহাকাব্য ‘শাহনামা’এবং তার রচনার কারণ লৈখিক অক্ষরে লেখা না থাকত তাহলে আমরা ঐতিহাসিক এই ঘটনা রটনা এবং গযনীর সুলতান মাহমুদের নাম শতাব্দীর পর শতাব্দী জানতে পারতাম বলে সন্দেহ ছিল। 

আমি কেন কবিতা লিখি? নাকি কবিতাই আমাকে দিয়ে যখন তখন লিখিয়ে নেয় তাকে? জানিনা, তবে শুধু এটুকু জানি, যখন চলতে পথে হঠাৎ হৃদে ঝড় ওঠে, আন্দোলিত হয় নিজের মন ও মনন। বার বার ধিকিধিকি জ্বলে। নেভে না। অকারণ কথা বলে বলে আমাকে অতিষ্ঠ করে তোলে। হার্টবিটে যখন তবলা বাজায়, দরদর করে ঘাম নামে সারা শরীরে। 

বাঙময় হয়ে ওঠে নিজের ভেতর। তখন লেখণি ছাড়া তা প্রশমনের আর কোন উপায় থাকে না আমার। তখনই বাধ্য হয়ে, কখনো বা আনন্দের আতিশায্যে কলম উঠে আসে আঙুলের ডগায়। কী বোর্ডে আঙুল ছোঁয় অজান্তেই।

তাকে উপেক্ষা বা এড়িয়ে যাবার মতো সাহস বা অধিকার থাকে না, নেই আমার। কবিতাই তখন আমাকে ভারমুক্ত করে। প্রসব যন্ত্রণার মতো অসহিষ্ণুবেদনাকে সৃষ্টির আনন্দে ভরে দেয় কবিতা। আমি যেভাবে যা কিছু দেখি, ঠিক সেভাবেই পাঠককে দেখাতে চাই তা। আমার দেখার মধ্যে, আমার বোঝার মধ্যে, আমার মননের গভীরেই মুকুলিত অবস্থায় তা যেন শুকিয়ে না যায়, তা যেন প্রস্ফুটিত হয় অনাগত দিনের পাঠকের জন্য, তারাও দেখতে থাকুক ঠিক আমারই মতো, দৃষ্টিতে, অন্তরে; তাই আমি লিখি।

কখন লিখতে বসি? সংসার জীবনের হাজারো ঝাঞ্চাকে মাথায় নিয়ে পথ চলতে হয় সারাক্ষন। নিরন্তর নিজের সাথে যুদ্ধ করে চলি। কখনো বাঘ কখনো সিংহ কিংবা নেহায়েত কোন জাল কাটা ইঁদুরও সাজানো ভাবনাগুলোকে নস্যাৎ করে দেয় মুহূর্তেই। সাজানো বাগানগুলো তছনছ হয়ে যায় এক নিমিষে। জ্ঞান, প্রজ্ঞা, ব্যক্তিত্ব এবং সমস্ত সৌন্দর্যকে মিশিয়ে দিতে চায় অহেতুক নিতান্ত মাটির ধুলোয়। বনের সিংহটা হঠাৎই বুনো ইঁদুরের কাছে নাকাল হয়ে ওঠে। তারপর? তারপর একদিন...দুইদিন...একদুইতিন। হাঁটি হাঁটি পা পা... বেজে ওঠে ঝনাৎ। লেখনির কলম যেন নড়ে চড়ে ওঠে...হুংকার ছাড়ে- গর্জন করে মুর্হুমূহু। হয়ত তাতে এ সমাজের বদলায় না কিছুই কিন্তু ভেতরটা তো শান্ত হয়। আবার হেসে ওঠা যায়। বদলায় না, তাই বা বলি কি করে? বদলায়ই তো। এই বদল করবার জন্যই তো লিখে যাওয়া। হেসে ওঠা। এই দু’হাত দিয়ে চোখ মুছে জীবনের ¯্রােতে নিজেকে নতুন করে মিশিয়ে ফেলবার নানা মুখী প্রচেষ্টার জন্যই এই লিখে যাওয়া। জীবনের বহুমুখী ব্যাখ্যাকে সরল অংকের মত মিলিয়ে দেবার জন্যই এই নিরন্তর প্রচেষ্টা।

 কবিতার রকমফের অর্থাৎ কবিতা, কিশোর কবিতা, শিশুতোষ ছড়ার মতো কবিতার ভাষাও বিভিন্ন রকম। কোনো কোনো কবিতার ভাষা একেবারে সহজ, সরল, সোজা পথের মতো, পথের মাথা থেকে শেষ অবধি দেখা যায় স্বচ্ছতায়।কোনো কবিতা ফনাতোলা সাপের মতো, সুযোগ পেলেই ছোবল মারে গোখরোর শক্তিমত্তায়। কোনোটা ঘোরানো পেঁচানো। বাঁকে বাঁকে বদল হয়। হাজার চেষ্টায় জট খোলে তার। কোনো কবিতার ভাষা একেবারে আটপৌরে। একেবারে নিজের মতো, ঘরের মতো, যাপিত জীবনের একান্ত প্রতিটি মুহূর্তের মতো নৈসর্গিক।তাই বা বলি কি করে? আবার কোন কোন ভাষা আছে মাধুর্যময়, অসাধারণ। কোন কোনোটা ছলাৎ ছলাৎ, কোনটা গম্ভীর আবার কোন কোন ভাষা আছে বয়ে যাওয়া ভাটি নদীর পানির মতো তরঙ্গবিহীন, সাধারণ। কোন ঢেউ নেই, কোন ঝড় নেই তাতে, শুধু চাঁদের ¯িœগ্ধ আলোয সে আলোকিত। তাই তো কোনো কবিতা অক্ষর বৃত্তের শরীরে জড়িয়ে যায়, কোনো কোনো কবিতা মাত্রা বৃত্তের চালে পাল তোলে কোনো কোনো কবিতা আবার স্বরবৃত্তে নাচিয়ে নেয় আমাকে।

কবিতা বিশ্বের সব সাহিত্যেরই একটি প্রধান শাখা। কবিতা হল কোন জাতির এমনই এক জ্ঞান ভাÐার যার চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কোন জ্ঞান এই পৃথিবীতে নেই। সেই শ্রেষ্ঠ জ্ঞানের ধারক যিনি তিনিই কবি। তাকে সেভাবেই প্রস্তুতি নিয়ে কবিতার কাতারে সামিল হতে হয়। তাকে হতে হয় দায়িত্বশীল, কর্তব্যপরায়ণ এবং কাক্সিক্ষত লক্ষ্যপথে অবিচল এবং মেধাবী। এমনও হতে পারে কেউ আছেন, যিনি মেধাবী কিন্তু কবিতা লেখেন না। কিন্তু এমনটি কখনোই হতে পারে না যে, কেউ কবিতা লেখেন অথচ তিনি মেধাবী নন। কবিকে হতে হয় অনুভূতিপ্রবন, মানবিকতা সম্পন্ন এবং সব সময়ই সাম্প্রতিক। কবিতার সাথে হৃদ্বিক, মমতাময়ী।কবি এগুলো প্রকাশ করেন তার নিজস্ব অনুভূতি, উপলব্ধি এবং প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে। তার সাথে মিশে থাকে কবির মনের আবেগ, অনুভূিত, কষ্ট, ভালোবাসা, সুখ, দুঃখ, রাগ, ক্ষোভ, উস্মা, জাতি, রাষ্ট্র, প্রেম, প্রণয়, দিন এবং রাতের প্রতিটি মুহূর্তের চিত্র। সাথে থাকে প্রকৃতি, আকাশ, বৃষ্টি, মেঘ, মৃত্তিকা ও জলের মত মাধুরী এবং ক্লেদ। এভাবেই তৈরি হয় কবিতা, যা একই সাথে কবির এবং পাঠকের। সাহিত্য সমাজের প্রতিচ্ছবি কিন্তু প্রকৃতির আরশি নয় বলেই কবি তার মন মানসিকতা চিন্তা ভাবনার রূপ ধারণ করে সাহিত্যে উপস্থিত থাকেনÑকবিতার শরীর গাঁথেন, মেখে নেন জীবনের সাথে একেবারে নিজস্বতায়।

পৃথিবীর প্রথম কবিতাটি কোথা থেকে এলো। কে বা লিখেছিলো তা? তা কি আর জানি, না। জানি না। তবে কেউ কেউ বিভিন্নভাবে তার বর্ণনা দিয়ে থাকেন। আমি আজ আর সেদিকে যাবো না। কবিতা সম্পর্কেআমার নিজের অনুভূতি, নিজের ভাবনা সম্পর্কেই লিখবো আজ। তবে রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন পৃথিবীর আদি কবি বাল্মিকী। তার মতে পৃথিবীর প্রথম কবিতা হচ্ছে 

মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতী সমাঃ।
যৎ ক্রোঞ্চ মিথুনাদেক মধবীঃ কামমোহিতম।

এই কবিতাটির সৃষ্টি ইতিহাসও বেশ রোমাঞ্চকর। মিথুনরত দুটো পাখির অপরূপ ভালোবাসার দৃশ্য দেখতে দেখতে কবির মনও ভালোবাসায় থই থই করছিল। কিন্তু কোথা থেকে এক পাপীষ্ঠ শিকারী তীর ছুঁড়ে পুরুষ পাখিটিকে মেরে ফেলে। সঙ্গী স্ত্রী পাখিটি তখন সঙ্গী হারানোর যন্ত্রণায় কাতর হয়ে ছটফট করতে থাকে। সেই যন্ত্রণা কবির হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। কবি রূষ্ঠ হয়ে শিকারীকে অভিশাপ দেবার জন্যই অজান্তে উচ্চারণ করে অবিস্মরণীয় এ লাইন দুটি। সেই থেকে হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া হুঁচোট খাওয়া অবলীলায় বলিয়ে নেয়া সার্থক লাইনগুলিই কবিতার লেবেল এঁটে পৃথিবীতে অমর হয়ে যায়। 

এই অমরত্বের সার্থক লাইন কবিতা সম্পর্কে পৃথিবীতে নানা মুনির নানা মত। কেউ কেউ কবিতাকে ভালবেসে জীবন দিতে প্রস্তুত, কেউ আবার কবিতাকে দুই চোখে দেখতে পারেন না আজীবন। কবিতা সম্পর্কে প্লেটো বলেন: কবিরা হলেন মিথ্যেবাদী। তারা যা ভাবে যা লেখে তা সবই মিথ্যাপ্রসূত; বাস্তবের সঙ্গে এর কোন মিল নেই। তিনি বলেন: কবিদের বাস্তবের কোন জ্ঞান নেই। তারা খুব সহজেই প্রচ্ছন্ন জিনিষের অথবা অন্ধ বিশ্বাসের অনুকরণ করে থাকে। তিনি আরো বলেন: কবিরা এমন সব মহৎ ও জ্ঞানসমৃদ্ধ জিনিষের কথা বলে থাকে, যা তারা নিজেরাও বুঝতে পারে না।’ তার মতে, তারা আবেগকে স্তিমিত করে দেয়ার পরিবর্তে খাদ্য খাইয়ে জল ছিটিয়ে আরো বেশি সতেজ করে তোলে, এবং মানব জাতির শান্তি ও কল্যাণের উদ্দেশ্যে আবেগকে শাসন করার পরিবর্তে আবেগকে বরং তাদের উপরে শাসন চালাতে দেয়। প্লেটো কবিদেরকে অভিযুক্ত করেন। কারণ তারা আবেগ অনুভূতিকে ভংঙ্কর রূপে চাঙা করে তোলেন বলে তার বিশ্বাস। ফ্রানসিস বেকন তাঁর ‘অব ট্রুথ’ প্রবন্ধে একজন পাদ্রী লেখকের উক্তি উল্লেখ করেছেন, যিনি কবিতাকে শয়তানের মদ বলে অভিহিত করেছেন। কারণ এটা মানুষের মনে অর্থহীন কল্পনার প্রসার ঘটায় এবং এটা মিথ্যার প্রতিবিম্ব ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাদের থোরাই যুক্তিকে এভাবে খণ্ডন করেন:

‘ঘটে যা তা সত্য নহে। কবি, তব মনোভূমি
রামের জন্মস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।’

রবীন্দ্রনাথের মত আল্ডাস হাক্সলিও সাহিত্যের সত্যকে ‘সুপার ট্রুথ’ বলে উল্লেখ করেছেন। কবিতাকে সুপার ট্রুথ বা ‘অব ট্রুথ’ যাই বলা হোক না কেনআসলে কবিতার সঙ্গা কি? কোলরিজের ভাষায়: শ্রেষ্ঠতম বিন্যাসে শ্রেষ্ঠতম শব্দসমূহের প্রকাশÑই হল কবিতা। তিনি আরো বলেন: ‘কোন ব্যক্তিই একজন মহান কবি হতে পারেন না, যদি না তিনি একই সঙ্গে একজন প্রচন্ড দার্শনিক না হন।’

কবিতায় অবশ্যই দর্শন থাকতে পারে, কিন্তু একজন শক্তিমান উচ্চমান কবিকে সতর্ক থাকতে হয় যেন তার দর্শন তাঁর কবিতাকে গিলে না ফেলে। কবিতা যেন দর্শনকে ধারণ করেও জীবনস্পর্শী হৃদয়স্পর্শী সঙ্গীতের মত প্রাণময় আকাশের মত উদার সমুদ্রের মত বহমান ছলাৎ ছলাৎ তরঙ্গ ধারণ করতে পারে। জীবনগন্ধী হয়। জীবনকে ছুঁয়ে থাকে প্রাণময়। কবিকে একই সাথে এমন একটি বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে হয়, যিনি একই সাথে তার কবিতায় জীবনকে ধারণ করেন প্রেম, প্রকৃতি, মানবিকতা এবং কাব্যিকতার ঝিনুক মুঠোয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর মতে,রূপের মধ্যে অরুপের সন্ধানই কবিতা। রবার্ট ফ্রস্ট বলেছেন, সেইটুকুই বিশুদ্ধ কবিতা যার অনুবাদ সম্ভব নয়। জীবনানন্দ দাশের মতেউপমাই কবিতা। মালার্মে বলেছেন- শব্দই কবিতা। দার্শনিক এরিস্টটল বলেছেন, কবিতা দর্শনের চেয়ে বেশি, ইতিহাসের চেয়ে বড়।’ ম্যাকলিশ বলেছেনকবিতা কিন্তু বোঝার না, কবিতা হয়ে ওঠে। বুদ্ধদেব বসু কবিতা সম্বন্ধে ‘বোঝা’ কথাটাই অপ্রাসঙ্গিক। কবিতা আমরা বুঝিনা, অনুভব করি। কবিতা আমাদের বোঝায় না, স্পর্শ করে, স্থাপন করে একটা সংযোগ। ভালো কবিতার প্রধান লক্ষণই এই যে, তা বোঝা যাবে না, বোঝানো যাবে না। কবিতা সম্পর্কে ভাষাবিদ হুমায়ুন আজাদ বলেন, যা পুরোপুরি বুঝে উঠবো না, বুকে, ওষ্ঠে, হৃৎপিন্ডে রক্তে মেধায় সম্পূর্ণ পাবো না, যা আমি অনুপস্থিত হয়ে যাবার পরও বয়ে যাবে রক্তের কাছে তার নাম কবিতা।

কবি শিব নারায়ণ রায়ের মতে, ‘মানবতন্ত্রী শিল্পাদর্শে শিল্পকলার অনুশীলন যে বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছে তার কারণে মানুষের অন্যসব ক্রিয়াকর্মের তুলনায় শিল্পকলার প্রকাশরীতি সব চাইতে বেশি সমৃদ্ধ ও পরিণত। রেনেসাঁর শিক্ষাব্রতী, শিল্পী ও কবিরা তাই বারবার ঘোষণা করেছেন যে, ব্যক্তিকে প্রকাশক্ষম করে তোলা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। 

মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে কবিদের উদ্দেশ্য করে তাদের নামে সুনিপুণ এক বর্ণনা সমৃদ্ধ সূরা‘আশ-শুয়ারা’ প্রণয়ন করেছেন। উক্ত সূরায় মহান আল্লাহ বলেন: এবং কবিদের যারা অনুসরণ করে তারা বিভ্রান্ত। আপনি কি দেখেন না যে তারা প্রতি ময়দানেই উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায় এবং এমন কথা বলে যা তারা করে না। তবে তাদের কথা ভিন্ন যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে এবং অত্যাচারিত হলে প্রতিশোধ গ্রহণ করে। অত্যাচারীরা অচিরেই জানিবে কোন স্থানে তারা ফিরে আসবে।

 আল কুরআন: ২৬: ২২৪-২২৭। 

পবিত্র কুরআনে এই আয়াত নাযিল হওয়ার পর হযরত আব্দল্লাহ বিন রাওয়াহা, হাসসান বিন সাবিত, কা’ব ইবনে মালিক প্রমুখ সাহাবী কবি কাঁদতে কাঁদতে রাসূলুল্লাহ সা. এর নিকট হাজির হন এবং বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এই আয়াত নাযিল করেছেন। আমরা তো কবিতা রচনা করি, এখন আমাদের উপায় কী? রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, আয়াতের শেষাংশ পাঠ কর। এ আয়াতের উদ্দেশ্য এই যে, তোমাদের কবিতা যেন অনর্থক ও ভ্রান্ত উদ্দেশ্যে প্রণোদিত না হয়। কাজেই তোমরা আয়াতের শেষাংশে উল্লিখিত কবিদের শামিল। 

 ফতহুল বারী 

ইসলামের দৃষ্টিতে কবিতা দু’ধরনের- একটি সত্য ও সুন্দরের পথপ্রদর্শক অপরটি মানব সভ্যতার জন্য ধ্বংসাত্মক, অকল্যাণকর, কুরুচিপূর্ণ। ইসলাম একদিকে যেমন কল্যাণকর সাহিত্যের সৃষ্টিতে উৎসাহ ও প্রেরণা দিয়েছে ঠিক তেমনি সভ্যতার জন্য ক্ষতিকারক ও অশ্লীল সাহিত্য তৈরিতে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। 

কবিদের এ ভাবের জগৎ থেকে, কল্পনাপ্রবণতা থেকে দূরে রাখা আল্লাহর ইচ্ছা নয়। তবে তারা যেন এ ভাবের জগতে বিচরণ করতে গিয়ে বিপথগামী না হয় এ জন্য মহান আল্লাহ কয়েকটি শর্ত জুড়ে দিয়েছেন: একজন কবিকে ঈমানদার হতে হবে। ঈমান আনার সাথে সাথে অসৎ কর্ম বর্জন করে সত্য ও সুন্দরের অনুসারী হতে হবে। এ ভাবপ্রবণতা ও আবেগী বিচরণ যাতে তাকে সৎ পথ থেকে বিচ্যুত করতে না পারে সে জন্য আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে সদা সর্বদা তাঁর সাহায্য চাইতে হবে এবং যখনই মানবতা বিপন্ন হবে, নিপীড়িত, নির্যাতিত হবে তখনি কবি তার সর্ব শক্তি নিয়োগ করে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করবেন, সাহসী হবেন, প্রতিবাদী হবেন।

 মানুষকে তার প্রাপ্য অধিকার সচেতন করে তোলার জন্য, নিপীড়ন ও নির্যাতনের ব্যপারে জনগণকে সচেতন ও একত্র করার জন্য, কিসে এবং কিভাবে মানবতা বিপন্ন হচ্ছে তা স্পষ্ট করার জন্য সভ্যতার স্বপক্ষে বিপ্লবের বাণী উচ্চকিত করার প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে কবিদের।

যে উদ্দেশ্য আমরা সা¤প্রতিক কালে ভুলতে বসেছি। কিন্তু কবি হিসেবে এই মহান ব্রত আমাদেরকে মনে রাখতে হয় সারাক্ষণ। এ জগৎ সংসারে যে কোন সৃষ্টির মূলেই রয়েছেভালোলাগা, ভালোবাসা এবং দায়বদ্ধতা। ভাল না বাসতে পারলে, দায়বদ্ধতা না থাকলে কোন কিছুই সৃষ্টি সম্ভব নয়। এই ভালোবাসা যে শুধু মানব-মানবী কেন্দ্রিক, তা নয়। বরং প্রকৃতি, ফুল, পাখি, নদী, আলো, হাওয়া, পরিবেশ, সব, সবকিছু। সর্বোপরি মানবাধিকার। এমন কি সকাল বেলার এক কণা শিশির বিন্দুর আন্দোলন কিংবা সন্ধ্যার এক থোকা সন্ধ্যামালতীর শোভাতেও কবি রোমান্টিক হয়ে উঠতে পারেন। লনে ফুটে থাকা হলুদ অলকান্দের সৌন্দর্যও কবিদেরকে ভালোবাসতে শেখায় নতুন করে। তদ্রæপ রাস্তার একটি অবহেলিত শিশু, কিশোরের অবহেলিত মুখও কবিকে দয়াদ্র করে, সচেতন করে, বিপ্লবী করে। তার যোগ্য অধিকার ফিরিয়ে দিতে আন্দোলনমুখী হয়ে ওঠে। তাঁর হাতে থাকা কলম বেজে ওঠে ঝনাৎ।

তাই কবি হওয়ার প্রধান শর্তই হচ্ছে ভালোবাসা। এই অর্থে প্রতিটা কবিই প্রেমিক। যদিও পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে পাঠকের ভালোলাগা, মন্দলাগা, আবেগ, অনুভূতির কারণেও কবিরা অন্য কোন উপাধি বা অভিধায় ভূষিত হতে পারেন। তবে তাকে অবশ্যই ভালোবাসার কবি হিসেবে ভূষিত হতে হয়। সব সময়। সারাক্ষণ।

কবিতার বিশাল প্রান্তর জুড়ে রয়েছে প্রেম,প্রেমিক প্রেমিকার মন, নারীর আবেগ, পুরুষের উৎকণ্ঠা, সত্ত¡া, ভালবাসা গভীর ব্যঞ্জনাময় স্মৃতিতর্পন। যা একইসাথে অকপট এবং দেহবাদী, মনোবাদী, বস্তুবাদী চৈতন্যের এক শিল্পিত পুস্পিত কাননযা কাব্যমোদী পাঠকের শিরায় শিরায় সৌরভ ছড়ায় অনাদিকাল। এই প্রেম!প্রেম আসলে কী? এই ছোট্ট নিবন্ধের গুটিকয় বাক্যের মধ্যে প্রেমের সংজ্ঞা অসম্পূর্ণ এবং অসম্ভব। কেবল তার আবেগ উচ্ছ¡াস কামনা বিরহ যন্ত্রণা ভালোলাগার বোধ, হতাশা কিংবা বঞ্চনাজনীত প্রক্ষোভ ইত্যাদি মানবিক বৃত্তি প্রকাশের মাধ্যমে তা বোঝানো যেতে পারে। একজন কবিও তার লেখার মাধ্যমে সেই রূপগুলো ফুটিয়ে তুলবার চেষ্টায় রত থাকেন। সরাসরি প্রেমের সংজ্ঞা দেন না কখনো। 

কেউ কেউ সমালোচনা করেন কবিরা বাস্তব বাঝেন না। স্বপ্ন কিংবা কল্পনার শরবতে, চাঁদ, তারার আকাশে, ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে প্রাণ ধারণ করেন কবি। সত্যিই কি তাই? আমি বলি, বাস্তবকে স্বপ্নের সাথে মিশিয়ে কবি পৃথিবীকে এক অনন্য সুন্দর মাত্রা দান করেন। 

কবিরা স্পষ্টবাদী। তারা তাদের দায় স্বীকার করে অকপট। তারা সত্যকে সামনে আনে অবলীলায়। হোক না যতই কষ্টকর কিংবা বেদনা দায়ক। সাধারণ একটি জিনিষের বর্ণনা কবির কলমে এত নিখুঁতভাবে উঠে আসে যে পাঠক তাতে আপ্লুত না হয়ে পারেন না। তাছাড়াও সেই বর্ণনাটির কল্যাণে সেই বস্তুটি পৃথিবীতে অমরতা পায়। সময় শেষে সেটি পৃথিবী থেকে ঝরে পরলেও সেটা থেকে যায় ঠিকই কবির বর্ণনায়। ধরা যাক কবি পথের পাশে ফুটে থাকা কোন এক নাম না জানা অসাধারণ ফুলকে নিয়ে লিখলেন। কিন্তু নির্ধারিত সময় শেষে ফুলটা ঝরে গেলেও কবির কবিতায়, বর্ণনায় সেটা থাকে অক্ষত অমর। তাই লিখে যান কবি। সৃষ্টির পরিপূর্ণতায়, পরম্পরায়। যা সভ্যতা নামক মালাটির অভ্যন্তরের গাঁথুনির শক্ত সুতো স্বরূপ। যে সুতোয় সাজানো থাকে প্রতিটি কবির একেকটা কবিতা ফুল। যা কালের কষাঘাতে ঝরে যায় না, বরং দিনকে দিন ঔজ্জ্বল্য পায় কালের পর কাল, মহাকাল। 

 

ড. শাহনাজ পারভীন
কবি, গবেষক, কথাসাহিত্যিক
উপাধ্যক্ষ, উপশহর মহিলা কলেজ, যশোর।
সম্পাদক: দ্যোতনা, নান্দনিক ধারার সাহিত্য কাগজ, যশোর। ছড়াঘর: ছড়াসাহিত্যের কাগজ, যশোর।
সভাপতি: অগ্নিবীণা, কেন্দ্রীয় সংসদ, যশোর। যশোর: ৩ আগষ্ট, ২০২০ খ্রি.

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top