সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

ধর্মবিশ্বাস, ধর্মাচার ও ধর্মদর্শন : আলী রেজা


প্রকাশিত:
২৬ জুলাই ২০২১ ২০:০৬

আপডেট:
২৬ জুলাই ২০২১ ২০:০৯

 

মানবজীবনের সাথে ধর্মের একটি বন্ধন আছে। এই বন্ধনটি কখনো সবচেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। আবার কখনো অত্যন্ত দুর্বল হয়ে যেতে পারে। ধর্ম যখন ব্যক্তিচিন্তাকে প্রভাবিত করে তখন ধর্ম শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আর ব্যক্তিচিন্তা যখন ধর্মকে প্রভাবিত করে তখন ধর্ম দুর্বল হয়ে পড়ে। ব্যক্তির মুক্তচিন্তা কখনো তার ধর্মবিশ্বাসকে দুর্বল করে দিতে পারে। ধর্মবিশ্বাস একটি পরিপূর্ণ বিষয় হলেও সবাই বিশ্বাসের পূর্ণতা অর্জন করতে পারে না। শূন্য থেকে পূর্ণ পর্যন্ত বিভিন্ন মাত্রায় বিশ্বাস মানুষকে চালিত করে। কারো ধর্মে বিশ্বাস নেই, কেউ আবার পূর্ণবিশ্বাসী। দুর্বলচিত্তের মানুষেরা মাঝামাঝি অবস্থান গ্রহণ করে থাকে। পূর্ণবিশ্বাসীরা যুক্তিতর্কের গুরুত্ব অস্বীকার করে চলেন। তাদের মতে ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর’। অবিশ্বাসীরা নানা তর্কের আশ্রয় নেন। নির্বিচারে বিশ্বাস করতে চান না কোন ধর্ম। অথচ সকল ধর্মই বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তাই অবিশ্বাসীরা অধার্মিকও বটে। ধর্মের ভিত্তি বিশ্বাস বলে ধর্মকে বিজ্ঞানভিত্তিক করার চেষ্টা অপ্রয়োজনীয়। বিজ্ঞান বিচার-বিশ্লেষণ করে, যুক্তি-প্রমাণ চায়। ধর্মের এসবের কোন প্রয়োজন নেই। তাই ধর্মকে বিজ্ঞানভিত্তিক করার চেষ্টা ও বিজ্ঞানকে ধর্মভিত্তিক করার চেষ্টা- দুটোই অপ্রয়োজনীয়। এতে ধর্ম বা বিজ্ঞান কোনটারই গুরুত্ব বাড়ে না। বিজ্ঞানভিত্তিক ধর্মের চেয়ে বিশ্বাসভিত্তিক ধর্মই অধিক শক্তিশালী। আবার ধর্মভিত্তিক বিজ্ঞান কোন বিজ্ঞানই নয়। তাই বিজ্ঞান ও ধর্ম সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র থাকাই বাঞ্ছনীয়।
বর্তমান প্রসঙ্গ শুধুই ধর্ম নিয়ে এবং সে ধর্ম অবশ্যই বিশ্বাসভিত্তিক। ধর্মবিশ্বাস কোন সার্বজনীন বিষয় নয়। এ বিশ্বাস ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়। সম্প্রদায়ভেদেও এর ভিন্নতা আছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের বিশ্বাস একক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর প্রতি। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস থেকেই ফেরেস্তা, আসমানি কিতাব, নবি-রাসুল, আখিরাত ইত্যাদিতে বিশ্বাস স্থাপন করেন মুসলিম সম্প্রদায়। ভাল-মন্দ সবকিছুই আল্লাহর তরফ থেকে হয় বলেও বিশ্বাস করেন তারা। খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাস হলো ঈশ^রের তিন রূপ। এই তিনরূপের প্রতি বিশ্বাসই হলো ত্রিত্ববাদ। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব- এই তিনে বিশ্বাস করেন সনাতন ধর্মাবলম্বিরা। এভাবে বিশে^ যত ধর্ম আছে, সব ধর্মেরই আছে বিশ্বাসের বিষয়। তবে বিশ্বাসের ভিন্নতা থেকেই আলাদা আলাদা ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে। যত ধর্ম তত ধর্মবিশ্বাস। তাই ধর্মবিশ্বাস মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেনি। স্ব স্ব ধর্মের প্রতি বিশ্বাস যত গভীর হয়েছে, ভিন্ন ধর্মের প্রতি ততই বিরূপ হয়েছে মানুষ। এভাবে ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলো পরস্পর বিচ্ছিন্ন হতে হতে বিরুদ্ধ হয়ে উঠেছে। তাহলে তো বলাই যায় ধর্মবিশ্বাস মানবজাতিকে বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত করে সাম্প্রদায়িক মনোভাবের জন্ম দিয়েছে। ধর্মবিশ্বাস মানব জাতিকে বিচ্ছিন্ন করেছে। এবার দেখা যাক ধর্মাচার মানব জাতিকে কীভাবে ঐক্যবদ্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে কিংবা কীভাবো বিচ্ছিন্ন করেছে পরস্পরকে।
ধর্মবিশ্বাসকে কেন্দ্র করে প্রতিটি ধর্মসম্প্রদায় পালন করে কিছু আচার-অনুষ্ঠান। এ সব আচার-অনুষ্ঠানে ইহলৌকিক কল্যাণের চেয়ে পারলৌকিক কল্যাণই কামনা করা হয় বেশি বেশি। বলা যায় ধর্মাচারের মূল উদ্দেশ্যই হলো পারলৌকিক শান্তি লাভ করা। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ইহজাগতিক কল্যাণ লাভের আশাও করেন অনেকে। অনেকে আবার ইহজাগতিক কষ্ট ভুলে থাকেন পারলৌকিক শান্তির আশায়। পারলৌকিক শান্তির লোভ ও শাস্তির ভয়েই ব্যক্তি ধর্মাচার পালন করে। সে যাই হোক ধর্মাচার পালনের মাধ্যমে একজন ধার্মিক ব্যক্তিগত প্রশান্তি লাভ করে নিঃসন্দেহে। বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ের বিশেষ বিশেষ আচার-অনুষ্ঠান ঐ ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়কে যেভাবে তুষ্ট করে অন্যান্য ধর্মসম্প্রদায়কে সেভাবেই বিরূপ করে তোলে। মুখে যতই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলা হোক না কেন- অন্য ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানকে অর্থহীন মনে করার প্রবণতা সকলের মাঝেই আছে। বিশেষ করে সে যদি হয় কোন বিশেষ ধর্মে বিশ্বাসী। ধর্মাচার পালনের মাধ্যমে প্রতিটি ধর্ম তার নিজস্বতা বজায় রাখে। এতে মানবজাতির অকল্যাণ হওয়ার কোন কারণ নেই। কিন্তু ধর্মবিশ্বাসীমাত্রই নিজের ধর্মকে শ্রেষ্ঠ এবং অন্যান্য ধর্মকে অসার ও অর্থহীন মনে করে। এখানেই সমস্যার সৃষ্টি হয়। প্রত্যেকেই নিজ নিজ ধর্মকে শ্রেষ্ঠ মনে করে বলে ‘পরধর্মসহিষ্ণুতা’ কথাটি একটি কাগুজে কথায় পরিণত হয়। মনোজাগতিক দিক থেকে পরধর্মসহিষ্ণুতা বলতে কিছু নেই। ব্যবহারিক জীবনে মানুষ আত্মস্বার্থে পরধর্মে সহিষ্ণু হওয়ার ভান করে। কিন্তু মনে মনে পরধর্মকে অবজ্ঞাই করে।
ধর্মাচার ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে দুরত্ব বাড়ায়। দুটি পৃথক ধর্মমতের বিশ্বাস যেমন আলাদা, তাদের ধর্মাচারও আলাদা। এই আলাদা আলাদা ধর্মাচার পালনের মাধ্যমে ধর্মসম্প্রদায়গুলো মনোজাগতিক দিক থেকে সব সময় বিচ্ছিন্ন থাকে। এই বিচ্ছিন্নতা কখনো কখনো পরস্পরকে প্রতিপক্ষ করে তোলে। ফলে সংঘটিত হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় যুগে যুগে অগণিত মানুষের নির্মম মৃত্যু ঘটেছে। পরিস্থিতি কখনো কখনো এতোটাই হিংসাত্মক হয়েছে যে এক সম্প্রদায়ের মানুষ আর এক সম্প্রদায়ের মানুষকে পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট মনে করেছে। মানুষের অমানবিকতা ও হিংস্রতার চূড়ান্ত রূপ দেখা গেছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়। প্রভাবশালী হিন্দু সম্প্রদায় মুসলমানের ধর্মীয় আচার গরু কুরবানিকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছে। আবার মুসলমানরা হিন্দুদের পূজা-অর্চনাকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছে। আচারনিষ্ঠ ধার্মিক ব্যক্তি কখনো অন্য ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানকে সুনজরে দেখেন না। সেগুলোকে পাপাচার বা অপকর্ম হিসেবে ঘৃণা করেন। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে সকল ধর্ম-সম্প্রদায়ের মানুষ মিলিত হলেও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে এই সম্মিলন কল্পনাই করা যায় না। কোন প্রগতিশীল উদারচিত্তের মানুষ যদি অন্য ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানে যোগ দেন তবে তিনি নিজ ধর্মের লোকদের কাছে নিন্দিত হন। এভাবেই ধর্মাচার মানবজাতিকে বহুবিভক্ত করে রেখেছে।
ধর্মবিশ্বাসের ভিন্নতার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে যে মনোজাগতিক বিভক্তি সূচিত হয়, ধর্মাচারের মাধ্যমে সেই বিভক্তি চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। একই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যেও ধর্মাচারের পার্থক্য দেখা যায়। এই পার্থক্যকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয় অনেক উপসম্প্রদায়। উপাসনার নিয়মে মুসলমানদের চার মাযহাবে রয়েছে পার্থক্য। কাদিয়ানি নামক উপসম্প্রদায় ধর্মাচার করে আলাদা নিয়মে। খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে আছে ক্যাথলিক ও প্রোটেস্টান্ট উপসম্প্রদায়। হিন্দুদের বহুদেবতা এবং একেক জন একেক দেবতার পূজা করার মাধ্যমে হিন্দু সম্প্রদায়ও নানাভাগে বিভক্ত। ধর্মাচার পালনের মাধ্যমে এই বিভক্তি সৃষ্টি হয়। তাই এর নিরসন করতে হলে অন্য দিকে আমাদের দৃষ্টি ফেরাতে হবে। এই অন্য দিকটিই হলো ধর্মদর্শন। ধর্মবিশ্বাসের ভিন্নতা আছে। ধর্মাচারেরও ভিন্নতা আছে। কিন্তু ধর্মদর্শন গোটা মানবজাতির জন্য একই বার্তা বহন করে। ধর্মদর্শনের সাথে ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মাচারের পার্থক্য পরিষ্কার করার মাধ্যমে ধর্মদর্শনের গুরুত্ব বুঝে নেওয়া যাবে।
মানবজীবনের জন্য অপরিহার্য সকল শুভ ও কল্যাণকর্ম করার নির্দেশনাই হলো ধর্মদর্শন। সকল ধর্মেই মানবজাতির জন্য শুভ ও কল্যাণকর্ম করার নির্দেশনা আছে। তাই মানবজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য আমাদের ধর্মদর্শনের আশ্রয় নিতে হবে। ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মাচার যেখানে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে, ধর্মদর্শন সেখানে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রেরণা জোগায়। ধর্মদর্শন বিশ্বাস ও আচারকে পরিহার করে একটি নীতি-আদর্শিক পথ নির্দেশ করে। যেমন- সদা সত্য কথা বলবে। ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মাচারকে আমরা যতই ইতিবাচকভাবে ব্যাখ্যা করি না কেন, শেষে এই কথাই সত্য প্রমাণ হয় যে ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মাচার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে না। কিন্তু ‘সদা সত্য কথা বলবে’- এই নীতি-আদর্শিক বাক্যটি যখন সকল ধর্ম অবশ্য পালনীয় বিষয় হিসেবে মেনে নেয় তখন তা সকল ধর্মের মানুষকে একই সমান্তরালে নিয়ে আসে। কারণ এই বাক্যটি সকল ধর্মের মানুষের জন্যই কল্যাণকর। সকল ধর্মের মানুষের জন্য শুভ ও কল্যাণকর কাজের নির্দেশনা আমরা পাই ধর্মদর্শনে। মানবজাতির কল্যাণে শুভকর্ম সম্পাদন ও অশুভ বা মন্দ কর্ম বর্জন করার কথা বলে ধর্মদর্শন। কিন্তু ধর্মবিশ্বাস বলে নিজের ধর্মে বিশ্বাস কর, অন্য ধর্মে বিশ্বাস পরিত্যাগ কর। ধর্মাচার বলে নিজের ধর্মীয় আচার মেনে চল, অন্য ধর্মের আচার বর্জন কর। তাই ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মাচারে মানবজাতি ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়-উপসম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে যায়; বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ধর্মদর্শনের বাণীগুলো সার্বজনীন। যেমন- মিথ্যা বলবে না, ঘৃণা করবে না, অন্যায় করবে না, অবিচার করবে না, দুর্নীতি করবে না ইত্যাদি। এগুলো মেনে চলার নির্দেশনা সকল ধর্মেই আছে। তাই ধর্মদর্শনই পারে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে। ধর্মদর্শন হলো ধর্মচিন্তা। ধর্মচিন্তায় যদি ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয় তবে মানুষ বিশ্বাস ও আচার নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে থাকলেও বৃহত্তর মানবকল্যাণে ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে। তাই ধর্মচিন্তা বা ধর্মদর্শনই মানবজীবনের জন্য মুখ্য। ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মাচারকে গৌণ বিবেচনা করে বিশে^র অনেক দেশ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি, সদ্ভাব ও ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে।
যারা ধর্ম পালন করেন তাদের মধ্যেও আছে বিভিন্ন শ্রেণি। এক শ্রেণির মানুষ দারুণভাবে ধর্মান্ধ। নিজ ধর্মের ব্যাপারে অন্ধবিশ্বাসী এবং অন্য ধর্মের ব্যাপারে অন্ধভাবে অবিশ্বাসী এই মানুষগুলো ধর্মাচারকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এরা কখনো কখনো উগ্র সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠে। জ্ঞানচর্চার চেয়ে ধর্মচর্চা করেই এরা আত্মতৃপ্তিতে ভোগে। এই জ্ঞানচর্চাবিহীন ধর্মচর্চার মাধ্যমে অনেক সময় সামাজিক সংকট সৃষ্টি হয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হয়। ধর্মের মূলনীতি থেকে সরে যায় ধর্ম। এতে যেমন সমাজের ক্ষতি হয়, তেমনি ধর্মেরও ক্ষতি হয়। এ কারণেই ধর্ম প্রথমেই জ্ঞানচর্চার কথা বলে। এই জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে যারা ধর্মচর্চা করেন তারাই প্রকৃত ধর্মপ্রাণ হয়ে উঠতে পারেন। ধর্মান্ধ মানুষগুলো যেমন সমাজ ও ধর্মের জন্য ক্ষতিকর তেমনি ধর্মপ্রাণ মানুষগুলো সমাজ ও ধর্মের কল্যাণকর। ধর্মপ্রাণ মানুষগুলো ধর্মদর্শনের ওপর বেশি গুরুত্ব দেন। কারণ ধর্মদর্শনের চর্চার মাধ্যমে ধর্ম একটি যৌক্তিক কাঠামো লাভ করে। তখন ধর্ম শুধু একটি বিশেষ জাতি বা ধর্মাবলম্বি নয়, পুরো মানবজাতির জন্য কল্যাণকর হয়ে ওঠে।
ধর্মীয় কুসংস্কার, ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস ও ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনোভাব দূর করার জন্য ধর্মের দার্শনিক ব্যাখ্যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। রাজা রামমোহন রায় সকল ধর্মের বিধি-বিধান ও রীতি-নীতি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন তা হলো- সকল ধর্মের সারবস্তু এক। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব যে সর্বধর্মসমন্বয়ের কথা বলেছিলেন সেখানেও সকল ধর্ম একই লক্ষ্যের দিকে ধাবমান। রামষ্ণৃষ্ণ-বিবেকানন্দ যে ‘যত মত তত পথ’- এর কথা বলেন সে সকল পথ যখন একই লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হয় তখন ধর্মভেদ বলতে কিছু থাকে না। ধর্মের দার্শনিক ব্যাখ্যা থেকে এটাই স্পষ্ট হয় যে একই সমান্তরালে থেকে সকল ধর্ম একই লক্ষ্য অর্জনে নিয়োজিত। এই আত্মোপলব্ধি থেকে ধর্মচর্চা করলে ধর্ম ইহজাগতিক কল্যাণ বয়ে আনবে। ধর্মকে ইহজাগতিক কল্যাণের বিষয় করে তোলাই ধর্মদর্শনের লক্ষ্য। কিন্তু ধর্মাচার শুধু পারলৌকিক সুখশান্তি নিয়ে ব্যস্ত। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি, চিন্তার বিকাশ ও বিবর্তন, সমাজ-রাষ্ট্র ও ধর্মনীতির নবমূল্যায়নের মাধ্যমে ব্যক্তিমানুষের মনে এই ধারণা ক্রমশ বদ্ধমূল হচ্ছে যে, ধর্মাচার পালন না করেও ব্যক্তি সুখী জীবন যাপন করতে পারে। বিজ্ঞানের উন্নতি ব্যক্তির যাপিত জীবনে ধর্মের প্রয়োজনীয়তাকে গৌণ করে তুলেছে বলা যায়। ধর্মাচার এখন অনেক ক্ষেত্রেই একটি আবেগের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কিছু মানুষ ধর্মাচারকে ধর্মব্যবসায় পরিণত করে ফেলেছেন। সাধারণ মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে কিছু মানুষ শুধু ধর্মাচারী হয়ে উঠছে। এই ধর্মাচারীর দল ধর্মের মূল জায়গা থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে।
প্রাচ্য মানবতাবাদের প্রধান পুরোহিত গৌতম বুদ্ধ একটি ধর্মের প্রবর্তক ছিলেন। কিন্তু ধর্মকে তিনি কখনো পারলৌকিক রহস্য বা ধু¤্রজালে ঘেরা বিষয় করে তোলেননি। গৌতম বুদ্ধের ধর্ম ছিল ইহজাগতিক কল্যাণের বিষয়। শুধু মানবকল্যাণ নয়, প্রাণিকূলের প্রতিটি প্রাণির কল্যাণ করার উপদেশ লক্ষ্য করা যায় তার ধর্মে। অহিংসা পরমধর্ম বলে তিনি জীবকূলের জাগতিক কল্যাণ কামনা করেছেন। গৌতম বুদ্ধ ছিলেন নিরীশ^রবাদী। ঈশ^রচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনদর্শনেও ধর্মের স্থান ছিল না। তিনি কোন ধর্মীয় আচার পালন করতেন না। ইহজাগতিক মানবকল্যাণকেই তিনি ধর্মজ্ঞান করতেন। ধর্মবিশ্বাস বা ধর্মাচার- কোনটারই প্রয়োজন ছিল না বিদ্যাসাগরের জীবনে। তাই তিনি ধর্মীয় সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে কোন সম্প্রদায় নয়, পুরো মানবজাতির মঙ্গলাকাক্সক্ষী হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। কোন ব্যক্তির কাছে ধর্মাচার মুখ্য বিষয় হয়ে উঠলে সে ব্যক্তি সংকীর্ণ বা সীমাবদ্ধ হয়ে যান। কিন্তু ধর্মাচারকে গৌণজ্ঞান করে ধর্মের দার্শনিক বা নীতি-আদর্শিক দিকটিকে প্রাধান্য দিলে একজন মানুষ সর্বমানবের কল্যাণে নিয়োজিত হতে পারেন সহজেই। মানুষের এই সর্বমানবিক হয়ে ওঠার মধ্যেই জীবনের সার্থকতা।
প্রশ্ন উঠতে পারে তাহলে কি ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মাচার মূল্যহীন? না, ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মাচার মূল্যহীন নয়। তবে ধর্মবিশ্বাস যখন মানুষকে ধর্মান্ধ করে তোলে তখনই দেখা দেয় বিপত্তি। ধর্মান্ধ ব্যক্তি নিজ ধর্ম ছাড়া অন্যান্য ধর্মকে শুধু মূল্যহীন মনে করে না, নিশ্চিহ্নও করে দিতে চায়। ফলে দেখা দেয় উগ্র সাম্প্রদায়িকতা। সংঘটিত হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। তাই নির্বিচারী ধর্মবিশ্বাস যেন ধর্মান্ধতাকে ডেনে না আনে সেদিকে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। ধর্মাচারের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। ধর্মাচার যেহেতু দৃশ্যমান আচার-অনুষ্ঠান তাই ধর্মাচার পালনের মাধ্যমে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই বিভক্তি মানুষের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধের জন্ম দেয়। ফলে এক ধর্মের আচার অনুষ্ঠান অন্যধর্মের অনুসারীদের কাছে শুধু মূল্যহীন নয়, অনাচার বলে মনে হয়। যেমন আল্লার নামে পশু কুরবানি মুসলমানদের কাছে পরম পূণ্যের কাজ মনে হলেও হিন্দুদের কাছে তা অর্থহীন ও নৃশংস কাজ বলেই প্রতীয়মান হয়। আবার দেবতার নামে পশুবলি হিন্দুদের কাছে পরম পূণ্যের কাজ মনে হলেও মুসলমানের কাছে তা অর্থহীন বলে মনে হয়। ধর্মাচার যদি মানুষকে পরধর্মবিদ্বেষী করে তোলে তাহলেই বিপত্তি ঘটে। তাই ধর্মবিশ্বাসকে ধর্মান্ধতার হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। ধর্মাচারকে পরধর্মবিদ্বেষী বা পরধর্মের জন্য হুমকির পর্যায়ে উগ্র করে তোলা যাবে না। আর এ জন্য প্রয়োজন ধর্মদর্শনের গভীর অনুশীলন।
বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী হিসেবে বিভিন্ন ধর্ম পালন করে মানুষ হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম, খ্রিস্টানসহ বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়েছে। কিন্তু মানবজাতির সাধারণ ধর্ম মানবতাবাদ। এই মানবতাবাদী চেতনা সকল ধর্মের মূলে থাকলেও ধর্মাচার পালনের মাধ্যমে এই চেতনা সকল মানুষের মাঝে সমভাবে প্রয়োগ হয় না। একজন মুসলিম অন্য মুসলিমের প্রতি যতটা মানবিক, হিন্দুর প্রতি ততটা মানবিক হন না। বিপরীত কথাটিও সত্য। তাই কোন একটি বিশেষ ধর্ম সর্বমানবের জন্য কল্যাণকর- এই কথাটি তাত্তি¡কভাবে সত্য বলে ধরে নেওয়া হলেও ব্যবহারিক বা প্রায়োগিক ক্ষেত্রে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সহজ নয়। যুগে যুগে সংঘটিত অসংখ্য ধর্মযুদ্ধ সে কথাই প্রমাণ করে। ধর্মযুদ্ধ কোনকালেই সর্বমানবিক কল্যাণ বয়ে আনতে পারেনি। কখনো পারবেও না। একমাত্র ধর্মদর্শন সর্বমানবিক কল্যাণের পথ দেখাতে পারে। ধর্মের দার্শনিক দিক হলো নীতি-আদর্শিক দিক। এই নীতি-আদর্শিক দিকটি প্রতিষ্ঠিত হলেই ধর্মবিশ্বাসের ভিন্নতা, ধর্মাচারের ভিন্নতা সত্তে¡ও মানুষ জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতি মানবিক হয়ে উঠতে পারবে। এই মানবিক হয়ে ওঠাই মানবধর্মের মূলকথা। আচরণিক ধর্ম কখনোই সর্বমানবের জন্য সমভাবে কল্যাণকর নয়। কিন্ত মানবিক ধর্ম বা মানবতাবাদ সর্বমানবের জন্যই কল্যাণকর।
ধর্মাচার পালনের মাধ্যমেই ব্যক্তির ধর্মবিশ্বাস দৃশ্যমান হয়। ব্যক্তির ধর্মবিশ্বাস ভেতরের ব্যাপার। এই বিশ্বাসকে প্রদর্শন করার ব্যাপারে ধর্ম উৎসাহীও করে আবার নিরুৎসাহীও করে। বলা হয়, লোক দেখানো ধর্মাচার কোন কাজে আসে না। আবার ধর্মবিশ্বাসকে দৃশ্যমান করার জন্য সবক্ষেত্রেই গোপনে ধর্মাচার করা চলে না। ময়দানে ঈদের নামাজ পড়া, মসজিদ-মন্দির-গির্জায় উপাসনা করা, মÐবে পূজা করা, মিনা বাজারে কুরবানি করা, নিজ নিজ ধর্মীয় পোশাক পরিধান করা- এগুলো ধর্মাচার এবং এর কোনটাই গোপনে করা চলে না। ধর্মাচারের এই প্রদর্শনবাদীতায় এগিয়ে থাকার প্রতিযোগিতাও চলে পুরোদমে। যে সব ধর্মাচারের সাথে আর্থিক বিষয় জড়িত সেগুলো অতি ব্যয়বহুল করে প্রদর্শন করার পেছনে অনেক সময় ব্যক্তির আর্থিক সক্ষমতা জাহির করার প্রবণতা থাকে। ফলে ধর্মবিশ্বাস ভেতরেই চাপা পড়ে দুর্বল হয়ে যায় এবং ধর্মাচার শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ধর্মাচার শক্তিশালী হয়ে ওঠার বিপদ হলো, এতে ধর্মভেদ প্রকট আকার ধারণ করে। ধর্মাচারের প্রদর্শনবাদিতা মুখ্য হয়ে উঠলে ধর্মচিন্তা বা ধর্মের দার্শনিক ব্যাখ্যা গুরুত্বহীন হয়ে উঠতে পারে। কারণ ধর্মদর্শন ধর্মের মূল অনুসন্ধান করে। এতে ধর্মভেদ অনেকটা কমে আসে। কিন্তু ধর্মাচারের মাধ্যমে ধর্মভেদ বেড়ে যায়। প্রকৃত ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ধর্মদর্শন অনুসারে ধর্ম পালন করে। ধর্মান্ধ ব্যক্তি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আচারসর্বস্ব ধর্ম পালন করে। ফলে ধর্মান্ধ মানুষ যেমন নিজ ধর্মের ক্ষতি করে তেমনি অন্য ধর্মের অসম্মান করে ধর্ম-সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে।
ধর্মাচার বা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানকে বাগাড়ম্বরপূর্ণ করার মাধ্যমে ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মচিন্তাকে দুর্বল করার মানে হলো দেহকে পরিপাটি করে আত্মাকে ধ্বংস করা। ধর্মীয় দৃষ্টিতে আত্মাহীন দেহ মূল্যহীন হলেও দেহহীন আত্মা মূল্যহীন নয়। আত্মা অমর এবং আত্মাই পাপ-পূণ্যের ফলভোগকারী। সুতরাং নিজ নিজ ধর্মবিশ্বাসকে অটুট রেখে ধর্মাচার পালন করা এবং অন্যান্য ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মাচারের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন না করার মধ্যেই সন্ধান করতে হবে ইহজাগতিক মঙ্গল। এই অনুসন্ধানের কাজটি করে ধর্মদর্শন। তাই ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মাচারকে ইহজাগতিক মানবকল্যাণে কাজে লাগানোর জন্য ধর্মদর্শনের চর্চা জরুরি।

 

আলী রেজা
প্রাবন্ধিক, সাহিত্যচিন্তক
টাঙ্গাইল, বাংলাদেশ
পেশা : অধ্যাপনা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা


বিষয়: আলী রেজা


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top