সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

সুরবালা : শাহানারা পারভীন শিখা


প্রকাশিত:
২৭ জানুয়ারী ২০২১ ২০:০৬

আপডেট:
২৭ জানুয়ারী ২০২১ ২০:২০

 

সুরবালা  হিন্দু ঘরের বৌ। হারানের সাথে বিয়েটা হয়ছে দুইজনের পছন্দে। যদিও সুরবালার বাপ মায়ের খুব একটা ইচ্ছে ছিল না, বাপ মা মরা গরীব ঘরের ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে। তাছাড়া শুনেছে ওই এলাকায় বাঘের আনাগোনা আছে। কিন্তু মেয়ে আর সবিতার জোড়াজুড়িতে শেষমেষ বিয়েটা দিতেই হলো।

জঙ্গলের পাশেই হারানের বাড়ি। বাড়ি বলতে বাঁশের বেড়া আর গোলপাতার ছাউনি দিয়ে তৈরি দুটো ঘর। তাও প্রায় ভাঙাচোরা দশা। বনের সাথের নদীতে চিংড়ির পোনা আর কাঁকড়া ধরার কাজ করে সে। নিজের একটা নাও নাই। তাই অন্যের সাথে টাকা দিয়ে কাজে যেতে হয়। নিজের একখান থাকলে অন্যের নাও ভাড়া করা লাগতো না। সহজ সরল হারানের বিয়ের বয়স পার হওয়ার পথে। এই এলাকার ছেলে মেয়েদের বিয়ে একটু কম বয়সেই হয়। সবিতা মাসি তো সেদিন সবার সামনেই ওর বিয়ের কথা তুললো।
হারান বলে, আমার মত গরীব ঘরে কেডা মেয়ে দিবি! কওতো তোমরা।
কেনরে! ঐ যে সেদিন আমার বাড়িতে আসলো আমার দুর সম্পর্কের আত্মীয় সুরবালা। তোর সাথে তো বেশ ভাব মনে হলো। হাসি হাসি কথা কচ্ছিলি যে।
হাসলিই বুঝি কিছু হয় নাকি কও! তুমি এখন যাওতো মাসি। আমারে কাম করতি দাও।

সুরবালাকে হারানের খুব একটা মন্দ লাগেনি। কি সুন্দর গায়ের রঙ। হাসলি কি যে সুন্দর লাগে। এসব কি ভাবতিছে সে। চান্দের মতো রূপ কি আর তার ভাঙা ঘরে মানায়! নিজের কাজে মন দেয় হারান।
সেই যে গেল বছর বন বিবির পূজোর সময় সুরবালার সাথে প্রথম দেখা হারানের। মাছের পোনা ধরে ফিরতে ফিরতে বেশ দেরি হয়ে যায়। জোয়ারের পানি নেমে গেছে। খাড়ির মধ্যে আটকে যায় হারানের নৌকা। ঠেলে ঠেলে পাড়ের কাছাকাছি এসে আর চলে না। কাঁদায় আটকে থাকে। সুরবালা রমা আর রমলার সঙ্গে ওপথ দিয়েই যাচ্ছিল।বনের মধ্যে শব্দ শুনে ওরা তাকায় সেদিকে। দেখে কাঁদা পানিতে মাখামাখি হারানের।
খিলখিল করে হেসে ওঠে সুরবালা। সে হাসির শব্দ বনের মাঝে হারিয়ে যায় না। হারানের বুকের মধ্যে এসে বারি খায়। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হারান আবার নৌকা ঠেলতে থাকে। পাড়ের কাছে না আনতে পারলে জোয়ারের জলে নৌকা ভেসে যাবে।
সুরবালা হঠাৎ থেমে যায়। রমা আর রমলা কে নিয়ে নেমে যায় জঙ্গলে। সাবধানে পা ফেলে ফেলে হারানের কাছে যায়। তারপর সবাই মিলে নৌকা পাড়ের কাছে নিয়ে আসে। এরপর চলে যায় ওরা। হারান নৌকা ভালো মতো বেঁধে বাড়ির পথে পা বাড়ায়। বিকেলে আবার পুজোয় যেতে হবে।

ঘরে ফিরে খেতে বসে হারান। আনমনা হারানকে দেখে মাসি জিজ্ঞেস করে, কি রে হারান! তোর মনডা কই রাখি আসলি রে?
কিছু হয়নি গো মাসি।
তুমি পুজোয় যাবানা মাসি?
কেন রে?
কিছু না।
আচ্ছা মাসি তোমার বাড়িতে কুটুম্ব আসছে নাকি শুনলাম।
তুই কেমনে জানলি।
না। রমা কইলো। সুরবালা নাম।
কি রে সুরবালারে মনে ধরলো বুঝি তোর? দেখ হারান। ওর বাপের কিন্তু খুব নাক উঁচা। যার তার হাতে মেয়ে দেবেনা শুনছি।
মাসি! আমি কি সেসব কিছু কইছি?

বন বিবির পুজোর জায়গাটা মানুষ আর মানুষ। হিন্দু মুসলমান সব এক জায়গায় আজ। বড় বড় হাড়িতে মানতের রান্না হচ্ছে। বনের ধারের বাড়ির বৌ রা রান্না করছে। তাদের স্বামীরা জঙ্গলে যেয়ে যেন বিপদের মধ্যে না পড়ে এজন্য। ভীড়ের মধ্যে হারানের চোখ কারে জানি খুঁজে। হঠাৎ চোখ যায় হলুদ রঙের শাড়ি পরা সুরবালার দিকে। দেবীর কাছে প্রার্থনা করছে। হারান আস্তে আস্তে সুরবালার পাশে যেয়ে দাড়ায়। মায়ের কাছে আশীর্বাদ নিয়ে ঘুরতেই হারানকে দেখতে পায় সুরবালা। মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে ভিড়ের মাঝে হারিয়ে যায়।
পরের দিন কাজে যায়না হারান। বাড়ির বাইরে যেতেই দেখে সুরবালা পোটলা হাতে নিয়ে ফিরে যাচ্ছে। কিছু বলতে যেয়েও বলতে পারেনা হারান।
সুরবালা কাছে এসে আস্তে করে বলে, আমি যাচ্ছি গো মাঝি। মাসি রে আমি আমার মনের কথা কইছি।
হারান বুঝতে পারেনা সুরবালার কথা। বুকের মধ্যে কেমন জানি করে ওঠে। কিছুই ভালো লাগে না। আনমনে হাঁটতে থাকে।
সবিতা মাসি হারানের মনের অবস্থা বুঝতে পারে। কি রে হারান? আইজ কাল তোর কামের দিকে মন নাই দেখি!
মন কি ঐ সুরবালা সাথে করে নিয়ে গেছে? সামনের মাসে বাড়িতে গেলি দেখি সুরবালার বাপের সাথে কথা কব।
হারান খুশি হয়ে বলে, সত্যি গো মাসি! তুমি বলবা কথা?
হ রে হ।
তোরে কিন্তু কাজকাম বাড়ায়ে দিতে হবি কলাম।
ওরাম সোনার মতন মাইয়াডারে তুই খাওন দাওন দিবি কেমনে?
মাসি। তুমি শুধু ওর লগে আমার বিয়ার ব্যবস্থা কর। আমি ওরে খুব যত্নে রাখবো দেইখো।

সুরবালার সাথে হারানের বিয়ে হয়ে যায়। বেশ ভালোই চলছিল ওদের সংসার। সুরবালাও খুব কাজের মেয়ে। সেও হারানের সাথে জঙ্গলে যায়। মাছের পোনা আর কাঁকড়া ধরে। দুজনের কাজে ওদের সংসারে উন্নতি হতে থাকে। টিনের ঘর ওঠে। নিজেদের একটা নৌকা। ঝকঝকে উঠোন। চারদিকে ফুল গাছ লাগিয়েছে সুরবালা। নিজ হাতে সব করে সে। দেখতে দেখতে দুটো মেয়ে হয় ওদের। ছয় বছর হলে স্কুলে ভর্তি করে দেয়। সুরবালার খুব ইচ্ছে মেয়ে দুটোকে অনেক লেখাপড়া শেখাবে। মেয়ে দুটোও হয়ছে মায়ের মতই লক্ষ্মী। সকালে দুবোন পাশের নালা থেকে মাছ ধরে এনে মাকে দিয়ে স্কুলে যায়। সুরবালা সেই মাছ রান্না করে মেয়েদুটো আর হারানের জন্য তুলে রাখে।

মেয়েদুটো সবে প্রাইমারি শেষ করেছে। সেদিনের ঘটনা। হারানের শরীরটা কয়দিন থেকে খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। কাজেও তেমন যেতে পারে না। ধারদেনা করে আর কয়দিন ই চলা যায়। সুরবালা খুব সকালে উঠে রান্নাবান্না  শেষ করে। মেয়ে দুটো স্কুলে যাওয়ার পর চুপিচুপি পাতিলখান নিয়ে বেরোতেই হারানের সামনে পড়ে যায়।
কি রে! তুই চোরের মত লুকোয় কই যাচ্ছিস সুরবালা?
নদীতে যাচ্ছি পোনা ধরতি। ঐ বিমলা বৌদির সাথে।
না না। তুই যাবি না। বাঘের পায়ের ছাপ দ্যাখছে পাশের ঐ পাড়ার মানুষ।
চিন্তা কইরো না গো মাঝি। আমরা বনের মধ্যে বেশি দূর যাব না। মেয়ে দুটোর পাতে কয়দিন হয় একটু ভালো কিছু দিতে পারিনা। তুমি না কইরো না। আমি এই যাবো আর আসবো।

হারান সুরবালার চলে যাওয়া দ্যাখে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তার হাতে পড়ে সুরবালার আজ এই অবস্থা। ছোট নৌকায় সুরবালা আর বিমলা বনের ভিতরে যায়।মাছের পোনা বেশ ভালোই পাচ্ছে আজ। মাছ ধরতে ধরতে বনের বেশ ভিতরে চলে আসে ওরা। চলরে সুরবালা ফিরে চল। বিমলা বলে। আজ আর ধরার কাম নাই। জায়গাটাও কেমন শুনশান।
তুমি নৌকায় বস বৌদি। আমি আর একটু ধরি।
বিমলা নৌকায় বসে এদিক ওদিক তাকায়। একটু অন্যমনস্ক মনে পড়ে। হঠাৎ সুরবালার চিৎকার। বিমলা সামনে তাকাতেই দেখে সুরবালাকে বাঘে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আকাশ বাতাস চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায় বিমলা।
ওদের চিৎকার শুনে অন্য মাঝিরা সব ছুটে আসে।

হারানের মনটা কেমন ছটফট করতে থাকে। বাড়ির বাইরে আসে সে। হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেঁচি শুনতে পায়।
'সুরবালারে বাঘে নিছে গো বাঘে নিছে' । সবার সাথে হারানও ছুটে যায় বনের ভিতরে। বহু খুঁজাখুঁজি শেষে সুরবালার বাঘে খাওয়া দেহটা পায়।
দুতলার বেলকনিতে দাঁড়িয়ে বনের দিকে তাকিয়ে সুরবালার কথায় ভাবছিলাম। ওর মৃত্যুর ঘটনা সবার মুখে বহুবার শুনেছি।
দিদি মনি! কেমন আছো তুমি? আমারে চিন্তি পারছো? আমি হারান। সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে সে।
ওখানে দাড়িয়ে আছ কেন? উপরে আস তুমি।
আমার সামনে মেঝেতে বসে হারান। বয়সের চেয়েও বয়স অনেক বেশি মনে হচ্ছে।
মেয়েদুটো এখন কি পড়ছে?
ওদের শহরের কলেজে ভর্তি করে দিছি। ওখান থেকেই লেখাপড়া করবি।
খুবই ভালো করেছো।
হ গো দিদিমণি। আমার সুরবালার স্বপ্ন পূরণ হবি। ভালো ঘরে বিয়ে দিতি পারবো। ওদের মায়ের মত বাঘের হাতে মরতি হবে না। বলেই চোখ মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়ায়। 
যাই গো দিদিমনি।
আমি ওকে ডেকে বলি, এবার একটা বিয়ে করে সংসারী হও হারান। মেয়েদুটো তো চলে গেল।
তা আর হবে না গো দিদিমনি। সুরবালারে যে আমি আমার জীবনের চাইতিও বেশি ভালোবাসি।
হারান চলে যায়। আমি অবাক হয়ে ওর চলে যাওয়া দেখি।

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top