সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৫ই বৈশাখ ১৪৩১

আধুনিক পান্তা বুড়ির গল্প : মোঃ ইয়াকুব আলী


প্রকাশিত:
১৭ জুলাই ২০২১ ২২:২৭

আপডেট:
১৯ এপ্রিল ২০২৪ ০২:১৩

 

ছোট নাতি রায়ান দাদির কাছে বায়না ধরেছে তাকে ঘুমানোর আগে গল্প শোনাতেই হবে নাহলে তার ঘুম আসছে না। গল্প শুনতে শুনতে ঘুমাতে যাওয়া তার প্রতিদিনের অভ্যাস। তাকে বলতে দাদির গল্পের ভাড়ার প্রায় খালি হয়ে গেছে। যাও দু একটা বাকি আছে বয়সের ভারে আর সেগুলো মনে আসে না। তাই দাদি ভাবলো পুরোনো একটা গল্পকেই নতুন চরিত্র দিয়ে বললে কেমন হয়। রায়ানের বয়স মাত্র পাঁচ বছর ও নিশ্চয় ধরতে পারবে না। বলেই দাদি শুরু করলো।

অস্টোলিয়া নামে এক দেশ আছে এখান থেকে সাত সুমুদ্দুর তের নদীর পারে। সেই দেশে বাস করতো আমাদের আগের পান্তা বুড়ির নাতির ঘরের পুতির ঘরের নাতনী। রায়ান বলল আগের পান্তা বুড়ি মানে তুমি কি সেই চোরকে জব্দ করা পান্তা বুড়ির কথা বলছো দাদি। দাদি বলল হ রে বাছা হ, সে ছাড়া আর কে আছে পান্তা বুড়ি? সে সহায় সম্বলহীন ছিলো বলেই তো একবেলা রেঁধে বেঁচে যাওয়া ভাতটুকুতে পানি দিয়ে রেখে দিতো অন্য বেলায় খাবে বলে। তখন আর তোমাদের এখনকার মতো ফ্রিজার ছিলো না তাই। কিন্তু চোর ব্যাটা সেই পান্তাতেই ভাগ বসাতো বুঝলি। রায়ান সমঝদারের মতো ঘাড় নাড়লো।

দাদির গল্প এগিয়ে চলে। তো সেই পান্তা বুড়ির নাতনির বাসায় যদিও ফ্রিজার ছিলো কিন্তু সে ছিলো একেবারে মনেপ্রাণে বাঙালি তাই তার পূর্ব পুরুষের প্রায় সবকিছুই সে ধরে রাখার চেষ্টা করতো। যদিও অন্যরা সেসব ভুলে নিজেদেরকে আধুনিক বানানোর জন্য অহোরাত্রি খাটতো। পান্তা বুড়ির নাতনির এটা দেখে মনেমনে খুব খারাপ লাগতো। সে সবসময় ভাবতো মানুষ এমন কেন? দেশ বদলালেই কেন দেশের মানুষ, দেশের অভ্যাসগুলোকে ভুলে যেতে হবে। তার কাছে এই গায়ে হাওয়া লাগানো আধুনিক মানুষদের চলাফেরাকে একেবারে মেকি মনে হতো। সে ভাবলো এগুলো থেকে এদেরকে কিভাবে বের করে আনা যায়। যেই ভাবা সেই কাজ।

একদিন সে একটা খাবার তৈরির প্রতিযোগিতায় নাম লিখিয়ে আসলো। সেখানে দেশ বিদেশের বিভিন্ন উপাদেয় খাবার রান্না করে রাজার রসনা তুষ্ট করতে পারলেই মিলবে পুরুস্কার আর তার পূর্ব পুরুষের খাবার পান্তাও ফিরে পাবে তার সম্মান। পান্তা বুড়ির নাতনী ভাবলো এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর আসবে না। হীনমন্যতায় ভোগা বাঙালিকে এইবার তাদেরই অস্ত্র দিয়ে ঘায়েল করতে হবে। অস্টোলিয়ার রাজার মুখ দিয়েই বলিয়ে ছাড়বে যে বাঙালির খানা খাদ্য কত উপাদেয়। এরপর একদিন সেই প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেলো। এক একটা ধাপে সে এক একটা পদ রান্না করে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যেতে শুরু করলো। 

এভাবে একসময় সে একেবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেলো। ঠিক তখনই আসলো সেই সময়। রাজা নিয়ে আসলো কয়েকটা জাদুর বাক্স। সেইসব জাদুর বাক্সের মধ্যে বেলের মতো দেখতে কিছু বস্তু রাখা। এক একটা বাক্স থেকে এক একটা বেল তুলে ফাটিয়ে ফেললে তার মধ্যে যে শর্ত থাকবে সেই শর্ত মেনে রান্না করতে করতে হবে। নাতনীর ভাগ্যে পড়লো একটা বেল। সেটা ফাটিয়ে দেখা গেলো তাকে এমনভাবে রান্না করতে হবে যেন তাতে ধোঁয়ার ব্যবহার থাকে। এখন বুঝতেই পারছো ওদের তো আর মাটির চুলা না যে ধোঁয়া হবে। তখন নাতনীর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেলো।

সে করলো কি প্রেশার কুকারে ভাত বসিয়ে দিলো। এরপর ভাত সিদ্ধ হয়ে আসলেই দিলো প্রেশার কুকারের নব খুলে। ব্যস, রেলগাড়ির মতো হুইসেল দিয়ে ফোয়ারার মতো ধোঁয়া বেরিয়ে আসলো। রাজদরবারে ধন্য ধন্য রব পরে গেলো। আর করতালিতে সারা রাজদরবার মুখরিত হয়ে গেলো। চারিদিকে নাতনীর প্রশংসা শুরু হয়ে গেলো কিন্তু নাতনী সেখানেই থেমে গেলো না। সে ভাটগুলোকে কুকার থেকে নামিয়ে পানি দিয়ে ভিজিয়ে রেখে তরকারি রান্নায় মনযোগ দিলো। প্রথমেই সে করলো আলুর ভর্তা তারপর বাংলাদেশের আদলে গ্যাসের চুলার আগুনে একটা টকটকে লাল মরিচ পুড়িয়ে নিলো। পান্তাভাতটা পরিবেশন করলো শানকির মতো একটা পাত্রে। তার মাঝে স্তুপ করে দিলো আলুর ভর্তা আর তারউপর সাজিয়ে দিলো পোড়া মরিচটা।  

এরপর লেগে গেলো তরকারি রান্না করতে। বাংলাদেশে পান্তা বুড়ির মতো গরীব মানুষেরা পান্তার সাথে শুধু এই পোড়া মরিচটাই খায়। ভাগ্য ভালো হলে একটু আলু ভর্তাও কপালে জুটতে পারে। কিন্তু রাজারা পান্তা ভাতের সাথে শখ করে ইলিশ মাছ খায়, সালাদ খায়। এখন এই দূরদেশে নাতনী ইলিশ মাছ পাবে কোথায় কারণ ইলিশ মাছ শুধু পাওয়া যায় বঙ্গীয় উপদ্বীপে। সে অনেক খুঁজে ইলিশের মাছের কাছাকাছি স্বাদের সার্ডিন মাছ তেল দিয়ে মুচমুচে করে ভাজি করে দিলো। আর ধনেপাতা, পেঁয়াজ দিয়ে বানিয়ে দিলো সালাদ। সবগুলো খাবার যখন একসাথে সাজিয়ে রাজার সামনে পরিবেশন করলো তখন রাজা মহাশয়ের তো চক্ষু চড়কগাছ। 

রাজা মহাশয়কে পান্তা খেতে হবে ভেবে উনার অনেক মোসাহেবই শুরুতে নাক সিটকাচ্ছিলেন কিন্তু পান্তা বুড়ির নাতনীর পরিবেশনা দেখে সবাই থ হয়ে গেলো। রাজা মহাশয় বসলেন টেস্ট করতে। শুরুতেই পান্তা ভাতের শানকি থেকে আলু ভর্তাসহ এক চামচ ভাত মুখে দিলেন। এরপর সেটা মুখের মধ্যে রেখেই মাছের টুকরাতে দিলেন এক কামড়। এরপর চোখ বন্ধ করে চিবুতে থাকলেন। চিবুতেই আছেন আর চিবুতেই আছেন। চোখ আর খুলেন না। মুখের খাবারটুকু অবশেষে পেটে চালান করে দিয়ে চোখ খুললেন। খুলেই একটা শব্দ উচ্চারণ করলেন মারহাবা মারহাবা।  

এরপর মন্ত্রীকে ডেকে বললেন এই খাবার আমাকে এতদিন কেন খেতে দেয়া হয়নি। মন্ত্রী বললেন, রাজা মহাশয় মাফ করবেন। এটাতো চাষাদের খাবার। গরীব চাষারা রাতে খাবার পর যে ভাই বেঁচে যায় সেটাতে পানি দিয়ে রেখে দেয় যাতে পচে না যায়। তারপর সকালে উঠে সেই পানি দিয়ে ভেজানো ভাতের মধ্যে লবণ ছিটিয়ে দিয়ে হাত দিয়ে ভালোমতো মাখিয়ে খেয়ে লাঙ্গল গরু নিয়ে বেরিয়ে পরে জমিতে চাষ দিতে। পান্তা খাওয়ার আরো একটা লাভ হলো ভাতের সাথে সাথে অনেক পানিও খাওয়া হয়ে যায় তাই দ্রুতই পেট ভরে যায়। সেই খাবারই খেতো আমাদের পান্তার বুড়ি। সেই খাবার জাহাপনা আপনার সমুখে আনি কোন সাহসে।

রাজা মহাশয় বললেন, আমি অতশত বুঝি না। এই খাবার এখন থেকে আমার সকালের নাস্তা। এই খাবার দেখতে খুবই সাধারণ হলেও এটা খুবই সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর। এই যখন রাজ দরবারের অবস্থা তখন একান ওকান হতে হতে নাতনীর কথা ছড়িয়ে গেছে রাজ্যময়। যার ঘরে ভাত ছিলো গরম কিংবা ঠান্ডা সবাই তাতেই পানি ঢেলে দিয়ে পান্তা ভাত বানিয়ে ফেললো এবং ধনী গরীব নির্বিশেষে ঘরে ঘরে মানুষ চাষাদের খাবার বলে খ্যাত সেই পান্তাভাত অবলীলায় খেতে শুরু করলো। অবশ্য গরীবদের আর আলাদাভাবে পান্তা ভাত তৈরি করতে হলো না। তাদের বেশিভাগেরই ঘরে ভাত ছিলো না যেটুকু ছিলো সেটুকু পান্তা ভাতই ছিলো। 

যাইহোক পান্তা বুড়ির নাতনীর অছিলায় সবাই আবার পান্তা ভাত নতুন করে চিনলো। জানলো দেশের একটা বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠী এই খাবার খেয়েই জীবনধারণ করে। আর এই খাবার খেলে যেহেতু রাজার জাত যায়না তাই তদেরও জাত যাওয়ার ভয় নেই তাই নির্ভয়ে খাওয়া যায়। আর এই খাবার তৈরি করাও অনেক সহজ। রাজা মহাশয় পান্তা বুড়ির নাতনীকে উপযুক্ত পুরুষ্কার দিয়ে বিদায় দিলেন। আর মন্ত্রী মহাশয়কে হুকুম দিলেন তার রাজ্য ঢেরা পিটিয়ে সবাইকে সকালবেলা এই খাবার খাওয়ার নিয়ম জারি করলেন। আর পার্শবর্তি সব রাজ্যে লোক পাঠিয়ে জানিয়ে দিলেন পান্তা ভাতের গুণের খবর। সেটা জেনে সব রাজ্যেই সকালবেলা পান্তা ভাতের নাস্তার চল শুরু হয়ে গেলো। স্বর্গ থেকে পান্তা বুড়ি তার নাতনীর এহেন কর্মযজ্ঞ দেখে খুশি হলেন। নটে গাছটি মুড়ালো, আমার গল্পটি ফুরালো। 

 

এই গল্প শুনতে শুনতে রায়ানের ঘুম চলে এসেছিলো। সে বলল কাল সকালে উঠে আমিও পান্তা ভাত খাবো। এটা শুনেই তার দাদি বললেন তাই তো রাতের খাবার শেষে কিছু ভাত পাতিলের তলায় পরে আছে। যাই সেটাতে পানি দিয়ে রেখে আসি।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top