সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

সাম্রাজ্যবাদ ও শ্রেনীবৈষম্যের বিপক্ষে দ্রোহী পণ্ডিত অধ্যাপক আহমেদ শরীফ : ডঃ সুবীর মণ্ডল


প্রকাশিত:
২৯ এপ্রিল ২০২১ ২১:১৫

আপডেট:
১৯ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:৩৮

ছবিঃ ডঃ সুবীর মণ্ডল এবং অধ্যাপক আহমেদ শরীফ

 

পাণ্ডিত্যে, প্রজ্ঞায় ও প্রাণসম্পদে ভরপুর এক বর্ণিল শিক্ষা ব্যক্তিত্ব। অসাম্প্রদায়িক উদার প্রসারিত দৃষ্টিতে মানুষ, জীবন ও জগতকে বিচার -বিশ্লষণ করেছেন আজীবন। মনের আকাশ জুড়ে ছিল বিশুদ্ধ মানবিকতা। দুই বাংলার সাংস্কৃতিক জগতের মহীরুহ। ঘাত -প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে বর্ণিল বহুমাত্রিক গুণের মানুষটি মাথা উঁচু করে শত বসন্তের সীমান্তরেখা অতিক্রম করলেন অনেকটাই নীরবে।     
শতবর্ষে পা দিলেন আহমদ শরীফ, দুই বাংলার সাহিত্য ও সংস্ক‌তিতে, মুক্তমনা, বিবেকবান ও খ্যাতনামা চিন্তক এবং মনীষী বলে যাঁর পরিচয়। তিনি অধ্যাপক, গবেষক, লেখক, সমাজ ও সভ্যতার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষক। তাঁর শানিত কলম, ধারালো যুক্তি অনেকের পছন্দ নাও হতে পারে, কিন্তু বাংলার বিদ্বৎ পরিমণ্ডলে তাঁকে অস্বীকার করার ক্ষমতা ক'জনের আছে?
আহমদ শরীফ বড় হয়ে উঠেছেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের দুর্লভ অমূল্য পুঁথির ভাণ্ডার ও সাময়িক পত্রপত্রিকার সম্ভারের মধ্যে। তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় তিনি ব্যয় করেছেন মধ্যযুগের সাহিত্য ও সামাজিক ইতিহাস রচনার জন্যে। তাঁর লিখিত গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। সেগুলো বাংলাদেশে পাওয়া গেলেও এ-বঙ্গে দুর্লভ। অথচ এদেশের গবেষক ও পাঠকদের কাছে আহমদ শরীফের বইগুলি প্রকাশ ও পরিবেশনের কোনো সুষ্ঠু ব্যবস্থা ছিল না।
অতঃপর এই অব্যবস্থার অবসান ঘটলো। ডঃ প্রথমা রায়মণ্ডল, কলকাতার বিদ্যাসাগর মহিলা কলেজের বাংলার প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান, যিনি দীর্ঘকাল ধরে আহমদ শরীফের মতো মহান মানুষটির স্নেহচ্ছায়ায় কন্যার মতো স্নেহ ও ভালোবাসায় বেড়ে উঠেছেন, যাঁর নিজস্ব গবেষণার বৃত্তটিও আহমদ শরীফকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত, যিনি মাত্র কিছুদিন আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই চিন্তাবিদের নামাঙ্কিত শতবার্ষিকী বক্তৃতা দিলেন, তিনি খণ্ডে খণ্ডে তাঁর রচনাসমূহ প্রকাশের সক্রিয় উদ্যোগ নিয়েছেন। তাঁর দক্ষ ও বৈদগ্ধপূর্ণ সম্পাদনা স্মরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এই অত্যন্ত শ্রমসাধ্য দুরুহ কাজে তাঁকে সাহায্য করছেন তাঁর স্বামী ডঃ চিত্ত মণ্ডল। এগিয়ে এসেছেন কলকাতার বিশিষ্ট প্রকাশনা সংস্থা 'একুশ শতক'। প্রথম খণ্ডটি, অত্যন্ত শোভন, সার্থক ও সুন্দর,  ইতিমধ্যেই প্রকাশিত। দ্বিতীয় খণ্ডের কাজও প্রায় শেষ। কিংবদন্তিতুল্য গবেষক, শিক্ষক, লেখক পণ্ডিত অধ্যাপক আহমদ শরীফ আমাদের হৃদয়ের মানচিত্রে চিরজীবী হয়ে আছেন ও থাকবে তাঁর সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে। তাঁর সাহিত্য সাধনা ও সৃষ্টিকর্ম আগামী প্রজন্মের কাছে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করবে বলে সবার বিশ্বাস। সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, দর্শন, ইতিহাস বিষয়ে তিনি লিখে গেছেন অজস্র প্রবন্ধ-নিবন্ধ। আহমদ শরীফ রচিত প্রবন্ধ-গবেষণামূলক মৌলিক গ্রন্থের সংখ্যা ৭০ টিরও বেশি। সম্পাদনা করেছেন মধ্যযুগীয় সাহিত্যবিষয়ক ৪৫ টি গ্রন্থ। বাংলা একাডেমীর প্রথম প্রকাশনা গ্রন্থ আহমদ শরীফের লাইলী মজনু প্রকাশিত হয় ১৯৫৭ সালে।
চিন্তা ও কর্ম, যুক্তি ও মানবতাবাদের আলোয় এক অন্তহীন অনুসন্ধানের সূত্রে গ্রথিত ছিল আহমদ শরীফের জীবন। তিনি তাঁর চিন্তাধারায় মৌলিকতা, যুক্তিবাদিতা ও আধুনিকতার স্ফুরণ ঘটিয়েছিলেন। তিনি অদৃষ্টবাদ-ভাববাদের বিরুদ্ধে যুক্তিবোধ ও মানবতাবোধের শাণিত কলম চালিয়েছেন আমৃত্যু। স্বৈরাচার, সামরিকতন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদ ও শ্রেণীবৈষম্যের বিপক্ষে দ্রোহী পণ্ডিত আহমদ শরীফ ছিলেন স্বাধিকার-সচেতন সাহসী কলমযোদ্ধা।
১৯২১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের সুচক্রদণ্ডি গ্রামে আহমদ শরীফের জন্ম। তাঁর বাবার নাম আবদুল আজিজ, যিনি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের ভাই। পিতৃব্য সাহিত্যবিশারদের কাছে থেকে পুত্রস্নেহে তিনি লালিত-পালিত হয়েছেন, বেড়ে উঠেছেন তাঁর দুর্লভ অমূল্য পুঁথির ভান্ডার ও সাময়িক পত্রপত্রিকার মধ্যে।
পুঁথি সাহিত্যবিশারদ আবদুল করিমের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে আহমদ শরীফ যেমন জ্ঞানতৃষ্ণা লাভ করেছিলেন, তেমনি নিজের নিরলস অধ্যবসায়ে অর্জন করেছিলেন এক বিস্ময়কর মনীষা। এই মনীষার জন্য তাঁর জনপ্রিয়তা শুধু বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও তিনি সমান জনপ্রিয় ছিলেন। ভারতের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৯৩ সালে তাঁকে সম্মানসূচক ডি. লিট ডিগ্রি দেয়।
আহমদ শরীফ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৪ সালে বাংলাভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর এবং ১৯৬৭ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। কলেজে অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে তাঁর পেশাজীবন শুরু। ১৯৫০ সালের শেষের দিকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়ে একটানা ৩৪ বছর অধ্যাপনা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘ অধ্যাপনা জীবনে তিনি বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যানসহ সিন্ডিকেট সদস্য, সিনেট সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি, বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের সভাপতি ও কলা অনুষদে চার মেয়াদের নির্বাচিত ডিন ছিলেন। ১৯৮৪-৮৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রথম ‘কাজী নজরুল ইসলাম প্রফেসর’ পদে কর্মরত ছিলেন।
আহমদ শরীফ শুধু শিক্ষক-গবেষকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রামের অগ্রবর্তী ব্যক্তিত্বও। আহমদ শরীফের সময়ে দেশের ভেতরে যত প্রতিক্রিয়াশীলবিরোধী এবং প্রগতিশীল ও বৈপ্লবিক আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে, এর প্রায় প্রতিটিতেই তিনি সক্রিয় ছিলেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অঙ্কুরোদয়ে আহমদ শরীফের ভূমিকা অগ্রনী। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তির লক্ষ্যে গঠিত ‘নিউক্লিয়াস’ স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল অতি ঘনিষ্ঠ।
১৯৬৮ সালে লেখক-শিল্পীদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর হস্তক্ষেপের প্রতিবাদসভার অন্যতম সংগঠক ও বক্তা ছিলেন আহমদ শরীফ। ১৯৭১ সালে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কর্তৃক অপ্রত্যাশিতভাবে পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে লেখক-বুদ্ধিজীবীদের স্বাধীনতার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পরিচালক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েও বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীর যেকোনো অগণতান্ত্রিক আচরণ বা স্বৈরাচারমূলক আইন অগ্রাহ্য করে আহমদ শরীফ বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে সব সময়ই জনগণের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। ১৯৭৪ সালে মানুষের সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে তিনি মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও আইন সহায়তা কমিটি গঠন করেন। ১৯৭৬ সালে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ‘প্রতিরোধের একুশে’ উদ্যাপন কমিটির নেতৃত্ব দেন।
শুধু দেশ নয়, বিশ্বের সব শোষিত-মেহনতি মানুপ্রতিবাদষের প্রতি তাঁর অপরিসীম দরদ। ইরান, ইরাক, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তানসহ বিশ্বের যেকোনো দেশ সাম্রাজ্যবাদী-আধিপত্যবাদী শক্তি কর্তৃক যখন আক্রান্ত হয়েছে, তখনই আহমদ শরীফ আক্রান্ত দেশের যন্ত্রণাকাতর মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে হামলাকারীদের নিন্দা জানিয়ে সব স্বাধীনতাকামী মানুষকে প্রতিকার-প্রতিবাদ-প্রতিরোধে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘আফ্রো-এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার মানুষের দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতা এবং কুসংস্করাচ্ছন্নতার জন্য দায়ী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ।’
শোষণ-নিপীড়নহীন কুসংস্কারমুক্ত সাম্যবাদী বিশ্ব গড়ার যে সংগ্রাম চলছে, আহমদ শরীফ ছিলেন তারই পতাকাবাহী। তাঁর অক্লান্ত সাধনা, দুর্জয় সাহস এবং অমিত শক্তির কথা মনে হলে আমাদের বিস্মিত হতে হয়। অত্যাচারী শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে তিনি যেমন ছিলেন প্রতিবাদী, তেমনি মুক্তচিন্তা আন্দোলনের পথিকৃত্। তিনি বিশ্ব ও জাতীয় পরিসরে বিপ্লবী শক্তির উত্থান কামনা করতেন। আহমদ শরীফ বিশ্বাস করতেন গণমানুষের মুক্তিতে; বিশ্বাস করতেন গণমানুষের মুক্তি সম্ভব সংগ্রামে।
আহমদ শরীফ জীবনে কোনো দিন চাপের মুখে নতি স্বীকার করেননি। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন অপশক্তির কাছে নতি স্বীকার না করতে। শিখিয়েছেন অন্যায়কে ঘৃণা করতে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি যেমন ছিলেন আপসহীন; সমাজকর্মে, প্রবন্ধ-চিন্তায় ও গবেষণাকর্মে তথা মননশীল চর্চায় তেমনি প্রতিবাদী ছিলেন। জীবিত অবস্থায় তো বটেই, মৃত্যুর পরও আমরা তাঁকে পাই মূঢ়তা, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এক অসীম লড়াকু মানুষ হিসেবে। ক্ষণজন্মা এই মনীষী ১৯৯৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।
কথা ও কর্মে অবিচল, অটল, আপসহীন দৃঢ় মনোভাবের ঐহিক জীবনবাদী আহমদ শরীফ সব রকম মেকি প্রথা-সংস্কার-শৃঙ্খল ছিন্ন করে ১৯৯৫ সালে লিপিবদ্ধ করা ‘অসিয়তনামা’র মাধ্যমে মানবকল্যাণে মরণোত্তর চক্ষু ও দেহ দান করে গেছেন। সেই অসিয়তনামায় উল্লেখ ছিল, ‘চক্ষু শ্রেষ্ঠ প্রত্যঙ্গ, আর রক্ত হচ্ছে প্রাণপ্রতীক। কাজেই গোটা অঙ্গ কবরে কীটের খাদ্য হওয়ার চেয়ে মানুষের কাজে লাগাই তো বাঞ্ছনীয়।’ 

হৃদরোগে  ৮০ বছর বয়সে  আক্রান্ত হয়ে হঠাৎ তিনি প্রয়াত হন। কিন্তু রেখে যান তার সারাজীবনের সঞ্চয়--অজস্র রচনা, অসংখ্য গ্রন্থ, অগণিত মূল্যবান গবেষণা। জীবনে এত বেশি লেখালেখি করেছেন যে সেগুলোর মুদ্রিত পৃষ্ঠা জড়ো করলে এক মহাস্তুপে পরিণত হবে বৈকি। নিঃসন্দেহে উত্তরসাধকেরা তার বিপুল গবেষণার ফসল দ্বারা ঋদ্ধ এবং তার অমল হিতবাদী চিন্তু দ্বারা অনুপ্রাণিত। বাংলাদেশের মনন ধারার সাহিত্যের ক্ষেত্রে তিনি এক প্রভাবশালী পুরুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের গবেষণা সহকারী হিসেবে তার যথার্থ অধ্যাপনা জীবন শুরু। কিন্তু প্রভূত অধ্যয়ন, পরিচ্ছন্ন ইতিহাসজ্ঞান ও সমাজদৃষ্টির বিশ্লেষণী ক্ষমতা দিয়ে তিনি তাঁর গবেষণা ও জ্ঞানকে অসামান্য এক ঠিকানায় পৌছে দেন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের গবেষক হিসেবে তার খ্যাতিও তুঙ্গে ওঠে। এ খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সবখানে, বাংলাভাষী সব অঞ্চলে! আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের ভাইপো ও পোষ্যপুত্র এবং ভাবশিষ্য আহমদ শরীফ আবদুল করিমেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে বাঙালি ও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনায় ব্ৰতী হন। সংস্কৃতি ও সাহিত্য ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমানের আত্মস্বরূপ অনুসন্ধানে ডক্টর শরীফের গবেষণা দৃঢ় ভিত্তি দিয়েছে। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের মতো মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যও যে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত সাহিত্য সেই সত্যটি প্রতিষ্ঠা করার কৃতিত্ব আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের ও আহমদ শরীফের। বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও সাহিত্য রাজ্যের বরপুরুষের পিতৃব্য ও ভাইপো উভয়কে নিশ্চয়ই উচ্ছ্বসিত করতালি দেবেন।
উপাত্তে মধ্যযুগ, কিন্তু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে ও দৃষ্টিভঙ্গিতে সম্পূর্ণ আধুনিক—এই হল আহমদ শরীফের মধ্যযুগের সাহিত্য গবেষণা। কিন্তু তবু অচিরে মূর্তিমান মধ্যযুগের তথাকথিত ভাবমূর্তি ভেঙে দেন আহমদ শরীফ এবং পদার্পণ করেন আধুনিক সাহিত্যের জগতে। মূল্যায়নে অভিনিবেশী হন উনিশ বিশ শতকের বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রূপকারদের–বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত এবং আরো অনেকের; একসময় যেমন তিনি মূল্যায়ন করেছেন সৌলত উজির বাহরাম খান, আলাওল, কাজী দৌলত, মুহম্মদ কবীর, সৈয়দ সুলতান, মুহম্মদ খান প্রমুখের। হয়তো কখনো তার মূল্যায়ন প্রতিক্রিয়াপূর্ণ, কিংবা কখনো বিতর্কিত, কিন্তু আহমদ শরীফের লেখার মূল্য এইখানে যে, একটা নতুন অভিমত ও দৃষ্টির পরিচয় সেখানে অবশ্যই আছে। আবার প্রতিদিনের সমাজপ্রবাহকে তিনি অভিনিবেশ সহকারে দেখেন, প্রগতি ও প্রগতির দ্বন্দকে বুঝতে চেষ্টা করেন, কিন্তু সবসময় প্রগতির পক্ষেই নিজের চিন্তা ও অভিমত অনুকূল করে রাখেন।

আহমদ শরীফের লেখায় বাংলাদেশের ভাঙাচোরা ও দুষ্ট সমাজের ক্লেদ ও ক্লিন্ন চিত্রগুলো অবশ্যই আছে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই আহমদ শরীফ নৈরাশ্য ভারাতুর নন বরং মানবিক প্রত্যয় ও প্রত্যাশায় দারুনভাবে বিশ্বাসী। আহমদ শরীফ কলাবাদী লেখক নন, উপযোগিতাবাদী লেখক। সেই উপযোগিতাবাদের মূল আধার মানুষ, বাংলাদেশের মানুষ।
উপমহাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে অসামান্য পণ্ডিত, বিদ্রোহী, অসাম্প্রদায়িক, যুক্তিবাদী, দার্শনিক, প্রগতিশীল, মানবতাবাদী, মুক্তবুদ্ধি ও নির্মোহ চিন্তার ধারক ড. আহমদ শরীফের জন্মদিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি সশ্রদ্ধ প্রণাম। 

তথ্যসূত্রঃ ব্য্যক্তিগত ঋণ- অধ্যাপক ডঃ চিত্ত, মণ্ডল, ডঃ প্রথমা রায় মণ্ডল, আনন্দবাজার পত্রিকার আর্কাইভ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কাইভ।

 

ডঃ সুবীর মণ্ডল
লোকগবেষক, প্রাবন্ধিক, অণুগল্প, ছোটগল্প, ফিচার, রম্যরচনা এবং ভ্রমণকাহিনীর লেখক 
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top