সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

করোনাকালীন জীবনবোধের সন্ধানে : মোঃ ইয়াকুব আলী


প্রকাশিত:
৭ আগস্ট ২০২১ ১৮:৪০

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ০৩:০৫

 

করোনার তৃতীয় ধাক্কায় সিডনির জীবনযাপন পুরোপুরি বিপর্যস্ত। অস্ট্রেলিয়ার নিউ  সাউথ ওয়েলস অঙ্গরাজ্য করোনার প্রথম ধাক্কা এবং দ্বিতীয় ধাক্কা খুবই ভালোভাবে মোকাবিলা করেছিলো। কিন্তু ডেল্টা ভেরিয়েন্টের মোকাবিলায় এখন পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত বেশ কয়েকজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। অনেকেই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তার মধ্যে অনেকেই আবার আইসিইউ তে ভর্তি আছেন। আর প্রতিদিনই নতুন নতুন মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। শুরুতে এই প্রকোপ কম থাকাতে লকডাউন চলছিলো বেশ ঢিলেঢালাভাবেই। কারণ প্রথম এবং দ্বিতীয়বার এমন লকডাউন দিয়েই করোনার সংক্রমণ ঠেকিয়ে দেয়া সম্ভব হয়েছিলো। কিন্তু এইবার আর সেটা সম্ভব হচ্ছিলো না। উপরন্তু দৈনিক করোনার আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছিলো। সত্যি কথা বলতে এখনও বেড়েই চলেছে। বিশেষকরে কমিউনিটিতে আক্রান্তের সংখ্যা কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। আর কমিউনিটির এই সংক্রমণরোধের একমাত্র উপায় লকডাউন।  

এই লকডাউনকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। যে সবার্বগুলোতে এখন পর্যন্ত সংক্রমণ দেখে দিয়েছে সেগুলোর সবগুলোতেই লকডাউন চলছে কিন্তু কিছু সবার্বকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে যেখানে কমিউনিটি সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি। সেই সবার্বগুলো হচ্ছে - ব্ল্যাকটাউন, ক্যাম্বেলটাউন, ক্যান্টারবুরি-ব্যাংকসটাউন, কাম্বারল্যান্ড, ফেয়ারফিল্ড, জর্জেস রিভার, লিভারপুল এবং পারামাটা। নাগরিকদের বাসায় থাকার জন্য প্রতিদিনই নিউ সাউথ ওয়েলসের প্রিমিয়ারসহ অন্যান্য দায়িত্বরত কর্মকর্তারা অনুরোধ করে যাচ্ছেন। কোন দরকারে বাসা থেকে বের হলেও বাসার কেন্দ্র থেকে দশ কিলোমিটারের মধ্যে থাকতে বলা হচ্ছে কিন্তু উপরোল্লিখিত সবার্বগুলোর জন্য পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে থাকতে বলা হচ্ছে।

বাসা থেকে কোন দরকারে বের হলে একবারে কেবলমাত্র একজনকে বের হতে বলা হচ্ছে। আর শরীরচর্চা বা বাজার করার জন্যও নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যেই থাকতে বলা হচ্ছে। যেকোন জনসমাগমের স্থানসহ জনপরিবহণে মাস্ক বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আর উপরের আটটা সবার্বের জন্য ঘরের বাইরে বের হলেই মাস্ক একেবারে বাধ্যতামূলক করে দেয়া হয়েছে। মাস্ক না পরলে আগে জরিমানা ছিলো দুইশ ডলার সেটাকে বাড়িয়ে এখন পাঁচশ ডলার করা হয়েছে।

এছাড়াও সবাইকে করোনার টিকা নেয়ার জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে তাঁদের প্রতিদিনকার বক্তব্যে। বলা হচ্ছে যে টিকায় পান নিয়ে নেন কারণ টিকা নেয়া মানুষের শরীরে সংক্রমণের হার অনেক কম। এছাড়াও এখন পর্যন্ত যারা মারা গিয়েছেন তাদের মধ্যে মাত্র একজন ছিলেন যিনি প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছিলেন। অন্যরা কোন টিকায় নেয়নি। আগে বয়সের হিসাবে বয়স্কদের জন্য টিকা নির্ধারিত ছিলো। কয়েকটা ধাপে বয়সসীমা বাড়িয়ে এখন আঠারো বছরের চেয়ে বড় যে কেউ টিকার জন্য আবেদন করতে পারবেন নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে যেয়ে। অস্ট্রেলিয়াতে বর্তমানে দুই ধরণের টিকা দেয়া হচ্ছে - ফাইজার এবং এস্ট্রেজেনেকা।

এরমধ্যেই নিউ সাউথ ওয়েলসের রাজধানী সিডনিতে কয়েক হাজার মানুষ জমায়েত হয়ে লকডাউনের বিরুদ্ধে মিছিল করেছে। পরেরবার আবার একইরকম সমাবেশ করতে চাইলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করে সেটা ঠেকিয়ে দেয়া হয়েছে। অনেকেই এখন পর্যন্ত টিকা নেয়ার ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করে যাচ্ছেন। যদিও টিকা কেন্দ্রের বাইরে প্রতিদিনই অপেক্ষমান মানুষের লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। আমার প্রথম ডোজের টিকা নেয়ার সময় ছিলো ৫ই জুলাই সকাল আট ঘটিকা ত্রিশ মিনিট। আমি তাই সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে যেয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম।  অত সকালেও দেখি আমার সামনে গোটা বিশেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। এবং সময়ের সাথে আমার পেছনে লাইন দীর্ঘ হতে শুরু করলো।

টিকা কেন্দ্রের বিষয়টা এখানে একটু বলে নেয়া দরকার। আগে থেকে নিবন্ধন করে সবাই নির্ধারিত সময়ে টিকা কেন্দ্রের বাইরে সুশৃঙ্খলভাবে লাইন দিয়ে অপেক্ষা করেন। সেখানে অবশ্যই শারীরিক দূরত্ব রক্ষার এবং মাস্ক পরার বিষয়টি গুরুত্ব পায়। প্রথমে একজন স্বাস্থ্যকর্মী এসে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের সাহায্যে প্রত্যেকের শরীরের তাপমাত্রা মেপে একটা ছোট বৃত্তাকার লাল রঙের স্টিকার দিয়ে সেটাকে শরীরে সেটে দিতে বলেন যাতে সহজে দেখা যায়। এরপর রিসেপশনে সবার মেডিকেয়ার কার্ড এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স চেক করে একটা ব্যান্ড হাতে পরিয়ে দেয়া হয়। এরপর ভেতরে প্রবেশ করার পর আবারও লাইনে অপেক্ষা করতে হয়। বিভিন্ন কক্ষের সামনে স্বাস্থ্য কর্মী দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষমান মানুষ এবং টিকাদানকারীর হিসাবে বলে দেন কাকে কোন লাইনে যেতে হবে।  

এরপর টিকা কক্ষে প্রবেশের পর আবারও তথ্যগুলো যাচাই করে টিকা প্রার্থীর শারীরিক বিষয়ের বিস্তারিত তথ্য নিয়ে নেন। এছাড়াও স্বাস্থ্যকর্মী টিকার বিষয়ে বিস্তারিত বলেন যেমন - কোন ব্রান্ডের টিকা, কত পরিমাণে দেয়া হবে এবং কতদিন পর দ্বিতীয় ডোজ নিতে আসতে হবে। টিকা নেয়া হয়ে গেলে সবাইকে অবজারভেশন কক্ষে যেয়ে অপেক্ষা করতে হয়। টিকাদানকারী টিকা দেয়ার সময় থেকে হিসাব করে একটা সাদা কাগজের স্টিকারে পনের মিনিট পরের সময়টা লিখে সেটা জামার সাথে লাগিয়ে নিতে বলেন। অবজারভেশন কক্ষে যেয়ে অপেক্ষা করার পর সেই স্টিকারের সময় ধরে ধরে সবাইকে ডেকে আবারো লাইনে দাঁড়াতে বলা হয়। এরপর আবারো একজন স্বাস্থ্যকর্মী সবকিছু চেক করেন যেমন টিকা নেয়ার পর কোন সমস্যা হচ্ছে কি না। সমস্যা হলে কি ধরণের ব্যবস্থা নিতে হবে এইসব বিষয়ে পরামর্শ দেন।

ঠিক একইভাবে তিন সপ্তাহ পর নিতে হয় টিকার দ্বিতীয় ডোজ। আমাদের বন্ধু আশফাক ভাই এবং দিশা ভাবিরা টিকা নিয়েছিলেন ক্যান্টারবুরি কেন্দ্র থেকে। দুই ডোজ টিকা নেয়া শেষ হয়ে যাওয়ার প্রায় সপ্তাহখানেক পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ফোন করে জানানো হয় উনারা টিকা নেয়ার জন্য যে সময়টা কেন্দ্রে অবস্থান করেছেন সেই সময়ে ওখানে এমন একজন ছিলেন পরবর্তিতে যাকে পরীক্ষা করে করোনা পজিটিভ বলে শনাক্ত করা হয়েছে। তাই উনাদেরকে আইসোলেশন থাকতে হবে এবং তিন দিন অন্তর অন্তর পরীক্ষা করাতে হবে। উনাদের প্রথম পরীক্ষাতে করোনা ডিটেক্ট হয়নি। এরপর আবারও উনারা টেস্ট করানোর জন্য নমুনা দিয়েছেন। এই কদিন উনারা কোথাও যেতে পারবেন না নিজেদের বাড়ির মধ্যেই থাকতে হবে। 

অন্যান্যবার সব ইন্ডাস্ট্রি বন্ধ ঘোষণা করলেও কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রি চালু ছিলো। আমি যেহেতু এই ইন্ডাস্ট্রির সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে কাজ করি তাই এটা জানি। কিন্তু এইবার কনস্ট্রাকশনও প্রায় বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। রেড জোনের মধ্যে কোন প্রকার কনস্ট্রাকশন কাজ চলছে না। উপরন্তু যেসব সবার্বগুলোকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রির একটা বিশাল সংখ্যক কর্মী সেখানে বসবাস করেন ফলে কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রি মূলত বন্ধই হয়ে গেছে। অবশ্য গ্রেটার সিডনির বাইরে নিউ সাউথ ওয়েলসের অন্যান্য জায়গায় ছোটোখাটো কাজ চলছে।

এভাবেই করোনা এক নতুন জীবনবোধের উপায় বাতলে দিচ্ছে। মাঠে ঘাটে পথে প্রান্তরে সবাই মুখোশ পরে ঘুরছে। কেউ কাউকে চিনতে পারছে না। আগে যেমন সবাই সবার বিপদে এগিয়ে এসে পাশে দাঁড়াতেন এখন সবাই দূরে সরে যেয়ে বরং পাশে দাঁড়াচ্ছেন। কারণ সংস্পর্শে আসলে এই রোগ আরো বেশি ছড়িয়ে বেশি সংখ্যক মানুষকে আক্রান্ত করবে। বাজার ঘাটের জন্য আগে যেমন সবাই শপিংমলগুলোতে হামলে পড়তেন এখন সেখানে সবাই অনলাইন শপিংয়ে ঝুঁকে পড়ছেন। বাড়ি বাড়ি এসে পোশাক থেকে শুরু করে মুদির সদাই পর্যন্ত ডেলিভারি দিয়ে যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। সেলুনগুলো বন্ধ হয়ে গেছে তাই অনেকেরই চুল কাটা বন্ধ হয়ে আছে। অবশ্য অনেকেই চুল কাটার যন্ত্র কিনে বাসায় নিজে নিজে চুল কেটে নিচ্ছেন। আমাদের বাসায় ছোট রায়ানকে কোনভাবেই চুল কাটানোর জন্য রাজি করানো যাচ্ছে না। তাই তার চুলের নিচে ঢাকা পরে যাচ্ছে কানের লতি।

এতকিছুর পরও থেমে নেই জীবন, থেমে নেয় উৎসব, আনন্দ উদযাপন। ঈদুল আজহার খুৎবা থেকে শুরু করে নামাজের জামাত আদায় করা হয়েছে জুম মিটিংয়ে বা অনলাইন ব্যবস্থায়। বেশিরভাগ কোরবানি দেয়ায় বন্ধ ছিলো এইবার। অনেকেই সেই টাকা দিয়ে করোনার কাজ হারানো মানুষগুলোর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। সামনে আসছে বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব দূর্গা পূজা। অবস্থাদৃষ্ঠে মনেহচ্ছে সেটাও আর যথানিয়মে পালন করা সম্ভব হবে না। সেটাও হয়তোবা পালন করা হবে জুম মিটিংয়ের মাধ্যমে। কিন্তু এরমধ্যেই বেরিয়ে গেছে আনন্দমেলার শারদীয় পূজা সংখ্যা। 

আমরা ছোটবেলায় পড়েছিলাম মানুষ সামাজিক জীব তাই সমাজে সবাই একত্রে মিলেমিশে বসবাস করেন। একে অপরের বিপদে পাশে এসে দাঁড়ান। গত প্রায় দেড় বছরে করোনার প্রকোপে এক ধরণের নতুন সমাজব্যবস্থা তৈরি ইতোমধ্যেই তৈরি হয়ে গেছে। আমরা একে ওপরের সংস্পর্শে না এসেও অন্যের পাশেই আছি। বিপদগ্রস্থ মানুষকে যতটুকু পারা যায় আর্থিক এবং মানসিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি। তাদের সাথে দেখাও হচ্ছে ইথারের ভার্চুয়াল মাধ্যমে, হচ্ছে মিথস্ক্রিয়া। করোনার প্রভাবে এভাবেই হয়তোবা একটা নতুন জীবনবোধ তৈরি হয়ে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্ম হয়তোবা এটাতেই অভ্যস্ত হয়ে যাবে। মুখোশ পরে চলাটাকেই হয়তোবা তাদের কাছে স্বাভাবিক মনেহবে। যেই বাতাসে রয়েছে জীবন রক্ষাকারী অক্সিজেন আবার সেই একই বাতাসের মাধ্যমে বিশ্বময় ছড়িয়ে যাচ্ছে করোনার জীবাণু।

এভাবে চলতে চলতে হয়তোবা কোন একদিন আসবে যখন করোনার জীবাণু পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হবে। মানুষ মুখ থেকে মুখোশ খুলে একে অপরকে দেখে অবাক হয়ে যাবে। আনন্দের আতিসয্যে বারংবার করবে কোলাকুলি। গুরুজনেরা আবারও ছুঁয়ে দেখবেন তাদের স্নেহের পরবর্তি প্রজন্মকে আর শোনাবেন করোনাকালের ভোগান্তির গল্প, যুদ্ধের গল্প বা বেঁচে থাকার গল্প। 

ছবিঃ লেখক

মো: ইয়াকুব আলী

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top