সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালির চিরকালীন: বাসন্তী পুজো ও রামনবমী : ডঃসুবীর মণ্ডল


প্রকাশিত:
১৯ এপ্রিল ২০২১ ২২:০৬

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ০২:২১

 

দুর্গাপূজা হল বাঙালি হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় এবং সামাজিক উৎসব। প্রচলিত কথা অনুযায়ী বাংলায় প্রথম দুর্গাপূজার প্রচলন করেন রাজা সুরথ। রাজা সুরথ বসন্তকালে প্রথম দুর্গাপূজা চালু করেছিলেন,তাই এর আরেক নাম বাসন্তী পূজা

এ- বছর  এক অন্য  বাসন্তী পুজো অনুষ্ঠিত  হচ্ছে। করোনার আবহে  নেই কোনও মন্ত্রোচ্চারণ। নেই আলোকমালায় সেজে ওঠা মণ্ডপ, প্যান্ডেল। কিন্তু চুপিসাড়ে আরও একটি দুর্গাপুজো দিন ক্ষণ মেনে ঘটটে চলেছে। চৈত্র- বৈশাখ জুড়ে বাঙালির সাজোসাজ বর্ণাঢ উৎসবের আয়োজন। উৎসব মুখরিত মাস হল বৈশাখ। নববর্ষের  হাত ধরেই   একের পর -এক বাসন্তীপুজো,  রামনবমী, হনুমান জয়ন্তী, পবিত্র  ঈদ পালিত হয়। প্রতিবছরই দুই বাংলায়, ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে দেবী মা বাসন্তীর আরাধনায় মেতে ওঠে বাঙালি জাতি। বাঙালির 'মাসে তেরো পার্বণ' আয়োজনের মধ্যে কোন খামতি নেই। মোহময় দুঃসময়ের মুখোমুখি  আমরা। শুধু তাই নয়, এই সময়ে গোটা বিশ্বজুড়ে মোহময় দুঃসময়। করোনার আবহে নতুন করে মারণরোগের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু হয়েছে। আজও বিপদ কমেনি। মৃত্যু মিছিল থামেনি, কবে থামবে কেউ জানি না। গত বছরের তুলনায় এবার নববর্ষের আয়োজন ও  ধুমধাম বেশ আনন্দদায়ক হয়েছে। সামিল হয়েছে আপামর বাঙালি জাতি। উৎসব মুখর বৈশাখ অনেকটাই ম্লান। মানুষের মধ্যে উৎসাহ ও উদ্দীপনার বড় অভাব। অজানা ভয়ে আতঙ্কিত। তবু ভক্তিনম্র চিত্তে বাংলার বাঙালি বাসন্তী পুজোয় সামিল হতে উদ্গ্রীব। কারণ বাঙালির জাতিসত্তার সঙ্গে এই পুজো গভীর ভাবে সম্পৃক্ত। প্রাণের আকুতি দিয়ে সামিল হয় আট থেকে আশির মানুষ। এবার অনেক খানি ভাঁটা পড়েছে।  

 - দুর্গা পূজা এবং বাঙালি এই দুটি শব্দ এখন একই কয়েনের দুটি পিঠের মতো
- একটির সঙ্গে অন্যটির আইডেনটিটি জড়িয়ে রয়েছে। একটি ম্লান হলেই বোধহয় পরিচয়হীনতায় ভুগবে একটা গোটা জাত।
- এক সময় বাঙালির কাছে দুর্গা পূজা মানে বাসন্তী পূজাই বোঝাত।

কোনও ঢাকের বাদ্যি নেই, নেই কোনও মন্ত্রোচ্চারণ। নেই আলোকমালায় সেজে ওঠা মণ্ডপ, প্যান্ডেল। কিন্তু চুপিসাড়ে আরও একটি দুর্গাপুজো দিন ক্ষণ মেনে ঘটে চলছে, তা বোধহয় কেউ লক্ষ্য করছেন না। দুর্গা পূজা এবং বাঙালি এই দুটি শব্দ এখন একই কয়েনের দুটি পিঠের মতো। একটির সঙ্গে অন্যটির আইডেনটিটি জড়িয়ে রয়েছে। একটি ম্লান হলেই বোধহয় পরিচয়হীনতায় ভুগবে একটা গোটা জাত। কিন্তু সেটা বললে অর্ধেক বলা হবে। দুর্গা পূজা মানে শারদীয়া দুর্গোৎসব। হ্যাঁ, আপামর বাঙালির কাছে দুর্গা পুজো বললে শরৎ কালের শিউলির গন্ধমাখা পরিবেশে নতুন করে সেজে ওঠা। এক সময় বাঙালির কাছে দুর্গা পূজা মানে বাসন্তী পূজাই বোঝাত। তা হলে বাসন্তী পুজো ব্যাক সিট নিয়ে নেওয়ার কারণ কী? কারণ খুঁজতে গিয়ে বেশ কয়েকটি তত্ত্বের অবতারণা হল।

প্রথমটি অবশ্যই ধর্মীয় একটা কারণ। শিক্ষক এবং গবেষক কিঞ্জল বসু জানাচ্ছেন, পুজোর কনসেপ্ট থাকলেও সেটা কিন্তু বারোয়ারি কখনই ছিল না। বাসন্তী পুজো মূলত হত গ্রামের জমিদার বাড়ি কেন্দ্র করেই। তিনি বলেন, 'আপনি লক্ষ্য করে দেখবেন, বাসন্তী পুজো এখন শুধুমাত্র কয়েকটি বনেদি বাড়ি এবং প্রাচীন জমিদার বাড়িতেই সীমাবদ্ধ হয়ে রয়ে গিয়েছে। অতীতেও কিন্তু এর অন্যথা ছিল না। হ্যাঁ, এটা বলতে পারেন, সংখ্যায় হয়তো বেশি হত, কিন্তু তা কখনও উৎসবে পরিণত হয়নি। আমার মতে এর মূলত দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, রামচন্দ্রের অকাল বোধনের কাহিনি বাঙালির কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছিল। দ্বিতীয় কারণটি অবশ্য রাজা সুরথের জন্য।'

এখানে একটি পৌরাণিক ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে। পুরাণে দুটি কালে বছরকে ভাগ করা হয়েছে। উত্তরায়ণ এবং দক্ষিণায়ণ। পুরাণ অনুযায়ী উত্তরায়ণে (অর্থাৎ সূর্য যে সময় পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের কাছাকাছি থাকে) দেবদেবীরা জেগেই থাকন। আর দক্ষিণায়ণের (অর্থাৎ সূর্য যে সময় পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধের কাছাকাছি থাকে) সময় হল তাঁদের নিদ্রার সময়। দক্ষিণায়ণের এই ছ’ মাস হল- শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ ও পৌষ। এ সময় তাঁরা ঘুমিয়ে থাকেন। তাই তাঁদের জাগানোর জন্য বোধনের প্রয়োজন হয়। তাই একটা দীর্ঘ সময় কোনও পুজো অর্চণার সুযোগ ছিল না। কিঞ্জল বলেন, 'রাজা সুরথ এই সময় তাঁর পুরোহিতদের ডেকে বলেন, পাঁজি পুঁথি ঘেঁটে এ সময়ে কোনও পুজা করা যায় কিনা তা দেখতে। সে সময় এক পুরোহিত তাঁকে বলেন, রামচন্দ্রের অকাল বোধনের কথা। সেই থেকে পুজোর চল বলে অনেকে মনে করেন

শরত্‍ নবরাত্রি ষষ্ঠী থেকে দশমী তিথি বাঙালিরা দুর্গাপুজো হিসেবে পালন করে। আর বসন্ত নবরাত্রি পালিত বাসন্তী পুজো হিসেবে। এই বাসন্তী পুজোও আসলে দেবী দুর্গারই আরাধনা। আগে বাসন্তী পুজোই করা হত।

 

নবরাত্রিতে নয় দিন ধরে দেবী দুর্গার পুজো হয়। বছরে চারটি নবরাত্রি পড়ে। তার মধ্যে শরত্‍ নবরাত্রি এবং বসন্ত নবরাত্রির উদযাপন প্রায় গোটা দেশজুড়ে হয়। সূর্য এবং চন্দ্রের নির্দিষ্ট অবস্থান মেনেই নবরাত্রি পালিত হয়।

শরত্‍ নবরাত্রি ষষ্ঠী থেকে দশমী তিথি বাঙালিরা দুর্গাপুজো হিসেবে পালন করে। আর বসন্ত নবরাত্রি পালিত বাসন্তী পুজো হিসেবে। এই বাসন্তী পুজোও আসলে দেবী দুর্গারই আরাধনা। আগে বাসন্তী পুজোই করা হত। কথিত আছে সীতাকে উদ্ধার করার জন্য রামচন্দ্র রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার আগে দুর্গা পুজো করেন। সেই অকালবোধনই তারপর থেকে শরত্‍ কালীন দুর্গাপুজো হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

বসন্ত নবরাত্রি ৬ এপ্রিল থেকে ১৪ এপ্রিলের মধ্যে পালিত হয়। অনেক  সময় এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে  অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। এ- বছর১৯  এপ্রিল বাসন্তী পুজো। কথিত আছে, রাজ্যহারা রাজা সুরথ এবং স্বজন পরিত্যক্ত বণিক সমাধি বৈশ্য একবার উপস্থিত হয়েছিলেন মেধা মুনির আশ্রমে। মুনির কাছে পদে নিজেদের দুঃখের কথা ব্যক্ত করেন তাঁরা। মেধা ঋষি সুরথ ও সমাধি বৈশ্যের দুঃখ - দুর্গতির কথা শুনে তাঁদের 'মধুময়ী চন্ডী'র কথা শোনান। মেধা ঋষির উপদেশ শুনে সুরথ ও সমাধি বৈশ্য অরণ্যের মধ্যেই ঋষি মেধসের আশ্রমে মৃন্ময়ী মুর্তি গড়ে সর্বপ্রথম দশভূজা দুর্গা পুজো শুরু করেছিলেন। এই বাসন্তী পুজোই দেবী মহামায়ার মূল পূজো। সনাতনী হিন্দু সম্প্রদায়ের দেবী দুর্গাকে কেন্দ্র করে প্রচলিত এক বৃহৎ উৎসব। এই পূজা সমগ্র হিন্দু সমাজেরই প্রচলিত উৎসব। তবে বাঙালি হিন্দু সমাজে এটি অন্যতম বিশেষ ধর্মীয় ও প্রধান সামাজিক উৎসব। আশ্বিন বা চৈত্রমাসের শুক্লপক্ষে দুর্গাপূজা করা হয়। আশ্বিন মাসের দুর্গাপূজা শারদীয়া দুর্গাপূজা এবং চৈত্র মাসের দুর্গাপূজা বাসন্তী দুর্গাপূজা নামে পরিচিত। শারদীয়া দুর্গাপূজার জনপ্রিয়তা বেশি। বাসন্তী দুর্গাপূজা মূলত কয়েকটি জায়গায় সীমাবদ্ধ। আর কয়েক দিন পরে বাসন্তী পূজা। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়  বাসন্তী পুজো অনুষ্ঠিত হয়। বিশেষ করে  পারিবারিক ও বারোয়ারি পুজো চল বেশি। বাঁকুড়া, উত্তর ও দক্ষিণ  চব্বিশ পরগনা, নদীয়া, দুই মেদিনীপুর জেলা, কলকাতা, হাওড়া, হুগলি, বর্ধমান, বীরভূমে ,মালদহ,তমলুক, ঝাড়গ্রাম।  এই পুজোর আধিক্য পরিলক্ষিত  হয়। বাংলাদেশের, যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা, ঢাকা, কুষ্টিয়া  প্রভৃতি জেলায় বাসন্তী পুজো অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া আসাম, ত্রিপুরা, ঝাড়খণ্ডের জামশেদপুরে ও রাঁচি   ও  দিল্লিতে  বেশ কয়েকটি  বড় ধরনের  বাসন্তী পুজো অনুষ্ঠিত হয়। বাসন্তী পুজোর  কিছু দিন পর অনুষ্ঠিত হয়  রামনবমী পুজো।  সনাতনী হিন্দু সম্প্রদায়ের দেবী দুর্গাকে কেন্দ্র করে প্রচলিত এক বৃহৎ উৎসব। আয়োজিত হতে চলেছে ১৯ এপ্রিল। আর অন্নপূর্ণা পুজো ২০ এপ্রিলে আয়োজিত হবে। এরপর হনুমান জয়ন্তী রয়েছে ২৭ এপ্রিল। উল্লেখ্য, চৈত্র সংক্রান্তির দিন রয়েছে চড়ক পুজো। অর্থাৎ তা পড়ছে ১৪ এপ্রিল।

মাসের ২৭ তারিখে রয়েছে চৈত্র পূর্ণিমা। অর্থাৎ সেই দিনই হনুমান জয়ন্তীও আয়োজিত হবে। ফলে সব মিলিয়ে আপাতত ভোটমুখী বাংলায় উৎসবের আসর ঘিরে তুঙ্গে পারদ।

 এ- বছর লক্ষ লোকের ভিড় উধাও। কার্যত রাজ্যের  বিভিন্ন স্থানে  জনশূন্য সমস্ত  ভারত সেবাশ্রম সংঘে হল নিয়মরক্ষার বাসন্তী পুজো। মুখে মাক্স পুরোহিতের, মুখে মাক্স ভক্তেরও। সামাজিক দুরুত্ব বজায় রেখেই চলল পুজোপাঠ। মন্ত্র উচ্চারনের ফাঁকেই পুরোহিতের ঘন ঘন করোনা নিয়ে সর্তকতার প্রচার। তবে, ভক্তদের দর্শনের জন্য এখনই বিসর্জন নয়। আগামী  বুদ্ধ পূর্নিমা পর্যন্ত মন্দিরেই থাকবেন দেবী। মায়ের দর্শন পাবেন ভক্তরা। রামনবমীতে লক্ষাধিক জনসমাগমই মালদহের ভারত সেবাশ্রমের ও বেলুড়মঠের  চেনা ছবি। কিন্তু, করোনার কারনে এবার কার্যতঃ নিয়মরক্ষার পূজো।  আশ্রমের মূল ফটক বন্ধ। মূল মন্দিরের ভেতরে বিশাল দেবীমূর্তির সামনে মুখে মাক্স লাগিয়ে পুজো করছেন পুরোহিতেরা। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে  ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে পুজোর সাক্ষী জনাকয়েক ভক্ত। প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের নিরাপদ দুরত্ব। তিন হাত দূর থেকে অঞ্জলির দূরের ভক্তদের অনলাইনে পুজো দেখার সুযোগ করে দিতে ফেসবুকে লাইভের ব্যবস্থা। এভাবেই কার্যতঃ নম নম করে বাসন্তী পুজো সারা হল মালদহের  ও বাঁকুড়া জেলার খাতড়ার ভারত সেবাশ্রম সংঘে ও বেলুড়মঠে। পুজো, অন্নকূট ভোগ, যঞ্জ, সমস্ত নিয়ম নিষ্ঠা মেনেই পুজো চললেও ভিড় জমানোর সুযোগ নেই ভক্তদের। অন্যান্য বছরের মতো রামনবমীর  মেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও বাতিল। ভক্তদের করোনা নিয়ে সতর্কতার বার্তা দিতে মন্ত্র উচ্চারনের মতোই পুজোর ফাঁকেই করোনার সচেতনতার প্রচারও সারলেন পুরোহিতেরা। সবমিলিয়ে অন্যরকম আবহে বাসন্তী পুজো  বাঁকুড়া, চন্দননগর   কলকাতা, আসানসোল, বোলপুর,  খড়গপুর,  পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম, মালদহের ভারত সেবাশ্রম সংঘে।

প্রতিবছর মহা ধুমধাম করে বাসন্তী পুজো হয় মালদহের সাহাপুরে ভারত সেবাশ্রম সংঘে। জেলায় ভারত সেবাশ্রম সংঘের যুক্ত ভক্ত সংখ্যা ৬০ হাজারেরও বেশী। আর প্রতি বছর বাসন্তী পুজো দেখতে ভারত সেবাশ্রম সংঘে আসেন লাখো মানুষ। এবার লকডাউনের জন্য ভক্তদের মন্দিরে না আসার জন্যই নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপরেও যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা স্বল্পসময়ের জন্য প্রতিমা দর্শন করেই ফিরে যান। নিয়ম মেনে এবারও ৫৬ রকমের ভোগ দিয়ে দেবী অন্নপূর্নার উদ্দেশ্যে অন্নকূট নিবেদন করেন মহারাজরা। মুখে মাক্স বেঁধেই চলে অন্নকুট নিবেদন। ভারত সেবাশ্রম সংঘ জানিয়েছে, ভক্তদের কথা ভেবে এখনই দেবী বিসর্জন দেওয়া হবে না। লকডাউন উঠে গেলে আগামী ৭ মে বুদ্ধ পূর্নিমায় ফের বিশেষ পুজো পাঠ হবে। সেই সময় ভক্তরা দর্শন ও প্রসাদ পাবেন। যঞ্জ আর দীক্ষা গ্রহনও। মালদহ, বেলুড় এবং  বাঁকুড়া জেলার খাতড়া মহকুমা শহরের নিকটে  ভারত  সেবাশ্রম সংঘের বাসন্তী পুজো আকর্ষণীয়। প্রতি বছর বিশাল নৃত্যশোভাযাত্রা, লাঠি খেলা, ভগবৎ পাঠ, ধর্ম সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠিত হয় রামনবমীতে লক্ষ লক্ষ মানুষ সামিল হয়ে শহর পরিক্রমায় অংশগ্রহণ করে। এই  উপলক্ষে  দরিদ্র  নারায়ন সেবার মাধ্যমে মানুষকে খাওয়ানো হয়  এবংএছাড়াও  মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। এ-বছরটা  করোনার আবহে বাসন্তী পুজো আকর্ষণীয়  হবে  কিনা  যথেষ্ট অবকাশ আছে। তবু সারাদেশ জুড়ে সাজোসাজ বর্ণাঢ উৎসবের প্রস্তুতি চলছে জোর কদমে।

দক্ষিণ বঙ্গের বাদকুল্লার  বাসন্তী পুজো আকর্ষণীয়। এখান থেকেই  প্রতিমা বিদেশে পাড়ি দেয় প্রতিবছরই। করোনার আবহে হয়তো এবছরে কম পরিমাণ প্রতিমা  বাইরে যাবে। মৃৎ-শিল্পীদের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। ২০২১ সালের ১৯ এপ্রিল  বাসন্তী রূপে পূজিত হবেন দেবী দুর্গা। প্রায় চার মাস আগে বাসন্তী পুজোকে সামনে রেখে নদিয়া থেকে সুদূর সুইজারল্যান্ডের জুরিক শহরে পাড়ি দেওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছে তিন-তিনটি দুর্গাপ্রতিমা। পুরান  মতে তিনি হলেন মহাবিশ্বের জীব ও জড় সমস্ত কিছুর সৃষ্টিকর্তা ও নিয়ন্ত্রক তিনিই। ঈশ্বরের শক্তিতে বিশ্বাসীকে আস্তিক আর অন্যপক্ষকে নাস্তিক বলা হয়। শুধুমাত্র একজন সার্বভৌম ঈশ্বরের ধারণাকে বলা হয় একেশ্বরবাদ। পঞ্চদেবতা পূজা বা পঞ্চায়তন পূজা হল হিন্দুধর্মের স্মার্ত সম্প্রদায়ের একটি পূজা পদ্ধতি। কথিত, অষ্টম শতাব্দীর হিন্দু দার্শনিক আদি শঙ্কর পঞ্চদেবতা পূজার প্রবর্তন করেন। এই পদ্ধতিতে পাঁচ দেবতার পূজা হয়— গণেশ, শিব, সূর্য, বিষ্ণু ও দুর্গা। স্মার্ত পারিবারিক নিয়ম অনুসারে, এই পঞ্চদেবতার একজন থাকেন কেন্দ্রে এবং বাকিরা কেন্দ্রীয় দেবতাকে ঘিরে থাকেন। ছোট মূর্তি বা পাঁচ ধরনের বিশেষ পাথরে বা মাটিতে আঁকা বিশেষ চিত্রে (যন্ত্র) পঞ্চদেবতার পূজা হয়।স্মার্তরা এই পঞ্চদেবতাকে পৃথক দেবতা হিসাবে না দেখে ব্রহ্মের পাঁচটি রূপভেদ মনে করেন। স্মার্ত মন্দিরগুলির গর্ভগৃহে পঞ্চদেবতা পূজার জন্য বিশেষ আসন দেখা যায়। এপ্রিল জুড়ে একের পর এক পার্বণ রয়েছে বাংলার ক্যালেন্ডারে। তবে কোভিড আবহে সেই পার্বণ উদযাপন নিয়ে বেশ কিছুটা শঙ্কা দেখা দিয়েছে। যেভাবে দেশে করোনার বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়েছে তাতে রামনবমীর মতো উৎসব উদযাপনে করোনা বিধি মানা নিয়ে ফোকাস বাড়ছে। তবে সেদিন ঘরের পুজোপাঠে প্রয়োজন সঠিক তিথি জানার। এপ্রিল মাসে রাম নবমীর উৎসব উদযাপিত হয়। পঞ্জিকা অনুসারে, রাম নবমী উৎসব ২০২১ সালের ২১ এপ্রিল বুধবার পালিত হবে। এই দিনটি চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের নবমী তিথি। হিন্দু ধর্মে এই তারিখটির বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। ধারণা করা হয় যে চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের নবমী তিথিতে ভগবান রামের জন্ম হয়েছিল। এই কারণেই এই তারিখটিকে রাম নবমী বলা হয়। এই দিনে ভগবান রামের জন্ম ।রামনবমীর দিন নবমীর পুজোর মুহূর্তের তিথি শুরু হবে ১১:০২ মিনিটে শুরু হবে। আর তা সেদিন ১: ৩৮ মিনিটে শেষ হবে। এটি কেবলই নবমীর পুদো মুহূর্তের তিথি। এই বিশেষ নবমী শ্রীরামচন্দ্রের জন্মতিথি হিসাবে পরিণগণিত হয়। ফলে এই তিথি ঘিরে বিশেষ বিশেষ উৎসব পালিত হয়। মতে, নবমীর তিথিটি ২১ এপ্রিল ২০২১ তারিখ, বুধবার রাত ১২ টা বেজে ৪৩ মিনিট থেকে শুরু হবে। নবমী তিথি শেষ হবে ২২ এপ্রিল বৃহস্পতিবার দুপুর ৩ টে বেজে ০৫ মিনিটে।

 দেশের বাইরে  বেশ কয়েকটি দেশে  যেমন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, সুইডেন, আমেরিকার বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় বাসন্তী পুজো অনুষ্ঠিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের নদিয়ার কৃষ্ণনগর, বাদকুল্লা, কলকাতার কুমোরটুলিতে তৈরি প্রতিমা বিদেশে পাড়ি দেয় প্রতিবছরই। নদিয়ার তাহেরপুর থানা এলাকার বাদকুল্লা বাজার লাগোয়া মৃৎশিল্পী বিজয় পালের তৈরি তিনটি দুর্গাপ্রতিমা এবছর সুইজারল্যান্ডের জুরিক শহরের উদ্দেশ্যে বাক্সবন্দি করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ৪ ফুট উচ্চতা এবং ৫ ফুট চওড়ার কাঠের বাক্সে এক চালির জরির সাজের দুর্গা-পরিবারকে সাজানো হয়েছে। মাটির তৈরি দুর্গা প্রতিমার উচ্চতা দুই ফুট এবং লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশের উচ্চতা দেড় ফুট। গত বছরের অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে কাজ শুরু করে, প্রায় এক মাসের মাথায় তিন তিনটি দুর্গাপ্রতিমা সম্পন্ন করেছেন মৃৎশিল্পী বিজয় পাল এবং তার সহশিল্পীরা।  করোনার আবহে নতুন এবছরটাওবাসন্তী পুজোর আনন্দ ম্লান হয়ে যাবে। ক্রমশ করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে কলকাতা সহ সমস্ত জেলায়, বিশেষ করে  দুই  চব্বিশ পরগনা, হাওড়ায়  এর ব্যাপকতা ক্রমশ ঊদ্ধমুখী।

গত বছর বাংলার বিভিন্ন স্থানে  নামমাত্র  বাসন্তী পুজো  অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাই  সাধারণ মানুষ  সামিল হতে পারে নি। রামনবমীতে  ভারতবর্ষে  সমস্ত জেলা জুড়ে  মহাধুমধামের সঙ্গে  পালিত। ভারতীয়  সংস্কৃতির সাথে  ওতোপ্রতো ভাবে  সম্পৃক্ত। এলাকায়  এলাকায় বর্ণাঢ্য  শোভাযাত্রা বের করা হয়। একটা আবেগময় পরিবেশ সৃষ্টি  হয়।ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী উৎসব হলো  রামনবমী। আবহমান কাল থেকে চলে আসছে  এই ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় অনুষ্ঠান। ভারতীয় ঐতিহ্যের  ধারক ও বাহক রামনবমী। ধর্মপ্রাণ  হিন্দু  সম্প্রদায়ের মানুষজন মেতে ওঠে চিরায়ত এই উৎসবের দিনে।     

তথ্যসূত্র- বিভিন্ন পত্রিকা ও গ্রন্থ, আনন্দবাজার পত্রিকার আর্কাইভ

 

ডঃ সুবীর মণ্ডল
লোকগবেষক, প্রাবন্ধিক, রম্যরচনা, অণুগল্প ও ছোটগল্প এবং ভ্রমণকাহিনীর লেখক 
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top