সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৮শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

আমি হাত দিয়ে যা ছুঁই (রম্য গল্প) : নুজহাত ইসলাম নৌশিন 


প্রকাশিত:
২০ জুলাই ২০২১ ০৮:৪১

আপডেট:
২৮ মার্চ ২০২৪ ১৮:০৩

 

বাস ছাড়ার আরও আধা ঘন্টা বাকি। এই ত্রিশ মিনিট চুপচাপ বসে থাকলে বার বার মনে হবে আমার পি চাপছে। সোজা বাংলায় আমার দাদীর ভাষায় ‘আবুর পেশাব’ চাপছে। এই জন্য বাসে ওঠলে আমি আতঙ্কে থাকি। 

এরমধ্যে চেপে গেছি একটা ভাব এসে গেছে। মন খুঁত খুঁত করছে। এখন যদি নামি – বাকি আছে দশ মিনিট। চাপা টেনশন কাজ করছে, হয়তো আমি আসতে আসতে ছেড়ে চলে গেল। একটা প্রেমিকা চলে গেলে এখন দশটা রেডি থাকে। বাসের ব্যাপার তো আর এমন না। গেল যে গেলোই – কপাল যদি খুব বড় সেন্ট্রাল ফিল্ডের মতো হয় না হয় তবে দ্বিতীয় বাসের দেখা পাওয়া অসম্ভব। 

কিডনির চিন্তা করে যেই নামতে যাচ্ছিলাম তখনি হুড়ধুড় করে ভদ্রলোকের নিচের গ্রেডের একজন আমার পাশে বসল।  

মনের খুঁত খুঁত ভাবটা আরো জটিল হয়ে উঠছে। মনকে স্বান্তনা দেওয়ার জন্য  হলেও একবার  নামা দরকার। যেই নামতে যাচ্ছিলাম অমনি  লোকটা আমার হাত ধরে  বসিয়ে দিল।  অবাকের চেয়ে বিরক্তই হলাম বেশি। এত দরদ তো আমার প্রাক্তন প্রেমিকা এবং  বর্তমান বউ কেউই দেখায়নি,  সম্ভবত অদূর ভবিষ্যতে  দেখাবে ও না। 

আহহা, হাত ধরলেন কেনো?  

জনাব, আর মাত্র দুই মিনিট বাকি– বাস এক্ষুনি ছাড়ে বলে। আপনি যাচ্ছেন কোথায় ? 

বিরক্তি না চেপেই বললাম, ‘আমার ডাক এসছে, ইমার্জেন্সী’।

ওহ, এসব মনের খুঁত খুঁত। বনের বাঘে খায় না, মনের বাঘে খায়। 

আমি চাই না আমাকে মনের বাঘে ও খাক। পরের কথাটা আর বলে শেষ করতে পারলাম না– বাস ছেড়ে দিল। 

মেয়ে মানুষের উপর অভিমান করা যায়। কিন্তু পাশের টাক মাথা ভদ্রলোকের এক গ্রেড নিচের মানুষের সাথে অভিমান যায় না। এর উপর রাগ করা যায়, অভিমান কোনো মতেই না। এই আহাম্মক  লোকের বউ একে কিভাবে সহ্য করে!  কথাটা ভেবে মনটা খারাপ হল। সুরমা আজ সকালেই বলেছিল, ‘তোমার মতো আহাম্মকের সাথে মানুষ থাকে! - সাথে আবার ছিহঃ ও দিয়েছে। 

পাশে বসা টাক মাথা মোলায়েম গলায় বলল, ‘রাগ করলেন নাকি’!

এরকম সহানুভূতি দিয়ে তো সুরমা ও কখনো কথা বলেনি। মনটা আমার গলে গেলো। 

নাহ, রাগ না ঠিক – তবে যেতে পারলে ভালো হতো, কিডনি তো আর দুইটার বেশি এক্সট্রা নেই বাসের বাড়তি চাকার মতো । 

আরে এত ঘাবড়ে যান কেন এই বয়সে, সব হচ্ছে মন।  

আমি চুপ করে বসে জানালার বাইরে তাকালাম। কথা বলা এবং শোনা দুইটার কোনোটাই এই মুহূর্তে ভালো লাগছে না। আর এই লোকটা স্রেফ আলাপী টাইপ, কথা নিজ থেকেই বলে যাবে মনে হচ্ছে। টাক মাথা এই গরমে আতর বের করে খানিকটা ময়লা সাদা শার্টে মেখে আবার রেখে দিল। অবশ্য রাখতে গিয়ে হাত ফসকে নিচে পড়ে শিশিটা  ভেঙে  গেলো। 

মুখ দিয়ে অসাবধানে বের হয়ে গেলো’ আহারে ‘এবং এই শব্দটাই তিন ঘন্টার জার্নিতে আমার কাল হয়ে দাঁড়াবে বুঝতে পারছি। 

গদগদ হয়ে লোকটা বলল, ‘বুঝলেন জনাব, আমার কপালটাই এমন। হাত দিয়ে যা ছুঁই তা দুঃখ হয়ে যায় টাইপ। 

মানে?

মানে খুব সোজা। একটু পর হাতে নাতে প্রমাণই দেখতে পাবেন। 

আমি একটু অবাকই হলাম। লোকটা শখের শিশি ভাঙায় মন খারাপ তো করলেই না, বরং তার হাতের ছোঁয়ায় সব দুঃখ হয়ে যায় বলে গর্ভবতী ভাব ধরল। ভাবটা এমন সে লাক্স সাবান আর তার স্পর্শে সব কারিনা হয়ে যাবে। 

কিছুক্ষণ চুপ করে আবার মুখ খুললো, বুঝলেন আমি যাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম তার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়নি।

আমি অবাক হলাম না। এটা তো কমন ঘটনা। 

মাঝামাঝি একটা মধ্যমশ্বাস ফেলে – বিয়ে হয়েছে সেই বাড়ির কাজের মেয়ের সাথে । 

এবার নড়েচড়ে বসলাম। প্রস্রাবের চাপটা ও তেমন লাগছে না। 

মানে?

লোকটা পান খাওয়া দাঁত অর্ধেক বের করে, অর্ধেক বন্ধ করে কেমন একটা হাসি দিল। 

বাড়ির কাজের মেয়ে অবশ্য বাড়ির মেয়ের চেয়ে অনেক সুন্দরী, কিন্তু তাতে কী! আমি তো কাজের মেয়ের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দিইনি। কষ্টটা জনাব সেখানে, নয়তো কাজের মেয়েকে খারাপ বলছি এতটা অমানবিক আমি না।

আমার বিরক্ত ভাব পুরোপুরি কেটে গেল। বলে কি এ!  বয়স বেশি হলে বিয়াল্লিশ, টাক মাথা হলে কি হবে – ফর্সা রঙ, চেহারা ভালোই তবে ভদ্রলোকের এক গ্রেড নিচে। জামা কাপড় আর একটু ঘষে টসে পড়ালে ঠিকে যাবে । 

তারপর ? 

গেলাম বিয়ে করতে। বিয়ে বাড়ি শুনশান নিরব। কেমন একটা খটকা লাগল। জামাই মানুষ আমি, এত কৌতূহল ও দেখাতে পারি না। এদিকে বরযাত্রীরা সব বউ দেখে ফিদা – সাক্ষাৎ হুর এই বিষয়ে সবাই একমত। বিয়ে বাড়ির কাচ্চির প্রতি দ্বিমত থাকলেও বউয়ের রূপ সব ভুলিয়ে দিল। 

 এদিকে আমি ছাড়া মেয়েকে আর কেউ দেখেনি, সবাই প্রথম বার দেখে যখন বাড়তি উচ্ছ্বাস দেখাচ্ছে মন কেমন জানি করে উঠল। মনে মনে ভাবলাম হয়তো মেকাপ বেশি দিয়ে কিছু একটা করে ফেলেছে, অত আর ভাবলাম না। ভদ্রলোক হয়ে এসব কি করে ভাবি!  মেয়ে মানুষ তো একটু সাজবেই।

তারপর ?  

ভুলটা ভাঙল গাড়িতে বসে। অবশ্য ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে, মানে বিয়ে তো হয়েই গেছে।  ভদ্রলোক হয়ে সোরগোল কিভাবে  করি – বলুন তো? 

আর বাকিরা যেহেতু জানে না, তাই আমিও চুপ করেই রইলাম। 

আমি এবার পুরোপুরি অবাক ! বলে কি এ? 

 তাই বলে কাজের মেয়ের সাথে ! 

আবার বিশেষ হাসি দিয়ে বলল, কাজের মেয়ে হলেও মন্দ না। বরং বেশিই ভালো, আফসোস একটা আছে অবশ্য – বিয়ের সাত বছরে শ্বশুর বাড়িতে যেতে পারলাম না।  

কেন? 

ওই যে যতবার যেতে চাই ততবারই কোনো না কোন বাধা আসে। কোনোদিন তুমুল বৃষ্টি, কোনোদিন আমিই সিঁড়ি দিয়ে হুড়মুড় করে পড়ে যাই ওই বাড়িতে যাওয়ার নাম করলেই । 

অহ। 

বাস থেমে গেলে যখন নামার সময় হল, লোকটা হুড়মুড় করে নামতে গিয়ে মোটামতো এক মহিলার আঁচলে পা জড়িয়ে ধুড় ধার করে পড়ে গেলো। 

বুঝলাম লোকটার এবারের শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার প্রচেষ্টাও ইচ্ছেকৃত ভাবে মাঠে মেরে ফেলল।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top