সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৫ই বৈশাখ ১৪৩১

ভুতুড়ে ছাদ : হুমায়ূন কবীর 


প্রকাশিত:
২৬ জুলাই ২০২১ ১৮:৫৩

আপডেট:
১৯ এপ্রিল ২০২৪ ০৫:৩১

ছবিঃ হুমায়ূন কবীর 

 

রাতের বেলা আমার বাড়ির ছাদটা ভূতুড়ে হয়ে ওঠে। হওয়ার কারণও আছে। আমার বাড়িটা ইটের রাস্তার উত্তরে। এর চারিদিকে সব পরিচিত  বড়ো বড়ো গাছেরা। দিনের বেলায় ওদের সাধারণ বন মনে হয়। কিন্তু সন্ধ্যাবেলায় ছাদে গেলে দেখা যায় ওরা আর সাধারণ বন নেই -  কিরকম রাগে নীরবে গজগজ করে ফুসতে থাকা জংলী জংগল হয়ে ওঠে ওরা। হাল্কা অন্ধকারেও প্রতিবেশীর মতো পরিচিত গাছগুলো কিরকম অপরিচিত ভৌতিক হয়ে ওঠে। ভয় ভয় করে।শরীর ভারি হয়ে আসে। সেই সাথে আমার বাড়ির নিজের ছাদটাও ঐ জংলী গাছগুলোর দলে মিশে বিরোধী পক্ষের মতো দল পাকায়। আমি কাজ সেরে দ্রুত ছাদ থেকে নেমে আসি গোবেচারার মতো। 

এই কারণে একান্ত কাজ না থাকলে   ভয়ে সন্ধ্যার পর আমি ছাদে উঠি না। কখনো কোনো কাজে উঠলে একা উঠি না। একা উঠলে গা ছমছম করে। শরীর ভারি হয়ে আসে। কিন্তু আজ সন্ধ্যার পর ছাদে আমার কাজ আছে। দীর্ঘ সময় থাকতে হবে। অতো সময় কে আমাকে সঙ্গ দেবে? ভুত? আমি পাচ্ছি ভুতের ভয়, অথচ দেখা গেলো সেই ভুতই এসে আমাকে সঙ্গ দিচ্ছে। সব ভুত তো আর খারাপ না। মানুষের ভিতর যেমন ভালো আছে,মন্দ আছে ভুতের ভিতরও ভালো-মন্দ আছে। যখন আমি প্রচন্ড ভয় পাচ্ছি তখন দেখা গেলো আমার স্ত্রী এসে হাজির।আসলে তো সে আমার স্ত্রী না, স্ত্রীর রূপধারী ভুত।  সে এসে হয়তো বলছে, কী ব্যাপার এই রাতে ছাদে তুমি একা একা, ভয় করছে না?তুমি তো সন্ধ্যার পর ভয়ে একা ছাদেই ওঠো না। 

তারপর হয়তো কিছুসময়  সে আমার সাথে সঙ্গ দিলো। তারপর একসময় হয়তো বিরক্ত হয়ে বললো, যাও যাও ঘরে যাও। আমার ঘুম পাচ্ছে। 

বলে সে একটা বিরাটাকার  হায় তুললো। হায় তুলতে যেয়ে তার মুখের বিরাট দর্শন দাঁতগুলো বেরিয়ে এলো, বেরিয়ে এলো তার বিভৎস ভৌতিক চেহারা। তার চেহারা দেখে আমি ভয় পেতেই সে অনিচ্ছাকৃত ভয়প্রদর্শনের জন্য লজ্জা পেলো। তারপর মেলে ধরলো বিকট গন্ধময় তার নোংরা বিশাল ডানাটি। উড়ে যেয়ে বসলো পাশের মেহেগিনি গাছের মাথায় ঝোপের ভিতর। আমি তখন ভয়ে ব্যস্ত হয়ে ছাদ থেকে  নামতে যেয়ে পড়ে গেলাম নিচে। তারপর আমার আর মনে নেই। 

সন্ধ্যারপর ছাদে গেলে আমার মাথায় এইরকম  দেশের সমস্ত কুচিন্তা এসে মাথাটা ভারি করে দেয়। আমি ভয়ে মাথা তুলে তাকাতে পারি না। এমনকি প্রিয় নারকেলগাছে নারকেল গুলো কীএকটা অপরিচিত বোমার মতো কালোকোলো চোখ করে তাকিয়ে থাকে। অথচ, দিনের বেলায় যখন আমি অনেক সময় ওদেরকে হাত দিয়ে আদর করে দিই তখন ওরা চুপচাপ হাসে। সন্ধ্যা নামলেই ওরা সব ভুলে যায়। 

কিন্তু আজ আমার কী হলো?  সন্ধ্যার পর সাহস করে একাই ছাদে এলাম। ছাদে পানি দিতে হবে। জলছাদ না করলে ছাদ নষ্ট হয়ে যাবে। খসে খসে পড়বে। সেইজন্য জলছাদ করা জরুরি। সেটা করতে হলে ছাদ ভরে পানি দিতে হবে। সেই পানি কয়েকদিন ধরে রাখতে হবে।

 

দিনের বেলাতেই পানি দিচ্ছিলাম, কিন্তু সেই পানি দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছিলো। এখন চৈত্রমাস। প্রচন্ড খরা। এতো খরা যে রোদে ৫ মিনিট দাড়িয়ে থাকলে মাথা গরম হয়ে খইফোটা ফুটে যাবে। এই খইফোটা রোদ পানিকে ছাদে দাড়াতে দিচ্ছে না। বাধ্য হয়ে রাতকে টার্গেট করতে হলো। সিদ্ধান্ত নিলাম রাতে পানি দেবো। রাতে পানি দিলে অন্য সুবিধাও আছে। এইসময় মটরে পানি বেশি ওঠে। সুবিধা থাকলে কী হবে, অসুবিধাও আছে। প্রধান অসুবিধা হচ্ছে ভুতের ভয়। কিন্তু সে কথা লজ্জায় কারোর সাথেই বলা যাবে না। বললে হাসাহাসির শিকার হতে হবে। আমি তো আর কঁচি খোকা না। দিব্যি সুস্থ স্বাভাবিক একজন পুরুষ মানুষ। একজন পুরুষ যদি নিজের বাড়ির ছাদে একা যেতে ভয় পায় তার চেয়ে লজ্জাজনক আর কী থাকতে পারে? 

মানুষ বোঝে না কিছু বিষয় আছে যা ছোট -বড়ো দোহাই মানে না। মানে না পুরুষ মহিলা।  সেটা শুরু হয়, শেষ হয় না। ভুতের ভয় তেমনই একটা বিষয়। এটা ছোটোবেলা থেকে শুরু হওয়া বংশীয় অসুখের মতো। শুরু আছে, শেষ নেই। আর তাছাড়া আমাদের বাড়ির আশেপাশের পরিবেশটা রাতে সত্যি অন্যরকম। চারপাশে জংগল। এর পশ্চিম পাশে বড়বড় গাছের মেহেগিনি বাগান,বাঁশঝাড়। বাঁশঝাড়ের ভিতর ঘন জংগলে ভরা কবরস্থান। দক্ষিণে আমবাগান, লিচু বাগান তারপর ঘন বাঁশঝাড়। উত্তর পাশে ফাঁকা মাঠ। দিনের বেলায় এদিকে লোকজন চলাচল করে তাই অতোটা বোঝা যায় না। কিন্তু রাতের বেলা পরিবেশটা পাল্টে যায়। ঘরের ভিতর থাকলে অতোটা বোঝা যায় না। বোঝা যায় রাতেরবেলা ছাদে গেলে।দিনেরবেলা মরে থাকা ভুতুড়ে পরিবেশটা রাতে জীবন্ত হয়ে ওঠে।এইসময়  একা-একা ছাদে উঠলে হার্টবিট আর গোপন থাকে না। সাউন্ড বক্সের তীব্র আওয়াজের মতো বুক কাপিয়ে দেয়। তাই রিক্স নিয়ে আমি একা উঠি না। 

আজ উঠতে হলো। উপায় নেই। সন্ধ্যার আগে থেকে পানি দেওয়ার কথা অথচ বাজার থেকে ফিরতে আমার সন্ধ্যা পার হয়েগেছে। বন্ধুদের সাথে অকারণ আড্ডা মারার ঝাল এখন টের পাওয়া যাবে হাড়েহাড়ে।  ঘরে ঢুকে দেখি মেয়ে মোবাইলে সিরিয়াল দেখছে। স্ত্রী ছেলেকে খাওয়াচ্ছে। কাকে বলি আমার সাথে ছাদে যেতে? আর তো কেউ নেই। আমরা চার সদস্যের এক ছোটো পরিবার। 

মেয়ে এখন সিরিয়াল দেখা বাদ দিয়ে কিছুতেই উঠবে না। ঘাড় ভেঙে সে মোবাইলে মজে আছে। এখন ওর সামনে যত যা-ই ঘটুক তাতে ওর কিছু যায়-আসে না। কেউ মরুক কি বাঁচুক ওর দেখার সময় নেই। সিরিয়ালের কাগুজে মানুষগুলোর হাসিতে ও হাসে, ওদের দুখে ও কাঁদে। মোবাইলে যারা মজেছে তাদের সবারই প্রায় একই অবস্থা,ছোটোবড়ো বাছবিচার নেই। এই অবস্থায় মেয়েকে ডাকা বৃথা। আবার স্ত্রীকেও ডাকা যাবে না। ছেলে কান্নাকাটি করবে। বাধ্য হয়ে একাই ছাদে উঠলাম।মনেমনে সংকল্প করলাম,আজ ভুতের ভয় জয় করবোই।  

ছাদে উঠে দেখি রাতের বিশাল ফাঁকা  পরিস্কার আকাশের মাঝখানে একটা  অর্ধেক চাঁদের রাজত্ব চলছে। । এই অর্ধেক চাঁদটা একটা আস্ত পূর্ণিমা চাদের চেয়ে বেশি আলো দিচ্ছে। আজ পূর্ণিমা না কিন্তু তার চেয়ে বেশি। বিষয় কী, এই অর্ধেক চাঁদের এতো শক্তির উৎস কী?এর ভিতর কোনো ভৌতিক বিষয় নেই তো?  এটা তো একটা ভালো গবেষণার বিষয়। গবেষণা করতে হবে। মনটা গবেষণার ভিতর ঢুকিয়ে দিলে মন থেকে ভুতের ভয় চলে যাবে।  

ওদিকে আবার দক্ষিণ দিক থেকে হাল্কা ঝিরিঝিরি মিষ্টি বাতাস আসছে। বাতাস মিষ্টি কিন্তু অতি মৃদু। এতো মৃদু যে গাছও টের পাচ্ছে না। একটা পাতাও নড়ছে না। মনে হচ্ছে ভুতুড়ে গাছ আর অসম্ভব সুন্দরী মিষ্টি  বাতাস এই গামাখা গামাখা আবছা আঁধারে চুপিচুপি প্রেম করছে। কেউ যেনো বুঝতে নাপারে। হয়তো গভীরভাবে খেয়াল করলে ওদের গোপন আালাপের বিষয় বস্তু বোঝা যেতো। কী দরকার অন্যের প্রেমালাপে আড়িপাতার? আমি কি আধুনিক গোয়েন্দা রাষ্ট্রব্যস্থা রোগে আক্রান্ত হয়েছি? দরকার নেই আমার আড়িপাতার। তার চে আমি এই চাঁদের আলোর নিচে গাছের সাথে বাতাসের  আলাপের সুন্দর মুহুর্ত ইপভোগের চেষ্টা  করি। দৃষ্টি সুস্থ হোক। মন মেরামত হয়ে যাক। কিন্তু, মন মেরামত করতে চাইলেই তো তা আর পারা যায় না।

 অনেকসময় পায়ে কাটা ফুটলে খুজে পাওয়া যায় না। লুকিয়ে থাকে। হাটতে গেলেই খচখচ করে মাংসের আরো গভীরে ঢুকতে থাকে। আজকে আমার মনেরও সেই একই অবস্থা।  চাঁদ, বাতাস আর গাছের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য মনকে ভুতের ভয় থেকে মুক্ত করে শান্ত করা প্রয়োজন। কিন্তু মন শান্ত হচ্ছে না। মনের ভিতর ভয় কাটার মতো ফুটছে।  তাই, এই অপরূপ রাতের সৌন্দর্য সম্পূর্ণ উপভোগ্য হয়ে উঠছে না। 

ছাদে পানি দেওয়ার পাইপ ঠিকঠাক করতে-করতে মনে হলো এতো সুন্দর পরিবেশের খবর যদি পরিবারের সবাইকে না জানায় তাহলে অন্যায় হয়ে যাবে। স্বার্থপরতা হয়ে যাবে। আর তাছাড়া,  আসলে -   মনের ভিতর গেঁথে থাকা ভুতের ভয়ের কাটাটা বেরিয়ে যাবে। ভয়মুক্ত  নির্মল স্বচ্ছন্দ পরিবেশে আজ প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করা যাবে। যাই ওদের ডেকে আনি।চোখগুলো একটু প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের মধ্যে হারিয়ে যাক ।

সাহস করে একা বসে থাকতে পারলে ভালো হতো। সব সয়ে যেতো তখন এই বিপুল সৌন্দর্যের ভিতর গা ডুবিয়ে বসে নীরবে সবকিছু উপভোগ করা যেতো। পৃথিবীর কোলাহলে যারা আমার ভিতর শামুকের মতো গুটিয়ে থাকে হয়তো তারা গোলাপের পাপড়ির মতো ডানা মেলে উড়তো। উড়তো  আর উড়তো। 

কিন্তু আমার ভুতের ভয়ও জয়করা হলো না, গোলাপের পাপড়ির মতো ডানার উড়ানিও দেখা হলো না। 

আমি এখন ছাদ থেকে নিচে নামছি। আমি গণআনন্দের দিকে যাচ্ছি। 

সমস্ত প্রকৃতি আমার চালাকি বুঝতে পেরে গেছে। সে মিটিমিটি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসছে। 

ভুতুড়ে ছাদটিও ওদের দলে যোগ দিয়েছে। সে বুক ফুলিয়ে বিজয়ীর  হাসি হাসছে। 


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top