সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

হায় চিল : নবনীতা চট্টোপাধ্যায়


প্রকাশিত:
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৭:৫৪

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:৫৮

 

সে ছিল এক রৌদ্রকষায়িত অপরাহ্ন। হঠাৎ করে বাড়িতে অতিথি আসায়, গৃহিণী মমতা কিশোর বাবলুকে পাঠিয়েছিলেন মিষ্টির দোকানে। শালপাতার ঠোঙায় মোড়া উপাদেয় গরম কচুরি ও তরকারি নিয়ে কিশোর বাবলু বাড়ি ফিরছিল, কিন্তু তার চোখ ছিল আকাশের ঘুড়ির দিকে। সে যখন আনমনে ঘুড়ির ওঠানামা দেখতে ব্যস্ত, চিলে এসে ছোঁ মেরে এক লহমায় নিয়ে গেল খাবারের ঠোঙাটি। প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পূর্ব পশ্চিম উপন্যাসের অধ্যায়ে এভাবেই এঁকেছেন চিলে ছোঁ মারার ঘটনাটি যা পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর এমনকি আশীর দশকেও হামেশাই দেখা যেত। এই কাজে চিল এতটাই পটু ছিল যে বাংলা বাগধারায় চিলের মত ছোঁ মারা কথাটি একটি সুপরিচিত প্রবাদ বাক্যই হয়ে গেছে। চিলের মত ছোঁ মারা, চিল চীৎকার, চিল শকুনের নজর কথাগুলি বাংলা ভাষায় বেশ পোক্ত জায়গা করে নিয়েছে। আমাদের দৈনিক জীবনে প্রায়শই আমরা এই কথাগুলি ব্যবহার করি। কিন্তু চিল সম্বন্ধে আমরা কতটুকু জানি? কেনই বা আজকাল তাদের খুব বেশি দেখা যায় না? কোথা থেকে আসে তারা কোথায় বা যায়?
চিল মূলত আসিপিট্রিডে প্রজাতির মাঝারি থেকে বৃহৎ আকারের শিকারী পাখি। ভারতীয় উপমহাদেশ, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি গ্রীষ্মকালীন অঞ্চলে এদের দেখা যায়। এদের লম্বা ডানা ও শাখাবিভক্ত লেজ থাকে। এদের পা দুটি অপেক্ষাকৃত দুর্বল। অনেক উঁচুতে ডানা স্থির রেখে এরা চক্রাকারে ঘুরপাক খায় ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিশক্তির মাধ্যমে নজর রাখে শিকার ও খাবারের প্রতি। প্রধানত: কীটপতঙ্গ, সাপ, মাছ, ছোটো ইদুঁর, মৃতদেহ, বর্জ্য পদার্থ ইত্যাদি ওদের খাদ্য। গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলিতে তিন ধরনের চিল দেখা যায়। শঙ্খচিল, কালো চিল, ভুবন চিল। শঙ্খচিল বাংলাদেশ ও ভারতীয় উপমহাদেশে একটি সুপরিচিত পাখি। ৭৬-৮৪ সেমি এদের দৈর্ঘ্য। নদীনালা, বিভিন্ন ধরনের জলাশয়, ডোবা, পুকুরের আশেপাশে এদের দেখা যায়। এদের মাথা ,ঘাড়, বুকের রং শঙ্খের মত সাদা। পিঠের উপরে মরচে রঙের ডানা, ছোটো ঠোঁট, লেজের ডগা গোলাকার। এরা জীবিত বা মৃত মাছ, জলজ প্রাণী, ছোটো সাপ, হাঁস মুরগীর বাচ্চা খেয়ে জীবনধারণ করে। এরা খুব উঁচু গাছের ডালে ছোট ছোট ডাল ও শুকনো পাতা দিয়ে বাসা তৈরী করে এবং সেই একই বাসা বছরের পর বছর ধরে ব্যবহার করে। শঙ্খচিল দিনে দুটো করে ডিম দেয়। মা পাখি, বাবা পাখি দুজনে মিলে বাচ্চা বড় করে যদিও ডিমে তা দেয় শুধু মা পাখি। এরা জোড়ায় থাকে। এরা সবসময় জলাশয়ের পাশে বাসা বাঁধে। সুযোগ পেলে জেলেদের নৌকা বা ট্রলার অনুসরণ করে মাছ শিকার করে। সুন্দরবনের বিভিন্ন অঞ্চলে, বাংলাদেশে এদের ব্যাপক হারে দেখা যায়।
কালো চিল পৃথিবীর সমস্ত গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলিতে, এমন কি আফ্রিকা মহাদেশের সাহারা মরূভূমি, ইউরোপের স্পেন ও পর্তুগালেও দেখা যায়|সমভূমি ছাড়া সিকিমের অনেক উঁচু এলাকাতেও এদের বাস আছে। গাছের উঁচু ডালে এদের বাসা হয়। স্ত্রী চিল গড়ে ৩ থেকে ৪ টি ডিম পাড়ে। এরা পালা করে ডি মে তা দেয়। ডিম ফুটে বার হবার পর ছানারা প্রায় ৮০দিন বাবামায়ের কাছে থেকে খাদ্য গ্রহণ করে। তারপর নিজেরাই খাদ্য সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পরে এবং শিকারের জন্য অনেক উঁচুতে উঠে মহাশূন্যে ভেসে বেড়ায়। এই প্রজাতির চিল ও দলবদ্ধ হয়ে থাকতে ভালোবাসে। একসাথে তিরিশ পঁয়ত্রিশ কালো ডানার চিল বড় বড় মহীরূহের ডালে বাসা বাঁধে।
ভুবন চিল বা পরিযায়ী চিল লম্বা চেরা লেজওয়ালা কালচে বাদামী রঙের মাঝারি আকারের শিকারী পাখি। গাঢ় ধূসর ও কালো ঠোঁ। বাদামী রঙের চোখ, পা ও পায়ের পাতা হালকা হলুদ। খোলামেলা প্রান্তর, মুক্ত এলাকা এদের পছন্দের বিচরণ ভূমি। এছাড়াও বন জঙ্গল, পার্বত্য এলাকা, নদীর পাড়, শহর, গ্রাম বিভিন্ন অঞ্চলে এদের দেখা যায়। বড় বড় মহীরূহে এরা দলবদ্ধ ভাবে রাত কাটায়। ভোরবেলায় সূর্য ওঠার পরে দল বেঁধেই চক্রাকারে আকাশে পাক দিয়ে বেড়ায়। সারা দিন শিকারের সন্ধানে ঘুরে সন্ধ্যাবেলায় এরা আবার বাসায় ফিরে আসে। ভুবন চিল সুযোগ সন্ধানী পাখি। খাবার ছিনিয়ে নিতে এরা ওস্তাদ। খাবারের সন্ধানে এরা অনেক ক্ষণ অলস ভঙ্গিমায় বাতাসে চক্কর কেটে উড়ে বেড়ায়। ডানার তুলনায় শরীর হালকা হওয়ায় এরা দীর্ঘ সময় স্থির ভাবে আকাশে ভেসে থাকতে পারে। লেজটাকে নৌকার হালের মত ব্যবহার করে এরা ঝটপট দিক পরিবর্তন করতে পারে| ভুবন চিল আকাশে উড়ার সময় দীর্ঘ কাঁপা কাঁপা সুরে ডাকে। কালো ডানার চিল আবার বেশিরভাগ সময়ে নীরব থাকে এবং খুব নমনীয় ভাবে স্বর বিনিময় করে। কিন্তু বিভিন্ন মরশুমে বিশেষত: প্রজনন মৌসুমে এদের ডাক উচ্চস্বরের হয়।
মোটামুটিভাবে যে কোনো প্রজাতির চিলের গড়পড়তা আয়ূ ২৪ বছর। কিন্তু কখনো কখনো কীটনাশক দ্রব্য মেশানো বর্জ্য পদার্থ খেয়ে অথবা অবস্থানগত কারনে তারা আগেই শেষ হয়ে যায়। যেমন আফ্রিকার দক্ষিণাংশে পথের পাশে অবস্থানজনিত কারণে কখনো কখনো দ্রুতগামী যানবাহনের ধাক্কায় বহু চিল মরে পরে থাকে। আমাদের এই নীল গ্রহটির প্রাকৃতিক পরিবেশে ভারসাম্যতা রাখার ক্ষেত্রে চিলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। বর্জ্যভুক পাখি হিসাবে চিল নানা স্থানের যাবতীয় বর্জ্যপদার্থ, ময়লা, পচনশীল দুর্গন্ধময় উচ্ছিষ্ট, মৃত পশু প্রাণীর লাশ ইত্যাদি খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে পরিবেশকে নির্মল রাখে| অথচ আগ্রাসী মানব সভ্যতার জন্য বর্তমানে চিলের সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান। বড় বড় জলাশয়গুলি যেমন খাল বিল ঝিল পুকুর ইত্যাদি বুজিয়ে ফেলে, গাছপালা, বন কেটে ফ্লাটবাড়ি নির্মান, উঁচু টেলিফোন টাওয়ার, শস্যক্ষেতে ও বিভিন্ন বর্জ্য আবর্জনায় শক্তিশালী কীটনাশক ব্যবহার এই পৃথিবীতে তাদের অস্তিত্ব রক্ষায় সংকট এনে দিয়েছে। বাসস্থানের অপ্রতুলতা ও খাদ্যের অভাবে আমাদের চারিপাশের পরিবেশ থেকে খুব নি:শব্দে নিরভিমানে চিল নামক একটি পাখি বিলুপ্তের পথে। গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলির অধিবাসী হিসাবে আমাদের দৈনন্দিন পরিবেশের সাথীটি এখন আর অলস মধ্যাহ্নে চক্রাকারে রৌদ্রতপ্ত আকাশে পাক দিয়ে দিয়ে এক বিষাদ সুরে আচ্ছন্ন করে না মন, যা শুনে আমাদের প্রিয় কবি লিখেছিলেন,
"হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে/ তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে/ তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে/পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে/ আবার তাহারে কেন ডেকে আনো? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে? "
নিজেদের মুঠোর মধ্যে নীল গ্রহটিকে আনতে গিয়ে মানুষ বহু প্রাণের অস্তিত্ব সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবিলম্বে এই শিকারী পাখিটির সংরক্ষণের ব্যবস্থায় নজর না দিলে হয়ত বা কবির ইচ্ছা "আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়/হয়তো মানুষ নয়, হয়তো শঙ্খচিল শালিকের বেশে.... " এক অলীক অবাস্তব স্বপ্নে পরিণত হবে।

 

নবনীতা চট্টোপাধ্যায়
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top