সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

পাপ : শাকিলা নাছরিন পাপিয়া


প্রকাশিত:
১৩ মে ২০২১ ০৬:৪১

আপডেট:
১৩ মে ২০২১ ০৭:১৮

 

এক.

- তুমি এখনো ছাত্র। আবেগের বশে যে সিদ্ধান্ত তুমি নিয়েছো তা ভুল। তোমার সামনে এখন দুটি পথ।
লাবনীকে নিয়ে অনিশ্চিত পথে পা বাড়ানো। এ বাড়ির পথ চিরতরে বন্ধ করে। অন্য পথ লাবনীকে ভুলে গিয়ে একটি সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়া। যে ভবিষ্যৎ নির্মাণে আমি আর তোমার মা সব সময় তোমার পাশে থাকবো। ভেবে দেখ কী করবে তুমি?

হাসান ঘোর লাগা দৃষ্টিতে মা বাবাকে দেখে। তার চিন্তা ভাবনা যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। লাবনী দাঁড়িয়ে আছে চৌরাস্তার মোড়ে। শেষ পর্যন্ত এটা ছাড়া কোন পথ খোলা ছিল না সামনে। দু'জন দু'জনকে ছাড়া বাঁচা সম্ভব নয়। অনেক অনেক ভেবে দেখেছে দু'জনই। ব্যাগটা গুছানো ছিল। আচমকা সব প্লান এভাবে ব্যর্থ হয়ে যাবে তা বুঝতে পারেনি হাসান। হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকায় বাবার দিকে। কোন কথা খুঁজে পায় না। কে যেন গলাটা চেপে ধরেছে। বাবার দৃষ্টির সম্মূখে  কুঁকড়ে যায় হাসান। বাবা দুটো ট্যাবলেট বাড়িয়ে দিয়ে বলে, এ দুটো খেয়ে নাও। ভালো ঘুম হবে। মা পানির গ্লাসটা এগিয়ে দেয়। যন্ত্রের মত আদেশ পালন করে হাসান।

চিৎকার, কান্না আর কোলাহলে ঘুম ভাঙ্গে হাসানের। উত্তরের আম বাগানের আম গাছে ঝুলছে লাবনী।
কি বিভৎস দৃশ্য! জ্ঞান হারায় হাসান। যখন পুরোপুরি জ্ঞান ফিরে নিজেকে আবিষ্কার করে মামা বাড়ির সুসজ্জিত কক্ষে।

দুই.

দীর্ঘ পাঁচ বছর পর গ্রামে এসেছে  হাসান। গ্রামের মানুষ জেনে গিয়েছিল সব। প্রভাব প্রতিপত্তির কারণে কেউ প্রকাশ্যে কিছু বলবার সাহস দেখায়নি।
তারপরও গ্রামে ফিরেনি সে।
মামাতো বোন ঝুমাকে বিয়ে করছে। ঢাকাতেই আনুষ্ঠানিকতা সেরেছে।
ঝুমাকে বিয়ে করে রাজকন্যা আর রাজত্ব দুটোই পেয়েছে। ঝুমা ঘুমাচ্ছে। হাসান একাই হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে উত্তরের আম বাগানে। থোকায় থোকায আম ধরে আছে গাছে গাছে।  কতদিন পর সেই পরিচিত সুবাস, পরিচিত প্রকৃতির স্পর্শ। হাত রাখে হাসান একটা আমগাছে। এই সেই গাছ। লাবনী ঝুলছিল এখানে।
হাসান চোখ বন্ধ করে দু হাতে জড়িয়ে ধরে গাছটিকে। দু চোখে প্লাবন। হঠাৎ স্পর্শে চমকে তাকায়।
জল ভরা চোখে বাবা তাকিয়ে তার পানে।
- বাবা তুমি?
- আমার ওপর এখনো রাগ আছে তোর?
- না, বাবা। তুমি যা করেছিলে সন্তানের মঙ্গলের জন্য করেছিলে।
- মাঝেমাঝে নিজেকে অসহায় লাগে। কে জানতো মেযেটা এমন করবে? পুরোটা পরিবার এভাবে ছাড়খাড় হয়ে যাবে? মেয়ের শোক সইতে না পেরে তিন মাসের মধ্যে ওর বাবা চলে গেল। এক বছরের মাথায় ওর মাও চলে গেলো। নিজেকে ক্ষমা করতে পারি না কিছুতেই। আচ্ছা খোকা, তুই কেন সেদিন তোর ভালোবাসার জন্য প্রতিবাদ করলি না? আমি বাবা হিসাবে আমার কর্তব্য করেছিলাম। তুই প্রেমিক হিসাবে তোর কর্তব্য করতে যদি না পারবি তাহলে একটা মেয়েকে কেন ঘর থেকে বের করলি?
- বাবা, আমি লাবনীর মতো করে ভালোবাসতে পারিনি। আমার মধ্যে স্বার্থপরতা, লোভ ছিল। আমাদের মনে হয়েছিলো আমরা কেউ কাউকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না। অথচ দেখ কেমন দিব্যি বেঁচে আছি। সফলতা, আনন্দ কোথাও কম নেই কিছু।

ন্যুব্জ দেহে, ঝাঁপসা চোখে ছেলের দিকে তাকায় এক সময়ের প্রতাপশালী পিতা।

তিন.

বিশ বছর পর।
সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলছে হাসান আর ঝুমার সন্তান স্বপ্না। একমাত্র মেয়ে স্বপ্নাকে ঘিরেই ছিল হাসানের গোটা পৃথিবী। যেন তার আত্মাটা থাকতো মেয়ের কাছে।
ঝুমা চিৎকার করে কাঁদছে। সারা বাড়ি লোকে লোকারণ্য। মিডিয়ার লোকজন চলে এসেছে পুলিশ আসার আগেই। পুলিশ এসে লাশ নামাবে। লাশের কাছাকাছি কাউকে যেতে দেয়া হচ্ছে না।
ঝুমা চিৎকার করে কোন এক ছেলেকে অভিশাপ দিচ্ছে। লোকজন বলাবলি করছে কোন এক ছেলে স্বপ্নাকে ধোকা দিয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে এই পরিণতি বেছে নিতে হয়েছে।
হাসানের কানে কোন কথাই যেন ঢুকছে না।
কিন্তু একি! ফ্যান নয়, সে দেখছে আমগাছ। স্বপ্না নয়, সে দেখছে লাবনীকে।
হাসানের মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ঐ তো ঘরের এক কোনায় দাঁড়িয়ে হাসছে লাবনীর বাবা।
হাসান বিড়বিড় করে বলে, আপনি হাসছেন কেন?
ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকায় লাবনীর বাবা। দাঁতে দাঁত পিষে বলে, সেদিন আমি ছিলাম বাবা। আজ তুমি বাবা। কেমন মজা তাই না?
একটা অট্টো হাসি ছড়িয়ে পড়ে সারা ঘরময়।



শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
শিক্ষক, কলামিস্ট ও কবি   

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top