সিডনী বুধবার, ১৭ই এপ্রিল ২০২৪, ৩রা বৈশাখ ১৪৩১

ঈশ্বর, নদী এবং অভিশাপ : নবনীতা চট্টোপাধ্যায়


প্রকাশিত:
৮ মার্চ ২০২১ ২১:৪২

আপডেট:
১৭ এপ্রিল ২০২৪ ০১:৪২


এই নদী একটু অন্য ধরণের। বুকের মধ্যে বয়ে নিয়ে যায়  এক অন্য ধরনের গল্প। আসলে প্রতিটি নদীই এক একটি নারীর মতো, অন্ত:করণে নাড়াচড়া করে অজস্র বর্ণমালা। জলের  হাঁসমুখে, স্রোতের উচ্ছ্বলতায় ঢেকে  রাখে সেই গল্প। সময়ের পলি পড়ে, কত চরিত্র আসে যায়। ব্যস্ত মানুষ খেয়াল ই করেনা নদীর না বলা গল্প । একদিন হঠাৎ করে এক উদাসী পথিক এসে নদীর জলের থেকে তুলে ফেলে এক পাললিক শিলা। খুলে যায় গল্পের সিংহদুয়ার।
নদীর নাম গন্ডোকী বা কালীগন্ডোকী। নেপালের অন্যতম প্রধান নদী। নেপালের পশ্চিমে উচ্চ হিমালয়ে ৬২৬৮ মিটার উচ্চতার গ্লেসিয়ার থেকে উৎপন্ন হয়ে ভারতবর্ষে  বিহারের পাটনার কাছে গঙ্গায় মিশেছে। নেপালের পৌরাণিক গাথা অনুযায়ী গন্ডোকী নামক এক বারবণিতার কাছে মধ্যরাতে এক সুদর্শন যুবক আসেন। তার শরীরে কুষ্ঠরোগ ছিল। এতটুকু ও  ঘৃণা না দেখিয়ে  গন্ডোকী তার সেবা করেন এবং সূর্য ওঠার আগেই তাকে বিবাহ করেন। সূর্য উঠবার পর যুবাপুরুষ মারা যান। তদানীন্তন প্রচলিত সতীদাহ প্রথা অনুযায়ী গন্ডোকী ও তার স্বামীর সাথে সহমরণের জন্য চিতায় আরোহণ করেন। চিতায় অগ্নিসংযোগ করার প্রাকমূহুর্তে গন্ডোকী লক্ষ্য করলেন তার স্বামীর দেহ সম্পূর্ণ স্বর্ণের হয়ে গেছে এবং তার চারটি হাত দেখা যাচ্ছে। হতবাক গন্ডোকীরকানে ভেসে এলো ভগবান বিষ্ণুর কন্ঠস্বর "আমি ভগবান বিষ্ণু । আমি তোমার ভালোবাসার পরীক্ষা নিতে এসেছিলাম। তুমি পরীক্ষায় পাস করেছ। তাই তোমায় আমি তিনটি বর দিতে চাই। বলো তুমি কি কি চাও?" গন্ডোকী বিনম্র কন্ঠে উত্তর দিলেন "তিনটি নয় প্রভু, আমার একটাই ইচ্ছা যে আপনি কখনো আমায় ছেড়ে যাবেন না।" ভগবান বিষ্ণু জানালেন "তথাস্তু, আমি অভিশাপগ্রস্ত হয়ে পাথরে পরিণত হয়েছি । তুমি এখনই গন্ডোকী নদীতে পরিণত হবে এবং আমি তোমার  বুকে আজীবন শালগ্রাম শিলা হয়ে ভেসে বেড়াব।"
গৌতমীয় তন্ত্রকথা অনুযায়ী গন্ডোকী নদীর ফিরে শালগ্রাম নামে এক বর্ধিষ্ণু অঞ্চল ছিল। এই শালগ্রাম অঞ্চলের যাবতীয় কালো শিলাকে শালগ্রাম শিলা বলা হতো। হিন্দু পুরাণ বলছে অন্য এক কাহিনী। ভগবান বিষ্ণু এক অভিশাপেই শালগ্রাম শিলায় পরিণত হয়েছিলেন। এই অভিশাপ এতোটাই শক্তিশালী ছিল যে ভগবান বিষ্ণু ও এড়াতে পারেননি তাঁর ভবিতব্যকে। কেননা এই অভিশাপ তাঁকে দিয়েছিলেন তাঁর একনিষ্ঠা ভক্ত এক অসামান্যা নারী, দৈত্যকন্যা ও অসুর জলন্ধরের পন্তিয়াচ বৃন্দা।
কি সেই কাহিনী? হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী অসুররাজ জলন্ধর (যার জন্ম হয়েছিল মহাদেবের তৃতীয় নয়ন থেকে) ক্রমশই মহাপরাক্রমাশালী হয়ে স্বর্গ মর্ত্য পাতাল এই ত্রিভুবন জয়ে অগ্রসর হয়ে ওঠেন। জলন্ধরের স্ত্রী ছিলেন বৃন্দা। বৃন্দার শারীরিক ও মানসিক পবিত্রতা এবং স্বামীর প্রতি একনিষ্ঠ প্রেম জলন্ধরের রক্ষাকবচ ছিল। জলন্ধরের কাছে শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয়ে স্বর্গের ছোট বর সব দেবতারা  এসে মহাদেবের শরণাপ্রার্থী হলেন। মহাদেব জানতেন তিনি জলন্ধরকে পরাজিত করতে পারবেন না, কেননা জলন্ধর তাঁর ই অংশ থেকে সৃষ্ট। তবু ও তিনি জলন্ধরের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে গেলেন। কিছুতেই জলন্ধরকে দমন করতে না পেরে দেবতারা এক ছলনার আশ্রয় নিলেন । ভগবান বিষ্ণু জলন্ধরের ছদ্মবেশে বৃন্দার কাছে গেলেন । ঘনিষ্ঠ মূহুর্তে বৃন্দা বুঝতে পারলেন তিনি যাকে স্বামী ভেবে ঘনিষ্ঠ হয়েছেন সে অন্যপুরুষ। তিনি তার পবিত্রতা হারিয়েছেন যে পবিত্রতা তার স্বামী জলন্ধরের রক্ষাকবচ ছিল । এই দুর্বল মূহুর্তের সুযোগে মহাদেব জলন্ধরকে হত্যা করলেন।  ক্রুদ্ধা, অপমানিতা, বিপর্যস্তা বৃন্দা সেই ছদ্মবেশধারী পুরুষকে তাঁর স্ব রূপ ধারণ করতে আদেশ দিলেন এবং প্রবল মনোবেদনায় লক্ষ্য করলেন যে দৈত্যকন্যা হয়েও তিনি যে ঈশ্বরের একনিষ্ঠা সাধিকা  স্বয়ং সেই ঈশ্বর ই তার সর্বনাশ করার জন্য ছলনার আশ্রয় নিয়েছেন। বৃন্দা তৎক্ষণাৎ ভগবান বিষ্ণুকে অভিশাপ দিলেন যে এই মূহুর্ত থেকে তিনি শিলায় পরিণত হবেন। বৃন্দা নিজেও আত্মঘাতী হতে চাইলেন। ভগবান বিষ্ণু নীরবে এই অভিশাপ গ্রহণ করলেন। সম্ভবত: তাঁর ও খুব খারাপ লেগেছিল একনিষ্ঠা ভক্ত কে প্রতারণা করতে। তিনি বৃন্দাকে বর দিলেন যে মৃত্যুর পর বৃন্দার শরীরের ছাই থেকে জন্ম নেবে একটি নতুন চারাগাছ, যার নাম তুলসী। শালগ্রাম শিলার স্ত্রী হবেন তুলসী। বিষ্ণুরূপে শালগ্রাম শিলার পূজা তুলসী। ছাড়া হবে না। এমন কি প্রসাদ ইত্যাদি নিবেদনের সময়ে ও  তুলসী পাতা লাগবে।
বিজ্ঞান ও ভূতত্ব অনুযায়ী নেপালের মুক্তিনাথের পথে প্রবাহিত গন্ডোকী নদীর বুকে ভেসে থাকা কুচকুচে কালো রঙের শিলা যা ভাঙলে ভেতরে আমোনাইটের ফসিল  পাওয়া যায়  তা হল একধরনের আমোনাইট গোষ্ঠীর জীবাশ্ম। লক্ষ লক্ষ বছর আগে হিমালয় যখন সমুদ্রের নীচে ছিল তখন এরা এককোষী জলজ প্রাণী ছিল। সৃষ্টির আদিতে পৃথিবী ছিল এক জ্বলন্ত অগ্নিগোলক। ধীরে ধীরে ঠান্ডা হবার পর জল, পাথর, মাটি ইত্যাদির সৃষ্টি হয়। সেই অগ্নিগোলক থেকে প্রাণীর বাসযোগ্য হতে সাড়ে চার মিলিয়ন বছর লেগেছে। এখন যেখানে হিমালয়  সেইসময় সেখানে ছিল টেথিস মহাসাগর। টেথিস মহাসাগরে পরবর্তীকালে সৃষ্টি পৃথিবীর প্রথম প্রাণী  একধরণের সামুদ্রিক এককোষী জীব যারা কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করত এবং অক্সিজেন ছাড়ত। পরবর্তীকালে  ক্রম:বিবর্তনের ফলে এই জীব নিশ্চিহ্ন হয়ে সমুদ্রের তলদেশে চলে যায়। যুগের পর যুগ পলি পড়ে এরা শালগ্রাম শিলায় পরিণত হয় কিন্তু  পাথরের মাঝে থেকে যায় তাদের সর্পিল পাকানো আকৃতির দেহাবশেষের ছাপ।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে শালগ্রাম শিলা স্বয়ং নারায়ন। শ্রীবিষ্ণুর প্রতীক চিহ্ন। একমাত্র ব্রাক্ষণরাই এই শালগ্রাম শিলা পূজা করতে পারেন। প্রতিটি গৃহে পূজা পার্বণ, বিবাহ ইত্যাদি সময়ে পুরোহিত মশাই তামার টাটে শালগ্রাম শিলা নিয়ে আসেন এবং নিষ্ঠা ভরে পূজা হয়। এই শিলার পূজা তুলসীপাতা ও শ্বেতচন্দন সহকারে হয়। ভারতে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে সবচেয়ে বৃহৎ আকারের শালগ্রাম শিলা দেখতে পাওয়া যায়। ভারতের বাইরে স্কটল্যান্ডের ইস্কনের মন্দিরে ও একটি বৃহৎ শালগ্রাম শিলা আছে। হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে শালগ্রাম শিলা নিয়মিত পূজা করলে ধনলাভ, সুরক্ষিত জীবন, সুস্বাস্থ্য, আধ্যাত্বিক চরনের বিবাহ হয়।
চারপাশে ঝুঁকে পড়া পাহাড়ের সারি নিয়ে সশব্দে গর্জন করতে করতে বয়ে চলছে গন্ডোকী নদী। ঈষৎ কালচে রঙের জল নদীর। যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর  সর্বক্ষেত্র থেকে তীর্থযাত্রীরা  আসেন এই পূন্যসলিলার তীরে। শুধু নদী জানে কিভাবে বয়ে যেতে হয় বুকে বিশ্বাসহীনতার যন্ত্রনা নিয়ে। কেননা বহমানতার আর এক নাম জীবন।

ছবিঃ ইন্টারনেট থেকে

 

নবনীতা চট্টোপাধ্যায়
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top