সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

সুহাস ও রঙিন প্রজাপতি : ফারুক নওয়াজ


প্রকাশিত:
১৪ এপ্রিল ২০২১ ২০:৫২

আপডেট:
১৪ এপ্রিল ২০২১ ২১:২৪

ছবিঃ ফারুক নওয়াজ

 

দু’পাশে গভীর বন। মাঝখান দিয়ে সরু পথ চলে গেছে দূর-বহুদূর। তারপরে মাঠ। মাঠের নাম আঠারখাদা। সেই মাঠ পার হয়ে যে সবুজ সুন্দর গ্রাম-নাম তার কাজলপুর।

কাজলপুরের সুহাস।

সুহাস মানে যার হাসি সুন্দর। হ্যাঁ, সুহাসের হাসি দারুণ মিষ্টি। কোকড়া চুল। টানা টানা চোখ কাজলবরণ গায়ের রঙ। বাঁশি বাজাতে পারে মোহন সুরে। এতো গুণ যে ছেলেটির সে কেন এতো দুখি?

সুহাসের বাবা নেই। বাবা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ এ বছর দেশের ডাকে ছুটে যান সুহাসের বাবা যুদ্ধ করতে।

রাতে। গভীর রাতে। সুহাস তখন হয়নি। মায়ের নাম সোহেলি। সোহেলি পাখির নাম। মিষ্টি গানের পাখি। মাও যেন গানের পাখি। সুহাস মাকে ভোলেনি। এখনো তার মুখটা ভেসে ওঠে সুহাসের স্মৃতিতে। ওকে গান করে করে ঘুম পাড়াতো মা।

সুহাসের মা নেই। ও তখন বছর ছয়েকের শিশু। হঠাৎ করে মা মারা গেল। সুহাস তখন নানার বাড়িতে। মা যেন কি একটা অসুখে অনেক ভুগে শেষমেশ মারা যানয়। ছোট হলেও মাকে হারিয়ে মনটা হু হু করে ওঠে। অনেক দিন মায়ের জন্য মন খারাপ করেছেন তার। তারপর ধীরে ধীরে মায়ের শোক ভুলে যায়। এমনই হয়। মানুষকে সব দুঃখ ভুলে যেতে হয়। সুহাসও তো মানুষ।

আর সুহাসের বাবা। নাম তার মনজেল। সুহাস তার মামা খালাদের কাছে শুনেছে একাত্তরের এক পূর্ণিমা রাতে বাপ চলে যায় যুদ্ধে। তার মাকে বলে যায়, আমি যুদ্ধে যাই, তুমি থেকো। দেশ স্বাধীন হলে ফিরবো। আর যদি নাই ফিরি-দুঃখ করো না। আল-াহর দুনিয়ায় কতো দুঃখ নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকে-তুমিও বেঁচে থাকবে। যদি আমাদের কোনো সন্তান হয় তার নাম রাখতে সুহাস।

বাবার কোনো ছবি নেই যে সুহাস সেটা দেখে বাবার চেহারা কেমন ছিলো জানবে।

দেশ ঠিকই স্বাধীন হলো, বাবা ফিরে আসে নাই। বাবার অপোয় থেকে থেকে মায়ের কঠিন অসুখ হলো। সেই অসুখেই সুহাসের দুখি মা চিরতরে হারিয়ে গেল।

সেই সুহাস এখন দশ বছরের বালক। নানা বেঁচে নেই। মামারা গরিব। কি আর করা! কাজলপুরের কাজী বাড়িতে সুহাস কাজ করে। সারাদিন কাজীদের গরুগুলো আগলে রাখে। নিয়ে যায় আঠারখাদা মাঠে। দিন শেষে সূর্য ডুবুডুবু হওয়ার আগে গরু নিয়ে ফিরে যায় কাজীদের গোয়ালে।

হেমন্তের মাঝামাঝি কোনো একটা মায়াবি বিকেল। সুহাসের হাতে বাঁশের বাঁকানো বাঁশি। গরুগুলো চড়ে বেড়াচ্ছে মাঠে। বাঁশিটা বাজাতে বাজাতে সুহাস থেমে যায়। থামারই কথা। সুহাসের চোখ ঝিলকে ওঠে মেয়েটাকে দেখে। এতো সুন্দর পরীর মতো মেয়ে সে কখনোই দেখেনি। সুন্দর কোকড়ানো ঢেউ ঢেউ চুল। গায়ের বরণ হলুদ মাখা পরী। কেমন ময়ূর পেখমের মতো জামা গায়ে। মেয়েটা এই মাঠের  দিকে আসছে।

সুহাস তাকিয়ে থাকে ফ্যাল ফ্যাল করে। মেয়েটা যেন সুহাসের ভ্যালভেলে তাকানো দেখে একটু হাসে। মেয়েটা আরো কাছে আসে। সুহাস তখনো তাকিয়ে। তার মনে হয়-আহা এই মেয়েটি যদি আমার বোন হতো!

মেয়েটা সুহাসের এমন অবাক তাকানো দেখে আবারো হাসে। এক সময় অনেক কাছে এসে প্রশ্ন করে, তুমি আমাকে দেখে কি অবাক হচ্ছো?
হ্যাঁ, সুহাস মাথা দোলায়।

হাসে মেয়েটি। কেন?

সুহাসে কথা বলে না।

মেয়েটি আবারো হাসে। বলে, তুমি কি আমরা বন্ধু হতে চাও?

সুহাস মাথা দুলিয়ে বলে, তুমি আমার বোন হবে? মেয়েটি হাসে। কি যেন ভাবে মেয়েটি। পরে বলে, হতে পারি তোমার বোন। তবে একটা শর্ত।

কি শর্ত? সুহাস জানতে চায় বিনম্র স্বরে। শর্ত হচ্ছে-আমাকে একটা রঙধনু রঙ প্রজাপতি এনে দিতে হবে। এমন প্রজাপতি আমাদের ঢাকা শহরে পাওয়া যায় না।

মেয়েটির শর্তে সুহাস হ্যাঁ-না কিছুই না বলে বললো, আমি চেষ্টা করবো তোমাকে খুশি করার। মেয়েটি আবারো হেসে বললো, তুমি চেষ্টা করো। আমি সন্ধ্যার আগে এ পথ দিয়েই ফিরে যাবো শহরে। ফেরার পথে তোমার রঙধনু রঙ প্রজাপতি পেলে আমি তোমার বোন হতে পারি।

মেয়েটি চলে গেলো, সুহাসও মাঠের পাশে কাশবনে ছুটে যায় প্রজাপতির খোঁজে।

কাশবনে কোনো প্রজাপতি নেই। পাশের মৌরিবনে যায়। সেখানে অনেক প্রজাপতি। নীল ডানার লাল রঙের। হলুদ আর গোলাপি রঙের মিশেল প্রজাপতি, কালো ভ্যালভেটের মতো প্রজাপতি-অনেক প্রজাপতি আছে, কিন্তু রঙধনুর সাত রঙের প্রজাপতি একটাও নেই।

সুহাসের মন খারাপ হয়ে যায়। দুঃখ দুঃখ মনে সে মৌরি বনের শেষে মহুয়া গাছে হেলান দিয়ে বাঁকানো বাঁশের বাঁশিতে কষ্ট কষ্ট এক মোহন সুর তুলতে থাকে।

এমন ব্যথা ব্যথা সুর শুনে মহুয়া গাছের ডালপালা নড়েচড়ে ওঠে।

সুহাস-তোমার এতো দুঃখ কিসের? মহুয়া গাছ কথা বলে ওঠে।

সুহাস এদিক ওদিক তাকায়। কই কেউ তো নেই। আবারো মহুয়া গাছ কথা বলে ওঠে। সুহাস আমি মহুয়াগাছ। তোমার মনে এতো কষ্ট কেন? তোমার বাঁশিতে বেদনার সুর যে! আমাকে বলো-যদি তোমার কষ্ট কিছুটা লাঘব করতে পারি।

এবার সুহাস ঘাড় ঘুরিয়ে মহুয়া গাছের উঁচু ডালের দিকে তাকায়।

সুহাস হাসে। কষ্টের হাসি।

কি বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি আমাকে? তুমি এমন করে হাসলে-যেন আমি তোমার কোনো উপকারই আসতে পারবো না। এবার সুহাস যেন মহুয়া গাছকে বন্ধু ভাবলো। জানালো তার মনের গোপন কথাটা। সুহাস বললো, বন্ধু মহুয়া গাছ-পরীরা মতো এক সুন্দর মেয়ে এসেছে এই গাঁয়ে। সে আমার বোন হতে পারে যদি তাকে একটা রঙধনু রঙ প্রজাপতি উপহার দিই। কিন্তু কোথাও এমন প্রজাপতি নেই।

মহুয়া গাছ তার কথাটা মন দিয়ে শোনে। একটু চিন্তা করে। তারপর হাসে। হেসে বললো, ও এই কথা। তবে বোন হতে কোনো শর্ত কেউ দেয় না। যারা শর্ত দিয়ে বন্ধুতা পাতায়, বা ভাইবোন হতে চায়-তারা কোনো দিনই আপন হয় না। সুহাস মহুয়া গাছকে তবুও অনুরোধ করলো। দেখো, তোমার এতো সব নীতিকথা আমাকে তৃপ্ত করতে পারছে না। আমি একটা রঙধনু রঙ প্রজাপতি চাই।

কি আর করে মহুয়া গাছ। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ঠিক আছে। আমি চেষ্টা করে দেখি পাওয়া যায় কি না।

এই বলে মহুয়া গাছ ফুর ফুর বাতাসে নেচে উঠলো। তার জলপাই রঙ পাতাগুলো ঝিরঝির হওয়া ময়ূরের পেখমের মতো মেতে উঠলো। এভাবে মহূর্তেই ফুলে ফুলে ভরে উঠলো পুরো গাছ।

আর সেই ফুলের মধু মধু ঘ্রাণে কোত্থেকে ঝুনঝুন করে পাখা নাচিয়ে উড়ে এলো অনেক প্রজাপতি নানা রঙের প্রজাপতি।

সুহাস হঠাৎ দেখে এতো প্রজাপতির মধ্যে একটা রঙধনু রঙ অপরূপ সুন্দর প্রজাপতিও আছে। কিন্তু ওটা সে পাবে কিভাবে। একেবারে গাছের উঁচু ডালে ফুলের উপর গিয়ে বসেছে ওটা। এমন ভাবনা মনের মধ্যে লুকোচুরি খেলতেই সুহাসকে অবাক করে প্রজাপতিটা এসে তার বাঁশির ওপর বসে।

সুহাস বাঁশিটা বাঁ হাতে নিয়ে ডান হাতটা পেতে দেয়। প্রজাপতিটা সুহাসের হাতে এসে বসে। যেন সে সুহাসের জন্যই এসেছে। সুহাসের মুখে ঝিলকে ওঠে সব পেয়েছির আনন্দ। সুহাস ছুটতে ছুটতে এসে দাঁড়ায় মাঠের শেষে যেখানে মেঠো পথটা এসে মিশেছে কাঁচা রাস্তায়। সে রাস্তা দিয়ে ঢেউ খেলানো চুলের মেয়েটা শহরের দিকে যাবে।

সুহাস দাঁড়িয়ে থাকে। হাতে তার রঙধনু প্রজাপতিটা পাখা দুলিয়ে দুলিয়ে বাতাসের সঙ্গে খেলা করে যাচ্ছে।

সুহাস অধীর অপোয় দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা আসলে হাসি মুখে সে প্রজাপতিটা তাকে উপহার দেবে। বিনিময়ে মেয়েটা মিষ্টি হেসে বলবে- আজ থেকে তুমি আমার ছোট ভাই।

তখন সূর্যটা হেলে পড়ে পশ্চিমে। সন্ধ্যার ধূসরতা ছাপিয়ে আসছে। গরুগুলোও ঘরে ফেরার জন্য সুহাসের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।

তাহলে কি মেয়েটা এ পথে ফিরবে না। মনে মনে একথা ভাবতেই বাতাস তার কানে কানে বললো সুহাস তুমি বাড়ি ফিরে যাও। কারণ, মেয়েটি এ পথে আসবে না। সে হয়তো তোমার কথা ভুলে গেছে। সে এতোণে হয়তো শহরে তার বাড়ির কাছাকাছি চলে গেছে।

সুহাসের বিশ্বাস হয় না। সে বাতাসের একথা মেনে নিতে পারে না। সে প্রতিবাদ জানায়-না, কনো না। আমি তার জন্য রঙধনু রঙ প্রজাপতি যোগাড় করে এনেছি। এমন প্রজাপতি তার খুব প্রিয়। সে আসবেই এবং এই সুন্দর প্রজাপতি উপহার পেয়ে সে আমাকে ভাই বলে ডাকবে তার সুন্দর মিষ্টি কণ্ঠে। বাতাস এবার ঝিরঝির করে হেসে ওঠে, সত্যিই সে আসবে না। আমি তাকে চলে যেতে দেখেছি কুসুমপুরের লাল ইট বিছানো রাস্তা দিয়ে। একটা সবুজ রঙের গাড়িতে সে চলে গেছে। গাড়িতে তার ছোট্ট ভাইটিও ছিলো।

না, সে গেলে এই পথ দিয়েই যেতো।

সুহাসের এমন কথায় বাতাস আবারো রিনরিন করে কথা বলে উঠলো-কথাটা ঠিক নয়। কারণ, কুসুমপুরের শ্যামল বিলে সে পাখি দেখতে এসেছিলো। বিলের পাড়েই তাদের গাড়িটা ছিলো। সেখানে গাড়িটা রেখে সে গ্রাম দেখতে বেরিয়েছিলো। মাঠপারের গ্রাম দেখে সে যখন মেঠো পথ দিয়ে ফিরে যাচ্ছিলো তখনই তার সাথে তোমার দেখা হয়েছিলো।

তবে কি সে তার কথা রাখবে না? আমি যে তার জন্য রঙধনু প্রজাপতি এনেছি?

বাতাস তার এ প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে শনশন করে আঠারখাদা মাঠের ওপর দিয়ে কাশবনে কাঁপন তুলে মিলিয়ে যায় দূরে আরো দূরে...।

এক সময় সন্ধ্যা আরো আঁধার হয়ে এলো। সুহাস তখনো মাঠের শেষে দাঁড়িয়ে ছিলো, না গরুগুলো নিয়ে কাজলপুরের কাজীদের গোয়ালের দিকে গেলো তা জানি না। তবে প্রজাপতিটাকে মহুয়া বনের দিকে উড়ে যেতে দেখেছে আলোর পাখি জোনাকিরা। আর সুহাসের বাঁশির করুণ সুর শ্যামল বিল ছাড়িয়ে হাকালুকি হাওড়ে ছড়িয়ে পড়েছিলো।#

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top