সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

ধ্রুবপুত্র (পর্ব ষোল) : অমর মিত্র


প্রকাশিত:
১৪ জানুয়ারী ২০২১ ২১:২০

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ০১:৫৮

 

মাঘের দুপুর। গন্ধবতী তামার কলস রজ্জু নামিয়ে দিচ্ছিল কূপের অন্ধকারে। জল নেমে গেছে অনেকটা। এই গম্ভীরা গ্রাম গম্ভীরা নদীকূলে হওয়ার কারণে জলস্তর এখানে কাছেই। চৈত্র থেকে তা অকুলান হতে থাকে, স্তর নেমে যায় অনেকটা। আবার যদি মাঘে বৃষ্টি হয়, চৈত্রে বৃষ্টি হয়, একদিনেই জলস্তর উঠে আসে। তবু ওই চৈত্রেই রজ্জুর দৈর্ঘ্য বদলাতে হয়, প্রমাণ মাপের চেয়েও বেশি লাগে। অনেক। এবার জলস্তর অনেক নীচে। রজ্জু বদলাতে হয়েছে অঘ্রানের শেষে। সেই রজ্জুও যেন ছোট হয়ে আসে। গন্ধবতী কূপের অন্ধকারে তাকায়। তাকিয়েই থাকে। তার মুখখানি অন্ধকারে ঢেকে যায়। মনের ভিতরে সেই অন্ধকার প্রবেশ করে। 

এই কূপ রাজার দেওয়া। কোন রাজা? গন্ধর্ব সেন। দশপুরা বিজয়ের পর গ্রামে পুষ্করিনী খনন, বৃক্ষরোপণ, গ্রামে গ্রামে যত কূপ, শিপ্রা, গন্ধবতী, গম্ভীরার তীরে যত দেবালয় আছে সব সংস্কার করেছেন রাজা ভর্তৃহরি। এসব শোনা কথা গন্ধবতীর। তখন সে কত ছোট। সে ছিল সুগন্ধা। কার্তিককুমারের কন্যা সুগন্ধা। খুব আবছা মনে পড়ে গন্ধবতীর।

রাজা ভর্তৃহরির নাম অবন্তী দেশের মানুষ সম্ভ্রমের সঙ্গেই উচ্চারণ করে। ধ্রুবপুত্রের কাছে সে রাজার কথা শুনেছে। রাজা বিদ্বান, বিদ্যোৎসাহী। সান্দীপনি আশ্রমে সাহায্য পাঠান প্রতি পূর্ণিমায়। রাজা কবিতা প্রেমী। কাব্য-শ্লোকের দু’একটি পদ ধ্রুবপুত্র উচ্চারণ করেছিল তার সামনে। কর্ণমূল আরক্ত হয়ে গিয়েছিল অজান্তেই। ধ্রুবপুত্র কি নিষ্ঠুর ছিল?  উদাসীন! সে কি একবিন্দুও টের পায়নি গন্ধবতীর মনের কথা? তাকে শোনাচ্ছে সখা সেই শৃঙ্গারের শ্লোক, অথচ সখার তখন মন পড়ে আছে গণিকায়। গণিকা দেবদত্তার কাছে যাবে গন্ধবতী। দেখতে চায় তাকে। কত না তার রূপ তা নিজ চোখে দেখবে। 

চারদিক থমথমে। কূপের এখানটা তো নির্জনই। তাদের গৃহ-প্রাঙ্গণ এখান থেকে দেখা যায় না। মা বসে আছে একা। মা রেবা দিন দিন মৌন হয়ে যাচ্ছে। এবার শীত ততো কঠিন হয়নি বটে, কিন্তু তাও তো কম নয়। এদেশে শীতের প্রকোপ বেশি। সেই শীতও শেষ হয়ে এল প্রায়। চারদিকের গাছগাছালি নির্জীব। বট, অশ্বত্থ, পিপুল, অশোক, নিম, সিন্ধুবার, যত লতাগুল্ম সব যেন মৃতপ্রায়। মলিন হয়ে গেছে পাতা। পত্রঝরণের কাল চলছে। বাতাসে ধুলো উড়ছে, ধুলোয় ঝরাপাতা। গম্ভীরার পশ্চিমে শালবন। পাতা খসে যাচ্ছে ধ্যানমগ্ন তপস্বীর মতো গাছগুলির। 

কূপের প্রায় তলদেশে পৌঁছে গেছে তাম্রকলস। গন্ধবতী অন্ধকারে দৃষ্টিপাত করে। রজ্জু তার দু’হাতে ধরা। সে একটু একটু করে কলসটি তুলে আনতে থাকে। নির্ভার কলসটি  উঠে এল অনায়াসে। গন্ধবতী দু’হাতে কলসটি কূপের পাশে রাখে। কোথায় জল? গন্ধবতীর মুখ চোখে বিভ্রান্তি  এল। সে অবাক হয়ে দ্যাখে যেটুকু জল উঠেছে তা বালিমাখা, কাদামাখা। এই বছরে কূপ সত্যিই শুকিয়ে গেল?  তার এই সামান্য জীবনে এমন অভিজ্ঞতা তো হয়নি আগে। কূপের জল যে শুকিয়ে যেতে পারে তা সে ভাবতেও পারে না। গন্ধবতী কলসের জল পায়ের কাছে ঢেলে দেয়। পায়ের পাতা বালুকণায় ভরে যায়। সে আবার কলস নামিয়ে দিতে থাকে কূপের  অন্ধকারে। দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অনুমান করতে থাকে জল আছে কিনা। অন্ধকারে বিভ্রম লাগে। কিছুই আন্দাজ করতে পারে না। কলসটি জলে পড়লে যে ধ্বনি উঠে আসে, তা কানে আসে না। কানে যা আসে তা ধ্বনির ভঙ্গুরতা। আচমকা কলসটি গিয়ে পড়েছে বালু মৃত্তিকার কঠিন স্তরদেশে। এ ধ্বনি বড় কর্কশ। অথচ জলে যখন আচমকা গিয়ে পড়ে কলস, জলে যখন ঝাঁপায় কলস, সেই ধ্বনি কী গম্ভীর, কী শীতল সেই ধ্বনির মায়া। কানে এলেই গম্ভীরা নদী ভেসে ওঠে চোখের সামনে। গন্ধবতী রজ্জু টেনে কলসটির সাহায্যে পাতালে জল খোঁজে। হায়! পাতালও জলহীন হলো! সে মাথা নিচু করে জলচিহ্ন খুঁজতে থাকে। ব্যর্থ হয়। ডাক দেয় অন্ধকারে, জল-জল? আ-হা-হা-আহ্! প্রতিধ্বনিত শব্দরাশি তার কাছে উঠে আসে। সে কলস দোলায় অন্ধকার শূন্যে। রজ্জুর পরিমাপে ধরা যায় এই জায়গায় জল থাকার কথা ছিল। নেই। সে কলসটি টেনে তুলতে থাকে। কলসটি কি ভরে গেছে জলে? কলস উঠে এলে সে অতি সাবধানে তা জমিতে রেখে পায়ের পাতার অগ্রভাগে ভর দিয়ে জানু ভেঙে বসেছে।  কোথায় টলটলে জল! কর্দমাক্ত বালুমাখা জলের মুখ দেখে গন্ধবতী কলস উপুড় করে দেয় মাটিতে। আকাশে তাকায়। এমনকি কখনো হয়েছে? সবে তো মাঘ মাসের পক্ষপাল গেছে। সামনে তাহলে কী দিন আসছে? বুকটা ধকধক করে ওঠে তার। আকাশ এখন ঘোর শূন্য। উড়ন্ত পাখিও  চোখে পড়ে না। মহাশূন্যে, সেই দৃষ্টি সীমার শেষে উড়ন্ত শকুনও যে নেই। গন্ধবতীর মুখে ছায়া নামে। এ ছায়া মনের। কী করবে সে এখন? সকলকে জানিয়ে দেবে শুকিয়ে আছে রাজার কুয়ো। ধ্রুবপুত্রই না বলত, রাজার কুয়ো শুকোবে না কোনোদিন, এত গভীর করে খনন করা হয়েছে তা। গন্ধবতী কি এবার দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে জানাবে রাজার কুয়োয় জল নেই? রাজার কি তাহলে তৃষ্ণা নিবারণের শক্তি ফুরোল? ধ্রুবপুত্র কেন, তার পিতামহ শিবনাথও বলে, ওই কূপের জল কখনো শুকোবে না। রাজশক্তি নিহিত আছে কূপের অন্ধকারে, ওই কূপ দিয়ে রাজা তৃষ্ণা নিবারণ করছেন সব সময়, এটা মনে রাখলে রাজভক্তি অটুট থাকে, রাজভক্তি ব্যতীত রাজার রাজত্বে বাঁচা যায় না।

গন্ধবতী বিড়বিড় করে, কী হলো, অবন্তীরাজও তৃষ্ণা নিবারণের ক্ষমতা হারালেন, হায় রাজা! তোমার দেওয়া জল তো ফুরোবার কথা নয়। ধ্রুবপুত্র থাকলে এর ব্যাখ্যা পেত গন্ধবতী। আচমকা তার মনে হলো ধ্রুবপুত্র থাকলে কি জলহীন কূপের সামনে বসে থাকতে হতো তাকে? জল থৈ থৈ অন্ধকারে গিয়ে ঝাঁপাত না তাম্রকলস? ধ্রুবপুত্র থাকলে কি অবন্তী দেশের আকাশ নির্মেঘ থাকত আষাঢ়, শ্রাবণে? পরপর দুটি বৎসর? সূর্যদেব তার শুভ্র কিরণ দিয়ে যে শুক্লবর্ণ জলরাশি সমস্ত বৎসর ধরে মেঘেদের দান করেছেন, সেই মেঘ কোথায়? ধ্রুবপুত্র বলত, সূর্যের তাপ বাতাসের সাহায্যে সর্বভূত থেকে, বিশেষত সরোবর, নদী, সমুদ্র থেকে জলরাশি আহরণ করে মেঘেদের দেয়। সেই মেঘ থেকে যে বৃষ্টি নামে তা সর্বজীবের মঙ্গল সাধন করে।

কলসটি বুক চেপে গন্ধবতী আকাশে তাকায়। আকাশের নির্দয়া ছায়া ব্যতীত আর কিছুই দেখতে পায় না সে। ভীতা চাতকিনীর মতো আকাশের পূর্ব-পশ্চিমে দ্যাখে, উত্তর দক্ষিণে ভ্রমণ করে মনে মনে। মেঘের কোনো চিহ্ন নেই। দীর্ঘকাল যে জলরাশি আহরণ করলেন সূর্যদেব, তা কোথায় নামছে? কোন দেশে? সখা বলত, সূর্যদেব পৃথিবী থেকে যে জল আহরণ করেন তাঁর উত্তাপে, ফিরিয়ে দেন তার সহস্র গুণ। সখা নেই। তার কথাও অসত্য হয়ে যাচ্ছে। কতদিন বৃষ্টি নেই! গন্ধবতী মনে মনে গণনা করে শেষ বৃষ্টি কবে দেখেছিল সে। মনেই পড়ে না। বৃষ্টি নেই বলে, আকাশের জল নেই বলে, পাতালের জলও ফুরিয়েছে। হায় ধ্রুবপুত্র! তুমি কি মেঘ! মেঘ হয়ে চলে গেছ অবন্তী দেশ থেকে। চোখে জল চলে আসে গন্ধবতীর।

সখা, তুমি কি জানো, তুমি অবন্তী ত্যাগ করার পর এই দেশ আর মেঘের ছাযা দ্যাখেনি। সেই মেঘ, আগ্নেয় মেঘ, ব্রহ্মজ মেঘ, পক্ষজ মেঘ, তুমিই তো বলেছিলে আমাকে। বলেছিলে মেঘ বায়ুজাত বজ্রধ্বনি, আর অগ্নিজাত বিদ্যুৎ প্রকাশ করে স্বমহিমা দেখায়। হে সখা, তোমার সেই আগ্নেয় মেঘ, ব্রহ্মজ মেঘ, পঙ্কজ মেঘ কোথায়? তুমি কি জানো, অবন্তীর মানুষ শুধু মেঘের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছে? কী অপরূপ ছিল সেই মেঘময় অবন্তীর আকাশ। এখনো মেঘের কথা মনে করলে তোমার কথা মনে আসে যেন। ধ্রুবপুত্র তুমি, তোমার প্রিয় ঋতু ছিল বর্ষা।

বর্ষাই ছিল ধ্রুবপুত্রের প্রিয় ঋতু। ধ্রুবপুত্র বলত, সর্বভূতের শরীরে জল আছে। স্থাবর জঙ্গম যখন ভস্মীভূত হয়, যে ধোঁয়ায় রাশি আকাশে ওঠে তা তো জলই। সেই জল থেকে অভ্রের উৎপত্তি। ভ্রষ্ট হয় না বলেই মেঘের নাম অভ্র। আহা কী দিনই না গেছে এই গম্ভীরা তীরে! আকাশ ঢেকে আছে কৃষ্ণকায় ঐরাবতের মতো মেঘে, বৃষ্টির শব্দে মুখর হয়ে আছে পৃথিবী। গম্ভীরা নদী আকাশের জলে পুষ্ট হয়ে অধীরগামিনী হয়েছে। মেঘের ছায়া ধারণ করে সে হয়েছে নিমীলিত চক্ষু, ঘোর শ্বাস-প্রশ্বাসে দিকহারা প্রায়। তার স্রোতের উপর ঝুঁকে পড়েছে নীল রঙের বেতস লতাগুলি, স্রোতের টানে  কাঁপছে সব সময়। যখন থামল বৃষ্টি, আকাশে আবার ডাকতে লাগল মেঘ, ময়ূরগুলি পেখম সাজিয়ে মেঘকে অর্চনা করল। ময়ূর-ময়ূরীর সেই রূপ কতদিন যে দ্যাখেনি গন্ধবতী। গেল বর্ষায়, তার আগের বর্ষায় গন্ধবতীর মন ছিল না নদীতীরে যাওয়ার। দুই ঋতুতেই বর্ষা আসতে আসতেই বিদায় নিল। যেন ভুল পথে এসেছিল মেঘ। অবন্তী তার গন্তব্য ছিল না। তাই গম্ভীরাতীরের বেতস লতাগুলির নীল মেঘবর্ণ পুড়ে গিয়েছিল রৌদ্রে। গম্ভীরা নদী হয়েছিল শ্লথগতি , বিগতযৌবনা যেনবা, কোনোরকমে টানছিল নিজেকে। এখনো তাই। সেই সমস্ত দিনও তাই। সেই যে তাম্রধ্বজ গেল, আচার্য বৃষভানুর শিষ্য নবীন জ্যোতির্বিদ... কী আশ্চর্য! তার কথা মনে পড়ল কেন? সেই বা কীরকম কথা বলেছিল, একেবারে বর্ষার কথা। বর্ষায় গম্ভীরার যে রূপ হয় সেই কথা বলল কিনা পৌষে এসে। একেবারে ধ্রুবপুত্রের মতো কথাগুলি। সে যেন দেখেছিল বর্ষায় গম্ভীরাতীরের বেতসকুঞ্জ, বেতসলতার নীলরঙ। গন্ধবতী নিশ্চুপ, নিঃঝুম, বিহ্বল, তার চোখের সামনে থেকে মুছে যাচ্ছে এই দ্বিপ্রহর, ভেসে উঠছে পৌষের সেই সন্ধ্যা, অন্ধকারে উপচে পড়ছে ফুটন্ত দুধ। বসে আছে নবীন জ্যোতির্বিদ। তার আবার  আসার কথা ছিল। আসেনি কেন? কেন এল না এতদিনে? গণনা কি শেষ হয়নি ? 

টাঙ্গন অশ্বটি কখন এসে দাঁড়িয়েছে পথের উপর তা খেয়াল করেনি গন্ধবতী। সে তো আর নিজের ভিতরে ছিল না। মুখখানি নামিয়ে মগ্ন হয়ে গিয়েছিল নিজের ভিতরে। তখন অশ্বটি পথের ধারে আমগাছের গায়ে বেঁধে খটখট করে হেঁটে এল উদ্ধবনারায়ণ। তার মাথায় রক্তবর্ণের শিরস্ত্রাণ, গায়ে নীলবর্ণের রেশম বস্ত্র, তার উপরে মদ্রদেশীয় পশম আবরণ। সেই আবরণে মেঘের রং। গলায় একটি হলুদ রঙের বুনো ফুলের মালা। পাদুকাটিতে জরির কাজ। রাজপুরুষের মত লাগছে উদ্ধবকে। ঈষৎ পান করেছে, ফলে চোখ মুখে ঘোরালো ভাবও এসেছে। টাঙ্গন অশ্বটি নতুন মনে হয়। বেশ স্বাস্থ্যবান। অশ্বের গলাতেও একটি রক্তবর্ণের বুনো ফুলের মালা। কোন মালিনী দিয়েছে কে জানে?

উদ্ধবনারায়ণ গলাখাঁকারি দেয়, এখানে যে পাব তা তো আশা করিইনি মেয়ে, তুমি কি আমার জন্য অপেক্ষা করছ? আমি যে এই পথ অতিক্রম করি তা তো তুমি জান, কিন্তু এখন যে যাব তা কে বলেছে, কোন শুকপাখি?

চমকে ঘুরে তাকায় গন্ধবতী। কী লজ্জা! সে না ধ্রুবপুত্রের কথা ভাবতে ভাবতে সেই গণক জ্যোতির্বিদ যুবকের কথা ভাবছিল। আর তখন কিনা এসে দাঁড়িয়েছে এই পাষণ্ড উদ্ধবনারায়ণ। সে উদ্ধবের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকল। জবাব দেয় না উদ্ধবনারায়ণের কথার।

উদ্ধবনারায়ণ বলে, আমি ঠিকই করেছিলাম আজ আমার প্রণয় নিবেদন করব গম্ভীরার এই কন্যাটিকে, হে সুগন্ধা আমার দিকে তাকাও।

কণ্ঠস্বরেই গন্ধবতী ধরতে পারে সুরা পান করে এসেছে উদ্ধবনারায়ণ। কিন্তু সুরা পান করে অনাত্মীয়া যুবতীর সামনে এসে দাঁড়ান তো বিধি সম্মত নয়। সে কেমন জবুথবু হয়ে গেল। উত্তরীয়খানি টেনে আবৃত করল উর্ধাঙ্গের বসন। উদ্ধবনারায়ণ রাজকর্মচারী। রাজকর্মচারীর ক্ষমতা অনেক। সে দেখছিল টাঙ্গন অশ্বটিকে। পা আছড়ে ধুলো ওড়ালো। কলসের অন্তর্গত শূন্য অন্ধকারে দৃষ্টিপাত করে গন্ধবতী।

উদ্ধবনারায়ণ বলে, আজ কৃষ্ণপেক্ষর তৃতীয়া, রাত্রির প্রথম প্রহরে চাঁদ উঠবে, তখন কি দেখা হতে পারে?

গন্ধবতী কেমন বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে শূন্য কলস অবলম্বন করে বসেই থাকে। ভয় লাগছে। লোকটা কত কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। উদ্ধবনারায়ণের কণ্ঠস্বর আবার  কানে আসছে, খুড়োমশায় কি তোমাকে সবকিছু অবগত করাননি, আচ্ছা তিনি কি গৃহে আছেন, মাঘ মাস বয়ে যায়, এই মাসেই কার্য সম্পন্ন হতে পারে, কোথায় খুড়োমশায়, তিনি যে কথা দিয়েছেন আমাকে।

সাহস সঞ্চয় করে গন্ধবতী তাকায় উদ্ধবের দিকে, তিনি নগরে গেছেন।

নগরে গেছেন, এখন আমি কী করি, অবশ্য তোমার সঙ্গে দেখা হলো সুগন্ধা, তুমি এমন তপস্বিনীর মতো বসে আছ কেন?

গন্ধবতী বলল, আপনি যে পথে যাচ্ছিলেন সেই পথে যান।

সেই পথ তো এসেই গেছি, গন্তব্য তো এইখানেই, সুগন্ধা তুমি কি জানো রাজসভায় আমি কোন পদে আছি?

গন্ধবতী হেসে ফেলেছে, রাজকবির পদে, শুনেছি ওই পদটির দাবীদার হওয়া সহজ।

উৎসাহিত হয় উদ্ধবনারায়ণ, না না রাজকবি কেন, খুব বড় পদে আছি, তুমি বিবাহের পরেই জানবে, আর যদি ইচ্ছা করো এখনই জানাতে পারি, তবে খুব গোপনীয়।

গন্ধবতীর মুখের হাসি নিভে গেছে। সে কলসটি দু’হাতে চেপে কলসকেই আশ্রয় করে যেন। তার ভয় করতে থাকে। ঠাকুর্দার সঙ্গে তো মায়ের কথা হয়ে গেছে। ঠাকুর্দা কি সেই কথা এই লোকটিকে জানাননি এখনো। কী ভয়ানক ব্যাপার! লোকটির দৃষ্টি তার সর্ব অঙ্গ স্পর্শ করছে। কে জানে কী কল্পনা নিয়ে এসেছে উদ্ধবনারায়ণ। সখা বলত লোকটা মূর্খ। কিছু বিদ্যা অর্জন করেছে বটে, কিন্তু কল্পনাহীন। কল্পনাহীনের বিদ্যা অর্জন বৃথা। গন্ধবতী ভীত বিহ্বল চোখে উদ্ধবনারায়ণকে দ্যাখে, কী কল্পনা করেছে ও?

উদ্ধব বলে, এই রেশম বস্ত্র বাহ্লিক দেশের, পশম বস্ত্র মদ্র দেশের, টাঙ্গন অশ্বটি হিমালয়ের, সদ্য কিনেছি, তুমি অশ্বে সওয়ার হয়েছ কখনো, এসো সুগন্ধা।

গন্ধবতী বলে, আপনি যান, আমি কোথাও যাব না, অশ্ব নিয়ে আপনি ফিরে যান, অনাত্মীয়া নারীর সঙ্গে আপনার কী কথা?

ঈষৎ বিমর্ষ হলো উদ্ধবনারায়ণ, সে পায়চারি করছে, পথের উপর। টাঙ্গন অশ্বটির পাশে দাঁড়াল। শিরস্ত্রাণটি ঠিক করে, কোমর থেকে একটি ক্ষুদ্র রেশমপেটিকা বের করে তার ভিতর থেকে একটি রত্নহার আঙুলের ডগায় তুলে আনে। রত্নহারটি দেখতে থাকে নিজের মনে। দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অদূরে আসীন গন্ধবতীর দিকে। চেয়েই থাকে। দৃষ্টিতে বিমোহিত ভাব ফুটে ওঠে। যুবতী অতি সুন্দরী, এমন যৌবন যে কোনো পুরুষের আরাধ্য হতে পারে। অলঙ্কার একে আর কত সুন্দর করে তুলতে পারে? সে ধীরে ধীরে আবার গন্ধবতীর সামনে দাঁড়ায়, অনুচ্চ কণ্ঠে বলে, তোমার জন্য একটি কণ্ঠহার এনেছিলাম, মহালতার অনুরূপ, বহু মূল্য এর, ধরো রাজরানীর কণ্ঠেই এই হার শোভা পায়, এমন এর সৌন্দর্য, ধরো কোনো রাজকন্যার গলায় শোভা পাওয়ার জন্যই এর নির্মাণ, রাজকন্যাকে এই কণ্ঠহার হয়ত পরিয়ে দিতে পারেন কোনো শ্রেষ্ঠী, রাজপুরুষ। তুমি মুখ তোলো, দ্যাখো কণ্ঠহারটি।

গন্ধবতী অধোমুখে নিশ্চল, ধীরে ধীরে বলে, আমি কোনো রাজকন্যা নই, আমি সামান্য সৈনিকের পুত্রী, পিতা, যুদ্ধ গিয়ে ফেরেননি, আমার চিরসখা অবন্তী ত্যাগ করেছে প্রায় দুই বর্ষকাল, আমি উদ্বিগ্ন, চিন্তিত, নিদ্রাহীন যায় প্রতিটি রাত, আপনি ফিরে যান, আমি অন্যের জন্য বসে আছি, আপনার জন্য নয়।

উদ্ধবনারায়ণ তো এসব কথা জানে। জানে বলে বিস্মিত হয় না, বিমর্ষ হয় না। সে আরো জানে ইপ্সিত রত্নকে অধিকার করতে হলে অধৈর্য হতে নেই। আর তা যদি রমণীরত্ন হয় তবে তো আরো ধৈর্যশীল হতে হয়। সে গন্ধবতীর অজ্ঞাতে তার যৌবন সুধা পান করছিল দুই চোখ দিয়ে। ক্রমে দুই চোখ শত শত চোখ হয়ে উঠছিল। অপ্সরা ঊর্বশীর রূপ এর কাছে তুচ্ছ। উদ্ধবনারায়ণের দৃষ্টিতে কামভাব তীব্র হয়। আরক্ত চোখে সে গন্ধবতীকে লেহন করতে থাকে। গন্ধবতী এক নদী। স্রোতস্বিনী। বৃষ্টির স্মৃতি নিয়ে বাঁচে। উদ্ধবের দৃষ্টিতে ভয় পায় সে। মনে হতে থাকে আকাশ-বাতাস সব জ্বলে যাচ্ছে, পুড়ে যাচ্ছে। সেই জ্বলন থেকে তারও রেহাই নেই।

উদ্ধব এগিয়ে আসে, চাপা গলায় বলে, রমণী লুণ্ঠন বীরের ধর্ম।

গন্ধবতী পাথর। তার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে।

উদ্ধব হিসহিস করে, আমি রাজসত্রী, সত্রীর পদ অনেক উঁচু, কী না পারি, প্রয়োজনে তোমার ঠাকুর্দাকে নিধন করে ফেলতে পারি, মাতা-পুত্রী এক সঙ্গে লুণ্ঠিত হবে।

গন্ধবতী বালুকাময়। বাতাসে ঘূর্ণী হয়, বালুকায় ঝড় ওঠে। শুকিয়ে যেতে থাকে যত নদী, যত সরোবর। অধোমুখে বসে আছে গন্ধবতী। দু’চোখে জল আসতে আসতে উত্তাপে শুকিয়ে যায়। হে ধ্রুবপুত্র, দ্যাখো, উদ্ধব সত্রী আমাকে স্পর্শ করছে। হে ধ্রুব নক্ষত্র, দিনমানে জানি না তুমি আছ কিনা, উদ্ধব সত্রী আমার কেশ আকর্ষণ করেছে। অগ্নিময় নিঃশ্বাস নির্গত হয় গন্ধবতীর দেহ থেকে। গাছের মতো শ্বাস নেয় সে যেন অজস্র সবুজ পাতায়।

এ এক ভয়ানক সময়। এই কালে আগ্নেয় মেঘ, ব্রহ্মজ মেঘ, পক্ষজ মেঘ-সব নিয়ে ধ্রুবপুত্র নিরুদ্দেশে গেছে। এমন অনাবৃষ্টি বহুদিন দ্যাখেনি মানুষ। এমন জ্ঞানের অভাবও না। কোথাও কোনো আলোর চিহ্ন নেই, অজ্ঞানতা ছেয়ে ফেলছে অবন্তীর আকাশ। জ্ঞানভাণ্ডার যত আছে সব যেন নিয়ে গেছে ধ্রুবের পুত্র, সেই পরমরূপবান যুবক, গন্ধবতী নদীর সখা, শিপ্রা নদীর সখা, গম্ভীরা নদী, রেবা নদী, বেত্রবতী—সব নদীর সখা। তার মুখটিও ভুলে যাচ্ছে যেন গন্ধবতী। তবু সে তাকেই ডাকে। তার ভিতরে তাম্রধ্বজের মুখখানি ভেসে ওঠে। কী অদ্ভুত। ধ্রুবপুত্র যা বলত, তাম্রধ্বজ তাইই বলে। তবুও কি সে ধ্রবপুত্রই হয়ে উঠবে কখনো?

গন্ধবতী আর্তনাদ করে ওঠে। ডাক দেয় শূন্য আকাশের ভিতরে মহাশূন্যকে। দু’হাতে মাটি চাপড়ায়, ধুলো ওড়ে। ধুলো উড়িয়ে সে কাঁদে। উজ্জয়িনীর বাতাস তার কান্না বয়ে নিয়ে যায়। যায় যায়, বহুদূর যায় গন্ধবতীর আকূল আর্তনাদ।

দ্বিপ্রহরে বিভ্রান্ত অন্তীরাজ শোনেনন কান্নার শব্দ। অনাবৃষ্টিতে পক্ষীকূল কি এভাবে কাঁদে? বৃক্ষেরা? রাজা শূন্য দিগন্তে চেয়ে আছেন খোলা জানালা দিয়ে। দিগন্তে যেন মেঘের চিহ্ন। মেঘ নয় ও, গৃধিনী যূথ নেমে আসছে মাটিতে। তিনি যে গৃধিনী-উল্লাস শোনেন। গন্ধবতীর ডাক শুনতে পান না।

কান্নার শব্দ শোনেন প্রধান পুরোহিত। এমন কান্না তাঁর চেনা। ধর্ষিতা এভাবে কাঁদে। তাঁর মন্দির-পার্শ্বে গন্ধবতী নদী। নদীর বালি থেকে কান্নার শব্দ উঠে আসছিল, তিনি সহাস্যে শ্রেষ্ঠীর দিকে তাকান, শুনতে পাচ্ছেন, আর দেরি নেই, এই তো সময়।

কান্নার শব্দে চঞ্চল হয়েছে মা রেবা। ঘরবার করছে। রৌদ্রময় পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে চোখদুটি ঝলসে যায় যেন। এদিক ওদিক দেখে, না পেরে আঙিনায় নেমে এসে করতলে মুখ আড়াল করে ডাক দিল নদী জননী, সুগন্ধারে, সুগন্ধা-আ-আ।

মা জননীর ডাক বাতাস বয়ে গিয়ে যায় দূর থেকে বহুদূরে। উজ্জয়িনী নগর থেকে দশার্ণ দেশে, বিদিশা নগরীতে। রামগিরি, আম্রকূট কত পর্বত না শোনে নদী-জননীর ডাক। অনাবৃষ্টির কালে মা জননীকে এইভাবে ডাকতে হয়। না ডাকলে মেঘ আসবে কেন? মেঘ, মেঘ, মেঘ...। নদী তো মেঘেরও জননী। রেবা তো ধ্রুবপুত্রের জননীসমা। ডাকছিল রেবা তার মেয়েকে। ডাক শুনছিল তাম্রধ্বজ। আর কেউ কি? সেই ধ্রুবপুত্র! যে কিনা সঙ্গে করে নিয়ে গেছে সমস্ত মেঘ। মেঘজননী ডাকছিল তার সন্তানকে। মনে আছে কি ধ্রুবপুত্রের? মনে আছে সব? নাকি সে এক স্মৃতিভ্রষ্ট পুরুষ এখন। ভুলে গেছে সব। এই উজ্জয়িনীর কথা, এই গম্ভীরার কথা অবন্তী দেশের কথা। রেবা তার মেয়েকে ডেকেই যাচ্ছিল ভীরু পক্ষীজননীর মতো। অনাবৃষ্টির কাল প্রবাহিত হতে থাকে।

চলবে

 

ধ্রুবপুত্র (পর্ব এক)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব দুই)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব তিন)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব চার)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব পাঁচ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব ছয়)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব সাত)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব আট)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব নয়)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব দশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব এগার)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব বারো)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব তের)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব চৌদ্দ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব পনের)

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top