সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৮শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব দুই) : কাজী মাহমুদুর রহমান


প্রকাশিত:
১৬ জানুয়ারী ২০২১ ১৯:১৪

আপডেট:
২৮ মার্চ ২০২৪ ১৬:১২

 

সোনার খাঁচা প্যারিসে আমার দীর্ঘ একুশ বছর ধরে বসবাস। শিল্পচর্চায় সাদাচুলের চিত্রকর হিসাবে আন্তর্জাতিক পরিম-লে আমার ছবি, আমার নাম বিশেষভাবে আলোচিত, উচ্চারিত হয়েছে। প্যারিস, স্পেন, লন্ডন, নিউইয়র্কসহ বিভিন্ন দেশের আর্ট গ্যালারিতে আমার চিত্র প্রদর্শনী হয়েছে। আমার আঁকা বেশকিছু চিত্র সে সব দেশের আর্ট গ্যালারিতে সংরক্ষিত আছে। বিদেশি বহু পত্র-পত্রিকায় আমার ছবি নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনাও প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশের চিত্রকররা যারা প্যারিতে বসবাস করেন বা অতিথি হিসেবে প্যারিসে আসেন তাদের সাথে মাঝে মধ্যেই আমার দেখা হয়, হোটেলে পান-ভোজনে গল্প-গুজব হয়, জমাট আড্ডা হয়। তবে এইসব আড্ডায় আমি বা আমার চিত্রকলা বাংলাদেশ পরিচিত কিনা তা আমি ভুলেও জিজ্ঞাসা করি না, আলোচনা করি না। আমি শুধু ওদের চিত্রকলা, ওদের চিত্রকর্ম, ওদের শিল্পচেতনা ও শিল্পরূপের কথা মুগ্ধ শ্রোতার মতো শুনি। কেউ শিল্পীপল্লিতে আমার বাসায় আসার ও আমার ছবিগুলো দেখার আগ্রহ প্রকাশ করলে আমি তা নানা অজুহাতে সবিনয়ে এড়িয়ে যাই। সুতরাং কারো সাথেই আমার অন্তরঙ্গতা, আমার রসায়ন জমে ওঠেনি। আমার যাপিত জীবন চলতি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন। কারণ, আর দশজন শিল্পীর মতো সংসার আবদ্ধ জীবন যাপন আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তাই বলে আমি সাধু-সন্তও হতে পারিনি। স্পষ্ট করেই বলা যায় আমি আলবেয়র কামুর উপন্যাসের সেই বিপরীতধর্মী চরিত্র মশিঁয়ে মিয়েরসোর মতো নীতিনিষ্ঠ নয় আবার নীতিহীনও নয়। একুশ বছর আগে বাংলাদেশ ছাড়ার আগে আমি হয়তো এতটা নীতিভ্রষ্টহীন ছিলাম না। কিন্তু প্যারিতে শিল্পের জগতে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে আমি কেমন যেন বদলে গেলাম। অতীত হারালাম, মূল্যবোধ হারালাম, চরিত্রও হারালাম। বাস্তব জগত আর শিল্প জগতের অন্তর্দ্বন্দ্বে, একটা বিভ্রান্তির মধ্যে আমি পরিণত হলাম একটা অ্যাবসার্ড-বিমূর্ত চিত্রের মতো বিমূর্ত চরিত্রে। যে সব নারী আমার ছবির আকর্ষণে কিংবা ভালোলাগার জৈবিক চাহিদায় আমার সান্নিধ্যে এসেছে আমি সবসময় যে তাদের উপেক্ষা করতে পেরেছি তা নয়। হয়তো কিছু সময়, কিছুদিন নদীর মাতাল স্রোতের মতো ভেসে গেছি। তারপর একসময় ক্লান্তি ভর করেছে। নদী থেকে কুলে উঠে যে যার মতো কোনো স্মৃতি বা দুঃখবোধ ছাড়াই অনায়াসে চলে গেছি। যাদের হারিয়েছি তাদের জন্যে অনুতাপ করিনি। নিজেকে ভেবেছি আ অ্যাম অলওয়েজ অ্যান আউট সাইডার। এ স্ট্রেঞ্জারএভরি টাইম, এভরি হয়ার, টু এভরিবডি।

নিউইয়র্ক থেকে প্যারির শিল্পীপল্লির নিজগৃহে ফিরে আসার পরও নিজেকে আগন্তুক মনে হয়। মনে হয় এই ঘর-বিছানা, ছড়ানো ছিটানো বইপত্র, কারুকার্যখচিত সকল আসবাব কিছুই আমার নয়। আ অ্যাম অ্যান স্ট্রেঞ্জার হিয়ার। যে অন্ধ মরুতৃষ্ণায় আমি খ্যাতি আর অর্থের মোহে শুধু ছুটে বেড়িয়েছি তার সবকিছুই এখন অন্তঃসারশূন্য। শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিগত ব্যর্থতা ছাড়া আমার কোনো কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।

দিনের বেলাটা প্যারিস থেকে বিদায় নেবার প্রস্তুতির নানা কাজকর্মে সময়টা কোনোরকম পার করি। কিন্তু রাত্রে নিঃসঙ্গতার কালো বিড়ালগুলো আমার ঘরের দরজা, জানালা, বিছানায় ছুটোছুটি করে, হিংস্র আক্রোশে সবকিছু নখ দিয়ে আঁচড়াতে থাকে। ওদেরকে তাড়াতে আমি ছুটোছুটি করতে থাকি। দূর হয়ে যা বলে চিৎকার করতে থাকি। ডাক্তারের নিষেধ সত্ত্বেও আমি মদ খেয়ে মাতাল হবার চেষ্টা করি, বেহালা বাজাতে থাকি... কিন্তু ঘুম কিছুতেই আসে না।

প্যারিস ত্যাগের আগে ট্রেনে করে প্যারি থেকে বেশ দূরত্বের রেইন সিটি শহরে চিত্রকর, চিত্র সমালোচক মাদাম জুলিয়াঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম শেষ বিদায়ের কথা বলতে। মাদাম জুলিয়াঁ আমার মতোই নিঃসঙ্গ। বহুকাল, বহু বছর তার সাথে আমার দেখা হয় না। শুনেছি সে অসুস্থ। প্রেম, বিয়ে, সংসার কেনোটাই তার টেকেনি। জুলিয়াঁ এখন অসুস্থ বৃদ্ধা যে তার একত্রিশ বছরের সোনালি বয়সে আমার মতো একজন একুশ বছর বয়সের তরুণকে প্রথম চুম্বনের স্বাদ দিয়েছিল এবং আমার হৃদয়ে প্যারিস আসার স্বপ্নের বীজ বুনে দিয়েছিল।

জুলিয়াঁ বোধহয় আমার তরুণ বয়সের বায়োস্কোপের স্মৃতি ছবি। সেই স্মৃতির কাছে যেতে হলে কতদূর পেছনে উল্টো পথে হেঁটে যাওয়া যায়? জুলিয়াঁর সাথে আমার পরিচয়-যখন আমার বয়স একুশ, জুলিয়ার একত্রিশ। আঠারো থেকে একুশ এই বয়সটা বড় ভয়ংকর, সর্বনাশার গভীর খাদ। এই বয়সে তরুণ-তরুণীরা কেউ ওঠে উচ্চাভিলাষের বিশাল পাহাড়ে। কেউবা ব্যর্থতায়, হতাশায় পা ফসকে পড়ে যায় মৃত্যুর গভীর খাদে। জুলিয়াঁ আমার হাত ধরে টেনে ওঠাতে চেয়েছিল পাহাড়ের চেয়ে আরো বেশি উচ্চতায় স্বপ্নের আইফেল টাওয়ারে।

জুলিয়াঁ আমার শিল্পের বাগানে সবুজ তৃষ্ণা..., অবিনাশী গান... তাকে কেমন করে ভুলি? বল হে নিদ্রার পরি?

প্যারিস থেকে জুলিয়াঁ ঢাকায় এসেছিল ঢাকা শহরের প্রাচীন স্থাপত্য ও চিত্রকলা সম্পর্কে একটা গবেষণার কাজে। আমার সঙ্গে তার দেখা বা আলাপ পরিচয়ের কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। অথচ দৈবাৎ দেখা হয়ে গেল বংশালের প্রভাবশালী রিকশা মহাজন খলির সর্দারের রিকশা তৈরির কারখানায়। একটা গাড়িতে তারা তিনজন এসেছিল সঙ্গে সুদর্শনা তরুণী মাদাম জুলিয়াঁ। আলিয়ঁস ফ্রসেঁজ এর একজন দোভাষী যুবক এবং ঢাকার আর্ট কলেজের একজন নামী চিত্রকর ও অধ্যাপক আমানুল্লাহ কবির।

ঢাকা শহরের রিকশার সাজসজ্জা, রিকশার পেছনের চিত্র-বিচিত্র অঙ্কন, চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকাদের মোটাদাগের রঙিন ছবি দেখে জুলিয়াঁ মুগ্ধ। গাড়ির চাইতে রিকশায় চড়ে বেড়াতেই তার দারুণ আনন্দ। এসব রিকশা কোথায় তৈরি হয়, কারা এই রিকশার পেছনের সাজসজ্জা, চিত্রকর্ম করে তা জানা ও দেখার জন্যে খুব আগ্রহ প্রকাশ করায় আর্ট কলেজের অধ্যাপক এবং আলিয়ঁস ফ্রসেঁজের দোভাষী রিকশাচালকদের কাছে খোঁজখবর নিয়ে বংশালের এক গলির মধ্যে রিকশা মহাজন খলিল সর্দারের আস্তানায় জুলিয়াঁকে নিয়ে এসেছিলেন। ওরা যখন এলেন আমি তখন রিকশার পেছনে রাজ্জাক, শাবানার রোমান্টিক মুহূর্তের একটি ছবি আঁকায় মগ্ন। খলিল সর্দার ওদের দেখে অবাক। তারপর মহাখুশি তার রিকশা কারখানায় এমন সুদর্শনা বিদেশিনীসহ বিশিষ্টজনদের আগমনে। তিনি বুঝে উঠতে পারছেন না এমন মেহমানদের তিনি কোথায় বসাবেন, কোন ভাষায় কী কথা বলবেন? কোনোক্রমে গোটা চারেক হাতলবিহীন চেয়ার গামছা দিয়ে মুছে ওদের বসানো হল। তারপর খলিল চাচা বেশ খুশহাল কণ্ঠে বললেন, ছার, আপনেরা আমার এই রিক্ছা কারখানায় এতো মেহনত কইরা যে আইবার পারছেন তাতে আমার দিল বহুত খুছ্ হইয়া গ্যাছে। আপনাগো ধন্যবাদ। হালায় আমি হইলাম একটা অছিক্ষিত বেয়াকুল্লা মানু। কি কইতে কি কমু জানি না। তয় একটা কথা হিম্মত কইরা কইবার পারি, এই যে ঢাকার ছহরে বহুত রিকছা কারখানা আছে, বহুত আর্টিছ আছে মাগার আমার কারখানার রিকছা সেরা, আমার আর্টিছ সেরা। ঐ যে দেখতাছেন রিকছার পেছনে যেই পোলা আর্টিছ কাম করতাছে বহুত এলেমদার। হেই কুনো আর্ট ইছকুল থেক্যা ছিক্ষা লয় নাইক্কা। কিন্তু তারে ছবি আঁকার এলেম দিছেন আল্লায়। তারপর খলিল চাচা আমাকে যেন একটা স্নেহস্বরে ধমকে বললেন, অই ব্যাটা  রং-তুলি রাখ। উঠ্। দ্যাখ, কেঠায় আইছেন আমাগো কারখানায়। সালাম দে।

দোভাষী মাদাম জুলিয়াঁকে খলিল চাচার কথা ফ্রেন্স ভাষায় অনুবাদ করে শোনাল। আমি তুলি হাতেই উঠে দাঁড়ালাম। নিঃশব্দে সালাম দিলাম। ওরাও মৃদু হেসে নিঃশব্দ সালামের প্রত্যুত্তর দিলেন।

আমার হাতে রং, শার্ট-প্যান্টে নানান রং এর ছোপ ছোপ দাগ। কারো মনেই হবে না আমি একজন শিল্পী। শুধুমাত্র একজন রং মিস্ত্রি।

আর্ট কলেজের অধ্যাপক আমানুল্লাহ কবির ধরেই নিলেন আসলেই আমি একজন রং মিস্ত্রি। রিকশার পেছনে নায়ক নায়িকাদের এসব সস্তা ছবি আঁকাআঁকি করতে তেমন একটা প্রতিভা বা শিল্প চেতনার প্রয়োজন হয় না। বাস, লরির হেলপাররা যেমন তাদের ওস্তাদ ড্রাইভারদের কাছে থাকতে থাকতে গাড়ি চালানো শেখে, ইঞ্জিনের নাড়ি, নক্ষত্র চিনতে চিনতে নিজে ওস্তাদ বনে যায় এই আমিও তেমনি একজন নবিস রিকশা পেইন্টার। তিনি আমাকে প্রশ্ন করা শুরু করলেন,

- তোমার নাম?
- তাইমুর হাসান।
- কতদিন ধরে এই কাজ করছ?
- প্রায় বছর খানেক।
- ছবি আঁকা কোথায় শিখেছ? কার কাছে?
- আপনাদের দেখে শেখা।
- পড়াশুনা কিছু করেছ?
- কিছু কিছু।
- কিছু কিছু মানে কতদূর?
- অর্ধ শিক্ষা মানে হাফ এডুকেটেড।

খলিল চাচা চিৎকার করে উঠলেন ছার, এই হালার পোলায় যদি আধা ছিক্ষিত হয় তা হইলে ঢাকার ছহরের ছব পোলা, ছব মানু অছিক্ষিত। আমি কইতাছি, দিল লাগাইয়া হুনেন। এই পোলা ছুপা রুস্তম। মেট্রিক না এছএছছি কী কয় হেইখান পাস দিছে সাতখান লেটার লইয়া। আইএছছি পাস দিছে ছয়খান লেটার লইয়া। ওর বাপজান জনাব ফজলুল হাছান একাত্তরের যুদ্ধের গেরিলা যোদ্ধা তারে দিই হাজার ছালাম। তিনি অহন আমাগো আরমানিটোলা হ্ইা স্কুলের অঙ্কের মাস্টার। বহুত এলেমদার, ইজ্জতদার। তার ছব পোলা মাইয়া এক একখান হিরার টুকরা। আমিতো হালায় তাজ্জব হইয়া যাই এই হিরার টুকরা পোলায় আমার এইহানে কাম করে! রিকছার পিছনে ছবি আঁকে! দেইখা আমার কইলজাডা ভইরা যায়।

খলিল চাচার সংলাপ দোভাষী ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করে শোনালেন। মাদাম জুলিয়াঁর চোখে বিস্ময়। বিস্মিত আমানুল্লাহ কবির স্যারও। তিনি প্রশ্ন করলেন, তোমার এমন ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট অথচ তুমি পড়াশুনো বাদ দিয়ে রিকশার পেছনে এইসব সস্তা ছবি এঁকে ক্যারিয়ারটা নষ্ট করছ কেন ?

আমি বললাম, শুধু রিকশার পেছনে নয়, আমি শাবিস্তান, লায়ন সিনেমার সামনে বাঁশের ভারায় দাঁড়িয়েও সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের ছবি আঁকি।

- কিন্তু কেন? অধ্যাপক মহোদয়ের প্রশ্ন।
- টাকার জন্যে। আমার এক কথায় উত্তর।

অধ্যাপক নাছোড়বান্দা। তিনি আবার বিরক্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, তোমার টাকার এতই অভাব? আই ডোন্ট বিলিভ ইট। তোমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা, একটা নামী স্কুলের শিক্ষক। তার সন্তান হয়ে ... কী আশ্চর্য! তোমাদের চাইতে অতি দরিদ্রের ছেলেমেয়েরাও তো ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে, মেডিকেল বা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ছে! অথচ তুমি...

আমি বাধা দিয়ে বললাম, স্যার আমি সবগুলোতেই ভর্তি হবার সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু আমিস্যার, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড আপনারা বোধহয় ঢাকার রিকশার পেছনের চিত্রকর্ম দেখতে এসেছেন। আমার ভেতরের গল্প শুনতে আসেননি। গল্পটা এই বিদেশিনীর সামনে বলা বা না শোনাই ভালো।

আমানুল্লাহ স্যার গম্ভীর হয়ে গেলেন। স্যারের অতিরিক্ত ঔৎসুক্যে ও প্রশ্নে আমি বোধহয় পানি ঢেলে দিলাম। তিনি অসন্তুষ্টির ভঙ্গিতে চুপ করে গেলেন। ক্রমে বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে। আমাকে অসমাপ্ত ছবির কাজটি শেষ করতেই হবে চুক্তি অনুযায়ী দিনের কাজ দিনেই। এক্সকিউজ মি, বলে আমি ওদের সামনে থেকে সরে রিকশার পেছনে আবার ছবি আঁকার কাজে মন দিলাম।

জুলিয়াঁ এবং তার ফরাসি দোভাষী তাদের ক্যামেরায় বিভিন্ন রিকশার পেছনের অনেক ছবি তুললেন। অঙ্কনরত অবস্থায় আমার কাজের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে আমার ভিডিও করলেন। খলিল চাচার এখানে অনেক ছবিই আমার নয়। অন্য শিল্পীদের আঁকাও ছবি। খলিল চাচার এখানে আমার মতো বেশ কিছু নতুন, পুরনো শিল্পীরা চুক্তি অনুযায়ী ছবি আঁকা-আঁকি করে থাকে। আমার পারিশ্রমিক রিকশা প্রতি পাঁচশো টাকা। মাসে হয়তো আমি দশ থেকে পনেরো দিন কাজ করার সুযোগ পাই। সিনেমা হলের সামনে মাসে দু’চারটে ব্যানার আঁকলে সেখানেও কিছু আয় হয়। সন্ধ্যের পর আমি চলে যাই কোচিং সেন্টারে। স্কুল, কলেজের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক ছাত্রছাত্রীদের আমি সপ্তাহে তিনদিন ইংরেজি, বিজ্ঞান ও অঙ্ক শেখাই। কোচিং সেন্টার সম্মানী ও সম্মান দুটোই ভালো দেয়। এইসব উপজীবিকায় আমার আয়-ইনকাম মন্দ হয় না। দারিদ্রের হা-গহ্বর সংসারে নিজের কিছু হাতখরচ রেখে বাকি সব টাকাই তুলে দেই মায়ের শীর্ণ হাতে। মা’র চোখের তারায়, ঠোঁটের কোণে উজ্জল আভা আমাকে আনন্দিত করে। শুধু সন্তুষ্ট করতে পারি না বাবাকে। কারণ, আমি লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছি। কেন ছেড়েছি তারও অনেক কারণ। কিছুই তার অজানা নয়। তবু তার বড় দুঃখ, বড় যন্ত্রণা। আমি কেন আমার ভবিষ্যৎকে এভাবে অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে রিকশার পেছনে নায়ক-নায়িকাদের সস্তা ছবি আঁকি? আমি ডাক্তার হতে পারতাম, ইঞ্জিনিয়ার হতে পারতাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করলে অধ্যাপক হতে পারতাম। কিন্তু সব আশা জলাঞ্জলি দিয়ে আমি কী হলাম? শিল্পী নয়, শিল্পের নামে একজন রিকশা পেইন্টার রং মিস্তিরি।

আমার হাতের কাজ প্রায় শেষ। ছবির কোথাও কোথাও সুক্ষ্মতুলির আঁচড় টানছি নায়ক আর নায়িকার চোখের ভাষাকে বাক্সময় করতে।

ওদিকে দোভাষীর মাধ্যমে খলিল চাচার ইন্টারভিউ চলছে। পুরনো ঢাকার রিকশার ইতিহাস, পরবর্তীকালে যাত্রী আকর্ষণ ও বিনোদনে রিকশার সাজসজ্জায় সিনেমার জনপ্রিয় নায়ক-নায়িকাদের ছবি সংযোজনের গল্প বলে যাচ্ছেন খলিল চাচা। বলছেন, রিকশার পেছনে শুধু নায়ক-নায়িকাদের ছবি নয়-রিকশার পেছনে আঁকা হয় বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলিও। খলিল চাচা তার ঢাকাইয়া ভাষায় নিজের স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ওদের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাবার চেষ্টা করছেন। মাদাম জুলিয়াঁ সে সব কথা দোভাষীর মাধ্যমে শুনে নোট করছেন।

ইন্টারভিউ পর্ব শেষ না হতেই খলিল চাচার কর্মতৎপর ম্যানেজার হামদু মিয়া ট্রে ভর্তি গরম সিঙ্গাড়া, ডালপুরি, রসগোল্লা, সন্দেশ আর ফ্লাক্স বোঝাই চা নিয়ে আসলেন। ইন্টারভিউ শেষে পরিচ্ছন্ন কাপ-পিরিচে আর প্লেটে এইসব নাশতা পরিবেশন করা হল। মাদাম জুলিয়াঁ, দোভাষী চা, সিঙ্গাড়া খেলেন। সামান্য মিষ্টিও মুখে দিলেন। কিন্তু আমানুল্লাহ স্যার এই পরিবেশে সম্ভবত পেটপীড়ার ভয়ে চা ছাড়া আর কিছুই খেলেন না।

বিদায় নেবার আগে মাদাম জুলিয়াঁ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, দু ইউ নো ইংলিশ?
আমি মৃদু হেসে বললাম, ইয়েস আই নো। তারপর একটু চমকে দেবার জন্যেই বললাম, অন শহ্ন তায়। (অর্থাৎ দেখা হয়ে খুশি হলাম।)

জুলিয়াঁ এবার চমকে গেলেন। বিস্মিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এশ কে ভু পাহলে ফ্রঁসে? দু ইউ নো ফ্রেন্স?

আমি মাথা নেড়ে বললাম, নহ্ন-অর্থাৎ না। আবার ইংরেজিতে বললাম, স্যরি মাদাম। আই হ্যাভ নো নলেজ এবাউট ফ্রেন্স ল্যাংগুয়েজ। সো আই রিকোয়েস্ট ইউ নট টু টেস্ট মাই প্রফিসিয়েন্সি ইন ফ্রঁসে।

জুলিয়া হাসলেন। বললেন, অ কে। বাত আই উদ লাইক তু সে ইত ইজ মাই প্লেজার তু মিত সাচ এ ত্যালেনতেদ পেইন্তার লাইক ইউ। ইয়োর ওয়ার্ক ইজ ভেরি আর্তিস্তিক। ইত্স দিফারেন্ত তাইপ অব র্আত। হোপ তু সি ইউ এগেইন।

কথাগুলো বলে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন বিদায়ী সৌজন্যে। আমি ইতস্তত করে আমার রঙরঞ্জিত হাতেই জীবনে প্রথম একজন বিদেশিনীর হাত ধরলাম। আমার হাতের রঙ তার হাতে লেগে গেল। বোধহয় মনেও কিছুটা। আমি শুধু বললাম, অহ রুহ-ভ্বার। বিদায়। মাদাম জুলিয়াঁ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে সুন্দর করে হাসলেন। বললেন, আ বিয়েন্তত। শীঘ্রই দেখা হবে।
চলবে

 

লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব এক)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top