সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

 আজও দুই বাংলায় কবি নজরুলের প্রাসঙ্গিকতা ও জনপ্রিয়তা অম্লান : ডঃ সুবীর মণ্ডল


প্রকাশিত:
২৪ মে ২০২১ ২১:৪৬

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ০৪:২৪

ছবিঃ কবি কাজী নজরুল ইসলাম

 

কবি কাজী নজরুল ইসলামের যেমন ঘটনাবহুল বর্ণময় জীবন, তেমনি বিচিত্র তাঁর  সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি। শৈশব থেকেই অশান্ত উদ্দাম উপপ্লবী। প্রথাগত শিক্ষাকে প্রায় উপেক্ষা করে  নির্বিশেষে সমাজ ও প্রকৃতির মেধাবী পাঠ  নিয়েছিলেন তিনি। হয়ত সেই  কারণেই, অকুণ্ঠ মানবিক উদারতা, শীলিত অনুভবের পাশাপাশি প্রকৃতির  রুদ্র দহন তাঁর  বর্ণময় ব্যক্তিত্বের বিশেষ  দিক, ধর্মীয় কুসংস্কার ও সাম্প্রদায়িক নীচতার বিরুদ্ধে খণ্ডিত জীবনের  সাহিত্য--সাধনা দীপ্র প্রতিবাদ স্বরূপ। কবির 'বিদ্রোহী'   কবিতার শতবর্ষ পূর্তি  নানা দিক  থেকে  গভীর  তাৎপর্যপূর্ণ। 

অতিমারির তাণ্ডবলীলা, বিশ্বজুড়ে চরম দুঃসময়  চলছে, কবে কাটবে   কেউ  জানি না। মারণরোগের বিরুদ্ধে লড়াই আজও থামেনি। চারদিকে  রাজনৈতিক অস্থিরতা। পারমাণবিক  অস্ত্র পরীক্ষা ও প্রতিযোগিতা, অশুভ মৌলবাদী শক্তির আস্ফালনে তমিস্রাবৃত উপমহাদেশে, চারিদিকে ভাঙনের শব্দ জান্তব উল্লাস অনিশ্চয়তা আর সীমাহীন  অস্থিরতা, মন্দির-মসজিদ ঘিরে টিকি আর টুপিওয়ালাদের  আস্ফালন!  মোহময় স্বপ্নের সরণি বেয়ে যারা হাটঁছিল, থমকে দাঁড়িয়েছে----

ঘরপোড়া গরু যেমন! এমনি এক অরুন্তুদ সময়ের মুখোমুখি আমরা, তবু ভীত নই, উন্নতশির। কেননা সঙ্গে রয়েছেন নজরুল ও রবীন্দ্রনাথ। আমাদের প্রত্যয়ের বিন্দুতে সিন্ধুর উত্তরাধিকার। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ইসলাম আমাদের অভিজ্ঞান। একে রক্ষা করাই আমাদের 'বিদ্রোহী 'কবিতার শতবর্ষের শ্রেষ্ঠ অঙ্গীকার। 

 

'জনপ্রিয়তা' শব্দ বন্ধটি   সংক্ষিপ্ত হলেও তা গভীর ব্যঞ্জনাময় ও অর্থবোধক। শব্দটির অন্তর্নহিত অর্থ বহু ব্যাপ্ত। একজন কবি-সাহিত্যিকের জনপ্রিয়তা নিরূপণ করা অত্যন্ত দুরূহ কাজ। আসলে কোন কোন মানদণ্ডে? তাঁর জনপ্রিয়তা নিরূপণ করা হবে, তার নির্দিষ্ট সহজ-সরল পথ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর বলেই মনে হয়। প্রকৃত অর্থে জনপ্রিয়তা সহজলব্ধ নয়। অনেক ত্যাগ, তিতিক্ষা, শ্রম,নিষ্ঠা ও  অধ্যবসায়ের ফলশ্রুতিতে জনপ্রিয়তা অর্জন করা সম্ভব। পেশিশক্তি, অস্ত্রশক্তি, অর্থ বলে, প্রচারের  ফানু ফাটিয়ে যে জনপ্রিয়তা লাভ করা যায়, তা সাময়িক, দীর্ঘমেয়াদী কখনো নয়। আপামর জনসাধারণের  হৃদয়ের সবুজ উপত্যকায় যিনি স্থায়ী আসন করে নিতে পারেন, তিনিই  সত্যিকার জনপ্রিয়।  জনপ্রিয়তা লাভের রাস্তা খুব সোজা নয়, অত্যন্ত বক্র। সংখ্যায় এমন মানুষ লাখে মেলে না, কোটিতেই বা কয়জন? কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন তেমনই একজন, প্রকৃত অর্থে জনপ্রিয় বর্ণময় ব্যক্তিত্ব। 

পরম শ্রদ্ধেয় বর্ণময় ব্যক্তিত্ব এবং আমাদের সকলের জীবন আকাশের ধ্রুবতারা, বিস্ময়কর বিরল প্রতিভা হিসেবে বিশ্ববন্দিত বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমাদের গর্বের সীমা নেই, তবু সসঙ্কোচে বলতে দ্বিধা নেই যে, একটা সময়ে জনসাধারণের অত্যন্ত কাছের মানুষ হিসেবে জনপ্রিয়তার নিরিখেই বয়সে অনেক ছোট হলেও কবি নজরুল ইসলাম ও অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের স্হান ছিল একটু হলেও ওপরেই। বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী। এই ধরনের মন্তব্য অনেকেই প্রসন্ন চিত্তে কখনো হয়ত মন থেকে মেনেই নেবেন না। হয়ত  সমালোচনার ঝড় উঠবে, কটু মন্তব্য কেউ কেউ করবেন। এই ভাবনা আমার স্পর্ধিত অহংকার প্রসূত নয়, আধুনিক গবেষকদের গবেষণার তথ্য বলছে। ইতিবাচক, উদার প্রসারিত দৃষ্টিতে এবং মুক্তমনে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করাই যেতে পারে। অনেকেই বিরুদ্ধে নানা কথাও বলতেই পারেন। কিন্তু তৎকালীন বাস্তব চিত্র বিচার ও পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সে যুগে চলচ্চিত্রে রবীন্দ্র রচনার চেয়ে কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের কাহিনী দর্শকসমাজে বেশি আদরনীয় ও গ্রহণীয় হয়ে ওঠায় এবং যুবমানসে বিশেষত স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী মানুষদের মধ্যে নজরুল ইসলামের অবিসংবাদী জনপ্রিয়তা গড়ে ওঠায় রবীন্দ্রনাথের এই দুজনের প্রতি প্রচ্ছন্ন ঈর্ষা ছিল-  একথা অস্বীকার করলে ইতিহাস তথা চিরন্তন সত্যের অপলাপ হয় বলে আমার নিজস্ব বিশ্বাস। অবশ্য, ঈর্ষা কোনও নিন্দার্হ শব্দ নয় আদোও। কবি  গুরুর ভাষায় বলা যেতে পারে, 

" ঈর্ষা বৃহতের ধর্ম। ঈর্ষা সুমহতী/ দুই বনস্পতি মধ্যে রাখে ব্যবধান।" (গান্ধারীর আবেদন)

 

রবীন্দ্রভক্তের দল ও স্তাবকবৃন্দ প্রায়শই নজরুলের কাব্যের  নিন্দা  করতেন। রবীন্দ্রনাথ তাদের একদিন বলেছিলেন, "কাব্যে অসার ঝনঝনা থাকতে পারবে না, এও তোমাদের অদ্ভুত আব্দার বটে, আমি যদি আজ তরুণ হতাম, আমার কমলেও ঐ সুর বাজত।" তখন অমল হোম মশাই তাঁকে বললেন, "যাই বলুন, এ অসির ঝনঝনা জাতির মনের আবেগে ভাঁটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই নজরুলী কাব্যের জনপ্রিয়তাও মিলিয়ে যাবে।"

এর জবাবে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, "জনপ্রিয়তা কাব্য- বিচারের স্থায়ী নিরিখ নয়, কিন্তু যুগের মনকে যা প্রতিফলিত করে, তা শুধু কাব্য নয়, মহাকাব্য।"

 

নজরুলের রচনার মধ্যে যে আবেগ এবং প্রাণবন্যা ছিল তা একদিকে যেমন জনমানসে প্রচণ্ড উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল, অপরদিকে তেমনই ইংরেজ শাসক ও রক্ষণশীলদের মনে তীব্র আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিল। তাঁর কবিতা ও গান এদেশের অসংখ্য মানুষকে মুক্তিসংগ্রামে টেনে এনেছে অনায়াসে, আত্মদানে উদ্বুদ্ধ করেছে। জনমানসে তিনি যে গভীর প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন তার কারণ শুধুমাত্র তাঁর কবিমানস নয়, ব্যক্তিমানসেও তিনি তৎকালীন যুবসমাজের আশা-আকাঙ্খার প্রতীক হতে পেরেছিলেন। বালক বয়সে কঠোর দারিদ্র্যের সঙ্গে তাঁর সংগ্রাম, মেধাবী ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও মাত্র ষোল বছর বয়সে সৈন্যবাহিনীতে যোগদান, পরাধীনতার শৃঙ্খলমোচনের জন্য অদম্য আকুতি ও আবেগ, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অকৃত্রিম ও ঐকান্তিক উদ্যোগ ইত্যাকার চারিত্রবৈশিষ্ট্য তাঁকে সহজেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে গিয়েছিল। তবে এটা অনস্বীকার্য যে, শৈশবে পিতৃহারা এবং মাতৃস্নেহ থেকেও প্রায়-বঞ্চিত হবার ফলে নজরুলের মধ্যে সংবেদনশীল অনুভূতিপ্রবণতার প্রাবল্য ছিল। 

তাঁর যখন মাত্র ৮/৯ বছর বয়স, জ্ঞানোন্মেষের সেই প্রথম প্রহরেই ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী  প্রমুখের আত্মদানের ঘটনা তাঁর ওপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে। শিক্ষক হিসেবে বিপ্লবী নিবারণ ঘটকের সান্নিধ্য ও উপদেশাবলীও তাঁকে  স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তৎকালীন জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ আপসের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের উপায় খুঁজছিলেন। এই সময়ে সবাইকে অবাক করে দিয়ে নজরুল ইসলাম চলে গেলেন সৈন্যবাহিনীতে। আসলে ইংরেজদের তোষণ করে দেশের স্বাধীনতা আনা সহজসাধ্য নয়। সাধারণ বুদ্ধিতে মনে হতে পারে, তিনি কংগ্রেস নেতাদের ডাকে সাড়া না দিয়ে সৈন্যদলের যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি মনে মনে ভেবে রেখেছিলেন অন্য কথা "স্হির হল, অস্ত্রশস্ত্র চালনা না করলে ইংরেজকে তাড়ানো যাবে না। অতএব ইংরেজ সৈন্যদলে ঢুকে সব কিছু উত্তমরূপে শিখে দেশের তরুণদের  শিখিয়ে ইংরেজদের ঘা দিতে হবে।" ১৯২০ সালের মার্চ মাসে ফৌজ থেকে ফেরার পর তিনি মুজফ্ফর আহমেদের সঙ্গে বসবাস করতে শুরু করেন। স্বাধীনতার জন্য, সমাজ পরিবর্তনের লড়াইয়ে নেমে তিনি ঠিক মানুষকেই বেছে নিয়েছিলেন সাথী হিসেবে। 

ব্যক্তি নজরুল ইসলাম ছিলেন  আপাদমস্তক একজন অসাম্প্রদায়িক মুক্তমনা মানুষ। মানবতার পুজারি। সমস্ত ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে এক মানবপ্রেমিক মানুষ। সব ধর্মের ও বর্ণের মানুষের আপনজন। এই বিষয়ে বহু ঘটনার কথা ছড়িয়ে আছে  তাঁর বর্ণময় জীবনকে নিয়ে। মনের আকাশকে কখনো খণ্ড করে দেখেন নি। জীবন ভর পেয়েছেন মানুষের অকৃত্রিম ভালবাসা। তাঁর কাব্য জুড়ে আছে সর্ব-ধর্ম সমন্বয়ের কথা। কথায় ও কাজে তাঁর পরিচয় সুস্পষ্ট। খুব সহজেই মানুষকে আপন করে নিতে পারতেন। এটা তাঁর অসাধারণ জনপ্রিয়তার মাইলফলক। একবার ভুল বুঝে স্হানীয় কয়েকজন যুবক তাঁকে রাত্রে বাড়ি ফেরার পথে লাঠিসোটা নিয়ে আক্রমণ করে। নজরুল তাদের হাত থেকে লাঠি কেড়ে নিয়ে পাল্টা মার দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে তাঁর শৌর্য-বীর্য শুধু কলমেই শোভা পায় না। পরবর্তীকালে সেই যুবকেরা তাঁর অনুগত ভক্তে পরিণত  হয়েছিল।  নজরুলের জনপ্রিয়তা নিয়ে এরকম অসংখ্য ঘটনা আছে। শুধু মধ্যবিত্ত সমাজই নয়, আড়িয়াদহ থেকে শুরু করে নৈহাটি পর্যন্ত গঙ্গার ধারে প্রায় প্রতিটি চটকলে তিনি শ্রমিকদের সঙ্গে মিশেছেন, তাদের আন্দোলন ও সংগঠন এবং ধর্মঘটে  গান গেয়ে, আবৃত্তি করে, বক্তৃতা দিয়ে উৎসাহিত ও উদ্দীপিত করেছেন। চন্দননগরের একটি  সরস্বতী পুজোর উদ্বোধনের সময় এখানে তিনি  'দীপান্তরের বন্দিনী' কবিতাটি পড়ে শোনান। তখন ১৯২৪ সাল। আন্দামানের বন্দীদের মুক্তি আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে সারাদেশ। এই কবিতায় যুবকদের উদ্বুদ্ধ করতে তিনি আর বলেন----'বাজাও পাঞ্চজন্য শাঁখ/ দীপান্তরের ঘানিতে লেগেছে যুগান্তরের ঘূর্ণিপাক।' বাঙালির দুর্ভাগ্য, অসাধারণ প্রতিভা ও অফুরান প্রাণশক্তি অধিকারী নজরুল ইসলামের সৃজনশীল অবদান মাত্র ২০-২৫ বছর স্হায়ী ছিল। তার মধ্যে সচেতন কর্মপ্রয়াসের পরিধি ছিল আরও ছোট, ১৯২০ থেকে ১৯৩১ পর্যন্ত বছর ১২ মাত্র।  

স্বল্প সময়ের মধ্যেই বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জনের ক্ষেত্রে অন্যতম সহায়ক ছিল তাঁর সৌম্যকান্তি চেহারা। অন্যতম সুহৃদ সোমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বর্ণনায়, "সবল শরীর, ঝাঁকড়া চুল, চোখ দুটি যেন পেয়ালা, প্রাণের অরুণ রসে সর্বদা ভরপুর। গলার স্বরচিত ছিল ভারি, মোটা গলার সুরে ছিল যাদু। ঢেউয়ের আঘাতের মতো, ঝড়ের ঝাপটা মতো আছড়ে পড়তে তাঁর গান শ্রোতার বুকে।" আর তাঁর আচার--আচরণ, স্বভাবচরিত্র, সে ছিল অতুলনীয়। অধ্যক্ষ সুরেন্দ্রনাথ মৈত্রের কন্যা উমা, বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী প্রতিভা বসু (ছাত্রী অবস্থায় রাণু সোম) থেকে শুরু করে আঙুরবালা, ইন্দুবালা, ফিরোজা বেগম পর্যন্ত অসংখ্য মহিলা তাঁর কাছে গান শিখতেন। প্রত্যেকেই তাঁর চারিত্র বৈশিষ্ট্যে মুগ্ধ। সবচেয়ে কম কথায় প্রকাশ করেছেন কণ্ঠশিল্পী যূথিকা রায়, "ব্যক্তিগত জীবনে কাজী সাহেবকে মনে হয়েছে তিনি সুন্দর, সরল, সহজ, নিরহঙ্কার, আনন্দময় - শিশুর মতো মানুষ। এমন প্রাণখোলা আমি আর দেখেনি। কোথাও শুনিনি"।

আজকাল যুবসমাজ যেমন ফিল্মস্টারদের নকল করে আনন্দ পায়, সেকালে নজরুল ইসলামের পোশাক-পরিচ্ছেদ, চুলছাঁটা ইত্যাদি তারা নকল করত। আজ কালকার তরুণ প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের মুখে যেমন ফিল্মস্টারদের আমদানি করা অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ শোনা যায়, বয়স্ক সাধারণ মানুষ যা বুঝতে অক্ষম, সেই সময়ে অনুরূপ কতকগুলো বাক্য নজরুল ইসলামের কাছ থেকে তারা শিখেছিল এবং প্রায় আওড়াত। সেগুলি হল; ঘি চপচপ, কাবলি মটর, চালাও পানসি বেলঘরিয়া, দে গরু গা ধুইয়ে ইত্যাদি। মূলত যে গান আর আবৃত্তি জন্য নজরুল ইসলাম প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন সে বিষয়ে সবচেয়ে ভাল বলেছিলেন তারই সমবয়সী বিশিষ্ট গায়ক ও সুরকার দিলীপ কুমার রায়। তিনি বলেছিলেন, নজরুল- 'এমন গাইত যে ভাঙা গলাতেও ভাঙা বলে মনে হত না। আগুন ছটিয়ে দিত সে। এমন প্রাণোন্মাদী গায়ক কি আর দেখব এমন মরা যুগে!' প্রিয় বন্ধু পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর 'চলমান জীবন' গ্রন্থে এক জায়গায় লিখেছেন ''ঘর কাঁপিয়ে, মাথা ঝাঁকিয়ে, সর্বাঙ্গ দুলিয়ে গেয়ে চলল নজরুল" নজরুল থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত কেউ ব্যঙ্গের কশাঘাতে থেকে রেহাই পায়নি, সেই শনিবারের চিঠির অন্যতম লেখক পরিমল গোস্বামী পর্যন্ত নজরুলের গানের প্রশংসা না করে পারেননি। "গাইবার সময় নজরুল মেতে উঠতেন- গলা মধুর ছিল না, কিন্তু গানের মধ্যে এমন প্রাণ ঢেলে দিতেন যে, মুগ্ধ না হয়ে পারা যেত না।" সত্যিই আত্মহারা হয়ে গাইতেন নজরুল। নিজেই ঠাট্টার সুরে বলেছিলেন, "আমি তো গলা দিয়ে গাই নে, গান করি আমার কলজে দিয়ে।"

১৯২৪ সালে হুগলিতে গান্ধীজির সঙ্গে যখন কবি নজরুলের সাক্ষাৎ হয়, তিনি তাঁকে চরখা নিয়ে গান ও কবিতা লিখে উপহার দিয়েছিলেন। তবু গান্ধীজি নজরুলকে প্রভাবিত করতে পারেন নি। ১৯২৫-২৬ সালে নজরুল ইসলাম রাজনৈতিক কর্মধারায় গভীর ভাবে জড়িয়ে পরেন। বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি ও আন্দোলনে গানে, কবিতায়, বক্তৃতায় নজরুল উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিলেন। মুজফ্ফর আহমেদের সঙ্গে বসবাস করতে শুরু করেন। দুজনেই 'লাঙল' কাগজটি যুগ্মভাবে সম্পাদনা করতেন। নজরুল ইসলাম মুজফ্ফর আহমদ সম্পর্কে লিখেছিলেন তা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক- "মুজফ্ফরকে দেখলে লোকের শুষ্ক চক্ষু হেঁটেও জল আসবে। এমন সর্বত্যাগী আত্মবোধানেন্দর মোনী কর্মী, এমন ধ্যানীর দূরদৃষ্টি, এমন উজ্জ্বল প্রতিভা- সবচেয়ে এমন উদার বিরাট বিপুল মন নিয়ে সে কি করে জন্মাল গোঁড়া মৌলবীর দেশ নোয়াখালী, এই মোল্লা মৌলবীর দেশ বাংলায়, তা ভেবে পাইনে। ও যেন আগুনের শিখা, ওকে মেরে নিবৃত্ত করা যায় না।" ১৯২৬ সালের বেশিরভাগ সময়ই নজরুল কাটিয়েছিলেন কৃষ্ণনগরে।

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পর যখন সুভাষচন্দ্র বসু ও যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তর মধ্যে নেতৃত্বের লড়াইয়ে জাতীয় কংগ্রেস অন্তর্দ্বন্দ্বে দীর্ণ। নজরুল সেই সময় এক সম্মেলনে শোনালেন, "দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার।" এই সময়ে একটি ব্যঙ্গ কবিতা লিখেছিলেন "মুসলমানের হাতে ছুরি নাই, হিন্দুর হাতে বাঁশ নাই।" দেশবন্ধুর মৃত্যুতে শোকাহত নজরুল ইসলাম হুগলি থেকে শেওড়াফুলি বৈদ্যবাটি পর্যন্ত বিশাল এলাকা জুড়ে শোক মিছিল পরিচালনা করেছিলেন। গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে গেয়ে বেড়িয়েছেন, "খোলো মা দুয়ার খোলো/ প্রভাতের সন্ধ্যা হল/ দুপুরেই ডুবল দিবাকর গো”। সেই ১৯২১ থেকেই মানুষ তাকে নানান ভাবে দেখে এসেছেন। একজন মানবিক, অসাম্প্রদায়িক চেতনা সম্পন্ন, বিবেকবান, দায়িত্বশীল মুক্তমনা মানুষ রূপে। এইসব বিরল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তাঁকে সহজেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে গিয়েছিল বলে মনে হয়। জাতি-ধর্মনির্বিশেষে সবার প্রিয় মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। শুধু মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গকামী করেছিলেন। এমন আদর্শবাদী, সর্বত্যাগী মুক্তমনা মানুষই, মানুষের হৃদয়ের মানচিত্রে চিরজীবী হয়ে থাকে। 

 

জনগন হল সমুদ্রের মতো। সমুদ্রকে যেমন যা কিছু দেওয়া যায়, সমুদ্র তাই আবার ফিরিয়ে দেয়। এটাই বাস্তব সত্য। তেমনি কেউ যদি তাঁর মহান মানবিক কাজকর্মের মধ্যে জনগনের স্বার্থে কিছু করে তাহলে জনগন কৃতজ্ঞচিত্তে তা পরিশোধ করে দেয়। কিছু কিছু শিক্ষিত মহলের মানুষ আজও নজরুল ইসলামের প্রতি প্রচ্ছন্নভাবে উন্নাসিক মনোভাব পোষণ করে থাকলেও নজরুল ইসলাম আজও সাধারণ কোটি কোটি বাঙালির হৃদয়ের মানচিত্রে অধিষ্ঠিত, একজন পরমপ্রিয় মানুষ হিসেবে। আজও দুই বাংলার গ্রামে-গঞ্জ, অফিসে, আদালতে, স্কুল-কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রায় সমান গুরুত্ব দিয়েই তাঁর জন্মজয়ন্তী পালন করে থাকেন। তার কারণ একটাই। নজরুল ইসলাম তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সুস্থ অংশটাই দেশবাসীর পরাধীনতার বন্ধনমুক্তি অথবা দুঃখ-কষ্ট-শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে ব্যয় করেছেন। 

বিদেশি শাসকের শোষণ মুক্তি জন্য, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প দূর করার জন্য, মেহনতি মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যে লড়াই নজরুল ইসলাম শুরু করেছিলেন, তা আজও সম্পূর্ণ হয়নি, তাই আজও  দু বাংলার জনসাধারণ সমাজ পরিবর্তনের লড়াইয়ে নজরুল ইসলামকে প্রেরণাভূমি হিসেবে গণ্য করে, তিনি জনপ্রিয় হবেন না তো কে হবেন?     

আমাদের  প্রত্যয়ের বিন্দুতে সিন্ধুর উত্তরাধিকার। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ইসলাম আমাদের অভিজ্ঞান। একে রক্ষা করাই আমাদের শ্রেষ্ঠ অঙ্গীকার।  বর্তমানে বিশ্বজুড়ে মোহময় দুঃসময় চলছে, চরম দুঃসময়ের মুখোমুখি আমরা, কবে কাটবে কেউ জানি না, তবু ভীত নই উন্নতশির। কেননা সঙ্গে রয়েছেন নজরুল ও রবীন্দ্রনাথ। ধর্মীয় কুসংস্কার ও সাম্প্রদায়িক নিচুতলার বিরুদ্ধেই খণ্ডিত জীবনের সাহিত্য-সাধনা দীপ্র প্রতিবাদ স্বরূপ। আমাদের এই মোহময় দুঃসময়ে বেদবাণী হোক-"একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু- মুসলমান, মুসলিম তাঁর নয়নমনি হিন্দু তাঁর প্রাণ"—অথবা "হিন্দু না ওরা  মুসলিম 'ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?

কান্ডারী! বল, ডুবেছে  মানুষ সন্তান মোর মা'র।"  বাংলা কাব্য গগনে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব নানাভাবে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। সমস্ত সীমাবদ্ধতা, অসম্পূর্ণতা এবং অসংগতি স্বত্তেও কবি হিসাবে, মানুষ হিসাবে, যুগনায়ক রূপে তিনি যে, এক অনন্য পুরুষ সেটি কবিতা, গান, এমনকি  গদ্য রচনায় মূর্ত করে তুলেছিলেন। তাঁর কাছে বাঙালি সমাজের ঋণ এই যে, তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বাংলার হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করে, নব বিকাশ ধারায় ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে অনেক দূর পর্যন্ত গাথুনী নির্মাণ করেছিলেন। 

কবি নজরুল ইসলামের কাছে বাঙালি মুসলমান সমাজের প্রণিধানযোগ্য ঋণ এই যে, তিনি তাদের ভাষাহীন পরিচয় ঘুচিয়ে দিয়ে তাদের সামাজিক ভাষাকে সাহিত্য সৃষ্টির ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা দান করলেন এবং স্বীকৃতি অর্জন করে দিলেন। তাছাড়া নজরুল ইসলাম, ইসলাম ধর্ম ও বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যবর্তী ঐতিহাসিক ব্যবধান কমিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর সাহিত্য সাধনার মধ্য দিয়ে বাঙালি মুসলমান সমাজে সংস্কৃতি চর্চার এক নব দিগন্তের সন্ধান পেয়েছিল। বাঙালি মুসলমান সমাজ শিল্প ও সংস্কৃতি চিন্তার ক্ষেত্রে কবি নজরুল ইসলামের মত আর কারোর কাছে অত বিপুল পরিমাণ ঋণী নয় বলে মনে হয়। এই ভাবনা আমার নিজস্ব বিশ্বাস প্রসূত। 

২০২১ সাল একটি ঐতিহাসিক কাল। কবি নজরুল ইসলামের  'বিদ্রোহী' কবিতার শতবর্ষ। দেশ-কালের সঙ্গে এই কবিতা গভীর ভাবে সম্পৃক্ত। তাঁর 'বিদ্রোহী' কবিতার মাধ্যমে বিদ্রোহ ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে। অত্যাচারের বিরুদ্ধে। অধর্মের বিরুদ্ধে। যা মিথ্যা, কলুষিত, পুরাতন পচা, সেই মিথ্যা সনাতন বিরুদ্ধে। ধর্মের নামে ভণ্ডামি আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। 'বিদ্রোহী' কবিতা  নজরুল ইসলামের জীবনে নিন্দা ও প্রশংসা দুই এনেছিল। ইসলামিক শব্দের পাশাপাশি তিনি হিন্দু ও গ্রিক পুরাণের অনুষঙ্গ ব্যবহার করেছিলেন। এই কারণেই মৌলবাদীরা তাঁকে কাফের বলে অভিহিত করেছিলেন। এমনকী বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, "নজরুলের 'বিদ্রোহী' কবিতায় বিদ্রোহ যতটা সামাজিক ও রাজনৈতিক, ততটা সাহিত্যিকের নয়। কিন্তু এই কবিতা যখন প্রচুর সমাদর পেল, তখনো কবি গুরু রবীন্দ্রনাথকে নজরুল ভুলে যাননি। ৪কপি 'বিজলী', পত্রিকা নিয়ে তিনি সটান জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্রনাথের কাছে যান। উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে তিনি সেদিন কবিগুরুকে 'বিদ্রোহী' কবিতা পড়ে শোনান। পড়া শেষ হলে নজরুলকে জড়িয়ে ধরেন রবীন্দ্রনাথ। সেই সময় তিনি বলেছেন- "তুমি নিশ্চয় আমাকে অতিক্রম করে যাবে। তোমার কবিতা শুনে মুগ্ধ হয়ে গেছি। আশীর্বাদ করি, তোমার কবি প্রতিভায় বিশ্বজগৎ আলোকিত হোক।"

আমরা  অনেকেই জানি, কবিগুরু তাঁর 'বসন্ত' নামের কাব্যনাটক নজরুলকে উৎসর্গ করেন। বসন্তের অগ্রদূতকে একেবারে সঠিক উৎসর্গ। 'বিদ্রোহী' কবিতা লেখার এ বছর শতবর্ষ। এই কবিতা নিয়ে আমাদের আবেগ রয়েছে। 'বিদ্রোহী' কবিতা যখন কবির ছেলে কাজী সব্যসাচী আবৃত্তি করতেন, তখন অনেক সংবেদনশীল মানুষেরই রক্ত টগবগ করে ফুটত। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অনুপ্রেরণা জোগাতে 'বিদ্রোহী' কবিতার এক উজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। 

এই মোহময় দুঃসময়ে প্রাসঙ্গিকতা: বাঙালি জাতি সৌভাগ্যবান যে নজরুলের মতন উদার, মুক্তমনা, অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি ও লেখক এই রাঢ় বাংলায় জন্মেছিলেন। আজকের দিনে যে হিংস্র জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মান্ধতার কালো মেঘ সারা পৃথিবীতে ছেয়ে গেছে, সেখানে লেখক -কবি-গায়ক নজরুল ইসলাম দিনে দিনে আরো বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন।

"গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।
নাই দেশ কাল পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,
সব দেশে সব কালে ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জাতি।"
এই সহজ সত্যটি এত সাদা মাটা ভাবে যিনি বলতে পারেন, তিনি সত্যের কবি, তিনি জনগণের কবি, তিনি দেশ-কাল-পাত্রের উর্দ্ধে মহাকবি। তিনি শুধু কবিই নন, তিনি সুরকার, তিনি গায়ক, তিনি লেখক, তিনি বিপ্লবী, তিনি বিদ্রোহী, তিনি সাম্যবাদী, তিনি বন্দে পুরুষোত্তম। তাই তো এই কথা একমাত্র তিনিই বলতে পারেন-
"প্রার্থনা করো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত লেখায় তাদের সর্বনাশ।"

আমি কোন নজরুল বিশেষজ্ঞ নই, সাহিত্যের লোকও নই, একজন নজরুল প্রেমিক সাধারন মানুষ। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এখনও নজরুলের যথার্থ এবং প্রকৃত মূল্যায়ন হয়নি। নজরুলের আদর্শকে যদি আমরা সত্যিই ভালোবাসি, নজরুলকে জানতে চাই, বুঝতে চাই, তবে অবশ্যই নজরুল চর্চার পরিধিকে ছড়িয়ে দিতে হবে সাধারণ মানুষের মধ্যে।                

 

ডঃ সুবীর মণ্ডল
প্রাবন্ধিক, লোকগবেষক, অণুগল্প, ছোটগল্প, রম্যরচনা ও ভ্রমণকাহিনীর লেখক 
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top