সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

রোদ : আলীয়া তামজিদা কান্তি


প্রকাশিত:
৯ জানুয়ারী ২০২১ ২০:২৫

আপডেট:
২৬ এপ্রিল ২০২৪ ০২:০৫

ছবিঃ আলীয়া তামজিদা কান্তি


সকালে উঠেই ছবি ঘরের জানালাটা খুলে দিল। রোদ না অাসলেও হালকা আলো বাতাস ঢুকলো। বাতাস যেন শরীর পেরিয়ে মনকেও স্পর্শ করল। ছবি উচাটন হয়ে উপভোগ করল বাতাস। সে ধাক্কা দিয়ে ধ্রুবর ঘুম ভাঙালো- দ্যাখ, হাসনাহেনার গন্ধ কি সুন্দর!

ধ্রুব মহা বিরক্ত- "আপু এই কাকভোরে কাকের মত ডাকাডাকি করছ কেন? একটু ঘুমাতে দাও। " তেড়ে উঠল ছবি- “কাক-ভোর, না?আটটা বাজে! ক্লাস কখন তোর? শীগগির ওঠ!”
" ক্লাস নেই, ক্যাম্পাসে ধর্মঘট!"- নির্লিপ্ত জবাব দেয় ধ্রুব।

শেষে ছবির যন্ত্রণায় তাকে উঠতেই হলো। ধ্রুবর হাতে চা ধরিয়ে ছবি বললো-“জানিস, রোদ আমার খুব পছন্দ অথচ এই বাড়িটায় রোদ আসে না। কেমন একটা অন্ধকার বাড়িতে আমরা আছি সেই বাবার রিটায়ারমেন্ট এর পর থেকে! ভালো লাগেনা।“
শুভ অবাক হয় কি হল আবার ছবি আপুর! ছবি তার স্বপ্নের কথা বলতে থাকে -তার এম.এ রেজাল্ট টা বের হলে সে ভালো একটা চাকরি খুঁজে নেবে। ধ্রুবও যদি কোনমতে দাঁড়িয়ে যায় পড়া শেষ করে তখন তারা বাবাকে আর চাকরি করতে দেবে না। এই বয়সে এত কষ্ট সহ্য হয়? আর তারা চাকরি না পেলেও টিউশনিতে তো তারা দুজনেই ওস্তাদ; আরো কয়েকজনকে সাথে নিয়ে একটা কোচিং সেন্টার খুলে ফেলবে। বাবার পেনশনের টাকা তো অাছেই; তাই দিয়ে সংসার চালিয়ে নেয়া যাবে। রিটায়ারমেন্টের যেটুকু টাকা বাকি আছে  তার  যোক্তিক সদ্ব্যবহার করতে হবে। ছবির চোখ চকচক করে- অারেকটা বড় বাসা নেব আমরা যে বাসায় অনেক রোদ আসে; অন্ধকার নেই। রোদেলা বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে বাবা পত্রিকা পড়বে আর তাদের মা টবের রঙ্গন, বেলী, পাতাবাহারের যত্ন নেবে। পূর্ণিমায় বারান্দা ভরা চাঁদের আলোয় বসে ছন্দ হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করবে। ধ্রুব বাজাবে মাউথ অর্গান।

ধ্রুব হাসতে থাকে – “ইজি চেয়ার আর হারমোনিয়াম কোথায় আবার?” এবার ছবিও হাসতে থাকে- “কোথায় আবার? দোকানে!”

ধ্রুব মজা করে -আপু তুমি তো এত বেশি ঘুমাও না; এত স্বপ্ন দেখো কখন? ছবি বলে- “স্বপ্ন দেখার জন্য একটা জুতসই মন দরকার, বুঝলি? স্বপ্ন দেখতে তো পয়সা লাগে না! সমস্যা কি? ছন্দ দুই  বেণি করে কলেজে যাওয়ার জন্য রেডি। সেও তাদের গল্প শুনেছে কিছু কিছু। যাওয়ার সময় বলল- “স্বপ্নে আমাকে হারমোনিয়াম কিনে দেয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ; আমি যারপর নাই কৃতজ্ঞ!" শুনে ওরা দুই ভাই বোন অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। বাবা অফিসের জন্য রেডি হয়ে ওদের সাথে যোগ দিল সেই মুহূর্তে- "কী নিয়ে এত আনন্দ?" খাবার টেবিল থেকে মায়ের ডাক শোনা গেল নাস্তার জন্য।ছবি জিভে কামড় দিল - "এইরে! আমার তো রুটি সেকার কথা ছিল।" ধ্রুব আর বাবা হাসতে থাকে। মা যোগ করল- আজকে দেখি ছুটির দিনের আনন্দ বাসায়; ব্যাপার কী?" জাফর সাহেব মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বললেন, "আজকে আমার মনটা খুব ভালো; অফিসে আজ বড় স্যার দেখা করতে বলেছে। আমার মনে হয় আমার বেতন বাড়ার একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে ; আমি এপ্লাই করেছিলাম।" শুনে তো সব হট্টগোল বাঁধিয়ে দিল- চাইনিজ খাওয়াতে হবে। কতদিন খাওয়া হয়নি বাইরে!

বেলা সাড়ে বারোটা বাজে প্রায়। ছবি শুক্রবার এর ইত্তেফাকের চাকরির বিজ্ঞাপন নিয়ে বসেছে। ধ্রুব এ্যাসাইনমেন্টের কাজ নিয়ে বসেছে। খালি ঘরে ঘরে টিভি চলছে। মা এসে বকতে বকতে বন্ধ করলেন টিভি। "টিভিটা ছাড়লেই শুধু সাদ্দাম- বুশ এর ঝগড়ার খবর! এই টিভি দেখে কে?" মায়ের রাগ দেখে হেসে ফেলে ছবি।এরইমধ্যে বাজলো কলিং বেল। অবাক হলো মা এসময় কে আসলো ভেবে। ছন্দের তো আরো দেরি হয়! দরজা খুলে ছবি অবাক। বাবা দাঁড়িয়ে আছে কেমন যেন উদ্ভ্রান্তের মতো লাগছে তাকে।

-বাবা তোমার শরীর খারাপ লাগছে?
ছবির প্রশ্নের উত্তর দিলেন না জাফর সাহেব। সোফায় বসে পড়লেন। ফ্যান ছেড়ে দেয়া হলো। ভেজা রুমাল দিয়ে মুখ মুছে দিল ছবি। শরবত করে আনলেন মা। ধ্রুব বেডরুমে নিয়ে যেতে চাইল বাবাকে। জাফর সাহেবের বেডরুমে গিয়ে বেশ শব্দ করে বমি করলেন। বমি করার পর ভালো লাগছে। তিনি বললেন জরুরী একটা ফোন করতে হবে। কেউ কিছু বুঝতে পারছেনা। ধ্রুব বাধা দিল- এখন থাক না ফোন। জাফর সাহেব খাটে বসে ল্যান্ডফোনের হ্যান্ডসেটটা তুললেন। আফজাল সাহেবের সাথে ফোনের কথোপকথনটা থেকে সবাই বুঝতে পারল জাফর সাহেবের চাকরিটা চলে গেছে। তিনি যে পদে আছেন সেখানে নাকি আরো কম বয়স্ক চালাকচতুর তরুণকে বেশি মানাবে। কোন নতুন পদ খালি হলে বড় সাহেব তাঁকে ডাকতে ভুলবেন না। জাফর সাহেব আফসোস করছিলেন যে তিনি যথাসাধ্য ভালোভাবেই অফিসের কাজ করছেন কোন অবহেলা না করে; অথচ তার এই পুরস্কার ? আসল কারণটা খুলে বললেন আফজাল সাহেব- এসব আসলে ভাঁওতাবাজি! আসল কথা হল বড় সাহেবের ডানহাত ইউনুস সাহেবের শালার জন্যে পোস্টটা খালি করা দরকার; এটাই মূল বিষয়; জাফর সাহেবের কাজে কেউ কোনদিন সমস্যা দেখেনি। উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করছেন জাফর সাহেব - "এত বড় জোচ্চুরি আমার সাথে? অামি কার কী ক্ষতি করেছি ? বলেন আমাকে! " ফোনে থাকতে থাকতেই একদিকে হেলে পড়লেন তিনি বসা থেকে।হ্যান্ডসেটটা পড়ে গেল হাত থেকে; অজ্ঞান হয়ে গেলেন।আর সব কিছু ঘটে গেলো ছবি, ধ্রুব আর মায়ের সামনে। বাবার অবস্থা দেখে চিত্কার করে সংজ্ঞা হারালো ছবি। এদিকে পাশের বাড়ির গাড়ি দিয়ে বাবাকে হসপিটালে নিয়ে গেল ধ্রুব। ইতিমধ্যে ছন্দও এসে পড়েছিল। ছন্দও গেল সাথে। তাদের মা আরেক চিন্তায় পড়লেন ছবিকে নিয়ে। পানির ছিটা দিয়ে কোনমতে চোখ খোলার ব্যবস্থা করা হলো। তাকিয়েই 'বাবা', 'বাবা', 'বাবা কোথায়' বলতে বলতে আবারও জ্ঞান হারালো ছবি। জাফর সাহেবের স্ত্রীর মনে হচ্ছে এর চাইতে অসহায় অবস্থায় তিনি কোনদিনও পড়েননি। কোথা থেকে যে কি হয়ে গেল যেন বুঝতেই পারছেন না। ছবিকে মনে হচ্ছে অসাড় হয়ে ঘুমাচ্ছে; ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার হয়ে যাচ্ছে ঘুম যেন ভাঙ্গেই না।
জাফর সাহেবের বিভিন্ন টেস্ট সহ সিটিস্ক্যান হয়েছে। ব্রেন স্ট্রোক হয়েছে তার। প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছে। বেশ কিছুদিন হসপিটালে থাকার পর বাসায় আনা হয়েছে। বিছানায় শোয়া অবস্থায় আছেন। তাকে নিয়ে শঙ্কা কমে আসলেও সবাই তখন আরেক ভয়াবহ সমস্যার কূয়ায় তলিয়ে গেছে যে সমস্যার কোন কূলকিনারা তারা বুঝতে পারছেন না। এধরনের সমস্যায় তাদের পড়তে হবে জীবনে কোনদিন চিন্তাও করেনি ধ্রুব, ছন্দ, জাফর সাহেব ও তার স্ত্রী। সমস্যাটা ছবিকে নিয়ে।মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে গেছে তার। প্রথম প্রথম সে ভাবছিল তার বাবা মারা গিয়েছে ঐ স্মৃতি মনে হতেই সে অস্থির আচরণ শুরু করে কিন্তু একপর্যায়ে সে ভুলেই গেল বাবার অসুস্থতার ঘটনা এবং খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সে জিজ্ঞেস করে বাবা অফিস থেকে ফিরেছে কিনা। বাবাকে সামনে দেখেও এসে বাবাকে খুঁজতে থাকে। দিনে দিনে আরও জটিল হয় সমস্যা । সে বাসা থেকে বের হয়ে যায় কখনো নতুন একটা বাসা খুঁজতে, কখনো বাজারের ব্যাগে করে 'রোদ' নিয়ে আসতে, কখনো যায় চাকরি খুঁজতে। বের হওয়া কিছুতেই থামানো যায় না। অশুরের শক্তি যেন ভর করে গায়ে। ধ্রুবকে ধাক্কা দিয়ে অবলীলায় চলে যায়। ধ্রুব ভাবতেই পারেনা এমন কিভাবে হয়ে গেল। লজ্জায় মাথা কাটা যায় যখন জানতে পারে প্রথম পাশের মুদির দোকানের লোকটার কাছে যে ছবি মানুষের কাছে টাকা চায়। এক দিন ছন্দের এক নতুন বন্ধু বাসায় এসেছিল। সে ছবিকে দেখেই অবাক -এই মেয়েটা তোমার বুবু? উনি তো পথে পথে মানুষের কাছে টাকা চায়। আমার মাও টাকা দিয়েছে ওনাকে। " এরপর থেকে কোন বন্ধুকে বাসায় অানে না ছন্দ। লজ্জা, অসহায়ত্ব কুড়ে কুড়ে খায় বাকি সদস্যদের। চিকিৎসাতে সাময়িক ফলাফল পেলেও তেমন উন্নতি হয় না। ওষুধের কারণে বেড়ে গেছে খাওয়া আর ঘুম। ভীষণ মুটিয়ে গেছে। চেনাই যায় না স্বপ্নে বিভোর, ব্য ক্তিত্বসম্পন্ন, দায়িত্বশীল মনের ছবিকে। রাস্তার মাঝে কড়া রোদ্দুরের হেলে দুলে হাঁটা ছবির সাথে কেউ মিলাতে পারবে না আগের ছবিকে। ধীরে ধীরে এই অস্বাভাবিক অবস্থায় তাদের স্বাভাবিক জীবনের সঙ্গী হয়ে পড়ে। কিছুই যেন করার নেই। মাঝে মাঝে রাগে ফেটে পড়ে ধ্রুব কিন্তু কোন লাভ নেই কোন কিছুতেই। বাবার পঙ্গুত্ব,ছবির অস্বাভাবিকতা, অবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম সবকিছু মিলে যখন নিঃশ্বাস চেপে ধরতে চায় ধ্রুবর, সে অবস্থাতেই বাবার অবস্থা খারাপ হয়ে আবারো। এর ভেতরে দিন গড়িয়েছে।ধ্রুবর এম. এ পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ছন্দ অনার্স পড়ছে। বাবা কে ঘিরে নতুন করে কষ্টের ঘোরে ঢুকে যায় সব। ধ্রুবর মা যেন হঠাৎ করেই অনেক বুড়িয়ে গেছে। মায়ের জন্য ভীষণ কষ্ট হয় ধ্রুবর- কিভাবে মা সহ্য করছেন এই কঠিন অবস্থা! না, বাবাকে বাঁচানো গেলোনা। সমস্ত চেষ্টা আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলেন তিনি। এক আকাশ অন্ধকারের মধ্যে তলিয়ে গেল তাদের জীবন। বাবার শোক কাটিয়ে ওঠার সংগ্রাম চলছে বাসায় কিন্তু চরম অস্বস্তি গ্রাস করছে ধ্রুব, ছন্দ আর তাদের মাকে। ছবি বুঝতেই পারেনা যে বাবা মারা গিয়েছে। সে মাঝে মাঝে কান্নার ভাব করে; আবার খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে অদ্ভুত প্রশ্ন করে বসে অাত্নীয়ের সামনে। ধ্রুবর আর সহ্য হয়না। মনে হয় মাথা ফাটিয়ে দেয় তার। মা বরং ধ্রুবকে শান্ত করে - "তবুও ছবিতো বেঁচে আছে; থাকুক না বেঁচে যেভাবেই থাকুক; তোর বাবার মতো চলে না যাক!" ধ্রুব অসহায় বোধ করে মায়ের কথা শুনে। তার রাগারাগিতে কেমন যেন নরম হয়ে ভয়ে এক কোণায় সিঁটিয়ে থাকে ছবি। ধ্রুবর ভীষণ মায়া লাগে। কাছে গিয়ে ছবির মাথায় হাত রাখে -" আপু, আমার আপু তুমি বোঝার চেষ্টা করো; সব ঠিক হয়ে যাবে একদিন । তুমি না রোদেলা বারান্দা চাও! একদিন দেখবে রোদে রোদে তপ্ত হবে আমাদের অন্ধকার জীবনের শীতল দিনগুলো।“ দুচোখ বেয়ে পানি গড়াচ্ছে ধ্রুবর। পানি আড়াল করতে ছাদে চলে যায় ধ্রুব। আকাশ ভরা কড়া রোদ্দুর; ওদের বাসায় ঢুকে না এক ফালিও। এই রোদ্দুরকে যেমন করে হোক ফিরিয়ে আনবেই তাদের স্যাঁতস্যাঁতে জীবনে- স্বপ্ন দ্যাখে ধ্রুব। জীবনযুদ্ধে যুঝতে যুঝতে ফিরিয়ে আনবেই স্বাভাবিকতা।

 

আলীয়া তামজিদা কান্তি
সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top