সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

হোয়াট এ বিউটিফুল ডে! : মোঃ ইয়াকুব আলী


প্রকাশিত:
১৭ এপ্রিল ২০২১ ২১:৩৬

আপডেট:
২৫ এপ্রিল ২০২৪ ১১:৪৩

 

আজ থেকে অস্ট্রেলিয়াতে রমজান শুরু অবশ্য অনেকেই পরশু থেকেও শুরু করেছেন। গতকাল আমাদের পাঁচ বছরের ছেলে রায়ানের সকারের প্রশিক্ষণ ছিলো। অস্ট্রেলিয়াতে রাগবীকে বলা ফুটি আর ফুটবল কে বলা হয় সকার। সকারের প্রশিক্ষণের সময় ছিলো বিকেল সাড়ে পাঁচটা। অবশ্য ডে লাইট সেভিংসটা গত ৪ঠা এপ্রিল থেকে বন্ধ হয়ে যাওয়াতে এখন সেটা দাঁড়িয়েছে সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটা। আমার অফিসে আসতে গাড়ি, ট্রেন এবং বাস মিলিয়ে পাক্কা দেড় ঘন্টা লাগে আবার যাওয়ার সময়ও একই সময় লাগে। পাঁচটায় অফিস শেষ করলে ফিরতে ফিরতে সাড়ে ছ'টা বেজে যায় তাই গতকাল মঙ্গলবার চারটায় অফিস থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম। এতে একদিকে ভালোই হয়েছিলো রায়ানের সকারের প্রশিক্ষণ চলাকালীন সময়ের পুরোটাই আমি পশ্চিম আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ট্রেন থেকে নেমেই প্রথম রায়ানকে তার চাইল্ড কেয়ার থেকে নিয়ে বাসায় যেয়ে পোশাক বদলে নিলাম। ততক্ষণে গিন্নীও মেয়ে তাহিয়াকে আশফাক ভাই দিশা ভাবীদের বাসা থেকে নিয়ে হাজির।

আমি তাহিয়াকে বললামঃ যদি তুমি রমজানের চাঁদ তুমি আগে দেখতে পাও তাহলে আমাকে কল দিবে আর যদি আমি আগে দেখতে পাই তোমাকে কল দিবো। সকারের প্রশিক্ষণ চলাকালীন অন্য বাচ্চাদের অভিবাভবকদের সাথে আলাপ হচ্ছিলো বিভিন্ন বিষয়ে। তারা প্রায় সবাই নেপালের মানুষ কিন্তু বাংলাদেশের কৃষ্টি সংস্কৃতির ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। আমার অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি দেখে জিজ্ঞেস করলেনঃ তুমি কি রমজানের চাঁদ খুজতেছো। আমি বললামঃ হ্যা কিন্তু আকাশ পরিষ্কার থাকা সত্ত্বেও খুঁজে পাচ্ছি না। উনাদের একজন বললেনঃ কিন্তু অনেকেইতো গতকাল থেকে রোজা শুরু করে দিয়েছেন তারা কি আলাদা। আমি বললামঃ আসলে তারা আলাদা না এগুলো যারযার বিশ্বাস। এরপর সকারের প্রশিক্ষণ শেষ হয়ে গেলো। ততক্ষণে পশ্চিমের আকাশ কালো হয়ে এসেছে কিন্তু চাঁদের দেখা পেলাম না। আমরা পরিবারই উৎসব করে রমজানের এবং ঈদের চাঁদ দেখি এটা রোজায় এবং ঈদে বাড়তি আনন্দ যোগ করে কিন্তু এইবার সেটা থেকে কিছুটা বঞ্চিত হলাম। আজকে দ্বিতীয় দিন হলেও আমরা আজকে চাঁদ দেখবো কারণ আজকেই তো চাঁদ মামার সাথে প্রথম দর্শণ হবে।

এরপর ভোরে ঘুম ভাঙলো মুঠোফোনের এলার্মে। ভোর চারটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে সেহরির শেষ সময় তাই চারটার সময় এলার্ম সেট করা ছিলো। বিভিন্ন অজুহাতে আমাদের ঘুমাতে দেরি হয়ে যায় উপরন্তু এখন আবার চলছে স্কুল হলিডে তাই বাচ্চারা রাত জেগে একটু সিনেমা দেখতে চায় তাই ভোরবেলা আমি সবার আগে উঠে খাবার ফ্রিজার থেকে বের করে গরম করতে শুরু করলাম। তারপর গিন্নী এবং মেয়েকে ডেকে উঠিয়ে একসাথে খেতে বসে গেলাম। খাবার টেবিলে মেয়েটাকে বলছিলাম, কুষ্টিয়াতে আমাদের গ্রামে আমাদের গ্রামের মাতুব্বর মন্টু চাচা এসে নাম ধরে ডাকতে শুরু করেন। যতক্ষণ পর্যন্ত না কেউ উত্তর নিচ্ছেন উনি ডাকতেই থাকেন। কেউ একজন সাড়া দিলেই তবে উনি পরের বাড়িটার কাছে যান। এভাবে সারা পারে একসময় জেগে উঠে উনার ডাকে। অন্যদিকে গ্রামের মসজিদের মাইক্রোফোনে আমাদের মসজিদের হুজুর আব্দুল মালেক চাচা সুর করে ডাকতে থাকেন

"উঠুন উঠুন উঠুন
সেহরির সময় হয়েছে
সেহরি খেয়ে নিন"

আবার কখনও বা বলেনঃ

"উঠে পড়ুন সেহরি খান
উঠে পড়ুন সেহরি খান"

আমাদের তাই আলাদা করে কখনওই মোবাইলে বা ঘড়িতে এলার্ম সেট করতে হতো না। এলার্ম ছাড়াও আমাদের জীবন চলতো কিন্তু বর্তমান বস্তুবাদী জীবনে আমরা এক একজন আমাদের নিজেদেরই বানানো প্রযুক্তির দাসে পরিণত হয়েছি। এরপর তাহিয়াকে বললামঃ বেশি করে পানি খেয়ে নাও কারণ নাহলে পরে খারাপ লাগেব। আর প্রথম রোজাটা একটু কষ্ট করে রাখতে পারলে বাকিগুলো রাখা অনেক সহজ হয়ে যাবে।

সেহরি খেয়েই শুয়ে পড়তে হলো। ভোরে আবারো ঘুম ভাঙলো মোবাইলের এলার্মে। অন্যান্য দিন ব্রাশ করা, প্রসাধন কক্ষে যাওয়ার তাড়া থাকে তাই এলার্ম একটু আগে সেট করা। আজও সেই সময়ে এলার্ম বাজলো। আমি চোখ খুলে সেটাকে আরো পনের মিনিট পিছিয়ে দিলাম। পনের মিনিট পরের এলার্মে ধড়ফড় করে উঠে পোশাকটা বদলে ওয়ালেট আর গাড়ির চাবিটা নিয়ে দৌড়। বাইরে এসে দেখি শীতের কারণে গাড়ির জানালা এবং লুকিং গ্লাসে পুরু শিশির জমে আছে। সেগুলো একটা টিস্যু দিয়ে মুছে স্টেশনের দিকে এগোলাম। স্টশনের কারপার্কে গাড়ি রেখে বের হতেই দেখি পূব আকাশে সূর্যি মামা হাস্যোজ্জ্বল উঁকি দিচ্ছেন। আমি ট্রেনে উঠে দোতলার একটা ডানপাশের সিটে বসলাম যাতে করে সকালের সূর্যের মিষ্টি আলো মাখতে মাখতে যেতে পারি। 

অফিসে এসে ডেস্কে বসার পরই আমাদের রুটিন হচ্ছে এক একদিন এক একজনের সবার জন্য কফি আনতে যাওয়া। আজকে ছিল মাইকেল মিকেলপ যার ডাক নাম মিক তার পালা। আমার কাছে এসেই বললঃ ওহ তুমি তো রোজায়। আমি তাঁকে বললামঃ আজকে একটা বিশেষ দিন। আজকে একই সাথে রোজার শুরু এবং বাংলা নববর্ষেরও প্রথম দিন। বলে ওকে 'এসো হে বৈশাখ' গানটার ইংরেজি করে বুঝিয়ে দিলাম। শুনে ও খুবই উচ্ছাস প্রকাশ করলো। আমি বললামঃ এবার আমরা এই গানের মাধ্যমে বলতে চাইছি অগ্নিস্নানে ধরা সূচিত হয়ে আসবে এক নতুন পৃথিবী যেখানে থাকবে না কোন অতিমারীর প্রকোপ। শুনেই ও ইংরেজিতে বললঃ গুড অন ইউ যার মানে হচ্ছে তোমার বা তোমাদের ভালো হোক।

প্রতিদিনই দুপুরের খাবারের বিরতির আধা ঘন্টাকে আমি টেনে টুনে কোনদিন পঁয়তাল্লিশ মিনিট আবারো কোনদিন এক ঘন্টা বানিয়ে ফেলি। সেই পুরো সময়টা আমি হাটি। কখনও খাবার হাতে নিয়ে আবার কখনও হাটার শেষে খাবার নিয়ে এসে ডেস্কে বসে খাই। আজকে তো খাবার ঝামেলা নাই তাই ঢিমেতালে বের হয়ে গেলাম। অফিস থেকে বের হতেই বাইরের রোডের আঁচে শরীরটা চনমনে হয়ে গেলো। অফিসের ভেতরে এতটাই ঠান্ডা যে আমাদের হাত পা জমে যাবার জোগাড় হয় আমরা তাই বাইরে যতই উষ্ণ আবহাওয়া বিরাজ করুক না কেন আমরা জ্যাকেট পরে বসে কাজ করি। বাইরে বেরিয়ে সিগন্যাল পার হয়ে একটা চাপা গলি। সেই গলিতে শুধুমাত্র একদিকে গাড়ি চলে। সেখানেরই একটা বাঁকে বাংলাদেশের কুঞ্জলতার মতো একটা ফুলের ঝাড় এবং সবুজ লতানো গাছে ঝাঁকে ঝাঁকে টকটকে লাল ফুল ফুটে থাকে।

ছবিঃ লেখকের সাথে বন্ধু জেমস

সেই গাছের কাছে যেয়ে ফুলের ছবি তুলছি এমন সময় কানে এলো বাচ্চাদের কলকাকলী। পেছন ফিরে তাকাতেই দেখি দুজন প্রৌঢ়, দুজন শিশু এবং একজন মধ্যবয়সী মহিলা কথা বলছেন। বুঝতে পারলাম স্কুলের ছুটিতে দাদা দাদির কাছে বৌমা এবং নাতি নাতনী বেড়াতে এসেছেন। আমি তাঁদের দেখে বললামঃ আমি দুপুরে হাটতে বের হলেই এখানে আসি এবং এই ফুলগুলোর ছবি তুলি। শুনে উনারা জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমার দেশ কোথায়? আমি বললামঃ বাংলাদেশ। আরো যোগ করলাম। আমাদের দেশেও প্রায় হবহু একই প্রজাতির একটা লতানো ফুল গাছ আছে। আমরা সেটাকে বাসা বাড়ির গেটের কাছে লাগিয়ে দিই তারপর সেটা গেটের চারপাশের পেঁচিয়ে বড় হতে থাকে আর গেটটা সবুজ হয়ে যায়। এরপর যখন সেখানে লাল ফুল ফোটে তখন আরো ভালো লাগে দেখতে। আমি গতবছর এই গাছ থেকে বীজ নিয়ে গিয়ে আমাদের বাসার পেছনের বারান্দার রেলিংয়ে লাগিয়েছিলাম এখন সেটা পুরোপুরি সবুজ হয়ে গেছে। সকালে যখন লাল ফুলগুলো ফোটে খুবই চমৎকার দেখায়।  

এরপর একটু এগিয়ে মূল রাস্তায় পড়তেই দেখা হয়ে গেলো ম্যাক্সের সাথে। ম্যাক্স একটা কুকুরের নাম। অস্ট্রেলিয়াতে কুকুর বেড়ালসহ সকল পোষা পশুপাখিকে নিজ পরিবারের সদস্যের গুরুত্ব দেয়া হয়। তাদের খাদ্য থেকে শুরু করে ডায়েট, ব্যায়াম, মনস্তাত্ত্বিক বিনোদন এবং চিকিৎসার দিকে কড়া নজর রাখা হয়। অনেকসময়ই রাস্তাঘাটে বিড়াল বা পাখি হারিয়ে যাওয়ার বিজ্ঞাপন দেখতে পাওয়া যায় সেখানে বলা থাকে সন্ধান দাতাকে উপযুক্ত পুরুস্কার দেয়াও হবে। ম্যাক্সের সাথে আমার পরিচয় অনেক আগে। আমি বর্তমানের এই কোম্পনিতে কাজ করছি প্রায় পাঁচ বছর। দুপুরে হাটতে যেয়ে বুরালী পার্কের বেঞ্চে বসে গায়ে রোদ মাখি। তখন ম্যাক্সকে ওর মালিক নিয়ে আসে। কুচকুচে কালো ওর গায়ের রং। কান দুটো লম্বা হওয়াতে কিশোরী মেয়েদের দুটো বেনীর মতো মাথার দু'পাশে ঝুলে থাকে। যখন দৌড়ায় তখন হুবহু কিশোরী মেয়ের মতো দেখায়। ওর মালিকের সাথে আলাপ করার পর ওর সাথেও ভাব জমে গেলো। কুকুরদের স্মৃতিশক্তি অনেক প্রখর। একবার কাউকে দেখলে তাকে দ্বিতীয়বার দেখলেই চিনতে পারে। আজও সে আমাকে দেখে কুঁইকুঁই আরম্ভ করে দিলো। আমি মাথার মধ্যে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। ওর মালিক জিজ্ঞেস করলো তোমার সাথে অনেকদিন পর দেখা হলো। আমি বললাম আমি ইদানিং অন্যদিকে স্যার জোসেফ ব্যাংকস পার্কের দিকে হাটতে যায় তাই তোমাদের সাথে আর দেখা হয়নি। এরপর ওদেরকে বিদায় দিয়ে পার্কের দিকে এগিয়ে গেলাম।

এরপর পার্কের বেঞ্চে যেয়ে বসতেই দেখি একজন পরিচিত মুখ সামনে দিয়ে হেটে যাচ্ছেন। আমি হেলো বলে সম্বোধন করতেই কাছে এসে বললঃ অরে তুমি, কেমন আছো। আমি বললামঃ অনেকদিন পর তোমার সাথে দেখা। আমি আগে গ্রিন স্কয়ার স্টেশনে নেমে সেখান থেকে বাসে উঠতাম। সেই বাসেই জেমসের সাথে পরিচয়। জেমসের চীনের মানুষ। সবসময় মুখে একটা হাসি লেগে থাকে। ফ্রন্ট ডেস্কে জব করে বলেই হয়তোবা  মুখে একটা আলগা হাসি ধরে রাখতে হয়। জেমসকে বললামঃ গত কয়েক বছর ধরে আমি মাস্কাটে নামি কারণ মাস্কাট থেকে ইস্ট গার্ডেনস পর্যন্ত একটা নতুন সার্ভিস চালু করেছে। আমি সেটাতেই অফিসে আসি। জেমস নামতো আমার স্টপেজের এক স্টপেজ আগে। অনেকদিন পর দেখা তাই বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ হচ্ছিলো। অতিমারী, চাকুরীর ব্যস্ততা, দুপুরের বিরতি, দৈনন্দিন ঘটনাবলী সবই আলাপে উঠে আসছিলো।

জেমস বলছিলো আর বলো না ফ্রন্ট ডেস্কের কাজ তো কত রকমের যে মানুষের সাথে কথা বলতে হয়। মাথাটা ঝিমঝিম করে তাই দুপুরের বিরতিতে এই পার্কে এসে হেটে এখানের বিশুদ্ধ বাতাসে মনটা আবার সতেজ করে নিই। আমি বললাম আমারও একই অবস্থা। সারাদিন ইমারতের হিসাব নিকাশ করতে করতে মগজটা রোবোটিক হয়ে যায়। দুপুরের বিরতিতে হেটে মগজের ক্লান্তি দূর করি। জেমস আবার বললঃ আজকের দিনটা খুবই সুন্দর একবারে বেশি রৌদ্রজ্জ্বল না আবার বেশি ঠান্ডাও পড়ছে না অন্যদিকে আবার বেশি বাতাসও নেই আজকে। আমি বললামঃ আজকে আবার আমাদের রমজান মাসের প্রথম দিন এবং একইসাথে আমাদের বাংলা পঞ্জিকারও প্রথম দিন। সবমিলিয়ে দারুণ একটা বৈপরীত্য। জেমস বললঃ এই বৈপরীত্যই তো পৃথিবীর সৌন্দর্য। আমি বললামঃ ঠিক তাই। সবচেয়ে বড় কথা আমরা আরো একটা দিন এই পৃথিবীর জল হওয়াতে বেঁচে থাকলাম। এরপর আমি জেমসকে বিদায়ী শুভেচ্ছা জানালাম। অফিসের দিকে আসতে আসতে ভাবছিলাম আজকের দিনটা আসলেই অনেক মধুর, হোয়াট এ বিউটিফুল ডে। আসলে জীবনের প্রতিটা দিনই নিজ নিজগুণে মাধুর্যপূর্ণ।  

 

মোঃ ইয়াকুব আলী
মিন্টো, সিডনী, অস্ট্রেলিয়া

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top