সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

এক মানবিক 'মা' : ডঃ সুবীর মণ্ডল


প্রকাশিত:
৬ এপ্রিল ২০২১ ১৮:৪৭

আপডেট:
১৯ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:১১

 

অতি সাদা -মাটা চেহারা। শহুরে কোন জৌলুস নেই,  সাধারণ পোশাক, অথচ আচার- আচরণে মার্জিত রুচির ছাপ। বুদ্ধিদীপ্ত চোখের চাহনি। গভীর প্রত্যয়ের ছাপ মুখজুড়ে। সম্ভ্রম আদায় করে শারীরিক ভাষা। আলাপচারিতায় একটা ব্যক্তিত্বের  ছাপ ফুটে  উঠছিল।  অফিস জুড়ে কেজো মানুষের ভিড়। ভর দুপুরে আটপৌরে এক ভদ্র মহিলা পাসপোর্ট অফিসে এসেছেন পাসপোর্ট করাতে। লম্বা লাইনের শেষে পৌঁছলেন এক অফিসারের  সামনে। 

অফিসার জানতে চাইলেন, আপনার পেশা কী?
মহিলা বললেন, আমি একজন মা।
-- আসলে, শুধু মা তো কোনো পেশা হতে পারে না। যাক, আমি লিখে দিচ্ছি আপনি একজন গৃহিণী ।
মহিলা খুব খুশী হলেন। পাসপোর্টের কাজ কোনো ঝামেলা ছাড়াই শেষ হলো। মহিলা সন্তানের চিকিৎসা নিতে বিদেশ গেলেন। সন্তান সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে এলো।

অনেকদিন পরে, মহিলা দেখলেন পাসপোর্টটা নবায়ন (রিনিউয়াল) করা দরকার, যেকোনো সময় কাজে লাগতে পারে। আবার পাসপোর্ট অফিসে আসলেন। দেখেন আগের সেই অফিসার নেই। খুব ভারিক্কী, দাম্ভিক, খিটখিটে  মেজাজের একজন  লোক বসে আছেন। 
যথারীতি ফরম পূরণ করতে গিয়ে অফিসার জানতে চাইলেন-- আপনার পেশা কী ?
মহিলা কিছু একটা বলতে গিয়েও একবার থেমে গিয়ে বললেন-- আমি একজন গবেষক। নানা রকম চ্যালেঞ্জিং প্রজেক্ট নিয়ে বিভিন্ন দেশে  কাজ করি। শিশুর মানসিক এবং শারীরিক  বিকাশ সাধন ও পর্যবেক্ষণ করে সেই  অনুযায়ী পরিকল্পনা প্রণয়ন করি। বয়স্কদের নিবিড় পরিচর্যার দিকে খেয়াল রাখি। সুস্থ পরিবার ও সমাজ বিনির্মাণে নিরলস শ্রম দিয়ে রাষ্ট্রের কাঠামোগত ভিত মজবুত করি। প্রতিটি মুহূর্তেই আমাকে নানারকমের চ্যালেঞ্জের ভিতর দিয়ে যেতে হয় এবং অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তা মোকাবিলা করতে হয়। কারণ, আমার সামান্য ভুলের জন্য যে বিশাল ক্ষতি হয়ে যেতে পারে ! আগামী প্রজন্মের শিশু,শিক্ষা,  স্বাস্থ্য,  অধিকার ও গর্ভবতী মায়েদের পরিষেবা  নিয়ে  গবেষণা করতে  হয় । এ-জন্য বিদেশে যেতে  হয়।  

মহিলার কথা শুনে অফিসার একটু নড়ে চড়ে বসলেন। মহিলার দিকে এবার যেন একটু শ্রদ্ধা আর বিশেষ নজরে তাকালেন । এবার অফিসার জানতে চাইলেন-- আসলে আপনার মূল পেশাটি কী ? যদি আরেকটু বিশদভাবে বলতেন । লোকটির আগ্রহ এবার বেড়ে গেলো।

মহিলা বলেন-- আসলে, পৃথিবীর গুণী জনেরা বলেন, আমার প্রকল্পের কাজ এতো বেশি দুরূহ  আর কষ্টসাধ্য যে, দিনের পর দিন আঙুলের নখ দিয়ে সুবিশাল একটি দীঘি খনন করা নাকি তার চেয়ে অনেক সহজ।
আমার রিসার্চ প্রজেক্ট তো আসলে অনেকদিন ধরেই চলছে। সর্বক্ষণ আমাকে ল্যাবরেটরি এবং ল্যাবরেটরির বাইরেও কাজ করতে হয়। আহার, নিদ্রা করারও আমার সময়ের ঠিক নেই। সব সময় আমাকে কাজের প্রতি সজাগ থাকতে হয়। দুজন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অধীনে মূলত আমার প্রকল্পের কাজ নিরবিচ্ছিন্নভাবে চলছে।
(মহিলা মনে মনে বলেন,দুজনের কাউকে অবশ্য সরাসরি দেখা যায়না। একজন হলেন আমার স্রষ্টা, আরেকজন হলো আমার বিবেক)
তিনি বলে চলেন-- আমার নিরলস কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ  আমি তিনবার স্বর্ণপদকে ভূষিত হয়েছি। (মহিলার তিন জন কন্যা সন্তান ছিল।)
এখন আমি সমাজবিজ্ঞান,স্বাস্থ্যবিজ্ঞান আর পারিবারিক বিজ্ঞান-- এ তিনটি ক্ষেত্রেই একসাথে কাজ করছি, যা পৃথিবীর সবচেয়ে জটিলতম প্রকল্পের বিষয় বলা যায়। প্রকল্পের চ্যালেঞ্জ হিসাবে একটি আর্টিস্টিক শিশুর পরিচর্যা করে মানুষ হিসাবে গড়ে তুলছি, প্রতিটি মুহূর্তের জন্য।

‘ঊষর মরুর ধূসর বুকে, ছোট্ট যদি শহর গড়ো,
একটি শিশু মানুষ করা তার চাইতেও অনেক বড়।‘

অফিসার মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে মহিলার কথা শুনলেন। এ যেন এক বিস্ময়কর মহিলা। প্রথমে দেখে তো একেবারে পাত্তাই দিতে ইচ্ছে হয়নি।

মহিলা বলে চলেন-- প্রতিদিন আমাকে ১৪ থেকে ১৬ ঘন্টা, আবার কোনো কোনো দিন আমাকে ২৪ ঘন্টাই আমার ল্যাবে কাজ করতে হয়। কাজে এতো বেশি ব্যস্ত থাকতে হয় যে, কবে যে শেষবার ভালো করে ঘুমিয়ে ছিলাম কোনো রাতে, তাও আমার মনে নেই। অনেক সময় নিজের আহারের কথা ভুলে যাই। আবার অনেক সময় মনে থাকলেও সবার মুখে অন্ন তুলে না দিয়ে খাওয়ার ফুরসত হয় না । অথবা সবাইকে না খাইয়ে নিজে খেলে পরিতৃপ্তি পাই না। পৃথিবীর সব পেশাতেই কাজের পর ছুটি বলে যে কথাটি আছে, আমার পেশাতে সেটা একেবারেই নেই। ২৪ ঘন্টাই আমার অন কল ডিউটি।

এরপর আমার আরো দুটি প্রকল্প আছে । একটা হলো বয়স্ক শিশুদের ক্লিনিক, যা আমাকে নিবিড়ভাবে পরিচর্যা করতে হয়।সেখানেও প্রতি মুহূর্তে শ্রম দিতে হয়। আমার নিরলস কাজের আর গবেষণার কোনো শেষ নেই।

আপনার হয়তো বা জানতে ইচ্ছে করছে, এ চ্যালেঞ্জিং প্রকল্প পরিচালনায় আমার বেতন কেমন হতে পারে। আমার বেতন-ভাতা হলো-- পরিবারের সবার মুখে হাসি আর পারিবারিক প্রশান্তি। এর চেয়ে বড় অর্জন আর বড় প্রাপ্তি যে কিছুই নেই।
এবার আমি বলি, আমার পেশাটি কী ?
আমি একজন মা। এই পৃথিবীর অতি-সাধারণ এক মা। মা-এক চিরন্তন আশ্রয়ভূমি,  প্রেরণাভূমি, মায়ের কোন জাত নেই, কোন ভৌগোলিক সীমায় বাঁধা  রাখা যায়  না। পরিচয়  শুধুমাত্র 'মা'।  মহিলার কথা শুনে অফিসারের চোখ জলে ভরে আসে। অফিসার ধীরে ধীরে চেয়ার ছেড়ে ওঠেন। নিজের মায়ের মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তিনি খুব সুন্দর করে ফর্মের সব কাজ শেষ করে, মহিলাকে স্যালুট দিয়ে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেন। তারপর নিজের অফিস রুমে এসে, একটি ধূসর হয়ে যাওয়া ছবি বের করে, ছবিটির দিকে অপলক নয়নে  চেয়ে থাকেন। নিজের অজান্তেই চোখের জল টপ টপ করে ছবিটির ওপর পড়তে থাকে ।

আসলে "মা" এর মাঝে যেমন নেই কোনো বড় উপাধির চমক, তেমনি নেই বড় কোনো পেশাদারিত্বের করপোরেটের জমকালো   চকচকে ভাব। কিন্তু কত সহজেই পৃথিবীর সব মা নিঃস্বার্থ ভাবে প্রতিটি পরিবারে নিরলস শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। মাতৃত্বের গবেষণাগারে প্রতিনিয়ত তিলে তিলে গড়ে তুলছেন এক একটি মানবিক নক্ষত্র'মা '। মাধূর্যমাখা বহুমাত্রিক অর্থবোধক শব্দ।  আমাদের লালনভূমি, আশ্রয়ভূমি, প্রেরণাভূমি,  দেশ- কালের সীমায় মাকে  কখনো  বাঁধা যায় না। একমাত্র  পরিচয় শুধুই মা।
সেই মা সবচেয়ে খুশি হন যিনি সন্তানের জন্য  নিজেকে  উড়ার করে দেন।         

তথ্যসূত্র—সংগৃহীত

 

ডঃ সুবীর মণ্ডল
বাঁকুড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত     

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top