সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

সাম্প্রতিক বেলুড় মঠ: সোনালি ইতিহাসের খোঁজে (পর্ব এক) : ডঃ সুবীর মণ্ডল


প্রকাশিত:
৭ জুলাই ২০২১ ২০:১৫

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ০২:১৯

 

বেলুড়মঠ হল রামকৃষ্ণ পরমহংসের প্রধান শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রধান কার্যালয়। গত ১লা মে উদযাপিত হলো ১২৫তম প্রতিষ্ঠা দিবস অতি সাধারণ ভাবে করোনার আবহে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হাওড়া জেলা শহরের বেলুড় অঞ্চলে হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত বেলুড়মঠ, তিলোত্তমা নগরী কলকাতার একটি আকর্ষণীয় দ্রষ্টব্যস্হল। বেলুড় মঠের রামকৃষ্ণ মন্দির- রামকৃষ্ণ ভাব - আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। এই মন্দিরটি হিন্দু- ইসলামি, বৌদ্ধ- খ্রিষ্টান স্থাপত্যের মিশ্রণে একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। ৩১ একর জমির উপর অবস্থিত মূল মঠপ্রাঙ্গণে রামকৃষ্ণ পরমহংস, সারদা দেবী, স্বামী বিবেকানন্দরের দেহাবশেষের উপর অবস্থিত মন্দির ও রামকৃষ্ণ মিশনের সদর কার্যালয় অবস্থিত। এছাড়া স্বামী ব্রক্ষানন্দ মন্দির ও রামকৃষ্ণমঠ এবং মিশনের বর্ণময় ইতিহাস তুলে ধরার লক্ষ্যে একটি সংগ্রহশালা এখানে স্থাপিত হয়েছে। বেলুড়মঠ সন্নিহিত একটি প্রাঙ্গণে গড়ে উঠেছে রামকৃষ্ণ মিশন অনুমোদিত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। স্বামী বিবেকানন্দের পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে মন্দিরের নকশা নির্মাণ করেছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংসের অপর শিষ্য স্বামী বিজ্ঞানানন্দ। বেলুড় মঠ ভারতের একটি ঐতিহ্যমণ্ডিত পর্যটন কেন্দ্র এবং একটি পবিত্র তীর্থভূমি। সমগ্র মানব জাতির কাছে এক ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। বেলুড়মঠ বিভিন্ন স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিক্ষা, নারীকল্যান, শ্রমিক ও অনগ্রসর শ্রেণীর স্বার্থে  গ্রামোন্নয়ন, ত্রাণ ও পুনর্বাসন, ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। রামকৃষ্ণ, সারদা দেবী, বিবেকানন্দের জন্মতিথি ও প্রয়াণতিথি সহ বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান, বড়দিন, দুর্গা পূজা, বিশেষত  মহাষ্টমীর কুমারী পূজা জগৎ বিখ্যাত। প্রতি বছর প্রচুর মানুষের সমাগম ঘটে। বেলুড়মঠের সন্ধ্যাবেলার আরতি অনন্য।
১৮৯৭ সালে পাশ্চাত্য থেকে কয়েকজন অনুগামী সংগ্রহ করে কলম্বো প্রত্যাবর্তন করেন স্বামী বিবেকানন্দ। এরপর ভারতে ফিরেই তিনি দুটি মঠের গোড়াপত্তন করেন। একটি আলমোড়ার নিকট হিমালয়ে অবস্থিত মায়াবতীতে অদ্বৈত আশ্রম ও অপরটি কলকাতার সন্নিকটস্থ বেলুড়ে রামকৃষ্ণ মিশন। এই মঠদুটি স্থাপনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল রামকৃষ্ণ মিশনে যোগদানে ইচ্ছুক যুবকদের গ্রহণ ও প্রশিক্ষণ এবং তাদের মিশনের কাজকর্মের উপযুক্ত করে তোলা। এই বছরেই দুর্ভিক্ষের সময় জনসেবার মাধ্যমে মিশনের কাজের সূচনা হয়।
বিশ্বধর্ম মহাসভায় ভাষণদানের আগে পরিব্রাজক জীবনে স্বামী বিবেকানন্দ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল পর্যটন করেছিলেন। এই সময় তাজমহল, ফতেপুর সিক্রি, দেওয়ান-ই-খাস, রাজপুতানার প্রাসাদ এবং মহারাষ্ট্র, গুজরাট, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক ও অন্যান্য অঞ্চলের প্রাচীন মন্দিরগুলি দর্শন করেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ ভ্রমণকারী সেই অঞ্চলের আধুনিক, মধ্যযুগীয়, গথিক ও রেনেসাঁ স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্যগুলিও অবগত হন। কথিত আছে, এই সকল স্থাপত্যের সংমিশ্রণে স্বামী বিবেকানন্দই বেলুড় মঠ স্থাপত্যের পূর্বপরিকল্পনা রচনা করেছিলেন।

ছবিঃ লেখক ডঃ সুবীর মণ্ডল

স্বামী বিবেকানন্দের পরিকল্পনা অনুযায়ী তার সন্ন্যাসী-ভ্রাতা ও রামকৃষ্ণ পরমহংসের অপর সাক্ষাতশিষ্য স্বামী বিজ্ঞানানন্দ মন্দিরের নকশা প্রস্তুত করেন। বিজ্ঞানানন্দ পূর্বাশ্রমে ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। ১৬ মার্চ, ১৯৩৫ মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। প্রখ্যাত ইঞ্জিনিয়ার ও শিল্পপতি স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে মার্টিন বার্ন অ্যান্ড কোম্পানি এই বিরাট মন্দিরটি নির্মাণ করেন। রামকৃষ্ণ মিশন এই মন্দিরের বর্ণনা দেন “স্থাপত্যের ঐকতান” রূপে।

আধুনিক ধর্মস্থান বেলুড় মঠ মন্দির, মসজিদ ও গির্জার স্থাপত্যের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের মিশ্রণে নির্মিত। রামকৃষ্ণ ভাবান্দোলনের বিশ্বাস অনুসারে বিশ্বধর্মের আদর্শকে তুলে ধরার জন্য একাধিক ধর্মের স্থাপত্য ও প্রতীকতত্ত্ব থেকে মন্দিরের এই স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য সংকলিত হয়েছে। ধর্মের রূপতাত্ত্বিক দিকটিরও একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন এই মন্দির।
মন্দিরের মূল প্রবেশপথটি বৌদ্ধ আদর্শে নির্মিত। মূল প্রবেশপথের উপরের অংশটি উচ্চ স্তম্ভযুক্ত দক্ষিণ ভারতীয় মন্দিরের আদর্শে নির্মিত। মন্দিরের ভিতরের জানালা ও অলিন্দ উত্তর ভারতের রাজপুত ও মুঘল স্থাপত্যের আদর্শে তৈরি। কেন্দ্রীয় গম্বুজটি ইউরোপীয় রেনেসাঁ স্থাপত্যের নিদর্শন। আবার ভিতরের মেঝেটি কতকটা খ্রিস্টান ক্রসের আকারে বিন্যস্ত।
বেলুড় মঠের অভ্যন্তরে দ্রষ্টব্য স্থানগুলি হল শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দির, পুরনো ঠাকুরঘর, স্বামী বিবেকানন্দের বাসকক্ষ, স্বামী ব্রহ্মানন্দ মন্দির, শ্রীমা সারদাদেবী মন্দির, স্বামী বিবেকানন্দ মন্দির, সমাধি পীঠ, পুরনো মঠ, রামকৃষ্ণ মিউজিয়াম ইত্যাদি। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বহিরাগত দর্শক ও পূণ্যার্থীদের দর্শনের নিমিত্ত মঠ ও মন্দিরের দ্বার খোলা রাখা হয়। দেশ ও বিদেশ থেকে বহু মানুষ প্রতিদিন এই মন্দিরে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসেন। 'শ্রীরামকৃষ্ণ  সংগ্রহ মন্দির' হল বেলুড় মঠ প্রাঙ্গণে অবস্থিত। এই জাদুঘরে রামকৃষ্ণ পরমহংস, সারদা দেব, স্বামী বিবেকানন্দ ও তাদের কয়েকজন  শিষ্যের ব্যবহৃত দ্রব্যসামগ্রী রক্ষিত করে  রাখা রয়েছে। এগুলির মধ্যে আছে পাশ্চাত্যে বিবেকানন্দের পরিহিত লংকোট, ভগিনী নিবেদিতার টেবিল এবং শ্রীমতি সেভিয়ারের একটি অরগ্যান। তাছাড়া রামকৃষ্ণ আন্দোলন ও সমকালীন বাংলার ইতিহাসের কালপঞ্জি রক্ষিত আছে। শ্রীরামকৃষ্ণ সংগ্রহ মন্দিরটি একটি দোতলা ভবন। এই ভবনের ভিতরে দক্ষিণেশ্বরের কালীবাড়ির কাছে অবস্থিত শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সাধনস্হল 'পঞ্চবটী'র (পাঁচটি পবিত্র বৃক্ষের উদ্যান) অবিকল প্রতিকৃতি নির্মিত হয়েছে। গলায় ক্যান্সার শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস তাঁর শেষ জীবনে যে কাল পাথরবাটিতে করে পায়েষ খেতেন এবং যে বালিশটি ব্যবহার করতেন, সে দুটিও কলকাতায় তিনি শেষ দিনগুলো কাটিয়েছিলেন, সেই বাড়ির আদলে নির্মিত কক্ষে রক্ষিত আছে। যে ঘরটিতে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর ১২জন শিষ্যকে গৈরিক বস্ত্র দান করেন এবং বিবেকানন্দকে (তখন নরেন্দ্র নাথ) তাঁর সন্ন্যাসী শিষ্যদের নেতা নির্বাচিত করেন, সেই ঘরের একটি মডেলও আছে। এই ঘরে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের কল্পতরু মূর্তিও রাখা আছে । এই মূর্তির পায়ে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ব্যবহৃত পাদুকাটি পরানো আছে। দক্ষিণেশ্বরের যেঘরটিতে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব থাকতেন, সেই ঘরটিরও একটি প্রতিরূপ প্রদর্শিত হয়েছে। এই ঘরে তাঁর ব্যবহৃত কাপড় ও অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী আছে। সেই সঙ্গে রাখা আছে বিবেকানন্দ যে তানপুরাটি বাজিয়ে তাঁর গুরুকে গান শোনাতেন, সেই তানপুরাটি এবং রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব কর্তৃক চারকোল দ্বারা অঙ্কিত দুটি ছবি। 
১৯১১ সালে সারদা দেবীর মাদ্রাজ (অধুনা চেন্নাই), মাদুরাই ও ব্যাঙ্গালোর (অধুনা বেঙ্গালুরু) তীর্থযাত্রার মডেলগুলিও তার ব্যবহৃত দ্রব্যসামগ্রীর সঙ্গে প্রদর্শিত হয়েছে। জাদুঘরের মধ্যে শিকাগো আর্ট ইনস্টিটিউশনের একটি মডেলের সামনে স্বামী বিবেকানন্দের একটি বৃহদাকার মূর্তি রয়েছে। উল্লেখ্য, শিকাগো আর্ট ইনস্টিটিউশনেই ১৮৯৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আয়োজিত বিশ্ব ধর্ম মহাসভায় বিবেকানন্দ ভাষণ দিয়েছিলেন। এই মডেলের পাশে যাত্রাপথে বিবেকানন্দের সহযাত্রী জামশেদজি টাটার একটি চিঠি রক্ষিত আছে। এই চিঠিটি জামশেদজি টাটার একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বিখ্যাত রচনা। বিবেকানন্দের অনুপ্রেরণাতেই তিনি বেঙ্গালুরুতে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স স্থাপন করেন।
চেন্নাইয়ের ভিক্টোরিয়া হলের কাঠের সিঁড়ি ও কাঠের পদ্ম এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। উল্লেখ্য, এই হলেই বিবেকানন্দ কয়েকটি জনপ্রিয় বক্তৃতা দিয়েছিলেন। এই মডেলের কাছেই রাখা আছে কুমারী জোসেফিন ম্যাকলাউড-সংক্রান্ত একটি প্রদর্শনী। কুমারী ম্যাকলাউডের সঙ্গে বিবেকানন্দের সাক্ষাৎ ১৮৯৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হয়েছিল। এরপর তিনি ৪০ বছর ভারতে কাটিয়েছিলেন। রামকৃষ্ণ আন্দোলনে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। এই কক্ষে প্যারিসের মণিকার রেনে ল্যালিকের নির্মিত বিবেকানন্দের একটি স্ফটিকমূর্তি আছে। 

সাম্প্রতিক বেলুড় মঠ:  পুণ্যসলিলা গঙ্গা সমগ্র ভারতীয় হৃদয় নিষিক্ত অনুভব বক্ষপটে ধারণ করে মন্দাকিনি ছন্দে এগিয়ে চলেছে সাগর সঙ্গমে। আন্তর্জাতিক মহানগরী, একদা ভারতবর্ষের রাজধানী কলকাতার বিপরীতে অর্থাৎ গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে দীর্ঘ ৩১ একর জমিতে অবস্থিত  শাশ্বত ভারতের চিন্তা--চেতনার নব তরঙ্গে উদ্ভাসিত ধর্ম-কর্ম-মর্মের মহা পীঠস্থান বেলুড় মঠ। ধর্মীয় হানাহানির নিরসনকারী, সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের, ঋত্বিক, বিবেকানন্দের ভাষায় 'অবতার বরিষ্ঠ' শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের মন্দিরকে মধ্যমণি করেই বেলুড় মঠের অবস্থান। প্রধান ধর্মগুলির ভাবের মিলেমিশে স্বামী বিবেকানন্দ পরিকল্পিত ভারতীয় স্থাপত্যের ভাস্কর্যশৈলীর, নান্দনিক চেতনার অপূর্ব নিদর্শন এই মন্দির- বাস্তবিক ক্ষেত্রে যা সর্বজনীন উপাসনালয়। এই মন্দির নির্মাণ প্রসঙ্গে বিবেকানন্দ বিশিষ্ট শিল্পী কলকাতা জুবুলি আর্ট কলেজের প্রতিষ্ঠাতা রণদাপ্রসাদ দাসগুপ্তকে তাঁর সংশ্লিষ্ট অভিপ্রায়ের কথা জানিয়েছিলেন। বিবেকানন্দের সতীর্থ প্রযুক্তিবিদ স্বামী বিজ্ঞানানন্দ, স্বামী বিবেকানন্দর পরিকল্পনাকে রূপায়িত করার আন্তরিক চেষ্টা করেছেন। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর স্বামী বিজ্ঞানানন্দ যখন রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের চতুর্থ অধ্যক্ষ, তখন ১৯৩৮ সালের ১৪ই জানুয়ারি বর্তমান দৃষ্টিনন্দন মন্দিরটির দারোদ্ঘাটন করেন। এই মন্দিরের প্রবেশদ্বার পেরিয়ে প্রশস্ত নাটমন্দির, সবশেষে গর্ভমন্দির। সেখানে 'নয়নাভিরাম' শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব প্রস্ফুটিত পদ্মের উপর বসে আছেন। ইতালিয়ান শ্বেত পাথরে তৈরি অপূর্ব মূর্তি। শিল্পী, সেকালের বিখ্যাত গোষ্ঠ পাল। বসন্তের অরুণ রাগের সঙ্গে মিলিয়ে পরানো হয়েছে পরিধেয় বস্ত্র 'বসন্তের দেবতা' শ্রীরামকৃষ্ণকে। পেছনে রাজস্থান বাটিকের পর্দা। ডাইনে- বাঁয়ে সামনে নানান ফুলের মাঝে শ্রীরামকৃষ্ণের উপবেষ্টিত ধ্যান তন্ময় মূর্তির অবস্থান। বারেকের জন্য পলক পড়ে না। শ্রীরামকৃষ্ণের মুখে স্মিত হাসি থেকে উৎসারিত আলো ক্রমাগত মনের সব কালিমা-অন্ধকার মুছে দিচ্ছে। অন্তরের অন্তঃস্হলে পৌঁছে সেই আলো শুধুমাত্র জমাট অন্ধকারকে সরিয়ে দেয়নি- অন্দর, বাহির আলোয় আলোয় আলোকময়। সসীম থেকে অসীমে আলোয় ভরে গেছে সমস্ত ভুবন। আপনা থেকেই কণ্ঠে উঠে আসে - এত আলো জ্বালিয়েছ এই গগনে কী উৎসবের লগনে। শ্রীরামকৃষ্ণের লীলাই তো প্রতিদিনের উৎসব। 
কথিত আছে,  শ্রীরামকৃষ্ণ মহাসমাধির আগে বিবেকানন্দকে বলে গিয়েছিলেন- 'তুই কাঁধে করে আমায় যেখানে নিয়ে যাবি, সেখানেই আমি যাব ও থাকব।' কাঁকুড়গাছির যোগোদ্যানে সংরক্ষিত শ্রীরামকৃষ্ণের আংশিক চিতাভস্ম এবং বাকি অংশটি বরাহনগর মঠ থেকে  আলমবাজার মঠ থেকে  পীতাম্বর মুখোপাধ্যায়ের  বাগানবাড়ি হয়ে   পৌঁছেছিল  স্থায়ীভাবে  প্রতিষ্ঠিত এই বেলুড় মঠে। আর সেই  পুণ্য- পূত পবিত্র  চিতাভস্মের আধারের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে  শ্রীরামকৃষ্ণের  এই অনিন্দ্যসুন্দর মন্দির। আবহমান কাল থেকে চলে আসছে-মন্দিরের নিত্য শ্রীরামকৃষ্ণের  পুজো ও ভোগরাগাদির অনুষ্ঠান।প্রভাতে অনুষ্ঠিত হয়  মঙ্গলারতি।সন্ধ্যায়  সন্ধ্যারতি। শুধুমাত্র  কলকাতা  নয়,পশ্চিমবঙ্গ নয়, সারা  ভারতবর্ষ  থেকে এবং  বহিরভারত   থেকে  দলে দলে মানুষ ছুটে আসেন  শ্রীরামকৃষ্ণের  সন্দর্শনে।  সে এক অপূর্ব পরিবেশ। এই পরিবেশেই অন্তরের চাঞ্চল্য  শান্ত হয়ে আসে, বিক্ষিপ্ত চিও  বিশ্রামের কোলে ঢলে পড়ে। দৃষ্টিতে মনে মুখে মধু ঝরে। 'মধুবাতা--ঋতায়তে'-র এমন পরিবেশেই  শান্তির অবগাহন, মুক্তির-স্বস্তির  প্রলম্বিত পথ চিনে  নেওয়া  যায়। যিনি 'অবতার বরিষ্ঠ' তিনি  সব ভাব, সব ধর্মের, সব সম্প্রদায়ের, সমন্বয়ের মধ্যে দিয়ে মানুষকে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন আনন্দের সাম্রাজ্যে।  তাই দেশ- বিদেশের  অনুরাগীরা শুধু নয়, অনেক পর্যটকেরাও ছুটে আসেন একবার এই মন্দিরে, তাঁর দর্শনে। বসন্তকালে আবির্ভূত 'বসন্তের দেবতা' শ্রীরামকৃষ্ণ সমাজের যত রুক্ষতা, সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, রিরংসা, ঈর্ষা, দ্বেষ,অন্তরঙ্গ--বহিরঙ্গের সব আবর্জনা সরিয়ে দিয়ে 'বসন্তের হাজারো গোলাপের নির্যাস প্রাণে প্রাণে ছড়িয়ে দিয়ে মানুষকে স্বমহিমায় উত্তুঙ্গে পৌঁছে দিতে ব্যস্ত। কারণ তিনি জানেন-'মানুষ বড় কাঁদছে'। 'সমস্যায় কিলবিল করা' মানুষকে তিনি কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছে দেবেন বলেই তো তাঁর আসা। ভুবনজোড়া আসনখানিতো আজ তাই ক্রম প্রসারিত। পাকিস্তানের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী মহম্মদ দাউদ, রোব্বার তাঁকে এই সূত্রেই চিহ্নিত করেছেন 'ফ্রেণ্ড কাম ফিলজফার'। তাঁর মতে শ্রীরামকৃষ্ণের আবির্ভাব সকলকে প্রতিকূলতার পার থেকে অনুকূলতার পারে পৌঁছে দেওয়ার জন্যই। বেলুড় মঠের সকালবেলার এক রূপ, আবার সন্ধ্যাবেলায় অন্য রূপ পরিলিক্ষত হয়। এখানকার দিন-রাতের পরিবেশে এক অসাধারণ দৃশ্য আমাদের সকলের বিস্ময়ের ব্যাপার। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় মনে হয়েছে এক স্বর্গীয় পরিবেশ সৃষ্টি করে এখানকার প্রভাতের ও সন্ধ্যার পরিবেশ এমন মনোরম যা, যে কোন মানুষের মনে এক অমল ভক্তিভাবনা জাগ্রত করে প্রতিটা মুহূর্তেই। এইসব কারণেই মনে হয় বেলুড় মঠের প্রতি এক মায়াবী দুর্নিবার আকর্ষণ সর্ব ধর্মের মানুষের । সূর্য পশ্চিম আকাশে ডুব দিয়েছে, চুপিসারে অন্ধকার নামছে। কুলায় ফেরা বিহঙ্গদের কলকাকলী ক্রমশ স্তব্ধ হয়ে আসছে। গোটা পরিবেশ শান্ত। কল্লোলিনী গঙ্গার প্রবহমানতা শব্দ ক্রমশ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে।

সারা বিশ্ব ছড়িয়ে থাকা রামকৃষ্ণ মঠ, রামকৃষ্ণ মিশনের বিভিন্ন শাখার প্রাণকেন্দ্র বেলুড় মঠের এ-এক অন্য চিত্র। শতবর্ষ অতিক্রম করেও তিলোত্তমা নগরী কলকাতার কাছাকাছি গঙ্গার তীরের এই তীর্থ ভূমির আকর্ষণে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত, এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আমার আজো বোধের অগম্য। আত্ম-পীড়িত মানুষের সেবায় এখানকার সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীগন নীরবে নিভৃতে সেবা প্রদান করে চলেছেন। এ-এক বিরাট কর্মযজ্ঞ। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে রামকৃষ্ণ মিশনের বিভিন্ন কেন্দ্র। "মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াও" এই বেদমন্ত্রে বেলুড়মঠ কাজ করে চলেছে গোটা বিশ্বে। ধর্ম কোন বিভেদের সীমান্তরেখা রচনা করতে পারেনি। বেলুড় মঠের অনেক খানি জুড়ে আছেন জগৎজননী মা- সাদরাদেবী। স্বামী বিবেকানন্দের কথায় একাধারে 'জ্যান্ত দুর্গা' এবং  'সংঘের হাইকোর্ট' তাই তো  শ্রীমার অনুমতি- নির্দেশ যা ছিল স্বামী বিবেকানন্দের প্রথম সাগরদ্বীপের পাড়ি দিয়ে পাশ্চাত্যে যাওয়ার 'পাসপোর্ট'।

 

আগামী পর্বে সমাপ্ত

 

ডঃ সুবীর মণ্ডল
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top