সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

নীল পাহাড়ের চূড়ায় (পর্ব পনের) : শাহান আরা জাকির পারুল 


প্রকাশিত:
৭ এপ্রিল ২০২১ ২০:৩২

আপডেট:
১৯ এপ্রিল ২০২৪ ০৭:০৬

ছবিঃ নীল পাহাড় এবং লেখিকা শাহান আরা জাকির পারুল 

 

কিছুক্ষনের মধ্যেই আমরা আমাদের বাড়িতে এসে পৌছুলাম।

আমার রুমটি একদম আগের মতোই পরিপাটি দেখে চোখে আপনা আপনিই পানি চলে এলো।

পরিপাটি বিছানা।

খাটের পাশে সাইড টেবিল এ ফুলদানিতে সাজানো টাটকা গাঁদা আর রজনীগন্ধা! মৌ মৌ করছে গন্ধ সারা ঘর জুড়ে।

বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলো। কি সুখেরই না ছিল আমার দিনগুলো।

- কি, ননোদিনী। তোমার রুমটায় সব ঠিকঠাক পেয়েছতো।
- ভাবী, তুমি আমার লক্ষী ভাবি।
- তুমিও আমার লক্ষী বোন নিতু! আমার বোন নেই! তুমিইতো আমার বোন সোনা।

ভাবীর এরকম সোনা ডাকের আদর আমায় তার খুব কাছে টানতো! আমার ও কোন বোন নেই । বড় ভাবীকে তাই আমার বড় বোন মনে হতো ।

- এসো হালকা কিছু মুখে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে।
- প্লিজ ভাবী,এখন কিছু খেলে নির্ঘাত আমার বমি হয়ে যাবে।
- ওরেব্বাবা, থাক থাক। তাহলে দরকার নেই! মুখ হাত ধুয়ে ফ্রেস হয়ে ঘুমিয়ে পর কেমন।
- ওকে ভাবী।

সেদিন কি গভীর ঘুমই না হয়েছিল আমার।

কেউ ডাকেনি! প্রায় এগারোটার দিকে ঘুম ভাঙলো।

খুব হৈচৈ করে সারাদিন কাটলো!রাতে ফোন করলো সুমন! এবার আর কিছু চেপে রাখতে পারলামনা। হড়হড় করে সব ঘটনা বলে দিলাম সুমনকে।

সুমন অনেক বোঝালো আমায়! আমি সব ভুলে গেলাম।

এর মধ্যে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুব খারাপের দিকে যেতে লাগলো। অসহযোগ আন্দোলন! শেখ মুজিবুর রহমান এর গ্রেফতার পরোয়ানা! স্বাধীনতা আন্দোলন চরম পর্যায়ে।

মিছিল মিটিং এর খবর প্রতিদিন রেডিওতে প্রচার হচ্ছে।

৭ই মার্চ শেখ মুজিব তার ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়ে দেশবাসিকে পাকিস্তান শাসকের বিরুদ্ধে লড়াই এর জন্য প্রস্তুতি নিতে আহ্বান জানালেন।

প্রায় পাঁচ মাস হয়ে গেল বাবার বাড়িতে আসার। শাশুড়ি খুব চাপ দিতে লাগলেন তাদের বাড়িতে যাবার জন্য।

সুমন বারবার বারণ করলো।

বাবা ও ভাইয়াকে নিষেধ করলো,ওদের বাড়িতে পাঠানোর।

কিছুতেই শাশুড়ি মানছিলেন না।

এর মধ্যে বলা নেই, কওয়া নেই হঠাৎ সুমন এসে হাজির।

চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছে। দেশের এমন পরিস্থিতিতে সুমন এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশে ফিরে এসেছে।

দেশের এই ক্রান্তিকালে বসে থাকলে চলবেনা! চুপি চুপি রাজনৈতিক বন্ধুদের সাথে মিটিং সভা করতে লাগলো।

আমাদের বাড়িতেই থাকে।

একদিন শাশুড়ি এসে হাজির!আমাকে পারলে জোড় করে নিয়ে যায় তাদের বাড়িতে।

সুমন এসে সামনে দাঁড়ায়।

সঙ্গে ছিলেন আমার বড় ভাসুর। নিয়ে যেতে পারলোনা বলে,যাবার সময় চোখ রাঙিয়ে কিসের নোংরা ইঙ্গিত দিয়ে গেলেন আমার ভাসুর।

কচি বয়স অতশত বুঝতে পারিনি।

মার্চ এর শেষ সপ্তাহে প্রচন্ড গোলাগুলি শুরু হলো শহরের মধ্যে। লোকজন যার যার বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে লাগলো যার যার গ্রামের দিকে।

সুমনের দাদাবাড়ি ছিল গ্রামে। বিশাল বাড়ি!লোকজন পাহারায় থাকে ।

ফসলের সময় আমার শাশুড়ি সেখানে যান।

সুমন আমাদের সবাইকে সেখানে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়।

আমার বেবি তখন প্রায় সাতমাসের পেটে।

কোন যানবাহন ছিলনা।

গোলাগুলির মধ্যে সবাই এক কাপড়ে রওয়ানা হলাম আমরা সুমনের দাদাবাড়ির দিকে।

খুব কস্ট হচ্ছিলো আমার হাঁটতে।

রাস্তায় বহুদিন পর দেখা হলো তোদের সাথে নীলিমা।

- হুঁ । সেদিন তোকে দেখে আমারও খুব কষ্ট হচ্ছিলো বন্ধু। কান্না পাচ্ছিলো খুব! সুমন ভাইকেও দেখছিলামনা। ভেবেছি উনি বিদেশে। তোর খুব কস্ট হচ্ছিলো হাঁটতে! খালাম্মা, খালুজিও খুব অসুস্থ ছিলেন।

কিছুই করতে পারি নাইরে সেদিন। যে যার জীবন নিয়ে পালাচ্ছিলাম আমরা।

- তারপর কখন কোথায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম আমরা।
- একদম তাই। আর খোঁজ পাইনি আমরা কেউ কারো।
- তারপর কি হলো বল নিতু।

তারপরের ইতিহাস খুবই মর্মন্তুদ নীলু।

দুদিন ধরে পায়ে হেঁটে, কখনো গরুর গাড়িতে চড়ে আমরা শেষমেষ সুমন এর দাদুবাড়িতে এসে পৌছুলাম।

সত্যিই আলিশান বাড়ি।

দুইতলা টিনের ঘর লাগানো একতলা বিশাল বিল্ডিং।

কাজের লোকের অভাব নেই।

খুব ধুমধাম করে রান্নাবান্না,খাওয়া দাওয়া চলতে লাগলো!বহু নিরাশ্রয় মানুষকেও আশ্রয় দেয়া হলো মাঝে মাঝে।

আমাদের পুরো পরিবারই এখানে আশ্রয় নিলো।

বিষয়টা আমার শাশুড়ি ও বড় ভাসুর খুব ভালো চোখে দেখলেন না বোঝা গেলো।

সুমন এর করা নির্দেশ ছিল তারা সবাই এখানেই থাকবেন।

সুমন চুপি চুপি মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে নেয়।

বাড়ির লোক প্রথমে বুঝতে পারে নাই।

আমার শশুর বাবা জানতেন সব। তিনি গোপন রেখেছিলেন!সুমনের সহায়তায় বড় ভাইয়া ও ছোট ভাইয়াও মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিলেন।

রাত বিরাতে সুমন দু একজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে বাড়িতে আসতো!গোপনে আমার সাথে দেখা করে চলে যেত!বড় ভাইয়া ও মেজো ভাইয়াও আসতেন চুপি চুপি।

একদিন আমার বড় দুই ভাসুর টের পেয়ে গেলেন।

তারা রাজাকার আলবদর বাহিনীর কমান্ডার হয়ে পাক আর্মিদের সাথে হাত মিলিয়ে ফেলেছিলো।

এরপরের ঘটনা খুব মর্মান্তিকরে নীলু।

হু হু করে কেঁদে ফেলে নিতু।

হটাৎ চারপাশের গাছপালাগুলোও দুলে ওঠে যেন।

নীলপাহাড় এর চূড়ায় সব গাছপালা উথাল পাথাল করে বইতে থাকে।

ধুলো ঝড় উড়িয়ে নিতে চায় চারপাশ।

নীলিমা নিতুকে নিয়ে ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে দেয়।

নিতু নীলিমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে!নীলিমা কোন বাধা দেয়না।

বাঁধভাঙা জোয়ারের জলে নিতুর দুচোখ যেন ভেসে যেতে চায়!বৃষ্টি নামে মুষলধারে। দু বন্ধুই দুজনকে জড়িয়ে বুক ভাসিয়ে কান্না করে। বৃষ্টির টাপুর টুপুর শব্দে তাদের কান্নার শব্দও হারিয়ে যায়।

চলবে

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top