সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৮শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

ভাগীরথী বয়ে চলে : ডঃ গৌতম সরকার


প্রকাশিত:
১৬ জানুয়ারী ২০২১ ২০:০২

আপডেট:
১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৭:২৪

 

বেশ কিছুক্ষণ ধরে পাখিটা ডেকে চলেছে, কি পাখি এ জানে! একটা আকাশ ছোঁয়া ওক গাছের মাথায় ডালপালার মধ্যে লুকিয়ে বসে ডেকে চলেছে৷ ওর কি প্রিয়জন এখনো বাসায় ফেরেনি! তৃষিত যখন এই জঙ্গল, পাহাড়, ঝর্নার নির্জনতাকে পরোয়া না করে চিৎকার করে ঝগড়া করছিল তখন সারা জঙ্গল জুড়ে কি ভয়ংকর তোলপাড় চলছিল। পাখিগুলো ভয় পেয়ে চিৎকার করতে করতে মাথার ওপর ডানা ঝাপটাচ্ছিল, কয়েকটা শেয়াল আর ভামবিড়াল জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে আরও গভীরে পালিয়ে গেল। চিৎকার শেষে তাকে 'মোস্ট ওয়ার্থলেস উওম্যান' বলে এই জঙ্গলের মধ্যে একলা ফেলে রেখে দুম দুম করে পা ফেলে  জঙ্গলকে আরেকবার চমকে দিয়ে হোটেলের দিকে ফিরে গেছে। সেই থেকে ইরাবতী এখানেই বসে আছে। চোখের সামনে দিনের শেষ আলো আস্তে আস্তে নিভে আসছে, ওর কিন্তু কোনো ভয় করছে না। জায়গাটা মূল রাস্তা থেকে একটু ভিতরে, রাস্তা দিয়ে চলে যাওয়া গাড়ির আওয়াজ স্পষ্ট শোনা গেলেও দেখা যাচ্ছেনা, তবে তাদের হেডলাইটের আলোর কিছু অংশ ঘন জঙ্গলের দেওয়াল চুঁইয়ে হালকা ভাবে ভিতরে ঢুকছে। পাখিদের ঘরে ফেরা শেষ, দুএকটি পশু নিজ গৃহে ফেরার পথে জঙ্গলের মধ্যে একাকিনী নারীকে দেখে থমকে দাঁড়িয়েছে, কোনো কোনো পাখি বাসার নিশ্চিন্ত আশ্রয় থেকে মুখ বাড়িয়ে কৌতূহল চোখে ইরাবতীকে লক্ষ্য করেছে। গাছের পাতা খসার টুপটাপ শব্দ ছাড়িয়ে দূর পাহাড়ে মন্দিরে সন্ধ্যারতির কাঁসর ঘন্টার আওয়াজ ভেসে আসছে ৷ ইরাবতী চুপচাপ একটা পাথরের টুকরোর ওপর বসে আছে, যেমন বসেছিল প্রায় দুঘন্টা আগে এখানে আসার সঙ্গে সঙ্গে। বিশ হাত দূরে পাহাড়ের মাথা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়া মন্দাকিনী ফলের আশপাশ কালো হয়ে উঠছে, শুধু মাঝখানের চওড়া সাদা ফিতেটি আস্তে আস্তে ধূসর হয়ে উঠছে। এই ঝর্ণা দেখতেই হোটেল থেকে দুজনে বেরিয়েছিল। দুপুরে হোটেলে পৌঁছনোর পর থেকেই ম্যানেজার ছেলেটি বলে আসছিলো, " স্যার-ম্যাডাম, মন্দাকিনী ফল দেখ কর আইয়ে, বহোত ফেমাস ফল হ্যায়৷ বহোত লোক দেখনে আতে হ্যায় ইসে " রাস্তাঘাট অন্ধকারের কালো চাদরে সম্পূর্ণভাবে ঢেকে যাওয়ার আগে ইরাবতী উঠে দাঁড়ালো। ফিরবে সে, কিন্তু কোথায়! ঘরে ...! হোটেলকে কি ঘর বলা যায়..! কিংবা আশ্রয়..! মনে মনে আওড়ায় ইরাবতী... হ্যাঁ বলা যায়, যদি সেখানে প্রিয়জন কেউ অপেক্ষায় থাকে।

এখানে আসার প্রস্তাবটা ইরাবতীই করেছিল। সেই পনেরো বছর আগে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে বাবা-মায়ের সাথে গঙ্গোত্রী এসেছিল ৷ এই জায়গায় বাবা গাড়ি থামিয়েছিল এককাপ চা খাওয়ার জন্যে ৷ ইরাবতীও গাড়ি থেকে নেমে পড়েছিল ৷ আর নেমেই জায়গাটির প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। অদ্ভুত সবুজ স্তব্ধতা ঘিরে ছিল গোটা চত্বর ঘিরে ৷ মাঝে মাঝে এক আধটা গাড়ি কালো সর্পিল পিচরাস্তা ধরে চলে যাচ্ছিল, আর একটু নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল সবুজ ভাগীরথী। প্রকৃতি যে এত সুন্দর হতে পারে ওইটুকু বয়সে কোনো ধারণাই ছিলনা ৷ বাবাকে জোরজবরদস্তি করেছিল ফেরার পথে এখানে একটা দিন থেকে যাওয়ার জন্যে। কিন্তু ট্যুর প্রোগ্রাম আগে থেকে ঠিক করা থাকায় বাবা তার আবদার রাখতে পারেনি। অভিমান করে পরের সারাটা দিন বাবার সাথে কথা বলেনি, ফেরার সময় একবারও মুখ বাড়িয়ে বাইরে তাকায়নি ৷ মা তখন হেঁসে বলেছিল, " মন খারাপ করিসনা, এখন হয়নি তো কি হয়েছে! বিয়ের পর বরের সঙ্গে আসিস ৷ " হ্যাঁ, সে বরের সঙ্গেই এসেছে, কিন্তু এরকম আসা কি মা চেয়েছিল!

আকাশে ঘন কালো মেঘ, আগামীকাল দিওয়ালি, ফলে চাঁদের কোনো চিহ্ন নেই ৷ রাস্তাটা পেরিয়েই ডিফেন্স এরিয়া ৷ ইতস্ততঃ কিছু আলো আছে, ইরাবতীর রাস্তা ধরে ফিরতে অসুবিধা হচ্ছেনা ৷ আর অসুবিধা হলেই বা কি! একা একা পথ চলা তো অভ্যাস করতে হবে ৷ বাবা মাকে সমানে বলতো-- মেয়েকে একটু ছাড়, একলা পথ চলতে দাও। মা হেঁসে বলতো -- মেয়ে আমার রাজার ঘরে যাবে। কত দাসদাসী, চাকর-বাকর... মেয়েকে রাস্তায় একা চলতেই হবেনা! মনে মনে হেঁসে ফেলে.... মা যদি দেখতে পেত নির্জন পাহাড়ি এই জংলা পথে অন্ধকারের সাথে মিশে গিয়ে তাঁর রাজ-রাজেন্দ্রানী মেয়ে একলা হেঁটে চলেছে ৷

হরশিলে গাড়োয়াল মন্ডলের রিসর্টটা একদম গঙ্গার ওপরে ৷ এখানে একটাই হাট আছে, হাটের বারান্দায় বসলে মনে হবে নীচের ভাগীরথী আপনার একমাত্র প্রতিবেশী ৷ আজ সারা দুপুর-বিকেল ইরাবতীর ওই ব্যালকনিতে বসেই কেটে গেছে। আর সারাটা সময় ঘরের ভিতর নাক ডেকে ঘুমিয়ে গেছে তৃষিত। হোটেলে ঢুকেই দু-বোতল বিয়ার খাওয়ার ধুনকি আর কি! বিকালে ঘুম ভেঙে ফোলা ফোলা বেজার মুখে চা খাচ্ছিল, তখন ম্যানেজার ছেলেটি ঘরে এসে আরেকবার মন্দাকিনী ফল দেখতে যাওয়ার কথা মনে করিয়ে দেয় ৷ কিছুটা বাধ্য হয়েই বউকে নিয়ে বেরিয়েছিল ৷ কিন্তু অনিচ্ছার কোনো কাজের পরিণামই মিঠে হয়না, তাই বেরোনোর আধ ঘন্টার মধ্যেই বেধে গেল ৷ দোষের মধ্যে প্রিয়ঞ্জনের ফোন এসেছিল, কিছুটা তৃষিতের অসভ্যতামির ভয়েই একটু দূরে গিয়ে নিচু স্বরে কথা বলছিল ৷ আর তাতেই তুলকালাম....ফোন ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আশপাশ ভুলে ইরাবতীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ৷ এই পরিবেশে কি অসভ্যের মতো লাগছিলো ওকে! অথচ সামনের ওই ঝর্ণা কত ওপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে..! কিন্তু কি সুন্দর...! কি বিভঙ্গি...! ঠিক যেন এক কবিতার মতো ৷

বিয়ের দুমাস পর থেকেই অশান্তি শুরু হয়, আর অশান্তির সূত্রপাত প্রিয়ঞ্জনকে নিয়ে ৷ অথচ তাদের ভালোবাসার বিয়ে ৷ চারবছরের প্রেম পর্ব শেষে তাদের বিয়ে হয় ৷ আলাপ শুরু ইউনিভার্সিটিতে.... দুজনেই ইউনিভার্সিটির হয়ে খেলাধুলা করেছে ৷ তৃষিত লন টেনিস আর ইরাবতী বাস্কেটবল ৷ মাস্টার্সের প্রথম বছরেই বাস্কেটবল টিমে চান্স পেয়ে ইন্টার-ইউনিভার্সিটি চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে পাতিয়ালা যায়, ওখানে লন টেনিস দলের ক্যাপ্টেন হয়ে তৃষিতও গিয়েছিল ৷ ওখানেই আলাপ, তৃষিতের তখন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ফাইনাল ইয়ার ৷ আলাপের পর ঘনিষ্ঠতা বাড়ল, তাদের দুজনকে আর্টস ফ্যাকাল্টির লবিতে, এসি ক্যান্টিনে, মিলনদার চায়ের দোকানে, লেডিস হোস্টেলের সামনের ঝিলে ঘন ঘন দেখা যেতে লাগলো ৷ কয়েকদিনের মধ্যেই সারা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে তারা রেজিস্টারড প্রেমিক প্রেমিকা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেল। পাশ করার সঙ্গে সঙ্গে তৃষিত চাকরি পেয়ে ব্যাঙ্গালোর চলে গেল, ইরাবতীর তখন ফাইনাল ইয়ার ৷ পাশ করার পর নেট ক্র্যাক করে একটা মেয়েদের কলেজের পার্ট-টাইম টিচিং জব করছে ৷ ইচ্ছে আছে গবেষণা করার...কিন্তু এই মুহূর্তে জীবনটা এতটাই ঘেঁটে আছে যে কোনো কিছুই পরিকল্পনা মাফিক এগোচ্ছেনা ৷ খেলোয়াড় হলেও তৃষিত মানুষের সাথে সহজভাবে মিশতে পারেনা ৷ মানসিকতায় একটু সেকেলে; অনেকবার হয়েছে ইরাবতীর ক্লাসের কোনো ছেলে একটু বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে কথা বলেছে তো বাবু মুখ ফুলিয়ে দুদিন দেখা করতোনা, ফোন বা মেসেজ করলেও কোনো উত্তর দিতনা ৷ তখন ব্যাপারটা ইরাবতী বেশ উপভোগই করতো.....মনে হতো সুন্দরী বউ নিয়ে একটু জেলাস...মনে মনে একটা আত্মসুখও আসত বইকি!

রাতের খাবার খেতে খেতে ম্যানেজার ছেলেটির সাথে ভালোভাবে আলাপ হল ৷ নাম রবি ভার্মা, তিরিশ-বত্রিশ বছর বয়স, বাড়ি হলদোয়ানিতে, এই রিসর্টে কাজ করছে মাত্র ছমাস ৷ এর আগে কুমায়ুন-গাড়োয়ালের বেশ কিছু রিসর্টে কাজ করেছে ৷ বিয়ে করেছে চার বছর হলো, একটা দু বছরের মেয়ে আছে ৷ লাজুক লাজুক মুখে খবর দিল আগামীকাল দিওয়ালি মানাতে তার স্ত্রী আর মেয়ে এখানে আসছে ৷ তৃষিত ডাইনিংয়ে খেতে আসেনি, এখনও সান্ধ্যকালীন রামপর্ব শেষ হয়নি, খাবার ঘরে নিয়ে নিয়েছে ৷ ম্যানেজার ছেলেটি দুজনের খাবারই ঘরে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু ইরাবতীই জানিয়েছিল তার খাবার সে ডাইনিংয়ে গিয়ে খাবে ৷ সাময়িকভাবে একটু থমকে গেলেও প্রফেশনাল দক্ষতায় সামলে নিয়ে হাঁসি মুখে বলেছিল, 'ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম, ম্যাডাম ৷' খেতে খেতে রবির পরিবারের গল্প শুনলো- খুব সহজ সরল ছেলেটি, পাহাড়ি মানুষেরা যেমন হয় আর কি! বাবা এখনও গ্রামে খেতি করে, মাকে নিয়ে গ্রামেই থাকেন। এই খেতি করেই এক মেয়ের বিয়ে দিয়েছে, তাদের দু ভাইকে লেখাপড়া শিখিয়েছে ৷ এখন শত অনুরোধেও গ্রামের বাড়ি, খেতি ছেড়ে হলদোয়ানিতে আসতে রাজি নয় ৷ ভাই দিল্লিতে ম্যানেজমেন্ট পড়ছে ৷ খুব ভালো লাগছে ইরাবতীর একটা নিটোল সুখী পরিবারের গল্প শুনতে ৷ সেও তো এমনটাই চেয়েছিল ৷ কলকাতায় জন্ম, বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা সত্বেও ইরাবতী মায়ের ধাত পেয়েছিল ৷ বাবা চাইত মেয়ে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে কর্পোরেট জব করুক, কিন্তু মা তাকে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়তে উৎসাহ দিয়েছে ৷ মায়ের ধারণা মেয়েরা যতই উচ্চ শিক্ষিত হোক, ভালো চাকরি করুক, সংসারের দায়িত্ব অবহেলা করতে পারবেনা ৷ আর সংসারে আসল শিক্ষা লাভ হয় সকলের সাথে একযোগে থাকাতে ৷ মা মেয়ের একটা ভরা সংসারের স্বপ্ন দেখতো, যেখানে শ্বশুর-শ্বাশুড়ি, দেওর-ননদের মাঝে তার মেয়ে নয়নের মনি হয়ে থাকবে ৷ তৃষিতের বাবা-মা, ভাই-বোন নেই শুনে মা প্রথমে খুব দমে গিয়েছিল ৷ আগাগোড়া বোর্ডিংয়ে মানুষ হওয়া ছেলেরা একটু আত্মকেন্দ্রিক হয়, মানে আত্মীয়তার আঠাটা তাদের মধ্যে কম থাকে ৷ বাবা ধমকে মা-কে চুপ করিয়ে দিয়েছিল ৷ আসলে তৃষিতের তখন বিরাট চাকরি, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখে বাবা আর আগাপাশ কিছু ভাবতে চায়নি ৷ ইরাবতীকে একটু অন্যমনস্ক দেখে ছেলেটি লজ্জা পেয়ে কথা থামিয়ে উঠে পড়ল ৷ ইরাবতীরও খাওয়া হয়ে গিয়েছিল, তাই সেও উঠে পড়ল ৷ 'গুড নাইট' জানিয়ে আগামী কাল সকালে মুখাইয়া গ্রাম ঘুরতে যাওয়ার কথা আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিল ৷

পরের দিন সকালে মুখাইয়া গ্রাম ঘুরে রিসর্টে ফিরে মনে হল সারা হোটেল চত্বর জুড়ে রঙিন ফুল ফুটে আছে ৷ আজ আকাশ ঘন নীল, তার প্রতিচ্ছবি ধরা পড়েছে ভাগীরথীর পান্নাসবুজ জলে। চতুর্দিকে ঝকঝকে রোদ ৷ দিওয়ালি উপলক্ষে সারা হোটেল সেজে উঠেছে কাগজের শিকলি, ফুল আর আলোর ঝালরে ৷ আর প্রশস্ত উঠোন জুড়ে খেলে বেড়াচ্ছে ফুলের মতো এক শিশু ৷ তার আধো আধো বুলিতে জায়গাটির গত সন্ধ্যার ক্লান্তি মাখানো আদ্রতা কেটে গিয়ে চারপাশ ঝকঝকে হয়ে উঠেছে। ইরাবতী দৌড়ে গিয়ে শিশুটিকে দুহাতে তুলে নিলো। ও মা! কোনো কান্নাকাটি নেই...অবাক চোখে কিছুক্ষণ দেখে নিয়ে খিলখিল করে হেঁসে উঠলো। ব্যাপার দেখে তৃষিতও পিছনে দাঁড়িয়ে গেছে ৷ ওর কোল থেকে ঘাড় বেঁকিয়ে এখন তৃষিতকে দেখছে ৷ আর সবাইকে অবাক করে দিয়ে ইরাবতীর কাঁধের ওপর দিয়ে ঝাঁপিয়ে তৃষিতের কাছে চলে গেল ৷ প্রথমটায় থতমত খেয়ে গেলেও সময়মতো হাত বাড়িয়ে বাচ্চাটিকে লুফে নিলো ৷ সত্যি এত মিষ্টি আর স্বতঃস্ফূর্ত বাচ্ছা সাধারণত দেখা যায়না ৷ বিচ্ছুটা এখন তৃষিতের কোলে গিয়ে ওর চশমা ধরে টানাটানি করছে ৷

আজ সকাল থেকেই মনে হচ্ছে তৃষিতের মেজাজটা একটু ভালো আছে ৷ কাল রাতে পানপর্ব কখন সাঙ্গ হয়েছে ইরাবতী জানেনা ৷ রাতের খাবার খেয়ে ফিরে দেখেছে ঠান্ডার মধ্যে তখনও বাবু ব্যালকনিতে বসে আছে ৷ খুব হালকা করে বিঠোফেন বাজছে ৷ ইরাবতী ঘরে এসে সোজা বিছানা নিয়েছে, আর তাড়াতাড়ি ঘুমিয়েও পড়েছিল৷ সকালে ইরাবতীর যখন ঘুম ভাঙল বাথরুমে জলের আওয়াজ শুনে একটু অবাকই হয়েছিল, পাশের বিছানা খালি ৷ কিছুক্ষণ পর তৃষিত বাথরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এল ৷ ইরাবতী তাকিয়ে দেখল ইতিমধ্যে ওর স্নানও সারা হয়ে গেছে ৷ ইরাবতীকে জাগা দেখে বললো -- যাও মুখ ধুয়ে নাও, আমি চা বানাচ্ছি ৷ চা খেতে খেতে তাড়া দিয়ে ইরাবতীকে স্নানে পাঠিয়ে দিল, ওর ইচ্ছা আজ সকাল সকাল মুখাইয়া গ্রামে যাবে ৷ সেইমতো ব্রেকফাস্ট সেরেই বেরিয়ে পড়েছিল ৷ মুখাইয়া গ্রামটি খুব সুন্দর, এখানের মন্দিরে শীতকালে গঙ্গোত্রীর গঙ্গামায়ের পূজো হয় ৷ মায়ের মূর্তি কালি পূজোর পর এই মন্দিরে নেমে আসে। একটা অনুচ্চ পাহাড়ের উপর মন্দির, আর মন্দিরকে ঘিরে কয়েকঘর বসতি ৷ তৃষিত খুব ভালো ফটোগ্রাফি করে, মন্দির ও আশপাশের বেশ কিছু ছবি তুলে একটা পায়ে হাঁটা পথ ধরে এগোতেই দেখতে পেল একজন মহিলা বন পাহাড় ভেঙে এগিয়ে আসছেন, পরনে স্থানীয় পোশাক ৷ তৃষিতের কাছে এর চেয়ে ভালো ছবির বিষয় হতে পারেনা ৷ ইরাবতীর মৃদু আপত্তিতে পাত্তা না দিয়ে ক্যামেরা ফোকাস করে কয়েকটি শট নিয়ে নিলো ৷ ইরাবতী প্রমাদ গনল, যদিও তৃষিতের সঙ্গে একজন মহিলা আছে....তবুও ৷ আরেকটু কাছে আসতে ইরাবতী দেখলো একজন বয়স্ক মহিলা, গায়ের রং ফর্সা, পরনে উজ্জ্বল পোশাক আর সারা মুখে মায়ের স্নেহ মাখামাখি হয়ে আছে ৷ হাঁসি হাঁসি মুখে ইরাবতীর কাছে এসে নিজেই আলাপ করলেন ৷ উনি মন্দিরের প্রধান ব্রাহ্মণের স্ত্রী ৷  এটুকু আলাপেই নিজের বাড়িতে ডেকে চা খাওয়ালেন ৷ মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে, এক ছেলে চাকরি সূত্রে দেরাদুনে থাকে, আর স্বামী এখন গঙ্গোত্রীতে ৷ বছরের ছমাস ভদ্রমহিলা একদম একা থাকেন ৷ এর মধ্যেই নিজের হাতে খেতি করেন, গরু-মোষের পরিচর্যা, তারপর রান্নাবান্না, ঘর সামলানো ৷ মুখের একটি রেখাতেও বিরক্তি বা ক্লান্তির চিহ্ন খুঁজে পেলোনা ইরাবতী ৷ ওঠার সময় দুজনের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন ৷ ইরাবতীকে আশীর্বাদ করলেন, ওর শাঁখা সিঁদুর যেন অক্ষয় থাকে ৷ আর তৃষিতের কান বাঁচিয়ে ইরাবতীর কানে কানে বললেন, ‘অব এক লেড়কা অর লেড়কি কো গোদি মে খিলাও’৷  অজান্তেই ইরাবতীর চোখমুখ লাল হয়ে উঠলো ৷ আড়চোখে তৃষিতের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলোনা কথাটা ওর কানে গেছে কিনা। কেন যেন মনটা খুব ভালো হয়ে গেল, ভক্তিভরে পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে উঠে পড়ল ৷ তৃষিতও বোঝা গেল ভদ্রমহিলার সাথে আলাপ করে খুশি, সে তখন যথেচ্ছ ছবি তোলার ছাড়পত্র পেয়ে গেছে৷ মুহুর্মুহু তার ক্যামেরা ঝলসে উঠছে ৷ বেশ খুশি খুশি মনেই দুজনে হোটেলে ফিরেছিল ৷ আর হোটেলে ফিরে মনটা আরও ভালো হয়ে গেল ৷

কিন্তু ' মর্নিং শোজ দ্য ডে ' তত্ত্বকথাটা যার জীবনেই হোক ইরাবতীর জীবনে প্রয়োগ হওয়া খুব দুষ্কর ৷ সকালের ঝকঝকে আকাশ যেমন দুপুরের পর কালো মেঘে ঢেকে গেল, একইভাবে ইরাবতীর আকাশটাও সকালের হালকা সোনারঙের আস্তরণ মুছে ফেলে ধূসর স্লেট রঙা হয়ে উঠল ৷ আকাশের রঙ পাল্টানো প্রকৃতির খেয়ালখুশি কিন্তু ঘরের রঙবদলের দায় যখন কর্কশ ভাষায় তৃষিত তার ওপর চাপিয়ে দিল তখন অনেকদিন পর ইরাবতীর চোখে জল এলো। দোষ কি সত্যি তার! সোফার ওপর ছড়িয়ে রাখা জামা-প্যান্ট-সোয়েটার-তোয়ালের মধ্যে তাঁর শখের এস.এল.আর ক্যামেরাটা রাখা ছিল, ইরাবতী না জেনে দুপুরের খাবার পর জামাকাপড়গুলো হাত দিয়ে সরিয়ে সোফায় একটু বসতে গিয়ে ক্যামেরার ওপর সামান্য চাপ দিয়ে ফেলেছে, তাতেই সারা রিসর্টকে চমকে দিয়ে ইরাবতীকে যা খুশি তাই গালিগালাজ করে ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে গেল ৷ আর ইরাবতীর স্বপের হরশিল ভ্রমণ ব্যালকনির ছোট্ট সোফায় বসে দুপুর থেকে বিকেলে গড়াতে গড়াতে কাটতে লাগল ৷ হঠাৎ নিজেকে ভাগীরথীর সাথে একাত্ম করতে পারলো ইরাবতী ৷ এই নদী পাহাড়ি পথে বয়ে চলেছে অন্তহীন, সেই বিশাল পথচলায় কত রকমের ছোট-বড় ধাক্কা সহ্য করতে হচ্ছে, তবু পথ চলায় কোনো ক্লান্তি নেই....কিসের মোহে সে ছুটে চলেছে এই অন্তবিহীন পথ! বারান্দার রেলিংয়ে থুঁতনি ঠেকিয়ে পলের পর পল বয়ে যায়। এখন চোখের জল শুকিয়ে গেছে ৷ জলের শুকনো দাগ ইচ্ছে করেই মুছে ফেলেনি ৷ মূল বাড়ি থেকে বাচ্চাটার খিলখিল হাঁসির শব্দ ভেসে আসছে ৷

ইরাবতীই আগে প্রেমে পড়েছিলো ৷ ছ-ফুট উচ্চতার নির্মেদ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের তৃষিতকে দেখে যেকোনো মেয়েই প্রেমে পড়বে ৷ তাছাড়া বেশি কথা বলেনা, মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করেনা, পড়াশোনায় ফাটাফাটি......ফলে অনুরাগিনীর সংখ্যা নেহাত কম ছিলোনা, তবু তৃষিত ইরাবতীর মধ্যেই তার কাঙ্খিত নারীর সন্ধান পেয়েছিলো। কি ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছিল দুজন দুজনকে....! আর আজ বিয়ের চারবছর পর কি করে এতটা দূরে পরস্পর সরে আসতে পারলো! যে প্রিয়ন্জনকে নিয়ে তৃষিতের যাবতীয় রাগ-দুশ্চিন্তা সেই ছেলেটি তার চেয়ে দুবছরের ছোট, তাকে দিদি বলে ডাকে ৷ তাকে নিয়ে ইরাবতীর পারিবারিক সমস্যার কথা জেনে ছেলেটি যারপরনাই লজ্জায় থাকে ৷ হ্যাঁ ছেলেটি একটু ইরাবতীর ন্যাওটা ৷ ইরাবতী জয়েন করার কয়েকমাস পর অতিথি শিক্ষক হিসেবে একই বিভাগে যোগদান করেছে। ওদের বিভাগে ওরা দুজনই মাত্র অতিথি অধ্যাপক, বাকিরা দীর্ঘদিন চাকরি করছেন ৷ স্বাভাবিকভাবেই ওদের দুজনের মধ্যে হৃদ্যতা বেড়েছে ৷ আসলে তৃষিত আধুনিক যুগে জন্মালেও মানসিকতা অষ্টম-নবম শতাব্দীর রয়ে গেছে ৷ ওর ধারণা নারী-পুরুষের মধ্যে দেহের সম্পর্ক ছাড়া আর কোনো সম্পর্ক হতে পারেনা ৷ অথচ এই প্রিয়ন্জনই তাঁকে বেড়াতে যাওয়ার বুদ্ধিটা দিয়েছে, বলেছে....দিদি, সব কিছু জোড়া লাগে...এমনকি কাঁচও...তার জন্যে উদ্যোগ নিতে হবে ৷ ঘরের কোণে বসে চোখের জল ফেললে সমস্যার সমাধান হবেনা ৷ পরিবেশ অনেক সময় মানসিকতা বদলে দেয় ৷ তুমি তৃষিতদাকে পাহাড়ে নিয়ে যাও...ও তো পাহাড় ভালোবাসে ৷ সম্পর্ক থেকে একেবারে বেরিয়ে আসার আগে একবার শেষ চেষ্টা করবেনা! দৈনন্দিন অশান্তিতে ইরাবতী তখন ক্লান্ত, প্রথমদিকে কিছু না বললেও বাবা-মা কিছু আঁচ করতো, বিশেষ করে মা ৷ তারপর তৃষিত যেদিন গায়ে হাত তুললো, কুৎসিত ভাষায় গালাগাল করলো সে তখন মায়ের কাছে চলে গিয়েছিল, তখন বাধ্য হয়ে সব বলতে হয়েছিল ৷ বাবাকে ওতটা বিশ্বাস করাতে না পারলেও মা তার কষ্টটা বুঝেছিল ৷ তার প্রায় একমাস পর তৃষিতের সাথে বাবা যোগাযোগ করে ইরাবতীকে আবার নিজের সংসারে ফিরিয়ে দিয়ে যায় ৷ কিন্তু তৃষিতের মধ্যে অনুশোচনা ব্যাপারটিই নেই, উল্টে ইরাবতীকে চাকরি ছাড়ার জন্যে চাপ দিতে লাগলো ৷ ইরাবতী অবাক....সে তার ক্যারিয়ারে এত বড় স্বার্থত্যাগ কেন করবে! নেট কোয়ালিফাই করেছে, পি.এইচ.ডি রেজিস্ট্রেশনের জন্যে নিজেকে তৈরি করছে, কিছুদিন পর সি.এস.সির ইন্টারভিউ হবে সেখানে টিচিং এক্সপিরিয়েন্সের জন্যে মার্কস আছে.... আর সব থেকে বড় কথা একটা মিথ্যা সন্দেহকে প্রশ্রয় দিয়ে চাকরি ছাড়বেটাই বা কেন! সমস্যা যখন তৃষিতের, তখন সমাধানের জন্য তার এটিটিউড বদলাক ৷ ফল দাঁড়াল মারাত্মক... আরও অশান্তি, আরও কাদা ছোঁড়াছুড়ি, আরও আক্রোশ আরও অবিশ্বাস ৷ ইতিমধ্যে ইরাবতীরও কানে এসেছে অফিসের একটা মেয়ের সাথে তৃষিতের ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে, এমনকি বেশ কয়েকবার মিটিং, সেমিনার, কনফারেন্সে বাইরেও নিয়ে গেছে। সব ঘটনা আস্তে আস্তে দুজনকে প্রতীতি দিল যে এই মৃত সম্পর্ককে মিছিমিছি বয়ে নিয়ে যাবার আর কোনোও মানে হয়না ৷ সব শুনে মা চুপ করে গেল কিন্তু বাবা খুব ভেঙে পড়ল ৷ যতই হোক জামাই নিয়ে বেশি নাচানাচি বাবাই করেছিল ৷ ইরাবতীর বাবা-মায়ের জন্য কষ্ট হলেও কিছু করার ছিলোনা ৷ দুজনে মিলে সম্পর্ক ভাঙার সিদ্ধান্ত নিল ৷ সেই সময়ে প্রিয়ন্জনের কথায় বহু কষ্টে তৃষিতকে রাজি করিয়ে কয়েকদিনের ছুটি ম্যানেজ করে এখানে এসেছে ৷ কিন্তু সিঁদুরে মেঘ কাটলোনা, ভেঙে পড়া সম্পর্কটা জেদি বাচ্ছার মতো গোঁ ধরে এক জায়গায় দাঁড়িয়েই পায়ের আঙুল দিয়ে মাটি খুঁড়তে লাগল ৷

এখন সূর্য পশ্চিম আকাশে অনেকটা নেমে এসেছে, এবার দূরের ঝাপসা পাহাড়গুলো ছুঁয়ে ফেলবে আর তারপরই ওই পারে টুপ করে ডুবে যাবে। ইরাবতী এখনও একই ভঙ্গিমায় বারান্দায় বসে আছে ৷ উঠতে ইচ্ছা করছেনা, একটা কিছু গায়ে চাপানো দরকার ৷ সূর্য পাহাড়ের ঢালে মুখ লুকোলেই হু হু করে ঠান্ডা বাড়তে শুরু করবে ৷ কালই তো ফেরা, ফিরে অসুস্থ হয়ে পড়লে আর কোনো ছুটি পাওয়া যাবেনা ৷ ভাগীরথীর জলে শেষ সূর্যের ঝিকিমিকি আলো, এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকলে চোখ ধাঁধিয়ে যায় ৷ ইরাবতীর নদীর দিকে তাকিয়ে বসেছিল। সেই ধাঁধানো দৃষ্টিতে আবছা ভাবে মনে হল একটা হলুদ আলো বাঁ দিক থেকে টলতে টলতে বাউন্ডারির রেলিংয়ে গিয়ে ঠেকল, তারপর আলোটা আস্তে আস্তে রেলিং বেয়ে ওপরে উঠতে লাগল, রেলিংয়ের নিচেই রাক্ষসী ভাগীরথী সাঁঝবেলায় ফুঁসতে ফুঁসতে চলেছে ৷ চোখটা কচলে নিয়ে দেখতে গিয়ে বুকটা ফাঁকা হয়ে গেল, ম্যানেজারের বাচ্ছা মেয়েটি সকলের অলক্ষ্যে বেরিয়ে এসে রেলিং ধরে ওপরে ওঠার চেষ্টা করছে ৷ কংক্রিটের ধাপটা নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করছে, একবার উঠে পড়তে পারলে আর রক্ষা নেই ৷ কোনোভাবেই টাল সামলাতে পারবেনা, কংক্রিটের দেওয়ালের ওপর খুব জোর দুফুট উঁচু লোহার রেলিং ৷ হঠাৎ করে ইন্টার-ইউনিভার্সিটির চ্যাম্পিয়ন দলের বাস্কেটবল খেলোয়াড়টি জেগে উঠলো....ওই অবস্থায় জোড়া পায়ে মুহূর্তের মধ্যে বারান্দার রেলিং টপকিয়ে প্রায় সাত ফুট নীচে লাফ দিলো, তারপর জীবনের সবচেয়ে গতিসম্পন্ন স্প্রিন্টটা টেনে কয়েক সেকেন্ডে বাচ্চাটির কাছে পৌঁছে গেল ৷ কিন্তু তখন দেরি হয়ে গেছে, বাচ্ছাটা পাঁচিলের নাগাল পেয়ে গেছে ৷ একহাতে রেলিংটির মাথা ধরে অন্য পা-টি বাড়িয়ে দিয়েছে নদীর ভয়াল গহ্বরের শূন্যতায় ৷ ইরাবতী কোনরকমে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাচ্চাটির একটা পা ধরতে পারল। কিন্তু বাউন্ডারিটা খুব জোর সাড়ে তিন ফিট হবে, এত জোরে দৌড়ে এসে পাঁচ ফুট আট ইঞ্চির ইরাবতীর যে মোমেন্টামটা তৈরি হলো তার ধাক্কায় বাচ্চাটিকে নিয়ে ইরাবতীর পা মাটি থেকে শূন্যে উঠে গেল ৷ সেকেন্ডের কয়েক ভগ্নাংশে তার শরীরটা রেলিং থেকে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোনে ঝুলে গেল, চোখে পড়লো উদ্দাম ভাগীরথীর ঘূর্ণি কালো স্রোত ৷ ঠিক সেই মুহূর্তে তার বাঁ পাটা ধরে কেউ প্রচন্ড জোরে হ্যাঁচকা টান মারল ৷ কিছুটা শূন্য পথে উল্টো বাগে উড়ে এসে চিত হয়ে পড়ার আগে বাচ্চাটিকে খেলোয়াড়ি দক্ষতায় বুকের মধ্যে গুটিয়ে নিল ৷ তারপর নিজের মাথার খুলি আর ঘাড় ভাঙার শব্দ শোনার অপেক্ষায় চোখ বুজল ৷ কিন্তু কিছুই ঘটলোনা, ওকে আর বাচ্চাকে কে যেন লুফে নিয়ে ঘাস জমিতে ঘষতে ঘষতে কিছুটা দূরে গিয়ে থামল ৷ ইরাবতী বুঝতে পারল ওর আর শিশুটির বিন্দুমাত্র আঘাত লাগলোনা ৷ রিসর্টের ভিতর থেকে হইহই, আর্ত চিৎকার করতে করতে লোকজন অকুস্থলে ছুটে আসতে লাগল। ইরাবতী আর কিছু ভাবলোনা, সেই অবস্থায়ই চোখ বুজল ৷ এমন সময় সবাইকে চমকে দিয়ে শিশুটি ইররাবতীর বুকের মধ্যে খিলখিল করে হেঁসে উঠলো ৷

         মা সবসময় বলে এসেছে -- একটা বাচ্ছা নিয়ে নে, দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। কথাটা শুনে ইরাবতী কেঁপে উঠেছে ৷ যেখানে তার নিজের জীবনই বিপন্ন, সেখানে একটা নিরপরাধ শিশুকে পৃথিবীতে আনার পাপের কথা ভাবতেও আতঙ্ক জাগে ৷ আজ সন্ধ্যাটা একটা ঘোরের মধ্যে কাটলো ৷ বাচ্চাটার বাবা-মায়ের হাউ হাউ কান্নায় দেওয়ালির সব রং ফিকে হয়ে গেল ৷ চারদিকে সাজানো হাজার বাতি জ্বালানোর কথা কারোর মনেও এলোনা ৷ কিন্তু কেউ জানেনা, ইরাবতীর মনের মধ্যে হাজার বাতির রোশনাই জ্বলে উঠেছে ৷ সেই আলোয় নিজের পুড়তে থাকা মনটা সেঁকতে সেঁকতে ইরাবতী দেখলো তৃষিত আজ সন্ধ্যাবেলা বোতল খুলে বসলোনা ৷ সারাটা সন্ধ্যা ওই একচিলতে ফাঁকা বারান্দায় অন্ধকারে বসে রইল ৷ রাত বাড়ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঠান্ডা। তৃষিতের ভ্রুক্ষেপ নেই, একটা পাতলা সোয়েটার পরে বসেই রইলো ৷ ইরাবতীর কিছু বলতেও ভয় লাগছে ৷ যখন ঘরের মধ্যেই শীতটা অসহ্য হয়ে উঠলো তখন স্যুটকেস থেকে কুলু থেকে কেনা শালটা বের করে ধীর পায়ে বারান্দায় এল ৷ পিছন থেকে তৃষিতের চওড়া কাঁধে শালটা জড়িয়ে দেওয়ার সময় তৃষিতের হাত দুটো তার দুটো হাত জড়িয়ে ধরলো ৷ একটু হুমড়ি খেয়ে ইরাবতীর শরীরটা তৃষিতের পিঠে আশ্রয় পেল ৷ আর নিজেকে সামলাতে পারলোনা, ভাগীরীকে চমকে দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো ইরাবতী ৷ তার বুকের মধ্যে আটকে থাকা তৃষিতের শরীরটাও থরথর করে কেঁপে উঠছে ৷ পুরুষ মানুষকে কখনোও কাঁদতে দেখেনি ইরাবতী, তৃষিতকে তো নয়ই ৷ একটা পুরুষালি মৃদু গোঙানি তার উচ্চকিত কান্নার সাথে মিশে ঠান্ডা হাওয়ায় ভর করে ভাসতে ভাসতে ভাগীরথীর জল স্পর্শ করলো। নিচের নিকষ কালো জলধারায় কোথায় গিয়ে মিশলো চোখে পড়লোনা ৷ তবে ইরাবতী স্পষ্ট শুনতে পেল ভাগীরথীর পাগলা স্রোত বাচ্ছার গলায় খিল খিল করে হাঁসতে হাঁসতে দূর পাহাড়ের দিকে ছুটতে ছুটতে চলে যাচ্ছে ৷

 

ডঃ গৌতম সরকার
লেখক, পশ্চিম বঙ্গ, ভারত দেশ

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top