সিডনী মঙ্গলবার, ২৩শে এপ্রিল ২০২৪, ১০ই বৈশাখ ১৪৩১

দাবানলঃ পরিবেশ বিপর্যয় ও ভয়াবহতা : অনজন কুমার রায়


প্রকাশিত:
১৭ আগস্ট ২০২১ ১৯:২৮

আপডেট:
২৩ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:৪৩

 

“আমি বাড়ি হারিয়েছি, কিছুই অবশিষ্ট নেই। কাল কি হবে জানি না। ”- নির্বাক চাহনিতে ব্যথিত কন্ঠে গ্রীসের ইভিয়া দ্বীপের এক বাসিন্দার কথা। ইভিয়া দ্বীপটি দাবানলে দাউ দাউ করে জ্বলছে। অনেক কিছু পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। বিপুল পরিমাণ সম্পদের ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে।
গ্রীসে এখন প্রবল তাপপ্রবাহ চলছে। বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ কম। দাবানলের কারণে ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উপরের দিকে উঠছে। সেই সঙ্গে ঝড়ো হাওয়া। তাই আগুন নিভানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আগুন নিভানোর জন্য অগ্নিযোদ্ধারা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। বিপর্যয় মোকাবেলায় কয়েকটি দেশ থেকে ইতোমধ্যে আগুন নিভানোর জন্য বিশেষ বিমান ও যন্ত্রপাতি পাঠিয়েছে। দাবানলে অনেক জনের প্রাণ হানি ঘটেছে। অনেকেই দাবানলের ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্ট ও আগুনে পোড়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।

শুধু গ্রীস নয়। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যসহ উত্তর আমেরিকার কিছু অঞ্চল, কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া অঙ্গরাজ্য, তুরস্ক, আলজেরিয়াতে ভয়াবহ দাবানল ছড়িয়ে পড়েছে। ইউরোপ থেকে আস্তে আস্তে আফ্রিকার দিকে দাবানল ছড়িয়ে পড়ছে।

বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ২০০৩ সালের পর চলতি বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত এমন দাবানল বিশ্বে আর হয়নি। তীব্র দাবদাহ আর দীর্ঘ খরার কারণে দাবানল সৃষ্টি হয়েছে। এতে বনাঞ্চল ও তৃণভুমি পুড়ে বায়ুমণ্ডলে ৩৪৩ মেগাটন কার্বন নি:সরণ হয়েছে, যা পরিবেশ সুরক্ষায় বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে।

গ্রীসের প্রধানমন্ত্রী কিরিয়াকোস মিটসোটাকিস দাবানল মোকাবেলায় ব্যর্থতার জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্ত:সরকার প্যানেলের(আইপিসিসি) বৈশ্বিক উষ্ণায়নের একটি প্রতিবেদন সম্প্রতি প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে চলমান দুর্যোগের জন্য গ্রীসের প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করেছেন। তবে দাবানল প্রকৃতির প্রতিশোধই বলা চলে। প্রকৃতির উপর মানুষের নিপীড়ন চলতে থাকলে দাবানলের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়তেই থাকবে।

কোন আগুনের উৎস তাপমাত্রা এবং অক্সিজেনের উপস্থিতিতে দাহ্য পদার্থের সংস্পর্শে আসলে আগুনের সূত্রপাত হয়। প্রাকৃতিকভাবে গাছপালা থেকে ক্রমাগতভাবে পানি বাষ্পীভূত হয়। গাছ মাটি বা বাতাসে বিদ্যমান জলীয় বাষ্প বা বৃষ্টির পানি শোষণের মধ্য দিয়ে বাষ্পীভূত পানির ঘাটতি পূরণ করে। কিন্তু অনেকদিন ধরে উত্তপ্ত কিংবা শুষ্ক আবহাওয়া বিরাজ করলে গাছপালা পানি শোষণ করতে পারে না। ফলে গাছ-পালা পানির সমতা রক্ষা করতে না পেরে শুষ্ক ও দাহ্য হয়ে উঠে। যার ফলে দাবানল দেখা দিতে পারে। তাই দাবানল সাধারণত শুকনো মৌসুমে দেখা দেয়। তবে বজ্রপাত থেকেও দাবানল হতে পারে।

দাবানলের আগুন থেকে প্রচুর পরিমাণ ধোঁয়া নির্গত হয়। National Oceanic and Atmospheric Administration(NOA) ’র তথ্যমতে, দাবানলের ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়লে বায়ুমণ্ডলে প্রচুর পরিমাণে এরোসল (ধূলিকণা) জমা হয়। গত বছরের জানুুুুারীতে অস্ট্রেলিয়ায় দাবানলের ফলে এরোসল (ধূলিকণা) সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

বায়ুমণ্ডলের প্রায় ৯০ শতাংশ ধূলিকণা, জলীয় বাষ্প, মেঘ থাকে বায়ুমণ্ডলের ট্রপোস্ফিয়ার স্তরে। কিন্তু দাবানলের ধোঁয়া যখন ট্রপোস্ফিয়ারের উপরের স্তরে চলে যায় তখনি দেখা দেয় বিপত্তি। বায়ুমণ্ডলে ট্রপোস্ফিয়ারের যত উপরে উঠা যায় তাপমাত্রা তত কমতে থাকে। কিন্তু,স্ট্র্য্যাটোস্ফিয়ারের বেলায় ক্রমশ উপরে গেলে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। আবার, স্ট্র্য্যাটোস্ফিয়ারে অবস্থানকারী ধূলিকণা ট্রপোস্ফিয়ারের মত ঘনঘন রদবদল হয় না। তাই, ট্রপোস্ফিয়ার অতিক্রম করে স্ট্র্য্যাটোস্ফিয়ারে এরোসল কণা পৌঁছলে অনেক দিন অবস্থান করে। সেখানকার জমাকৃত এরোসল কণা বৃষ্টির সাথে পৃথিবীতে আসে। বাতাসে ভাসমান এরোসল (ধূলিকণা) আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা, হাঁপানি রোগ বাড়িয়ে তুলতে পারে। তবে সেটা কতটা বিপদজনক তা নির্ভর করে এরোসল কণাগুলো স্ট্র্য্যাটোস্ফিয়ারে কতটুকু উচ্চতা পর্যন্ত পৌঁছে এবং তাদের পুরুত্বের উপর।

১৯৯২ সালে ইন্দোনেশিয়ার ‘পিনাটুবো’ আগ্নেয়গিরি বি¯েফারনের ফলে বায়ুমণ্ডলে প্রচুর পরিমাণে এরোসল কণার উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। যার ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রায় অর্ধেকে নেমে গিয়েছিল। যাকে বলা হয় গেøাবাল কুলিং বা বিশ্ব হিমায়ন। তা যেমন হিমায়নের কারণ হতে পারে তেমনি উষ্ণায়নেরও কারণ হতে পারে।

আবার, যেখানে বৃষ্টির পরিমাণ বেশি সেখানকার মাটিতে জৈব পদার্থের একটি পুরো আস্তরণ তৈরি হয়। এ সকল জৈব পদার্থের আস্তরণ মাটির নিচের কার্বনকে পরিবেশের সাথে সহজে মিশতে দেয় না। মাটির নিচের এ সকল কার্বন হলো লিগ্যাসি কার্বন। ঘন ঘন দাবানলের ফলে বন-বনানীর উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় সেখানকার বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে আসে। যে অরণ্যের এলাকাগুলোতে বৃষ্টির পরিমাণ কম সেই অঞ্চলে জৈব পদার্থের আস্তরণ ততটা পুরো নয়। তাই সে অঞ্চলে দাবানল হলে মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা কার্বন সহজেই বেরিয়ে এসে বাতাসের সাথে মিশে যায়। অক্সিজেনের সাথে যুক্ত হয়ে কার্বন মনোক্সাইড কিংবা কার্বন ডাই-অক্সাইডের মত গ্রীণ হাউস গ্যাস উৎপন্ন করে পরিবেশকে বিষাক্ত করে তুলে। গবেষণায় প্রকাশ, ২০১৪-সালে দাবানলে আমাজান অরণ্যের যে অংশ পুড়ে ছাই হয়েছিল, তার অন্তত ১২ শতাংশ লিগ্যাসি কার্বন যা মাটির উপরে এসে বাতাসে বিষের পরিমাণ ভারী করছে!

পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, গাছ কাটার ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে আসছে। অরণ্য শুষ্ক হয়ে উঠছে। যার ফলে দাবানলের সংখ্যা ও প্রাবল্য বাড়ছে। বনাঞ্চল এবং সেখানকার মাটির ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। মাটির নিচের কার্বন অক্সিজেনে পুড়ে বাতাসে গ্রীণ হাউস গ্যাসের পরিমাণ বাড়াচ্ছে। ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। The Arctic-Boreal Vulnerability Experiment (ABoVE)’র মতে, বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য রেইন ফরেস্ট বা চির হরিৎ অরণ্যগুলোর দাবানলের ঘটনা আগের চেয়ে বেড়েছে অনেক। অন্যদিকে, দাবানলের সংখ্যা ও প্রাবল্য বেড়ে যাওয়ায় গাছের পাতা, কাণ্ড, ডালপালা পুড়ে কার্বন মনোক্সাইড এবং কার্বন ডাই-অক্সাইডের মতো গ্রীন হাউস গ্যাসের পরিমাণ বাড়ছে। ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

তাই, দাবানলের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রেহাই পেতে পরিবেশ বিপর্যয় রোধ করতে হবে। গ্রীণ হাউস উৎপাদনকারী গ্যাসের পরিমাণ কমিয়ে নিয়ে আসতে হবে। তা না হলে পরিবেশের যেমন বিপর্যয় ঘটবে তেমনি পৃথিবী নামক গ্রহে বসবাসকারী প্রাণীদের জীবন শঙ্কিত হয়ে আসবে।

 

অনজন কুমার রায়
ব্যাংক কর্মকর্তা  লেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top