সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

 নজরুলের বিদ্রোহী: অজর, অমর, অক্ষয় : ড. আফরোজা পারভীন 


প্রকাশিত:
৯ জানুয়ারী ২০২১ ২২:০৫

আপডেট:
৯ জানুয়ারী ২০২১ ২২:৩৩

 

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কবিতা ‘বিদ্রোহী’। তাঁর বিদ্রোহী কবি আখ্যার মূলেও রয়েছে এই কবিতা। কবি-জীবনের শুরুতেই এই কবিতা তাঁকে সর্বমহলে একজন বড় কবি হিসেবে খ্যাতির চরম শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল। নজরুল দ্রোহ-ভাবাপন্ন আরও অনেক কবিতা লিখেছেন। শুধু এক ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্যই তিনি বাঙালির চিরকালের ‘বিদ্রোহী কবি’। বাংলা সাহিত্য তো বটেই বিশ্বসাহিত্যেও এরকম অসাধারণ শব্দচয়ন, স্বতন্ত্র ভাষারীতি ও অভিনব ছন্দের গাঁথুনিতে রচিত দ্রোহের আর একটি কবিতা খুঁজে পাওয়া ভার।

১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে এই কবিতাটি রচিত হয়েছিলো। ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে এই কবিতাটি রচনার ১০০ বছর পূর্ণ হয়েছে। কবিতাটির ৯০-বছর পূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ ও ভারত যৌথ উদ্যোগে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নজরুল-কেন্দ্রিক আলোচনা, পাঠ, আবৃত্তি, সঙ্গীত ও নৃত্যানুষ্ঠান ইত্যাদির আয়োজন করা হয়েছিল। আর এই আয়োজন থেকেই বোঝা যায় রচনার ৯০ বছর পরও কবিতাটির কত আবেদন রয়েছে দুই বাংলার পাঠকের মনে।  আর গত ১০ বছরে সে আবেদন বেড়েছে অনেক। ১০০ বছর পূর্তিতে সে আবেদন তুঙ্গস্পর্শী হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা তাঁর বিদ্রোহের পরিপূর্ণ প্রকাশ। কবিতাটির শুরু হয়েছে এভাবে:

বল বীর
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি আমারি, নত
শির ওই শিখর হিমাদ্রীর!

কবিতা এগিয়েছে। কবিতার ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে সমাজ ও মানবজীবনে  ঘটা নানা অব্যবস্থার প্রতি কবির সংক্ষুব্ধ মনোভাব। এ কবিতায় কবির ‘আমিত্ব’ বার বার প্রকাশিত হয়েছে। নিজেকে তিনি বীর বলেছেন, বলেছেন তাঁর শির চির উন্নত। তাঁর শির যে চির উন্নত ছিল এ বিষয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই। অর্থনৈতিকভাবে মানুষে মানুষে যে বৈষম্য তার কারণ হিসেবে নজরুল মানুষকে যেমন দায়ি করেছেন একইভাবে দায়ি করেছেন প্রকৃতিকে। মানুষের অন্যায়ের শোধ প্রকৃতি নেয় না বলে নিজেকে ‘চিরদুর্দ্দম’ ‘দুবির্নীত’ ‘এলোকেশে ঝড়’ এর মতো নানা অভিধায় অভিষিক্ত করে বিধাতার প্রতিও ক্রোধ প্রকাশ করেছেন।

নজরুল নিজের বিদ্রোহ সম্পর্কে পূর্ণরূপে সচেতন ছিলেন। কবির কাজ ‘সত্য’ প্রকাশ করা। রাজবন্দির জবানবন্দীতে কবি বলেছেন, ‘আমি শুধু রাজার অন্যায়ের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করি নাই, সমাজের, জাতির, দেশের বিরুদ্ধে আমার সত্য-তরবারির তীব্র আক্রমণ সমান বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে, তার জন্যে ঘরে-বাইরের বিদ্রোহ, অপমান, লাঞ্ছনা, আঘাত আমার ওপর পর্যাপ্ত পরিমাণে বর্ষিত হয়েছে, কিন্তু কোনো কিছুর ভয়েই নিজের সত্যকে, আপন ভগবানকে হীন করি নাই, লোভের বশবর্তী হয়ে আত্ম-উপলব্ধিকে বিক্রি করি নাই, নিজের সাধনা-লব্ধ বিপুল আত্মপ্রসাদকে খাটো করি নাই, কেননা আমি যে ভগবানের প্রিয়, সত্যের হাতের বীণা; আমি যে কবি, আমার আত্মা যে সত্যদ্রষ্টা, ঋষির আত্মা।’

কবি রাজশক্তির বাইরেও যুগ যুগ ধরে সমাজে, জাতিতে, দেশে ও বিশ্বে যে মিথ্যাচার জগদ্দল পাথর হয়ে বিরাজ করছে, তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। ব্যক্তি-বিদ্রোহ, সামষ্টিক বিদ্রোহ, রাজনৈতিক বিদ্রোহ, আর্থ-সামাজিক বিদ্রোহ, ভাষা-বিদ্রোহ, সাংস্কৃতিক বিদ্রোহ, নান্দনিক বিদ্রোহ এসব বিদ্রোহেই ছিলেন কবি।

নজরুল ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় নিজেকে অজেয় বলে উপলব্ধি করেছেন। বলেছেন, ‘আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়।’ আত্মশক্তি  আত্ম-দর্শন, আত্ম-উপলব্ধি, আত্মসম্মানের উদ্বোধন করেছেন এ কবিতায়। পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণিই ‘আমি’। এই ‘আমি’কে যে কতটা শক্তির জায়গায় নিয়ে যাওয়া যেতে পারে ‘বিদ্রোহী’ তার প্রমাণ। 

নজরুলের বিদ্রোহী কবিতাটি ১৩৯-পঙক্তির। বক্তব্যের অনুক্রম অনুযায়ী কবিতাটিকে মোট দশটি স্তবকে ভাগ করা যায়। প্রথম স্তবকে ‘আমি’-র শক্তিময়তার এবং বিজয়ের প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে। এই স্তবকেই নজরুল উল্লেখ করেছেন মহাবিশ্ব, মহাকাশ, চন্দ্রসূর্যগ্রহতারা, ভূলোক দ্যুলোক, খোদার আসন, বিশ্ববিধাত্রী, চির-বিস্ময়, রাজটীকা, রুদ্র ভগবান আর দীপ্ত জয়শ্রীর কথা।

১১ থেকে ২৭ পঙক্তি পর্যন্দ নজরুলের প্রতিহিংসার রূপ প্রত্যক্ষ করি : ‘আমি ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণি/ আমি পথ সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’। ২৮ থেকে ৩৭ পঙক্তি পর্যন্ত নিজেকে প্রকাশ করেছেন এভাবে:  আমি মুক্ত জীবনান্দ, করি শত্রুর  সাথে গলাগলি করে, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা ।

পরবর্তী দুই পঙক্তিতে  নজরুল আবার ফিরে গেছেন সংহারী রূপে: ‘আমি’ মহামারী, ভীতি, শাসন-ত্রাসন ও সংহার  এ ধরিত্রীর। ৪২ থেকে ৫১ সংখ্যক পঙক্তিতে আবার পাই উদ্দামতা ইতিবাচক মনোভঙ্গি, হোমশিখা, উপাসনা, নিশাবসানের আকাঙক্ষা। আর ৪৯তম পঙক্তিতেই আছে  অমর উক্তি : ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি, আর হাতে রণতূর্য’। ৫৩ থেকে ৮৬ পর্যন্ত পঙক্তিতে পাই  বিচিত্র পুরাণ বেদ বেদান্ত কোরআন, মানবসভ্যতার আদি থেকে বর্তমান পর্যন্ত নানা প্রসঙ্গ।  ৮৬তম পংক্তিতে আছে ‘আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ’। ৮৭-৮৮তম পংক্তিতে ‘আমি উত্থান, আমি পতন, আমি অচেতন চিতে চেতন / আমি বিশ্ব- তোরণে  বৈজয়ন্তী।’ এক সময় মনে হয়, অনেক দীর্ঘ মন্ত্রোচ্চারণ শেষে কবি শান্ত হন। কবি উচ্চারণ করেন,

মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়নের
ক্রন্দন- রোল, আকাশে বাতাসে
ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ
ভীম রণ-ভূমে রণিবে না

অত্যাচারীর খড়্গ-কৃপাণ থেমে যাবার পর কবি শান্ত হবেন বলেছেন। এ আশাবাদ করা অন্যায় নয়। কিন্তু বাস্তব পৃথিবী সম্পূর্ণ বিপরীত। তাই ব্যাধিতে থেমে যেতে বাধ্য না হলে নজরুল হয়ত থামতে পারতেন না। কারণ বিশ্বব্যাপী অত্যাচার, আধিপত্যবাদ, বৈষম্য নিপীড়ন, সংঘর্ষ কেবল বাড়ছেই। 

কাজী নজরুল ইসলাম ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তাঁর কবিতায় ব্রিটিশ বিরোধিতা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত।  ভারতবর্ষ ব্রিটিশের শাসন  থেকে মুক্ত হবে এ আকাঙক্ষা ছিল নজরুলের উদগ্র। সেই আকাঙক্ষা আর স্বপ্নের রূপান্তর ঘটিয়েছেন শব্দে, কবিতায়। ক্রোধ-ঘৃণা-প্রতিশোধস্পৃহা যাইই থাকুক না কেন মূল সুর মুক্তির আকাঙক্ষা । বিদ্রোহী কবিতা এ আকাঙক্ষার উত্তুঙ্গু প্রকাশ।

সময়টা ১৯২০ সাল। বাংলার রাজনীতিতে তখন বারুদের গন্ধ। দেশের যুবসমাজ স্বাধীনতার আন্দোলনের বেদিমূলে আত্মাহুতির জন্যে অঙ্গিকারাবদ্ধ, বিস্ফোরোন্মুখ।  সেই প্রতীক্ষালগ্নে নজরুল ইসলামের আবির্ভাব।

সৈন্যবাহিনী ভেঙে দেওয়ার আগে ১৯২০ সালে জানুয়ারির শেষদিকে নজরুল দিন সাতেকের ছুটি নিয়ে কয়েকদিনের জন্যে জন্মভূমি চুরুলিয়ায় যান। দিন কয়েক সেখানে কাটিয়ে ফিরে যান করাচিতে  সৈনিকের ছাউনিতে।

১৯২০ সালের মার্চ মাসে প্যারিস চুক্তি স্বাক্ষরের পর ভেঙে দেওয়া হয় ৪৯নং বেঙ্গলি রেজিমেন্ট। নজরুল পাকাপাকিভাবে  সৈন্যবাহিনী ছেড়ে কলকাতায় ফিরে এলেন। মার্চ মাসের শেষদিকে দেশে ফেরার আগে পত্র-পত্রিকায় ডাকযোগে  লেখা পাঠাতেন। ডাকযোগে পাঠানো তাঁর ১০টি রচনা কলকাতায় পরপর প্রকাশিত হয়েছিল তখন। প্রথমদিকে তাঁর রচনা মূলত সওগাত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা ও নূর পত্রিকায় ছাপা হতো। ডাকযোগে সে-সময় কবির ঠিকানা ছিল : ‘মৌলবি কাজী নজরুল ইসলাম, ব্যাটেলিয়ান কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার, করাচি’। নজরুল কলকাতায় ফিরেছেন। বেছে নিয়েছেন সাহিত্য চর্চা, সাংবাদিকতা ও রাজনৈতিক আন্দোলনের জীবন। ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ব্রিটিশ-বিরোধী অসহযোগ আন্দোলনে সারা ভারতবর্ষ তখন টালমাটাল।  তখন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। 

নজরুল কলকাতায় স্থায়ী হবার পর তাঁর রচনার পরিমাণ বাড়তে থাকে। সে-তালিকায় শুধু কবিতা নয়, উপন্যাস, গল্প ও অন্যান্য গদ্য এবং অসংখ্য গান ছিল।

জুলাই মাসে প্রকাশিত হলো  দৈনিক সান্ধ্য পত্রিকা নবযুগ। প্রকাশকাল ১২ জুলাই ১৯২০। সে-বছর সেপ্টেম্বরে কলকাতা কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে যোগ দিতে এসেছিলেন লালা লাজপত রায়, গান্ধীজি ও তরুণ নেতা জওয়াহেরলাল নেহরু। নবযুগ তখন বন্ধ ছিল। কিন্তু  নবযুগের দুই সম্পাদক নজরুল ও মুজফ্ফর আহমদ সে-অধিবেশনে পত্রিকার পক্ষে উপস্থিত ছিলেন। সেই অধিবেশনের আলোচনায় খিলাফত আন্দোলন সেবার অত্যন্ত  গুরুত্ব লাভ করেছিল।

এই পটভূমিকায় নজরুলের কবিতায় ক্রমেই সমকালীন রাজনীতির প্রত্যক্ষ ছায়াপাত ঘটতে লাগল। দেখা দিলো তাঁর গোপনে এতকাল লালিত বিদ্রোহী সত্তার প্রত্যক্ষ পরিচয়। অবশেষে কবি নজরুল লিখলেন তাঁর অন্যতম প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ কবিতা ‘বিদ্রোহী’। রচনাকাল : ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ ১৯২১ সাল। সময় মধ্যরাত্রি, স্থান : ৩/৪ তালতলা লেন, কলকাতা। একতলায় ছোট্ট একটি ঘরে কবির সঙ্গী মুজফ্ফর আহমদ তখন নিদ্রামগ্ন। নজরুল রাত জেগে ভোর হওয়ার আগেই শেষ করেছিলেন তাঁর দীর্ঘ সেই ঐতিহাসিক ‘বিদ্রোহী’ কবিতা।  ২৪ অথবা ২৫ ডিসেম্বর ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্ম হয়েছিল বলে অনুমান অনেকের। তবে ভিন্নমত আছে। কবিতাটি রচনাকাল সম্পর্কে কমরেড মুজাফফর আহমদ তাঁর কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথায় জানান, ‘বিদ্রোহী রচিত হয়েছিল ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহের কোনো এক রাত্রিতে। তার মতে, নজরুল বিদ্রোহী রচনা করেন ১৯২১ সালে কলকাতার ৩/৪ সি তালতলা লেন বাড়িতে। মুজাফফর আহমদ আরও তথ্য যোগ করেন, প্রথমে বিদ্রোহী কবিতাটি পেন্সিলে লেখা হয়েছিল। কবিতাটি রচনার পর মুজাফফর আহমদকে নজরুল প্রথম শুনিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি কবিতাটি সম্পর্কে কোনো অনুভূতি প্রকাশ না করায় মনঃক্ষুণœ হয়েছিলেন বলেও মুজাফফর আহমদ উল্লেখ করেছেন।’ এদিকে সুশীল কুমার সেনগুপ্ত জানিয়েছেন অন্য তথ্য, ‘বিদ্রোহী কবিতাটি রচিত হয়েছিল ১৯২১ সালের শরৎকালে।’ মাস-তারিখ-যা-ই হোক সময় ১৯২১ সাল, এ বিষয়ে ভিন্ন মত নেই।

১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি ‘বিজলী’ পত্রিকায় কালোত্তীর্ণ বিদ্রোহী কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। অত্যধিক চাহিদার কারণে ‘বিদ্রোহী’ ছাপা হলো পরপর তিনটি জনপ্রিয় পত্রিকা মোসলেম ভারত (কার্তিক ১৩২৮), সাপ্তাহিক বিজলী ( পৌষ ১৩২৮), প্রবাসী (মাঘ ১৩২৮)সহ ছোট-বড়ো প্রায় আটটি পত্র-পত্রিকায়। কবিতার ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তার এমন উদাহরণ আর নেই। বিদ্রোহী’ কবিতার এই পুনঃ পুনঃ প্রকাশনা তখনকার সময়ে পাঠক ও প্রকাশকদের মধ্যে এর তুমুল জনপ্রিয়তার প্রমাণ বহন করে। কবির মুখে এ-কবিতার আবেগময় আবৃত্তি-পরিবেশন ছিল এরপর ‘বিদ্রোহী’র অন্যতম আকর্ষণ। দেশের সর্বত্র তখন কবিকণ্ঠে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আবৃত্তি শোনার জন্য সবাই ব্যাকুল হয়ে থাকত।  বাধ্য হয়ে কবি তখন দেশের নানাপ্রান্তে বিদ্রোহী কবিতা নিজকণ্ঠে পরিবেশন করতে যেতেন।

‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনা ছিল কবির দীর্ঘকালীন প্রস্তুতির পরিপূর্ণ আত্মপ্রকাশ।  কলম নিয়ে বসেই এ কবিতাটি তিনি রচনা করে ফেলেননি। মনে লালিত ছিল দীর্ঘদিনের ক্ষোভ আর প্রকাশের বাসনা। অসহযোগ আন্দোলনে ব্যর্থতা এসেছিল, নেতৃত্বে আস্থা স্থাপনে সংশয় ছিল, দীর্ঘকালীন সামাজিক বঞ্চনা ও ঔপনিবেশিক শোষণ ও অত্যাচার সর্বত্র থাবা মেলে ধরেছিল, নজরুল  চেয়েছিলেন-হতাশার অবসান। অন্ধকার হটিয়ে মহাসৃষ্টির মহানন্দ। সাবেক ফৌজি 

‘বিদ্রোহী’র মনে তখন নতুন এক উপলব্ধির জগৎ। দুর্বল জাতির সামনে কবি প্রথম ঘোষণা করলেন অনাগতকালের দুর্জয় শপথবাণী, ‘বল বীর, চির উন্নত মম শির’। সেদিন সেই দীর্ঘ কবিতাই হয়ে উঠেছিল দেশবাসীর অকুতোভয় জীবনের মর্মবাণী।

 জনশ্রæতি আছে,  বিদ্রোহী কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পর পরই নজরুল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে স্বকণ্ঠে আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন কবিতাটি। আর হ্যদয়াবেগে আপ্লুত হয়ে বলেছিলেন, “গুরুদেব, আমি আপনাকে খুন করব, খুন।” রবীন্দ্রনাথ তখন বিদ্রোহী  নজরুলকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন,“হ্যাঁ, কাজী, তুমিই পারবে আমাকে খুন করতে।” সেদিন থেকেই তাঁদের মধ্যে গুরু-শিষ্যের মধুর সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছিল, যা রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু পর্যন্ত অটুট ছিল । 

এই কবিতার জন্ম বাংলা সাহিত্য ও বাঙালির সংগ্রামের ইতিহাসে একটি সাড়া জাগানো ঘটনা। ব্রিটিশরাজের অনুগ্রহ-প্রত্যাশী এক  শ্রেণির সুবিধাবাদী বাঙালি  তখন নিজেদের স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়ে বুঁদ হয়ে ছিল বৃটিশপ্রেমে। নজরুল এ কবিতার মাধ্যমে প্রবলভাবে ধাক্কা দিলেন তাদের অস্তিত্বে। মুক্তিকামী বাঙালি তরুণ সমাজের কাছে এ কবিতা ছিল রক্তে উন্মাদনা সৃষ্টিকারী এক বজ্রকঠিন বার্তা। নজরুল বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন:

আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস
আমি আপনাকে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ!

নজরুলের এই বিদ্রোহী সত্তা, তাঁর রুদ্ররোষে ভীত হয়ে পড়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। ব্রিটিশ সরকার তাঁর একাধিক প্রকাশিত গ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করেছিল। তাঁকে কারাদন্ড দিয়েছিল।

এ কবিতায় ‘আমি’ নজরুল একজন সাধারণ আমি  থেকে বিশেষ আমিতে উত্তরণের  চেষ্টা করেছিলেন। সফল হয়েছিলেন। 

১৯২২ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত নজরুলের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’য় এটি আরও বারোটি কবিতার সাথে স্থান পায়। ‘অগ্নিবীণা’ প্রকাশ করেছিল কলকাতার আর্য পাবলিশিং হাউস। এর প্রচ্ছদ পরিকল্পনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহোদর অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং অংকন করেছিলেন শিল্পী বীরেশ্বর সেন। ‘অগ্নিবীণা’ এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে প্রকাশের সাথে সাথেই এর প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং তারপর আরও কয়েকটি সংস্করণ বের হয়েছিল। বিদ্রোহী-ভাবাপন্ন কবিতা-সম্বলিত ‘অগ্নিবীণা’ বাংলা সাহিত্যের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ও ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থের উচ্ছ¡সিত প্রশংসা তখন বেরিয়েছিল বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার পাতায় পাতায়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত ও প্রেমেন্দ্র মিত্রের মত লেখকদের লেখায় লেখায়। 

১৯২১ সালের সময়টা প্রথম বিশ্বযোদ্ধত্তর সময়। বিশ্বব্যাপী অবক্ষয়, নৈরাজ্য, ব্যক্তির একাকীত্ব, বিশৃঙ্খলা চতুর্দিক ছেয়ে ফেলেছিল । এই অরাজকতায় উদ্বেল হয়ে উঠেছিলেন কবি। ঠিক ওই সময়েই নজরুল প্রতিভার প্রকাশ। প্রতিভা বিকাশের সময়টাকে নিজেকে উজাড় করে দেবার মতো প্রস্তুত ক্ষেত্র পেয়েছিলেন নজরুল।  তিনি মন প্রাণ ঢেলে দিয়ে মিটিয়েছিলেন সময়ের দাবি। তাইতো জন্ম হয়েছিল বিদ্রোহীর। আর সে সময়টাও যেন ছিল নজরুলের মনের মতো। নজরুল শব্দ নির্বাচন ও প্রয়োগে হয়ে উঠলেন নির্বিচারী, বিক্ষিপ্ত। বিদ্রোহীর শব্দ ব্যবহার প্রসঙ্গে  সৈয়দ আলী আহসান ‘আধুনিক বাংলা কবিতা ভূমিকা’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘নজরুল ইসলাম একই সঙ্গে বিক্ষিপ্ত চেতনার অধিকারী। তিনি বাংলা কবিতাকে তার শৃঙ্খলাবদ্ধ রূপাভিব্যক্ত থেকে মুক্ত করে একটি উদ্দামতার মধ্যে হিল্লোলিত করলেন।’

কবিতায় তিনি ব্যবহার করেছেণ অজস্র যৌগিক শব্দগুচ্ছ, তৎসম-তদ্ভব- আরবি-ফারসি-গ্রিক শব্দ । করেছেন সুসমঞ্জস্য প্রয়োগ।  পুরাণ, লোকশ্রুতি, কিংবদন্তী  কিছুই বাদ যায়নি তাঁর ও কুশলী কলম  থেকে। 

বিদ্রোহী কবিতায়  ‘আমি’-র একাধিক ব্যবহার অনেকে ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতার কথা স্মরণ করেছেন।  আবার কেউ কেউ এই কবিতায় ওয়াল্ট হুইটম্যানের ‘সং অব মাইসেল্ফ’-এর অনুরণনও লক্ষ্য করেছেন। আসলে মহৎ সৃষ্টির ক্ষেত্রে এ ধরণের ছায়াপাত থাকা স্বাভাবিক। কারণ মহৎপ্রতিভাধররা একই রকম ভেবে থাকেন অনেক ক্ষেত্রে। 

নজরুলের ভাষা নিয়ে অপেক্ষাকৃত কম আলোচনা হয়েছে। নজরুল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র  শৈলীর অধিকারী ছিলেন। তার কারণ তিনি প্রচলিত অপ্রচলিত বিদেশী শব্দের পাশাপাশি বাঙালির সর্বগোত্রের ভাষিক, সাংস্কৃতিক ও আত্মিক শব্দও ব্যবহার করেছেন। ব্যবহার করেছেন আঞ্চলিক শব্দও প্রচুর। লেখায় স্বাভাবিকতা আনতে তিনি কোন ভাষা বা বাক্য শ্রতিমধুর কোনটা নয় সে বিষয় নিয়ে ভাবেননি। শব্দ নির্বাচনে কবির কোনো জাত-বিচার ছিল না। ভেদিয়া ছেদিয়া ভীম ভাসমান মাইন ঠমকি হরদম ভরপুর মদ তুড়ি দিয়া এই সমস্ত শব্দ এবং বাক্যাংশ নির্বিবাদে ব্যবহার করেছেন। তাই তাঁর ভাষায় সমগ্রতা আছে। 

নজরুল নিজেই বলেছিলেন, আমি হিন্দু-মুসলমানদের পরিপূর্ণ মিলনে বিশ্বাসী; তাই তাদের এ-সংস্কারে আঘাত হানার জন্যই মুসলমানী শব্দ ব্যবহার করি, বা হিন্দু দেব- দেবীর নাম নিয়েছি। অবশ্য এর জন্য অনেক জায়গায় আমার কাব্যের সৌন্দর্যহানি হয়েছে। তবু আমি জেনে শুনেই তা করেছি।’ কিন্তু নজরুল তাঁর লেখার যতই ব্যাখ্যা দিন না কেন, তিনি প্রতিক্রিয়াশীলদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাননি। 

বিদ্রোহী কবিতায় আমরা বিদ্রোহীর পাশাপাশি এক প্রেমিককে পাই, পাই বিধবার পুত্রকে। পাই ব্যথিতের বন্ধুুকে। ‘ব্যথিতের বুকে ক্রন্দশ্বাস/ হাহুতাশ আমি হুতাশীর।’ এই পংক্তি মনে করায় আপনার আমার ঘরের ছেলেটিকে। 

‘বিদ্রোহী’ এক অসাধারণ কবিতা। অসামান্য এর ব্যঞ্জনা। কখনও পুরোনো হয় না। বারবার নতুন করে জন্ম হয় পাঠক মনে। যতবার পাঠ করি ততবারই নতুন মনে হয়, নতুন ভাবনা চিন্তার উন্মেষ ঘটে মনে। নজরুল যা লিখেছেন তা যেন বার বার বদলে অন্যরকম হয়ে ওঠে। 

নজরুল আজ নেই। পরাধীনতার শৃঙখল ভেঙ্গে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্মের একশ বছর আহত হলেও রাষ্ট্রের জনগণ রাজনৈতিক দুঃশাসন ও অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তি পায়নি। জনগণের অধিকার নিশ্চিত হয় নি। সুতরাং যতদিন শাসন- শোষণমুক্ত সমাজ গঠন না হবে, ততদিন  ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রয়োজনীয়তা থাকবে।  নজরুল আজ শান্ত হয়ে গেছেন প্রকৃতির অমোঘ খেয়ালে অত্যাচারিতের ক্রন্দন রোল থামার আগেই। 

কিন্তু নজরুলের সেই দৃপ্ত উচ্চারণের প্রাসঙ্গিকতা ফুরিয়ে যায় নি:

মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেইদিন সব শান্ত
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন- রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।

আজ বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশের ১০০ বছর পূর্ণ হলো। কবিকে কুর্ণিশ জানাই। বিদ্রোহী কবিতার আবেদন আজও অম্লান। প্রাসঙ্গিকতা সর্বকালীন, সার্বজনীন।  এ কবিতা বেঁচে থাকবে সকল দ্রোহে, সকল সংগ্রামে।

 

আফরোজা পারভীন
কথাসাহিত্যিক, প্রবন্ধকার, কলামলেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top