সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

বৃষ্টিভেজা সুখ : শাহানারা পারভীন শিখা


প্রকাশিত:
৮ জুলাই ২০২১ ১৮:৫৮

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ১৪:১১

 

"মা জানালা থেকে সরে আসেন। ঠান্ডা লেগে যাবে।" ছেলে নাবিলের ডাকে চমকে ওঠেন মা নায়লা হাসান। দ্রুত চোখটা মুছে নেন তিনি।
"বৃষ্টির ছাট ঘরের ভেতর আসছে তাই জানালাটা লাগিয়ে দিচ্ছি বাবা।"
ঠিক আছে মা। তুমি রেস্ট নাও এখন। বলে ছেলে নিজের রুমে চলে যায়।
আজকে শুক্রবার। তাই ছেলেটা বাসায় আছে। সারাদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষে যে যার রুমে চলে গেছে। অন্যদিন হলে নায়লা এই সময়টা একটু গড়িয়ে নিতেন।কিন্তু আজ কিছুতেই বিছানায় যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। জানালার কাছে এসে দাঁড়ান।বন্ধ জানালাটা খুলে দিতেই এক ঝটকা বৃষ্টি এসে চোখে মুখে লাগে। তিনি দাঁড়িয়ে থাকেন। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টিটা ছুঁয়ে দেন। সামনের কদমগাছটার ডালে থোকা থোকা কদমফুল ধরে আছে। বৃষ্টিভেজা কদম ফুল। খুব ইচ্ছে করছে আজ এই বৃষ্টিতে ভিজে কদম ফুল তুলতে।
নিজের ছেলেমানুষী ভাবনার জন্য আনমনে হেসে ওঠেন তিনি। মনে পড়ে যায় সে-সব দিনের কথা।
নায়লা বাবা মায়ের অনেক আদরের একমাত্র মেয়ে। একটু জেদি টাইপের। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় এক ক্লাস সিনিয়র ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র রাফির সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। খুবই ব্রিলিয়েন্ট। বাসা থেকে নায়লার বিয়ে ঠিক হয়।
রাফির কথা পরিবারকে জানায় নায়লা।কিন্তু কেউ রাজি হয় না বেকার ছেলের সাথে নায়লার বিয়ে দিতে।
ওর অমতে বিয়ে ঠিক করে ওর বাবা। অগত্যা নায়লা আর রাফি পালিয়ে বিয়ে করে ফেলে। ওরা যেদিন বিয়ে করে সেদিন তুমুল বৃষ্টি ছিল। রাফির এক বন্ধুর বাসায় ওরা সেদিন থাকে।
বৃষ্টির মধ্যেই রাফি বাইরে চলে যায়। কাক ভেজা হয়ে ঘরে ফেরে। ওর হাতে একগোছা কদমফুল।
কদমফুল নায়লার ভীষণ প্রিয়। তাই বলে বিয়ের রাতে কদমফুল! হেসে ওঠে ও। একটু লজ্জা পায় রাফি। বলে গোলাপ কিনতে বেরিয়েছিল। কিন্তু বৃষ্টির জন্য ফুলের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। ফেরার সময় বাড়ির কাছেই একটা কদমগাছ থেকে পেড়ে আনছে এই কদমফুল।
রাফি ভেজা পোশাক ছেড়ে ওর কাছে এসে বসে। ওর হাত ধরে বলে আজকের এই বিশেষ রাতে ওকে দেয়ার মতো কিছুই নেই। হুট করে বিয়ে করা। একেবারে ই শুন্য হাত। তাই বিশেষ উপহার হিসেবে একগোছা কদমফুলই ভরসা। হেসে ওঠে দুজন। এরপর কতো সময় পেরিয়ে গেছে। এক ছেলে একমেয়ে নিয়ে নায়লা রাফির সুখের সংসার। মেয়েটার বিদেশে সংসার। ছেলেটার বিয়ে হয়েছে আজ দশ বছর হলো। ফুটফুটে একটা নাতনি আছে। নিঃসঙ্গ জীবনের সঙ্গী। একবছর হলো রাফি নেই। হঠাৎ করেই মানুষটা ওকে একা করে দিয়ে চলে গেছে। অথচ দুজনে কতো সুন্দর সময় পার করতো। নিয়ম করে সকালে হাটঁতে যেতো।
বৃষ্টি তে ভিজে ওর জন্য প্রায়ই কদমফুল আনতো লোকটা। বৌমার সামনে খুব লজ্জা পেত সে। কিন্তু সেদিকে খেয়ালই থাকতো না ওর। ছেলের বৌ মাহিয়ার সাথে দারুণ সখা ছিল। চা খেতে খেতে ওদের ফেলে আসা জীবনের কতো গল্প করতো। শ্বশুরের মুখে তাদের গল্প খুব আনন্দ নিয়েই শুনতো মাহিয়া।

গতবছর বর্ষায় বাড়ির সামনের ঐ কদম গাছটায় যখন খুব করে ফুল এলো।

সেদিকে তাকিয়ে রাফি বলেছিল, নায়লা চল বৃষ্টিতে ভিজে কদম ফুল পেরে আনি। ওদের আর বৃষ্টি ভেজা হয়নি। কদম ফুলের সুঘ্রাণ নেয়া হয় নি। তার আগেই হঠাৎ করেই মানুষটা হারিয়ে গেল ওর জীবন থেকে।
মা! বলে শ্বাশুড়ির কাঁধে হাত রাখে মাহিয়া।
দ্রুত চোখ মুছে পিছনে তাকান তিনি।
বৃষ্টি দেখছিলাম মা। আমি জানালাটা লাগিয়ে দিচ্ছি এখনই।
মাহিয়া শ্বাশুড়ির হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় একদম গেটের বাইরে। নায়লার নিষেধ কানেই তুলেনা।
আজ আমরা খুব করে বৃষ্টিতে ভিজবো মা।
মাহিয়া একগোছা কদমফুল পেরে আনে।
শ্বাশুড়ির হাতে দিয়ে বলে, এটা বাবার তরফ থেকে আপনার জন্য আপনার প্রিয় বৃষ্টি ভেজা কদমফুল।
রাতে মাহিয়ার একটা পোস্টে চোখ আটকে যায় নায়লার। আজকের বৃষ্টির মধ্যে মাহিয়া ওর হাতে কদমফুল দেয়ার ছবি আর বহু পুরনো একটা ছবি ওদের বিয়ের রাতের কদমফুল দেয়ার ছবি। রাফির বন্ধু তুলেছিল।
আজকের ছবি টা কে উঠালো ভাবতে ভাবতেই মাহিয়া ঘরে ঢোকে।
মায়ের মুখ দেখেই বুঝতে পারে।
নিজে থেকেই বলে, মা আপনার ছেলে আমাদের এই ছবিটা তুলেছে।
আপনার নাতনী ওর বাবাকে যেয়ে আমাদের বৃষ্টিতে ভেজার কথা বলেছে। তাই তো এতো সুন্দর সময়ের স্মৃতি টা ধরে রাখা গেল আপনাদের সেই ছবিটার মতো।
মা চলেন। আপনার ছেলে অপেক্ষা করে আছে। রাতের খাবারের জন্য।
মাহিয়া চলে যেতেই নায়লা ওদের পুরনো সেই ছবিটা বারবার করে দেখে।
বাইরে এখনো বৃষ্টি হচ্ছে।
জানালার কাছে এসে দাঁড়ান তিনি।
সেদিকে তাকিয়ে নায়লার চোখটা ঝাপসা হয়ে আসে। খুব করে মনে পড়ে ওর প্রিয় মানুষটার কথা।



শাহানারা পারভীন শিখা
কবি ও লেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top