সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

অমলকান্তি : পরমার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়


প্রকাশিত:
২৩ জানুয়ারী ২০২১ ২০:১৪

আপডেট:
২৩ জানুয়ারী ২০২১ ২০:৩০

 

‘অমলকান্তি আমার বন্ধু,
ইস্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়তাম।
রোজ দেরি করে ক্লাসে আসতো পড়া পারত না,
শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে
এমন অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকতো যে,
দেখে ভারী কষ্ট হত আমাদের।’

অমলকান্তি মুখার্জি আমার বন্ধু, আমরা একসঙ্গে স্কুলে পড়তাম। অমলকান্তি রোজ দেরি করে স্কুলে আসত না, শব্দরূপ অঙ্ক সবই পারত এবং মোটেই অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকত না। (পাঠক নিশ্চয়ই অমলকান্তির কবিতাটি পড়েছেন) অমলকান্তি কখনও রদ্দুর হতে চায়নি এবং ওর ছাপাখানায় কোনওদিন কাজ করবার সম্ভাবনা নেই। অমুদের যদিও মনোহরপুকুরে তিন তিনখানা প্রেস আছে,পারিবারিক ব্যবসা। ও বলতো ঐ ছাপাখানার ব্যবসা ওর পোষাবে না। আমরা কেউ বা হতে চাই ডাক্তার, কেউ বা ইঞ্জিনিয়ার, কেউ বা উকিল। হতে চাই অথবা ওরকমই কিছু একটা হওয়ার কথা ভাবতে চাই; সেরকম ভাবাই তো নিয়ম। অমলকান্তি ওসব কিছুই হতে চায়নি, সে হতে চেয়েছিল বডি বিল্ডার। অমুর ধ্যান জ্ঞান ছিল আর্নল্ড শেয়ারজানেগার। নিজের ঘরের দেওয়াল শেয়ারজানেগারের ছবিতে ঢেকে ফেলে ডন বৈঠক, জিম নিয়ে থাকত। আমরা যখন লেকের মাঠে ফুটবল খেলছি, সদ্য শেখা অনভ্যস্ত সিগারেটে টান মারছি আর পাশের গার্লস স্কুলের মেয়েদের দিকে লুকিয়ে চুরিয়ে তাকাচ্ছি, তখন অমলকান্তি বাইসেপস ট্রাইসেপস নিয়ে সদা ব্যস্ত, এসবে মন দেওয়ার সময়ই ওর ছিল না। তারপর একদিন স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা এসে গেল, রেজাল্ট বেরোলে দেখা গেল অমলকান্তি আমাদের অনেকের চেয়েই ভাল ফল করেছে, ব্যায়াম করলে মাথা মোটা হয়ে যায় এ ধারণাকে বাপী বাড়ি যা করে দিয়ে অঙ্কে লেটার পেয়েছে। স্কুলের পরে বন্ধুরা অনেকেই এদিক ওদিক ছিটকে গেলেও আমি আর অমু একই কলেজে ভর্তি হলাম। কলেজে ঢুকে অনেকেরই ডানা গজায়, আমারও গজালো, ক্লাসে যাওয়া প্রায়ই হয়ে উঠত না, অনেক নতুন নতুন বন্ধু এবং বান্ধবী জুটে গেল, কলেজ কেটে সিনেমায় যাওয়া বেড়ে গেল, একই ক্লাসে পড়া সত্বেও অমুর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ একটু কম হতে লাগল।

‘ক্ষান্তবর্ষণ কাক-ডাকা বিকেলের সেই লাজুক রোদ্দুর,
জাম আর জামরুলের পাতায়
যা নাকি অল্প-একটু হাসির মতন লেগে থাকে।’

সেই লাজুক রোদ্দুর না মাধবীলতা সোম, কে অমলকান্তির বারোটা বাজিয়েছিল তা এখনও জানা যায়নি, তবে ধরা নেওয়া যায় দুয়ের ডাবল এফেক্টে শেয়ারজানেগারের ডাবল রোলের অ্যাফেক্ট হওয়ায় অমলকান্তি গুরুর মতন টার্মিনেটর হওয়ার বদলে নিজেই টার্মিনেটেড হয়ে গেছিল। তা কি আর করা! জাম আর জামরুলের পাতায় লেগে থাকা সেই লাজুক রোদে কলেজের করিডরে কলা বিভাগের ছাত্রী মাধবীলতা সোমকে দেখে বিজ্ঞান বিভাগের অমলকান্তির বাহ্যজ্ঞান লোপ পেল, যেরকম গল্প উপন্যাসে হয়ে থাকে। অমলকান্তির ক্লাস মাথায় উঠল, ব্যায়াম ভুলে গেল, এমনকি শেয়ারজানেগারের নামও মনে পড়ল না। সে সারাক্ষণ মাধবীলতার ক্লাসের আশে পাশে ঘুরঘুর করতে লাগল, মাধবীলতা কিন্তু তাকে প্রায় দেখলই না, কচ্চিৎ কদাচিৎ যদিও বা কলেজ করিডরে বা ক্যান্টিনে অমু মাধবীলতার দেখা পেল কিন্তু কথা বলবার সাহস অর্জন করতে পারল না, হাঁটু কেঁপে গেল, ডন বৈঠক করা হাঁটু কোনও কাজে এল না।

আমার একটু ঠান্ডা লাগার ধাত, এবার শীতটা পড়েছিল জোর আর তার জেরে জ্বর পাকিয়ে কয়েকদিন আর কলেজমুখো হইনি। সেদিন সন্ধ্যাবেলায় অমু এসে হাজির, এই শীতেও যথারীতি অঙ্গে জীন্স আর টী শার্ট, আমরা কলকাতার শীতে অমুকে কোনওদিন সোয়েটার পরতে দেখিনি, ওর পেটানো শরীরে শীতের নো এন্ট্রি। কবিতার অমলকান্তি, ‘চা খায়, এটা-ওটা গল্প করে, তারপর বলে, “উঠি তাহলে।”

আমার বন্ধু অমলকান্তি ওসবের ধার দিয়ে গেল না, বলল, “চল প্রদীপ ছাদে যাই।” আমি মিনমিন করে বলবার চেষ্টা

করলাম এই ঠান্ডায় ছাদে! ও চারদিক দেখে নিয়ে, আশেপাশে কেউ না থাকা সত্ত্বেও, গলাটা নিচু খাদে নামিয়ে প্রায় ফিসফিসিয়ে বলল, “আমার খুব বিপদ রে।” এরকম কথা কোনওদিন শুনিনি, আমাদের মধ্যে সবথেকে ডাকাবুকো, আর্নল্ড শেয়ারজানেগারের ভাব শিষ্য অমুর আবার বিপদ! কলেজের ইউনিয়নের দাদারাও ওকে এড়িয়ে চলে। ততক্ষণে মা চা আর অমলেট নিয়ে ঘরে ঢুকে বলল, “বাবা অমু, অনেকদিন পরে এলি”। আমি তাড়াতাড়ি একটা দরকার আছে বলে চা অমলেট সহ অমুকে উদ্ধার করে নিয়ে ছাদের দিকে পা বাড়ালাম, মা ভাবল আমি সিগারেট টানতে ছাদে উঠলাম। যথারীতি কান মাথা ঢেকে ছাদে ওঠার উপদেশ শুনতে শুনতে কৌতূহলে ফুলতে ফুলতে ছাদে উঠে গেলাম।

 

অমু এক নিশ্বাসে ক্ষান্তবর্ষণ কাক ডাকা বিকেলের সেই লাজুক রোদ্দুরে ওর মাধবীলতা দর্শনের কাহিনী আরও লাজুক ভাবে বলে গেল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম তোর এই ভরাডুবির কথা কি মাধবীলতা জানে? কেসটার অগ্রগতি কতটা? কোন ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে তোর মাধবীলতা প্রেম? বিশেষজ্ঞর মতন ভিতটা কতটা মজবুত জেনে নিতে চাই আর কি। অমু বলল মাধবীলতা নিশ্চয়ই টের পেয়েছে, যেভাবে ও রোজ বাস স্ট্যান্ডে মাধবীলতা দর্শনের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে তাতে না বোঝার কিছু নেই, আর কেসের অগ্রগতি অনেকটাই হয়েছে বলা যায়। মাধবীলতাদের ক্লাসের একমাত্র ছাত্র অলীককে (বাকি সবাই ছাত্রী, অমলকান্তি বোধহয় কলেজের একমাত্র ছাত্র যে মেয়েদের সঙ্গে এই ২০২০ তে কথা বলতে ভয় পায়) রোজ চা সিগারেট খাইয়ে হাত করে ফেলেছে, ওর থেকেই জেনেছে মাধবীলতা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার ভীষণ ভক্ত আর ও শেয়ারজানেগারের সিনেমা মোটেই পছন্দ করে না, ওর পছন্দ রনবীর কাপুর। আমার পিঠে একটা ভীম থাবড়া মেরে অমু বললো প্রদীপ, “কবিতা বুঝলি সুনীলের কবিতা দিয়েই বাজিমাত করতে হবে, তুই তোর সুনীলের সব কবিতার বই আমাকে দিয়ে দে, সব মুখস্থ করে ফেলব, আর যখন তখন কোট করে মাধবীলতাকে একেবারে চমকে দেব। রনবীর কাপুরের সিনেমাগুলোও সব দেখে ফেলতে হবে, দু একটা দেখেওছি ইতোমধ্যে।” আমি তো শুনে থ, অমু আর কবিতা! সে তো উত্তর মেরু আর দক্ষিণ মেরু, আমার কবিতা পড়া নিয়ে অমু অনেক ঠাট্টা করেছে আগে, সে নিয়ে আর খোঁটা দিলাম না ওকে, এমনিতেই যা বেহাল ওর হাল; নয়তো ভীমাকার শেয়ারজানেগারকে ছেড়ে রোগা পাতলা রনবীরের ছবি দেখতে রাজি হয় ব্যায়ামবীর অমলকান্তি। বুঝলাম আঁটঘাঁট বেধেই এগোতে চায় ও।

 

অমু সেদিন কবিতার বইগুলো নিয়ে চলে গেল, আমিও কলেজে যাওয়া এবং কলেজ কেটে সিনেমা যাওয়া শুরু করলাম। একদিন ক্যান্টিনে ওর সঙ্গে দেখা হতে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে কটা কবিতা মুখস্থ করলি রে! অমু বললো হচ্ছে হচ্ছে, “দাঁড়া না যা একখানা চিঠি লিখবো না, মাধবীলতাকে একদম তাক লাগিয়ে দেব। তুই তো পারবিই না ওরকম লিখতে, স্বয়ং সুনীলও পারতেন না।” বলেই ব্যস্ত হয়ে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে গেল। বুঝলাম কেস জন্ডিস, নিশ্চয়ই ফিল্ডিং করতে গেল।

এরই মধ্যে কোথা থেকে বিশ্ব জুড়ে থাবা বসাল করোনা ভাইরাস, রাতারাতি শুরু হয়ে গেল লকডাউন, কলেজ শিকেয় উঠল, বন্দী জীবন, মন মেজাজ ভালো নেই, কলেজ থেকে আমরা কিছুদিন এলাকার গরীবদের ত্রাণ বিলি করলাম, অমুও ছিল প্রতিদিন, ওর বাবা কমলকান্তিই আমাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। ঘটনার ঘনঘটায় অমলকান্তির মাধবীলতাকে প্রেম নিবেদনের কতদূর কী হল তা জানা হয়নি আর। আজকে সকালে হঠাৎ দেখি হোয়াটসঅ্যাপে অমুর মেসেজ। অনেকগুলো কান্নার ইমোজি দেখে জিজ্ঞাসা করলাম, হল কী? বলল এই লকডাউন ওর হৃদয়ে একদম শক্তিশেল বসিয়ে দিয়েছে, ব্যাটা অলীক বিট্রে করেছে, মাধবীলতার মোবাইল নম্বর যোগাড় করে দেয়নি, দিলে সেভ করে কমসে কম মাধবীলতার হোয়াটসঅ্যাপ ডিপিটা দেখে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে পারত। এখন লকডাউন শিথিল হবার পর ক’দিন মুদিয়ালিতে মাধবীলতাদের পাড়ায় সাইকেল নিয়ে চক্কর কাটছে, মাধবীলতা মাঝে মাঝে বারান্দায় আসছে বটে, তবে মাস্ক খুলছে না, বেচারা অমুর হাতে থাকছে পেন্সিল থুড়ি দৃশ্যপটে একমুখ মাস্ক। বারান্দাতেও মাস্ক পরে দর্শন দেবার কী যে দরকার! মাধবীলতা বোধহয় এত সহজে মনের ভাব প্রকাশে আগ্রহী নয়। মেয়েদের মন বোঝা ভার।

 

অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল, মরণ ভাইরাস বহু মানুষের জীবন ও জীবিকা কেড়ে নিল, সারা বিশ্বকে স্তব্ধ করে দিল আর তার সঙ্গে সঙ্গে কত অমলকান্তি মাধবীলতার প্রেম যে মুলতুবি থেকে গেল! এই অকালে তো সেইসব খবর স্যোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হবে না, হওয়া উচিতও নয় বোধহয়, কিন্তু হৃদয়ের গতি তো আর কোনও ভাইরাসের ভয়ে থেমে থাকে না, সে তো চির তারুণ্যের পতাকা বহন করে, ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি যোগায়। ভেতরে কে যেন গান গেয়ে ওঠে, ‘আমরা করব জয়’। আমি জানি অমলকান্তি আর মাধবীলতারা ঠিক জিতে যাবে। আবার চাকা ঘুরবে, ঘুরতেই হবে।

তাই সংগোপনে আমার বন্ধু অমলকান্তির গল্পটা তোমাদের বলে দিলাম। সেই অমলকান্তি, যে রোদ্দুর হতে চায়নি, যে অমলকান্তি মাধবীলতাকে ভালো বেসেছিল।

 

পরমার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top