সিডনী বুধবার, ২৪শে এপ্রিল ২০২৪, ১১ই বৈশাখ ১৪৩১

পূর্ণিমার রাত শালবন এবং এক নক্ষত্রপতনের ইতিহাস : নবনীতা চট্টোপাধ্যায়


প্রকাশিত:
১৪ জানুয়ারী ২০২১ ২০:৫৬

আপডেট:
১৪ জানুয়ারী ২০২১ ২০:৫৮

 

সে ছিল এক পূর্ণিমার রাত। গলানো রূপায় ভেসে যাচ্ছিল চরাচর। আকাশ এত পরিস্কার যে দৃশ্যমান অনেক নক্ষত্র। যেন নক্ষত্ররা সার দিয়ে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে আছে কেন না দিনটি নক্ষত্রপতনের দিন। পৃথিবীর এক উজ্জ্বল জ্যোতিস্ক আজ তার পার্থিব দেহ থেকে মুক্তিলাভ করে পাড়ি দেবেন অন্য এক ছায়াপথে যে পথে রয়েছে নক্ষত্রদের দেশ।
স্থান কুশীনগর। প্রাচীন হিরন্যবতী নদী পেরিয়ে জরাজীর্ণ শরীরে ভগবান বুদ্ধ গুটিকয়েক শিষ্য নিয়ে অবশেষে এসে পৌছলেন কুশীনগরের প্রান্তে এক শালবনে। তাঁর রোগজীর্ণ শীর্ণ শরীরে সূর্যাস্তের ছাপ প্রকট। নীরবে অশ্রুবিসর্জন করতে করতে শিষ্য আনন্দ ভগবান বুদ্ধের ইচ্ছানুসারে শালবনে দুটি শালগাছের মাঝখানে শুকনো পাতার উপর জীর্ণ চীবর বিছিয়ে শেষ শয্যা স্থাপন করলে। বুদ্ধ উত্তর দিকে তাঁর ডান হাতের উপর মাথা রেখে সিংহশয়ানে শুলেন। তাঁকে ঘিরে থাকলেন শিষ্য আনন্দ, সুভদ্র, ভিক্ষু অনিরুদ্ধ ভক্ত চুন্দ ও আরো কয়েকজন অনুচর। শালফুলের মিস্টিগন্ধে আমোদিত বাতাস। বৈশাখী পূর্ণিমার সেই অনির্বচনীয় পরিবেশে শোকার্ত শিষ্যরা চুপ করে বুদ্ধের শেষ নির্দেশ ও বাণীর অপেক্ষায়। বুদ্ধ অস্পষ্ট স্বরে বললেন "তোমাদের মধ্যে কোনো প্রশ্ন থাকলে আমায় বলো"। কেউ কোনো কথা বললেন ন। বুদ্ধ নিজেই আবার বললেন "আমি ধর্ম সম্পর্কে যা বলার খোলাখুলিভাবে ব্যাখা করেছি। ভিক্ষু সঙ্ঘের শেষ কথা সেই বলতে পারে যে অধিনায়ক হতে চায়। এখন থেকে তোমাদের নিজেদের উপর নির্ভর করে পথ চলতে হবে"। বুদ্ধের শেষ বাণী ছিল "বয়ধম্মাসংখারা অল্পমাদেন সম্পাদেন"। পালি ভাষায় এর অর্থ হলো পৃথিবীর সব বস্তুই অনিত্য ও ধ্বংসশীল। তোমরা নির্ভুল ভাবে কাজকর্ম করো। এর পরেই ভগবান বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ হয়। যেন একটি প্রদীপ শিখাকে নিভিয়ে দিয়ে তিনি চির ধ্যানস্থ হয়ে গেলেন। হাওয়ায় তাঁর দেহের উপর ঝরে পড়ল রাশি রাশি শালফুল।
ইতিহাস বলছে মহাপরিনির্বাণের আগে বুদ্ধ ভিক্ষুসঙ্ঘের সাথে বিহার ও উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়ান। তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিলেন ভিক্ষু আনন্দ, ভিক্ষুসঙ্ঘের পরিচালনা ও নানাবিধ সংকটে যিনি বুদ্ধকে নানাভাবে সহায়তা করেছেন। মৃত্যুর তিনমাস আগে  বৈশালীতে এসে বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের জানান যে  চৈত্রের পূর্ণিমার দিনে তিনি মহানির্বাণ লাভ করবেন। তাঁর নিজস্ব ভিক্ষাপাত্রটি তিনি দিয়ে দিলেন বৈশালীর ভক্তদের। এরপর পরিশ্রান্ত, কিছুটা অসুস্থ  ভগবান বুদ্ধ পাবা নামক স্থানে তাঁর অন্যতম ভক্ত চুন্দের আতিথ্য গ্রহন করেন। চুন্দ তাঁকে দ্বিপ্রাহরিক আহারের আমন্ত্রণ জানালেন। ভিক্ষুসঙ্ঘের কয়েকজনকে নিয়ে বুদ্ধ চুন্দের  আমন্ত্রণে গেলেন। চুন্দ তাঁকে খেতে দিয়েছিলেন সূকরমদ্দর (ঐতিহাসিকদের মতে শুয়োরের মাংস অথবা  একপ্রকার মাশরুম)। বুদ্ধ আহার গ্রহণ করে বুঝলেন খাদ্যবস্তুটিতে পচন ধরে গেছে। তিনি চুন্দকে অনুরোধ করলেন তাঁর অন্য অনুচরদের এই খাদ্যটি পরিবেশন না করতে। বুদ্ধ নিজেও অল্পই গ্রহণ করেছিলেন। তবু এই অল্প গ্রহণেই তিনি  অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সেই অবস্থায় বুদ্ধ তাঁর অনুচরদের নির্দেশ দিলেন চুন্দকে আশ্বস্ত করতে যে তার পরিবেশিত খাদ্যে বুদ্ধের অসুস্থতা আসে নি। বরং এই খাদ্য তাঁর শরীরে কিছুটা বল যুগিয়েছে। চুন্দকে আশ্বস্ত করে সেই  অসুস্থ শরীরেই তাকে কিছুটা ধর্মোপদেশ দিয়ে বুদ্ধ কুশীনগরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন।  তাঁর মনে হয়েছিল এখানে তাঁর মৃত্যু হলে হয়তো  সবাই চুন্দকে দোষারোপ করবে।
পালিভাষায় রচিত ত্রিপিটকের মহাপরিনির্বাণ সুত্রগুলি থেকে আমরা জানতে পারি ভগবান বুদ্ধের শেষ দিনগুলির কথা।  যদিও তাঁর মৃত্যুর কারণ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে তীব্র মতভেদ আছে। কারো মতে বয়সজনিত কারণে ভগবান বুদ্ধ ধ্যানের মাধ্যমে মৃত্যু গ্রহণ করেছিলেন, বিষক্রিয়ায় নয়। কেননা তাঁর মৃত্যুর দিন তিন মাস আগেই তিনি শিষ্যদের ঘোষণা করে দিয়েছিলেন।  মহাপরিনির্বাণ সুত্রগুলিতে একজন নয় দুজন বুদ্ধের কথা উল্লেখ আছে। প্রথমজন ছিলেন এক অত্যাশ্চর্য মহাপুরুষ যিনি  ঈশ্বরের অবতার হয়ে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, পৃথিবীর শেষদিন পর্যন্ত যার বেঁচে থাকার কথা ছিল একটি শর্তে যে তাঁর প্রিয় শিষ্য তাঁকে  পৃথিবীর শেষদিন অবধি থাকার অনুরোধ জানাবেন এবং  শিষ্য আনন্দ সেই অনুরোধ করেন নি । তাই তাঁকে ধ্যানের মাধ্যমে মৃত্যু গ্রহণ করতে হয়েছিল।  দ্বিতীয় বুদ্ধ যিনি একজন অশীতিপর মহাপুরুষ, শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় যাকে মৃত্যু বরণ করতে হয়েছিল শালবনে। এই শারীরিক অসুস্থতার ভক্ত চুন্দের দেওয়া পচনশীল খাবারের জন্য জোরদার হয়েছিল। বিভিন্ন মতবাদ বিশ্লেষন করে ঐতিহাসিকরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে প্রথম বুদ্ধ হয়ত কোনো কাল্পনিক চরিত্র যা বৌদ্ধ সঙ্ঘগুলির পারস্পরিক বিবাদের ফল। সুত্রগুলিতে দ্বিতীয় বুদ্ধের যে বর্ণনা দেওয়া আছে সেটাই অনেক বাস্তবসম্মত ও তথ্যনির্ভর বলে তারা মনে করেন।

শেষ মূহুর্তে অশ্রুসজল আনন্দ তথাগতকে প্রশ্ন করেছিলেন যে তাঁর দেহাবশেষের উপর স্তুপ নির্মাণ করা হবে কি না। বুদ্ধ তাঁর প্রিয়তম শিষ্যের অনুরোধ ফেলতে পারেন নি। তিনি স্তুপ নির্মাণের অনুমতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর শেষ বাণী ছিল "এই পৃথিবীর স্থবির ও গতিশীল সমস্ত বস্তুই অনিত্য ও ধ্বংসশীল তাই আমার দেহাবশেষের কথা না ভেবে তোমরা  নিজেদের অন্তরকে আরো আলোকিত করো, নিজেদের প্রতি যত্নবান হও, পরের উপকার করো। আমি তাতেই সুখলাভ করবো"। বুদ্ধ যদিও বলেছিলেন যে জগতে সবই অনিত্য কিন্তু তাঁর শিষ্যরা বুদ্ধের ভাবমূর্তি ও বাণী সর্বোপরি বৌদ্ধধর্মের প্রচারের জন্য বুদ্ধের মৃতদেহ সাতদিন রেখে দিলেন। আনন্দ কুশীনগরে তদানীন্তন মল্লরাজাদের খবর দিলেন। নানান বর্ণের টুকরো কাপড়ে জড়িয়ে মল্লরাজারা বুদ্ধের মৃতদেহ সৎকারের জন্য মুকুটবন্ধন নামে মল্লরাজাদের অভিষেক মন্ডপে নিয়ে গেলেন। চন্দন কাষ্ঠে আচ্ছাদন করা হলো ভগবান বুদ্ধের দেহ। আগুনে পুড়ে গেল তাঁর পার্থিব শরীর, রয়ে গেল তাঁর কিছু অস্থি দেহাবশেষ হিসাবে। বিভিন্ন রাজ্য ও দেশ থেকে রাজারা এসে তাঁর দেহাবশেষ নিয়ে তার উপর স্তুপ নির্মাণ করলেন। এমনকি শ্রীলংকা, ব্রক্ষ্মদেশ, মায়ানামার প্রভৃতি বাইরের দেশ থেকে নৃপতিরা এসে বুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে তাদের দেশে স্তুপ বা চৈত্য নির্মাণ করেছিলেন। পরিবর্তীকালে সম্রাট অশোক বিভিন্ন জায়গা থেকে বুদ্ধের দেহাবশেষ সংগ্রহ করে নির্মাণ করেন প্রায় ৮৪,০০০ স্তুপ। খ্রীস্টপূর্ব ২৪৯ এর কোনো এক সময়ে সম্রাট অশোক লুম্বিনী গ্রানে গিয়ে সিদ্ধার্থের জন্মস্থান খুঁজে বার করে সেখানে স্থাপন করেন এক অশোক স্তম্ভ যেখানে ব্রাক্ষ্মীলিপিতে লেখা হয় "হিদ বুধ জাতে শাক্যমুনিতি এবং লুম্বিনী গ্রামকে সেই পূণ্যে  করমুক্ত করা হয়। বৌদ্ধ ধর্ম যা কিনা সেই সময়ে মাত্র মাত্র কয়েকটি জায়গায় প্রচারিত হয়ে ছিল, সম্রাট অশোক তার বিস্তীর্ণ সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে দিলেন এই ধর্মপ্রচার। তিনি হীনযানপন্থী ভিক্ষু ও শ্রমণদের আশ্মীর, গান্ধার, নেপাল, তিব্বত, মহারাষ্ট্র, মহীশূর, শ্যামদেশ, যব্দ্বীপ, শ্রীলংকা, ম্যাসিডোনিয়া পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সে তো অন্য এক ইতিহাস...

বৈশাখী পূর্ণিমার রাতে লুম্বিনী উদ্যানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এক রাজপুত্র। শাক্যবংশের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ছিলেন তিনি। রোগ, শোক, জরা, দু:খ জীবনের এই অমোঘ পরিনতি গুলির কারণ ও মুক্তির  উপায় খুঁজতে হেলায় রাজপ্রাসাদ ছেড়ে বুদ্ধত্ব লাভের জন্য সন্ন্যাস নিয়েছিলেন। কঠোর তপস্যার মাধ্যমে বোধি লাভ করেন। তিনিই প্রথম মানব জাতিকে শেখান মানুষের আকাঙ্খা থেকে দু:খলাভ হয়। এর থেকে মুক্তি পেতে হলে অস্টাঙ্গিক মার্গ অবলম্বন করতে হবে অথার্ৎ সৎ বাক্য,সৎ কাজ, সৎ জীবিকা, সৎ চিন্তা,সৎ চেতনা, সৎ সংলাপ,সৎ চেষ্টা, ও সৎ হাসি। অজ্ঞাণতার অন্ধকারে  ডুবে থাকা মানবজাতিকে তিনি বুঝিয়েছিলেন পৃথিবীতে স্থায়ী কোনো কিছুই নয়। সবকিছুর ই বিনাশ আছে। তাই হিংসাকে বর্জন করতে হবে, ত্যাগের মন্ত্রে দীক্ষিত হতে হবে আর জ্ঞাণকে নৌকার নত ব্যবহার করে জীবনের পথে এগিয়ে যেতে হবে। এক পূর্ণিমার রাতে পৃথিবীকে আলোকিত করতে আবির্ভাব হয়েছিল তাঁর, সেইরকম আরো একটি পূর্ণিমার রাতে শালবনের মাঝে তাঁর মহাপরিনির্বাণ লাভ হলো। নিঝুম শালবনে ঝরে পড়লো একরাশ শালফুলের অঞ্জলি।

 

নবনীতা চট্টোপাধ্যায়
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top