সিডনী মঙ্গলবার, ১৬ই এপ্রিল ২০২৪, ৩রা বৈশাখ ১৪৩১

সেদিনও ছিল, আছে আজও, বাংলা'র নিঃশব্দ সেই আর্তনাদ! : তন্ময় সিংহ রায়                               


প্রকাশিত:
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৯:৪৩

আপডেট:
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৯:৪৬

 

সাত হাজার অতিক্রান্ত এ গ্রহের ভাষা বৈচিত্রে ব্যবহৃত ভাষা প্রায় হাজার সাড়ে ছয়-এর বেশিতো হবেই, ও এর মধ্যে বাংলা বোধকরি একদম প্রথম সারির প্রথমের দিকে এক অকৃত্রিম এবং রাজকীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ!

এ প্রসঙ্গে ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি তৎকালীন পূর্ববাংলায়, যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে চুড়ান্ত রূপ ধারণকৃত 'ভাষা আন্দোলন' সংঘটিত হয়েছিল, তা ছিল এমন,

'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলতে পারি?'

ভাষা আন্দোলনের এক করুণ ও মর্মস্পর্শী ইতিহাসের সেই আর্ত চিৎকার আজও যেন সমানভাবে প্রতিধ্বনিত হয় এই গানটাতে!

দিনটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে আছে, বাংলা প্রেমে উন্মাদ বাঙালি জনগণের ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এক হৃদয়বিদারক ও গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিবিজড়িত দিন হিসেবে!

বঙ্গীয় সমাজব্যবস্থায় বাংলা ভাষার যথার্থ অবস্থান নিয়ে, দুঃখ, যন্ত্রণা ও হতাশা থেকে বাঙালির আত্মসম্মানে জ্বলতে শুরু করে যে দাবানলের আগুন এবং উন্মেষ ঘটে ভাষাচেতনার, তার'ই সূত্রকে কেন্দ্র করে বিভাগোত্তর পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঢাকায় ১৯৪৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে শুরু হয় এই তুমুল ভাষা-বিক্ষোভ!

১৯৪৮-এর মার্চ মাসে এ নিয়ে আন্দোলনের সূত্রপাত হয় সীমিত পর্যায়ে, কিন্তু ধৈর্যের বাঁধকে ভেঙে তছনছ করে, অবশেষে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঘটে যায় এর চরম বহিঃপ্রকাশ!

ঐদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা অমান্য করে রাজপথে বেরিয়ে এলে, নির্বিচারে ও নির্দয় চিত্তে পাকিস্থানী পুলিশের গুলিতে সদ্য ঢাকায় আগত মাতৃভাষাপ্রেমী বছর ৩৩-এর এক বীর সন্তান আবদুল জব্বার রক্তাক্ত অবস্থায় লুটিয়ে পড়েন বাংলা মায়ের কোলে , ও কয়েক ঘন্টা পরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ঢলে পড়েন মৃত্যুশয্যায়!

এলোপাথাড়ি গুলি বর্ষণে, এদিকে আর একটা গুলি বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে যায় হোস্টেলের ১২ নম্বর শেডের বারান্দায়! সেখানেও গুলি গিয়ে বিদ্ধ করে সদ্য মাস্টার্স-এ ভর্তি হওয়া ২৫ বছরের আবুল বরকত-এর দেহকে!

দুর্ভাগ্যবশতঃ যন্ত্রণাবিদ্ধ শরীর নিয়ে রাত আটটা নাগাদ তিনিও ত্যাগ করেন তাঁর শেষ নিঃশ্বাসটুকু!

 

আরও যাঁরা শহীদ হয়েছিলেন এই ভাষা আন্দোলনে (প্রায় ১২ জন), তাঁদের মধ্যে ছিলেন আব্দুস সালাম, যিনি পেশায় ছিলেন ডিরেক্টরেট অব ইন্ডাস্ট্রিজ বিভাগের একজন পিয়ন, থাকতেন নীলক্ষেতের কোয়ার্টারে।

২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিক্ষোভে অংশ গ্রহণ করলে, পুলিশের গুলিতে তিনিও লুটিয়ে পড়েন মাটিতে! 

সৌভাগ্যক্রমে প্রাণটা তৎক্ষণাৎ দেহ ত্যাগ না করলেও, মাস দেড়েক ধরে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে, মাত্র ২৭ বছর বয়সে তিনি বরণ করেন অনিচ্ছাকৃত মৃত্যুকে!

এছাড়াও অতি দুর্ভাগ্যজনকভাবে পুলিশের গুলিতে মারা যায় অহিউল্লাহ নামের একজন ৮ থেকে ৯ বছর বয়সী এক নিষ্পাপ শিশু!

এ নিন্দনীয় ঘটনার তীব্র প্রতিবাদের কালবৈশাখীতে, ক্ষুব্ধ ঢাকাবাসী সমবেত হয় ঢাকা মেডিকেল হোস্টেলে।

নানান পাশবিক নির্যাতন সত্ত্বেও ছাত্রদের পাশাপাশি সে মুহুর্তে সাধারণ মানুষও প্রতিবাদ জানাতে পরের দিন অর্থাৎ ২২ ফেব্রুয়ারি পুনরায় নেমে আসেন ঢাকার রাজপথে!

তাঁরা অংশগ্রহণ করেন মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহীদদের জন্য অনুষ্ঠিত গায়েবি জানাজায়!

ভাষা শহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্যে ২৩ ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যে মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে তাঁরা গড়ে তোলেন এক স্মৃতিস্তম্ভ!

কিন্তু পিছু না ছাড়া দুর্ভাগ্য, অর্থাৎ তৎকালীন সরকার ২৬ ফেব্রুয়ারি তাও দেয় নির্দ্বিধায় গুঁড়িয়ে! অতঃপর একুশে ফেব্রুয়ারি'র এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলন হয়ে ওঠে আরও বেগবান! আন্দোলনকারীদের দোষ ছিল একটাই, মায়ের ভাষার ইজ্জৎ'কে যে কোনো মূল্যে রক্ষা করা।

 

সর্বশেষ ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরে বসবাসরত দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম প্রাথমিক উদ্যোক্তা হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানালে, তৎকালীন জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনান ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ ই নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘোষণা করেন 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে।

এবং ২০০০ সালের সেই ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে সেই বিশেষ দিবসটা আজও পালিত হচ্ছে জাতিসঙ্ঘের সদস্যদেশসমূহেও, এবং তা যথাযথ মর্যাদা'র সাথে।

 

পৃথিবীর মধুরতম ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার মর্যাদা আজ সমগ্র ভূপৃষ্ঠকে বেষ্টন করেছে বায়ুচাপ বলয়ের মতন বললেও নিতান্তই অযৌক্তিক কিছু বলা বোধ হয় হবে না।

কিন্তু প্রকৃত বাংলা ভাষাপ্রেমী সংখ্যালঘিষ্ঠ কিছু শ্রেণীর মানুষ বোধকরি এক চরম দুশ্চিন্তায় আজও প্রহর গুনছেন এর ভবিষ্যৎ অস্তিত্বকে কেন্দ্র করে, বলাবাহুল্য এর একাধিক যুক্তিসংগত কারণও আছে বৈকি!

সর্বোপরি রাষ্ট্রের বিশেষত বাঙালি শাসক সম্প্রদায় থেকে ফিল্মি ও খেলার দুনিয়ার সেলিব্রিটি প্রভৃতি সবাই ক্রমশই ছুটে চলেছেন ইংরিজি'র অভিকর্ষজ টানে!

আর অপুষ্টি ও চরম অবহেলায় জীর্ণ ও শীর্ণকায় বাংলা-টা ক্রমশই যেন আজ হয়ে উঠেছে শুধুই এক কথ্য ভাষা!

গোড়ায় গলদ-এর মতন, বছর চার অথবা পাঁচ এ ধরিত্রীর অক্সিজেন গ্রহণকারী নবপ্রজন্মের এক সিংহভাগের শিক্ষা শুরু আজ ইংরিজি মিডিয়াম থেকে।

শিক্ষায় জন্ম যে ছেলেটার বাংলা মিডিয়ামে, তাঁর কদর সমাজে অপেক্ষাকৃত আজ অনেকাংশেই কম, এমনটাই একবিংশের ক্যানভাসে ফুটে ওঠা এক জীবন্ত চিত্র!

খুচরো হোক বা আস্ত, ইংরিজি বলে যতটা আত্ম-গর্বিত ও সোসাইটি এক কেলাস উঁচুতে উঠে গেল বলে আমরা মনে করি, এমন অনুভবটা বাংলার সাথে আমাদের সাক্ষাৎ করার একমাত্র স্থান হল যেন আই সি ইউ-তে!

আমদের বাহ্যিক আচরণ হয়তো বলে দেয় যে, আমরা ভুলতে বসেছি, আমরা শুদ্ধ বাঙালী ও আমাদের অবিচ্ছেদ্য নাড়ি আজও সংযুক্ত বাংলা মায়ের নাড়িতেই!

 

এক পরিচিত দৃশ্য হলেও, আন্তরিক সাক্ষাতে মানসিক প্রতিক্রিয়া বেশ কিছুটা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিল সেদিন!

খুব সম্ভবত বৃহস্পতি অথবা শুক্রবার ও বেলা তখন বারোটা-টারোটা বাজবে, হঠাৎ দেখি আমার বেশ কিছুটা সামনের দিক থেকে একটা বাধাহীন ও গতিশীল মালভূমি দুরন্ত গতিতে হনহনিয়ে আসছে এগিয়ে, 

কাছে আসতেই দেখি, পরম উত্তেজিত ও উৎফুল্ল আননের সুমন্তদা।

এক নাতিদীর্ঘ কথপোকথন আবিষ্কারে সক্ষমের ফলাফল এমন যে, তাঁর একমাত্র ছেলে এবারে নামী ইংরিজি মিডিয়াম ইস্কুলে ক্লাস থ্রি-তে দুশো ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে প্রথম হয়েছে!

অনুভব করলাম পুত্রের এরূপ সাফল্যে পিতার বুক গর্বে মালভূমি হওয়াটাই অতি স্বাভাবিক।

অগত্যা কর্তব্যের খাতিরে প্রশংসা বিনিময়ের মাধ্যমে মনে মনে ফেললাম এক দীর্ঘনিঃশ্বাস!

 

সমগ্র বিশ্ব জুড়ে ইংরিজির আধিপত্যে অনেক ভাষার'ই জীবন বিপন্নপ্রায়, এমনকি জাতিসংঘের কাজকর্মের ভাষাও সমস্ত ইংরিজিতে!

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস অথবা একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলা প্রেমের বিপুল আকস্মিক উন্মাদনা কিংবা পহেলা বৈশাখ বাংলায় দুটো-একটা স্ট্যাটাস....'আমি গর্বিত, আমি বাঙালি' ইত্যাদি.... ব্যস! 

অতঃপর সারাবছর রক্ষণাবেক্ষণবিহীন বাংলা-টা মুখ থুবড়ে পড়েই থাকে রাস্তার এক কোণায়!

দু'দিন পরেই বাংলায় কোন মাস ও বিশেষত কত তারিখ প্রভৃতি, সব মনের অন্ধকারের গভীরে যায় এক্কেবারে তলিয়ে!

চুড়ান্ত যত্নহীন ও অবিবেচক হয়ে নিজেদের ভাষার সম্মানকে প্রতিদিন ও প্রতিমুহূর্তে বাজারের সস্তা পণ্য বানিয়ে নির্দ্বিধায় এবং আফশোষহীনভাবে বেচে দিচ্ছি আমরা নিজেরাই!

আর ঠিক এভাবেই চলতে থাকলে, অদূর ভবিষ্যতে বাংলার মুন্ডুটা, ধড় থেকে ছিটকে গিয়ে পড়ে না রাজপথে খায় গড়াগড়ি! 

জনসংখ্যার হিসেবে বাংলা পৃথিবীর সপ্তম ও মধুরতম ভাষা হলেও, বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে বর্তমানের বুকে দাঁড়িয়েই তা দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রায় অনুপস্থিত বলাটাই যুক্তিসংগত।

তাঁর বর্ণময় ও দীর্ঘ কর্মজীবনে বহুমুখী প্রতিভার সমন্বয় ঘটিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলাকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়ে যে ছিলেন'ই, এ কথা তো আমরা জানি প্রায় অনেকেই, এখন প্রশ্ন হল, এই মর্যাদা রক্ষার বিষয়ে কপালে প্রকৃত দুশ্চিন্তার কালো মেঘের আবির্ভাব অন্ততপক্ষে সিংহভাগ বাঙালি'র হবে কবে?

ডুবন্ত বাংলা ভাষাকে বাঁচাতে প্রায় সমগ্র পৃথিবী জুড়ে ক'জন বিশেষত বাঙালি'ই বা আত্মাহুতি দিতে প্রস্তুত তাতে?

 

তন্ময় সিংহ রায়
কোলকাতা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top