সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৮শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

ভাষাশিল্পী প্রমথ চৌধুরী : কৃষ্ণা গুহ রায়


প্রকাশিত:
১৯ জুলাই ২০২১ ১৮:৪০

আপডেট:
২৮ মার্চ ২০২৪ ২৩:০০

ছবিঃ কৃষ্ণা গুহ রায় এবং প্রমথ চৌধুরী 

 

আধুনিক মনস্ক বিলেত ফেরত সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর আর জ্ঞানদানন্দিনীর কন্যা ইন্দিরা দেবীর স্বামী তথা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্রির জামাতা ছিলেন প্রমথ চৌধুরী৷ সে সময় জ্ঞানদানন্দিনী ছেলে, মেয়ে এবং ভৃত্যকে সঙ্গে নিয়ে একাই বিলেত পাড়ি দিয়েছিলেন। 

সত্যেন্দ্রনাথ এতটাই আধুনিক মনের মানুষ ছিলেন যে ঘরের বউকে নিয়ে প্রকাশ্য রাজসভায় গিয়েছিলেন তৎকালীন গভর্নর জেনারেলের মজলিসে। সত্যেন্দ্রনাথ আনন্দিত হয়ে এই প্রসঙ্গে লিখেছেন, "শত শত ইংরেজ মহিলার মাঝখানে আমার স্ত্রী, সেখানে একটি মাত্র বঙ্গ বালা।" 

এখানেই থেমে থাকেননি সত্যেন্দ্রনাথ। কলকাতায় ফিরে জ্ঞানদাকে নিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে গিয়েছিলেন গড়ের মাঠের মুক্ত নিঃশ্বাস নিতে। 

সতেরো বছরের রবীন্দ্রনাথ যখন বিলেত গিয়েছিলেন তখন তাকে বিলিতি কায়দায় তৈরি করেছিলেন স্বয়ং তার মেজ বৌঠান৷

কুসংস্কার মুক্ত, উদারমনা সত্যেন্দ্র এবং জ্ঞানদার কন্যা ইন্দিরা দেবীর স্বামী প্রমথ চৌধুরী ও ছিলেন আধুনিক মনের মানুষ। 

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য সেই সময় এলবার্ট হলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইন্দিরা দেবীকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন বক্তৃতা দিতে৷ প্রমথ চৌধুরী সুন্দরী ইন্দিরাকে সেখানে দেখে প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ হয়ে যান৷ যা পরে শুভ পরিনয়ের সূত্রে আবদ্ধ করে৷

তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যে চলিত ভাষা ব্যবহারের প্রবর্তক। তিনি বাংলা সাহিত্যের গতিপথ ঘুরিয়ে দিয়ে নতুনত্ব এনেছিলেন। তাঁর সাহিত্য রচনার সুনিপুণতা, সৃষ্টিশীলতা, গাম্ভীর্য, যুক্তিনিষ্ঠতা সাহিত্যের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। সাহিত্যাঙ্গনে প্রমথ চৌধুরীর ছদ্মনাম ছিল ‘বীরবল’। এই ছদ্মনামে পত্রিকার পাতায় লেখালেখি করে তিনি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। তাই তাঁকে বলা হতো বাংলা সাহিত্যের বীরবল।

সম্রাট আকবরের দরবারে নবরত্নর একজন ছিলেন বীরবল। বাংলা সাহিত্যে প্রথম চৌধুরীও তেমনি এক রত্ন। প্রমথ চৌধুরীকে বাংলা সাহিত্যে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য সমালোচক হিসেবে অভিহিত করা হয়। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি প্রবন্ধ রচনা ও সাহিত্য সমালোচনার পাশাপাশি কবিতা, গল্প, চুটকি রচনায় খুব পারদর্শী ছিলেন। ব্যঙ্গাত্মক রচনাতেও তাঁর জুড়ি নেই। তাঁর কবিতাগুলো ছিল খুবই বাস্তববাদী। ছোটগল্পগুলো ছিল অসাধারণ। ছোট গল্প লেখার ক্ষেত্রে তিনি বাস্তবতার নিরিখে সুগভীর উপলব্ধিকে সাবলীল ভাষায় লিখতেন, যেন সাধারণ পাঠক লেখাটি পড়তে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এই ধাঁচটি পরে তাঁর প্রবন্ধগুলোয়ও দেখতে পাওয়া যায়। তিনি মূলত সাধারণ পাঠকদের কথা মাথায় রেখে সাহিত্য রচনা করতেন। 

 প্রসঙ্গত স্বামী বিবেকানন্দ গদ্যে চলিত ভাষার ব্যবহারের কঠোর সমর্থক ছিলেন। তার 

"বাঙ্গালা ভাষা" নামক প্রসিদ্ধ প্রবন্ধে সাহিত্যে কথ্য ভাষা ব্যবহারের স্বপক্ষে তিনি মত প্রকাশ করেন। 

প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন, ‘ভাষা মানুষের মুখ থেকে কলমের মুখে আসে, কলমের মুখ থেকে মানুষের মুখে নয়।’ তিনি রবীন্দ্র যুগে নিজেকে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে স্বতন্ত্রভাবে উপস্থাপন করেছেন এবং প্রশংসিতও হয়েছেন। প্রমথ চৌধুরী সেই সময়কার জনপ্রিয় ‘সবুজপত্র’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। 

একসময় রবীন্দ্রনাথ স্থির করেন যে, সাময়িক পত্রিকার জন্য তিনি আর কিছু লিখবেন না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেননি। বাদ সেধে ছিলেন রবীন্দ্রভক্ত মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় এবং প্রমথ চৌধুরী। কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তর ত্রৈমাসিক পত্রিকা "পরিচয়" এর প্রকাশ উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ যে পত্র প্রবন্ধ রচনা করেন তাতে এই বিষয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। 

মাসিক পত্রিকা প্রকাশের প্রস্তাব নিয়ে যেদিন মনিলাল রবীন্দ্রনাথের কাছে গিয়েছিলেন সেদিন তিনি আর না করতে পারেননি। পরামর্শ দিয়েছিলেন সেই পত্রিকার সম্পাদক প্রমথ চৌধুরীকে করার জন্য।

 রবীন্দ্রনাথ পত্রিকাটির নাম প্রস্তাব করেছিলেন "কণিষ্ঠ"৷ কিন্তু এই প্রস্তাব টেকেনি। পরে মনিলাল এবং প্রমথ শিলাইদহে এসে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলোচনায় পত্রিকাটির নাম স্থির করেন "সবুজপত্র"। এর থেকেই বোঝা যায় পত্রিকাটির মূল সুর বেঁধে দিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। 

এই পত্রিকার মাধ্যমে তিনি নতুন লেখকদের একটি শক্তিশালী সংঘ তৈরি করেছিলেন। এই পত্রিকার মাধ্যমে সাহিত্যের বিকাশে তিনি ব্যাপকভাবে অবদান রাখেন এবং তরুণ প্রজন্মের লেখক ও পাঠকদের কাছে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।

প্রমথ চৌধুরী ১৮৬৮ সালের ৭ আগস্ট যশোরে জন্মগ্রহণ করেন। জমিদার তনয় তাঁর পৈতৃক বাড়ি ছিল পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার হরিপুর গ্রামে। তাঁর বাবার নাম দুর্গাদাস চৌধুরী এবং মায়ের নাম মগ্নময়ী দেবী। প্রমথ চৌধুরী কলকাতার হেয়ার স্কুল থেকে এন্ট্রান্স, প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে দর্শনে প্রথম শ্রেণিতে বিএ পাস এবং ইংরেজিতে প্রথম শ্রেণিতে এমএ পাস করেন। তাঁর শিক্ষাজীবন ছিল অত্যন্ত কৃতিত্বপূর্ণ। ১৮৯৩ সালে ইংল্যান্ডে গিয়ে সেখান থেকে বার অ্যাট ল ডিগ্রি অর্জন করেন। কর্মজীবনে কিছুকাল তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে অধ্যাপনা ছাড়াও সরকারের উচ্চপদে দায়িত্ব পালন করেন। 

লেখালেখির প্রতি অতিরিক্ত আগ্রহের কারণে প্রমথ চৌধুরী সরকারি চাকরি ছেড়ে ‘সবুজপত্র’-এর সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। বাংলা সাহিত্যকে তিনি নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। বাংলা সাহিত্যের তিনি অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন সমালোচক। বর্তমানে সমালোচনার নামে যদিও অনেকে নিন্দা করে, ব্যক্তিকে খাটো করে, প্রমথ চৌধুরী ছিলেন তার উল্টো পথের পথিক৷ ব্যক্তিগত আক্রমণ তাঁর সমালোচনায় ছিল না বললেই চলে। তিনি সাহিত্যের গঠনমূলক সমালোচনা করতেন, যা এখনও তাঁকে প্রথম শ্রেণির সমালোচকের আসনেই আসীন রেখেছে। 

ইউরোপীয় শিক্ষার প্রভাব পড়েছিল তাঁর সাহিত্যে। অনেকের মতে, পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবের কারণেই তাঁর প্রবন্ধগুলোতে অনেক আশ্চর্য বিষয় স্থান পেয়েছে। নিঃসন্দেহে তাঁর লেখার ধাঁচটি বাংলা সাহিত্যের জন্য একটি মাইলফলক।

তিনি ছিলেন মননশীল ও প্রচণ্ড যুক্তিবাদী। তিনি বলেছেন, ‘জ্ঞানের প্রদীপ যেখানেই জ্বালো না কেন, তাহার আলোক চারিদিক ছড়াইয়া পড়িবে। মনোজগতে বাতি জ্বালানোর জন্যে সাহিত্যচর্চার বিশেষ প্রয়োজন।’ 

স্বদেশপ্রীতি সম্পর্কে তাঁর অভিমত, ‘আমরা স্বদেশে যাতে বিদেশি না হই, সে বিষয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করতে হবে।’ তিনি মানসিকভাবে তরুন প্রতিভাকে সমাজে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস করেছেন। কাব্যসাধনা যেন কখনও ‘জোর-করা ভাব, আর ধার-করা ভাষা’য় পরিণত না হয়, সে বিষয়ে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন।

পাবনার বিখ্যাত চৌধুরী বংশের সন্তান প্রমথ চৌধুরী কেবল কুলে-মানেই অভিজাত ছিলেন না, মনের দিক থেকেও ছিলেন উদার। কোনো কোনো সমালোচক মনে করেন, প্রমথ চৌধুরীর লেখা ‘প্যারাডক্সে আক্রান্ত’; অর্থাৎ যে উক্তি আপাতদৃষ্টিতে স্ববিরোধী মনে হলেও সত্যবর্জিত নয়। কিন্তু সত্য হলো—তাঁর লেখার ধরন খুবই বুদ্ধিবৃত্তিক ও যুক্তিনিষ্ঠ। 

 বয়সে কনিষ্ঠ হয়েও গদ্য রচনারীতিতে রবি ঠাকুরকেও প্রভাবিত করেছিলেন প্রমথ চৌধুরী, যা কবিগুরু নিজেই স্বীকার করেছিলেন। তিনি খুব উদার মানসিকতা থেকে বলেছিলেন, তাঁর গল্প ও সনেট বাংলা সাহিত্যে খুব একটা প্রভাব ফেলেনি। কিন্তু প্রমথ চৌধুরীর প্রবন্ধ ও ভাষাভঙ্গি আর ভাবনার ধারা পরবর্তী একটি গোষ্ঠীর ওপর বিশেষ ক্রিয়াশীল হয়েছে।

 বাংলায় কথ্যরীতি তাঁরই হাতে সাহিত্যিক স্বীকৃতি লাভ করে। রবীন্দ্রনাথের জোর সমর্থন ও ব্যক্তিগত চেষ্টায় সে রীতি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। বস্তুত, প্রমথ চৌধুরীর ‘সবুজপত্র’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করেই এ দুজনের প্রচেষ্টাতে এই কথ্যরীতির পূর্ণতম প্রতিষ্ঠা ঘটে।

‘সবুজপত্র’ পত্রিকার মাধ্যমে প্রমথ চৌধুরী বাংলা গদ্যে নবরীতি প্রবর্তন করেন এবং তাঁর প্রবন্ধাবলীতে প্রমাণ করেন যে, চলিত ভাষায় লঘু-গুরু সব ধরনের ভাব ও ভাবনার প্রকাশ সম্ভব। নাগরিক বৈদগ্ধ্য, মননের তীক্ষ্ণতা, চমক, রোমান্টিক ভাবালুতার বিরুদ্ধতা, বুদ্ধির অতিচর্চা এবং কিঞ্চিৎ ব্যঙ্গ, কিঞ্চিৎ রঙ্গ-ব্যঙ্গের হাসি প্রমথ চৌধুরীর প্রবন্ধের ভাষায় বিধৃত। উইট এপিগ্রামের সুপ্রচুর ব্যবহারে তাঁর লেখা প্রবন্ধগুলো আজও পাঠকদের আকৃষ্ট করে। দর্শন, রাষ্ট্রনীতি, ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস ইত্যাদি নানা বিষয়ে তিনি যেসব প্রবন্ধ লিখেছেন, সেগুলোর সর্বত্রই তাঁর রচনায় তীক্ষ্ণ মৌলিকতার চিহ্ন রয়েছে। বিষয়ের অভ্যন্তরে বিতর্কের ভঙ্গিতে প্রবেশ করে তার প্রাণকেন্দ্রে আলোকপাত করতে প্রমথ চৌধুরীর জুড়ি নেই। সাহিত্য সমালোচক হিসেবেও তিনি সেভাবে খ্যাত। তাঁকে এককথায় সৃষ্টিশীল এবং রূপবাদী আখ্যা দেওয়া যেতে পারে।

 

প্রমথ চৌধুরীর মতে, সাহিত্যের উপাদান হচ্ছে মানবজীবন ও প্রকৃতি। মানব জীবনের সঙ্গে যার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ নেই, তা সাহিত্য নয়। তবে সাহিত্য মানবজীবনের বস্তুগত রূপ নয়, আবার প্রকৃতির হুবহু অনুকরণও নয়। মানবজীবন ও প্রকৃতি থেকে গ্রহণ বর্জনের মাধ্যমে উপযুক্ত উপাদান নির্বাচন করে শিল্পী মনের রূপ-রস, সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা মিলিয়েই সৃষ্টি হয় প্রকৃত সাহিত্য। আমরা তাঁর রচনার প্রত্যেক পরতে পরতে দেখতে পাই মানবজীবন ও প্রকৃতির উপাদানের নির্যাসের পরিপূর্ণ অবয়বের চিত্র। মূলত সাহিত্যের দুটি দিক রয়েছে—বিষয় ও সৌন্দর্য। প্রমথ চৌধুরী সাহিত্যে বিষয় ও সৌন্দর্যকে সমমূল্যে বিচার করেছেন। প্রমথ চৌধুরী জীবনে একটি উপন্যাসও লেখেননি। বৃহদাকৃতি রচনার প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র আকর্ষণ ছিল না। তিনি ছোট লেখার প্রতি বেশি আগ্রহী ছিলেন। অল্প কথায় মূল বিষয়টি উপস্থাপন করতে পারার মধ্যেই সাহিত্য রচনায় সার্থকতা বলে বিশ্বাস করতেন।

বাংলা সাহিত্যে প্রমথ চৌধুরী ফারসি ছোটগল্পের আঙ্গিক রীতিকে প্রথম পরিচিত করিয়েছিলেন। তিনি বাংলা সাহিত্যে ইতালীয় সনেটের প্রবর্তক হিসেবে খ্যাত। বাংলা সাহিত্যে নিজস্ব ধারায় সনেট রচনাও করেছেন। বাংলা সাহিত্যে ‘চুটকি’ সাহিত্যের প্রচার, প্রসার, বাগ্‌বৈদগ্ধ্য ও সুনিপুণ বিন্যাসে, চুটকির নতুনত্বে প্রমথ চৌধুরীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। সাহিত্যে সত্য অন্বেষণ ও চর্চা ছিল যেন তাঁর জীবনের ব্রত। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, প্রমথ চৌধুরীর ভাষাদর্শের সঙ্গে সাহিত্যাদর্শের দ্বন্দ্ব ছিল। ভাষাদর্শে তিনি বিপ্লবী ও অগ্রবর্তী। কিন্তু সাহিত্যাদর্শে তিনি অতীতচারী গ্রিক, রোমান ও সংস্কৃত সাহিত্যাদর্শের উত্তরাধিকারী। তবে সাহিত্যাদর্শে তিনি প্রাণের, তারুণ্যের, যৌবনের উপাসক, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপের উপাসক, সামাজিক মিথ্যার শত্রু, সৌন্দর্যের ভক্ত, সাহিত্যে স্বতন্ত্র মর্যাদার সমর্থক এবং সব ধরনের নীতিশাস্ত্রের বিরোধী। বস্তুত বাংলা সাহিত্যে তিনি মানসিক যৌবনের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যে প্রাণের প্রতিষ্ঠা হোক, যে প্রাণ সব বাসনামুক্ত, যে প্রাণ নিজের পথ সৃষ্টি করে নেয়।

প্রথম চৌধুরী ছিলেন একজন সত্যিকারের ভাষা শিল্পী। ভাষা নিয়ে সাহিত্য সাধনা তাঁর কাছে জীবন সাধনার নামান্তর। তিনি মনে করেন, মানব মনে দুটি আকাঙ্ক্ষা বিদ্যমান। একটি জীবন ধারণের আকাঙ্ক্ষা, অন্যটি আত্মধারণের ও আত্মবিস্মৃতির। এ দুটির সমন্বয়েই সৃষ্টিশীল সাহিত্য সৃষ্টি হয়। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন, মানবজীবনে যৌবনই সৃজনশীল। ব্যক্তিগত জীবন ক্ষণস্থায়ী হলেও জাতির সমষ্টিগত জীবনপ্রবাহে নিজেকে সংযুক্ত রাখতে পারলে মানসিক জীবন বিনাশের আশঙ্কা থাকে না। তিনি তাঁর প্রায় রচনাতেই উল্লেখ করতেন, ‘আমাদের প্রধান চেষ্টার বিষয় হওয়া উচিত কথায় ও কাজে ঐক্য করা, ঐক্য নষ্ট করা নয়।’ 

তাঁর সবগুলো রচনা বিশ্লেষণ করলে আমরা তাঁর কথা ও কর্মের সংগতি স্পষ্ট দেখতে পাই।

প্রথম চৌধুরীর গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে কাব্যগ্রন্থ: সনেট পঞ্চাশৎ (১৯১৯) ও পদচারণ (১৯২০); গল্পগ্রন্থ: চার ইয়ারি কথা (১৯১৬), আহুতি (১৯১৯), ঘোষালের ত্রিকথা (১৯৩৭), নীল লোহিত (১৯৩৯), অনুকথা সপ্তক (১৯৩৯), সেকালের গল্প (১৯৩৯), ট্র্যাজেডির সূত্রপাত (১৯৪০), গল্পসংগ্রহ (১৯৪১), নীল লোহিতের আদি প্রেম (১৯৪৪), দুই বা এক (১৯৪০); প্রবন্ধগ্রন্থ: তেল-নুন-লাকড়ি (১৯০৬), নানাকথা (১৯১১), বীরবলের হালখাতা (১৯১৭), আমাদের শিক্ষা (১৯২০), দুই ইয়ারির কথা (১৯২১), বীরবলের টিপ্পনী (১৯২৪), রায়তের কথা (১৯২৬), নানাচর্চা (১৯৩২), ঘরে বাইরে (১৯৩৬), প্রাচীন হিন্দুস্থান (১৯৪০), বঙ্গ সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয় (১৯৪০) এবং প্রবন্ধ সংগ্রহ ১ম ও ২য় খণ্ড (১৯৫২-১৯৫৩)।

প্রমথ চৌধুরী বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে যে অবদান রেখে গেছেন, তা সত্যিই অতুলনীয়। তিনি রবীন্দ্র যুগে আবির্ভূত হলেও তাঁর সাহিত্য আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। বাংলা সাহিত্যের এই বিখ্যাত দিকপাল ১৯৪৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর শান্তিনিকেতনে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। বাংলা সাহিত্যে চলিত ভাষার প্রবর্তক ও বিদ্রূপাত্মক প্রাবন্ধিক হিসেবে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।   

 

কৃষ্ণা গুহ রায়
সাহিত্যকর্মী, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top