সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

যদি বন্ধু এনে দাও : নবনীতা চট্টোপাধ্যায়


প্রকাশিত:
১২ অক্টোবর ২০২১ ০০:১০

আপডেট:
১৯ এপ্রিল ২০২৪ ২০:৪৪

 

টায়রাকে নিয়ে বাড়ির সবাই খুব নাজেহাল। একদম কথা বলে না মেয়েটা। তার বয়সী ছয় বছরের শিশুদের কত আবোল তাবোল কথা, জিজ্ঞাসা থাকে। অথচ টায়রা একদম চুপ সবসময়ে। তা বলে কি সে কথা বলতেই পারে না। তা নয়। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে টায়রা ঠিকই উত্তর দেয়, কিন্তু নিজের থেকে সে একটিও কথা বলে না। নিস্পাপ নরম আয়তাকার কালো চোখ দুটি মেলে সে শান্তভাবে সবার কথা শুনে যায়।
এই অবধি তা ও ঠিকই ছিল। সবাই না হয় বলাবলি করতো টায়রা আসলে একটি শান্তশিষ্ট শিশুকন্যা। কিন্তু সেটাও ঠিক মেলে না। আপনমনে সে যখন খেলা করে তখন অজস্র কথা বলে যায়। যেন কোনো বন্ধুর সাথে কথা বলছে। অথচ সামনে কেউ নেই। অথবা  সামনে কেউ এলেই টায়রা অকর্স্মাৎ চুপ করে যায়। স্কুল থেকে আন্টি কমপ্লেন করেন টায়রা স্কুলে কারো সাথে কথা বলে না, খেলা করেনা। বাড়ীতে বাবা, মা, দাদু, ঠাম্মি। বাবা মা রোজ অফিসে বেরোন। দুপুরে টায়রা ঠাম্মির পাশে শুয়ে শুয়ে অনেক রূপকথা শোনে। তারপর ঠাম্মি ঘুমিয়ে পড়লে পা টিপে টিপে খাটের থেকে নেমে এসে জানালার ধারে বসে। জানালার ওপাশে একটি কাঠবাদাম গাছ চকচকে সবুজ মেরুণ পাতা মেলে দাঁড়িয়ে আছে।  তাদের বাড়িটা কলকাতা শহরের কাছেই এক মফ:স্বল শহরে। তাই বাড়ির সংলগ্ন ছোট একটি বাগান ও আছে। সেখানে ছোটো বড় অজস্র ফুলগাছের মাঝখানে একটি  কাঠবাদাম গাছ ও আছে। আছে মানে জমি কেনার সময় থেকেই ছিল। বাড়ীটা তৈরী  হবার পর দেখা গেল বাড়ীর পূবদিকে জানালার পাশেই তার অবস্থান। এটা দাদু ঠাম্মির ঘর। সারাদিন যখন বাবামা অফিসে থাকে এই ঘরেই টায়রার সময় কাটে। দাদু, ঠাকুমা , একরাশ গল্পের বই আর কাঠবাদাম গাছ নিয়ে। ছোটো থেকেই টায়রা গল্পের বই পড়তে খুব ভাল বাসে আর ভালোবাসে এই কাঠবাদাম গাছটিকে। মনে মনে গাছটিকে সে বন্ধু বলে ভাবে আর গাছবন্ধু বলে ডাকে। যখনই তার মনে কোনো নতুন চিন্তা আসে, অথবা কষ্ট দু:খ কিংবা   কিছু খুশীর খবর, টায়রা এসে কাঠবাদাম গাছকে বলে। সে লক্ষ্য করেছে যে তার সব কথা গাছবন্ধু খুব মন দিয়ে শোনে। অন্যদের মতো নয়। সন্ধ্যাবেলা মা অফিস থেকে বাড়ী ফিরলে  সে যখন কিছু কথা বলতে যায়, মা সাথে সাথে বলেন" টায়রা হোমওয়ার্ক শেষ হয়েছে? সারাদিন অফিস করে আমি খুব টায়ার্ড। তুমি বিকেলে দুধ খেয়েছো? তোমার পেন্সিল বক্স কোথায় গেল?  কোনো কিছু গুছিয়ে রাখতে শিখছ না। "মা গজগজ করতেই থাকে। টায়রা চুপ করে যায়। বাবা ফেরেন আরো অনেক পরে। কাজের চাপে বাড়িতে ফিরেও ল্যাপটপ নিয়ে বসে যান।  টায়রার ইচ্ছে করে বাবার সাথে গল্প করার কিন্তু কাছে গেলেই বাবা হাসিমুখে তার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলেন"যাও মা, মন দিয়ে পড়াশোনা করো। আমি একটু অফিসের কাজটা শেষ করে নিই।" বাকি থাকে দাদু আর ঠাম্মি। দাদুর কাছে গেলে দাদু একগাল হেসে বলেন "এসো দিদিভাই, বসো। দেখেছ তোমার ঠাম্মির আক্কেলখানা। সকালে আমাকে দুবার চা দেওয়ার কথা, দ্বিতীয়বারের চা এখনো পেলামনা। কি যে রাজকার্য তার। যাওতো ঠাম্মিকে একটু আমার চায়ের কথা মনে করিয়ে দিয়ে এসো" অথবা "দিদিভাই যাওতো বারান্দা থেকে কাগজটা একটু নিয়ে এসো।  একটু পড়ি। আর তুমি নিজের মনে খেলাধূলা করো। শুধু বাড়ীর বাইরে যেও না।"
এই যে বাড়ীশুদ্ধ  লোক তাকে এত যত্ন করে, তার নাওয়া খাওয়া নিয়ে খেয়াল রাখে, সে একটু চোখের আড়াল হলে চিন্তায় পড়ে যায় অথচ তাদের কারো ফুরসত হয় না টায়রাকে কাছে বসিয়ে তার মনের কথা শোনার। কিন্তু টায়রার যে মনের মাঝে অনেক কথা জমা হয়ে থাকে। তার মন ভার হয়ে থাকে, ঘুম থেকে উঠলে কান্না পায়, পড়তে বসলে আনমনা লাগে। স্কুলে গেলে ভয় পায় কি জানি তার কথা অন্যরা যদি অপছন্দ করে।  টায়রা তাই চুপ করে থাকে। তার মনের মধ্যে অজস্র অনুচ্চারিত কথা জমা হতে হতে পাথরের মত ভারী হয়ে যায়। তার কান্না পায়। কবে সে পারবে এই জমানো কথার ভারকে লাঘব করতে? ঠাম্মি যখন সংসারের কাজে ব্যস্ত থাকে, টায়রা চুপ করে পূবের জানালার পাশে বসে থাকে। সেইরকম একদিন ঘুমন্ত দুপুরে সে চুপ করে বসেছিল জানালার পাশে, খাটে ঠাম্মি দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রায় মগ্ন। জানালার পাশে টায়রার মুখে বিষন্ন ছাপ। এমন সময় কে যেন তার সারা শরীরে মিষ্টি হাওয়া বুলিয়ে দিয়ে বলল "মন খারাপ?" টায়রা চমকে চারপাশে তাকাল। কোথাও কেউ নেই। বাগানে ঘাসের উপরে কয়েকটা কাঠবিড়ালী দৌড়ে বেড়াচ্ছে। পাঁচিলের মাথায় তাদের হুলো বেড়াল ভুলো রোদ পোহাচ্ছে। ইলেক্ট্রিক তারের উপর কয়েকটা কাক ঝগড়া করে যাচ্ছে। কিন্তু আর তো কেউ নেই। তবে কে বলল কথাগুলো? কে টায়রার কপালে মিষ্টি হাওয়ার পরশ দিল? সেইসময় আবার জোরে হাওয়া দিল আর কাঠবাদাম গাছ থেকে একটা পাতা উড়ে এসে পড়ল টায়রার কোলে। টায়রা ছুটে দরজা খুলে বাগানে কাঠবাদাম গাছের তলায় এলো। সে বুঝতে পেরেছে আসলে কাঠবাদাম গাছটিই তাকে মনের কথা শুধিয়েছে। তার খুব আনন্দ হলো। এতদিন পর সে একজনকে পেয়েছে যে তার কথা শুনতে চায়। খুশীতে সে গাছের চারপাশে পাক দিয়ে দিয়ে ঘুরতে লাগল। গাছ ও খুব খুশি হয়েছে তা না হলে টায়রার মাথার উপর অত পাতা ঝরে পড়বে কেন? টায়রা গাছকে জড়িয়ে বলল, "তোমাকে আমি গাছবন্ধু বলে ডাকবো কেমন? আমার সব কথা তোমাকে শোনাব। কত কথা জমা আছে আমার ভিতরে। কারোর সময় নেই শোনার। আচ্ছা সবাই সবসময় কেন এত ব্যস্ত বলতে পার গাছবন্ধু? " চারপাশে শুনশান দুপুর, তবু তারই মধ্যে টায়রা শুনতে পায় গাছবন্ধু বলছে"আসলে বড় বড় মানুষেরা শুধু নিজেকে নিয়েই ছুটে চলেছে। চারপাশে এতকিছু রয়েছে তাদের দিকে তাকানোর দুদন্ড সময় নেই।"
"কিন্তু তুমিতো গাছ। গাছ কি কথা বলতে পারে?"
"আমরা মানুষের মত কথা বলতে পারি না ঠিকই। কিন্তু আমরাও কথা বলি নি:শব্দে। যারা আমাদের ভালোবাসে তারা শুনতে পায় সেইসব কথা। এই যেমন এখন তুমি শুনতে পাচ্ছ।"
"হ্যাঁ। টায়রা মাথা নাড়ে। আমি তো তোমাকে খুব পছন্দ করি। জানালার পাশে বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমি দেখি কেমন সুন্দর রোদ্দুর তোমার পাতার ভিতর দিয়ে আমাদের জানালায় এসে পড়েছে। কি সুন্দর চকচকে সবুজ রঙের পাতাগুলি তোমার। আমি আমার ড্রইং খাতায় তোমাকে এঁকেছি। দেখাবো তোমাকে।"
কাঠবাদাম গাছ যেন হঠাৎ করে খুব খুশি হয়ে যায় টায়রার কথায়। মাথা নেড়ে  ডালপালা দিয়ে একরাশ হাওয়া এসে টায়রাকে পরশ করে। টায়রার ও খুব ভালো লাগে। এতদিনে তার মনের কথা শোনার একটা বন্ধু হয়েছে। সে খুশীতে দুই হাতে তালি দিয়ে লাফাতে থাকে। "জানো গাছবন্ধু কাল রাতে মা আর বাপির মধ্যে খুব ঝগড়া হয়েছে আমাকে নিয়ে। বাপী মাকে বলেছে তুমি একদম মেয়েটাকে সময় দাও না। ও কেমন নিশ্চুপ হয়ে থাকে সবসময়। কথা বলে না আর পাঁচটা বাচ্চার মত। মা  বললো তুমিও তো সারাক্ষণ অফিস নিয়ে থাকো। কতটুকু সময় দাও মেয়েকে? তারপর দুজনে মিলে ঠিক করেছে যে আমাকে মনের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে| সত্যি গাছবন্ধু তুমি বলো তো আমার মনের কি অসুখ করেছে? "
"একদম ই না। তুমি  তো একটা ছোট্টো নরম মনের শিশু। তোমাদের মত নিস্পাপ শিশুরা আছে বলে পৃথিবীটা এখনো এত সুন্দর। এই যে আমরা গাছেরা কোথাও যেতে পারি না, একজায়গায় দাঁড়িয়ে থাকি সারাজীবন।  আসলে খুব মায়া জন্মে যায় সেই জায়গাটার উপর। শিকড় ছড়িয়ে শক্ত করে আঁকড়ে ধরি মাটি আর তাই তো ছায়া দিই, ডালে ডালে ফুল, ফল, পাখিদের বাসা।" টায়রা খুব মন দিয়ে শোনে আর ভাবে সত্যিই তো। কাঠবাদাম গাছের জন্য তাদের বাগানে কত সুন্দর ছায়া, অজস্র পাতার ফাঁক দিয়ে রোদের জাফরি পাতা থাকে তাদের জানালায়। কাঠবিড়ালী, পাখিরা খেলা করে। "তুমি খুব ভাল গাছবন্ধু। তোমার সাথে  রোজ আমি কথা বলবো।  তাহলে আর আমার মনখারাপ লাগবে না।" টায়রা বিড়বিড় করে।
 

দুইঃ


হালকা এসি চলছে ঘরে। সামনে নীল একটা ক্যালেন্ডার। তাতে ঝাঁকড়া একটা গাছ। সেই ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে আছে বাচ্চা মেয়েটি। বড় বড় টানা টানা আয়তাকার চোখ দুটি। মনোবিদ ডা:আম্রপালী দে একটু আগেই বাবামার সব কথা শুনে শিশুটির সাথে একা কিছুক্ষণ কথা বলতে চেয়েছেন ঘরে তাই আর কেউ নেই। মিষ্টি হেসে ড্রয়ার থেকে দুটি চকোলেট বার করলেন আম্রপালী। তারপর টায়রার দিকে একটা এগিয়ে দিয়ে বললেন "নাও, তুমি তো চকোলেট খুব ভালোবাসো, তাই না? "
কোনো কথা না বলে টায়রা ঘাড় নেড়ে উত্তর দিল।
"আর কি কি ভালোবাসো? "
"গল্পের বই পড়তে"
"খেলতে ভালো লাগে না ? স্কুলে যখন গেম পিরিয়ডে বন্ধুরা খেলে তখন ওদের সাথে খেলতে ইচ্ছে করে না? টায়রা আবার দুপাশে মাথা নেড়ে না জানালো।
" ওরা তো তোমার বন্ধু। বন্ধুদের সাথেই তো খেলা করতে হয়, গল্প করতে হয়। মনটা খুব ভালো লাগে তখন।"
টায়রা একটু চুপ করে থেকে বললো "আমার স্কুলে কথা বলতে ভয় লাগে।"
"ভয় লাগে? কেন? কেউ কি বকে তোমায়? "
"না, যদি আমার কথা ওদের শুনতে ভাল না লাগে। তাই ওরা যখন খেলে, গল্প করে আমি চুপ করে দূরে বসে থাকি।"
একটা মায়া এসে খেলে গেল আম্রপালীর চোখে। অনেকদিন আগে হোস্টেলে ছেলেবেলা কাটানো এক নি:সঙ্গ কিশোরী সামনে এসে দাঁড়ালো। প্রতি শনিবার সকালে হোস্টেলের প্রায় সব মেয়েদের বাড়ী থেকে বাবা মায়েরা এসে দেখা করে যেত। শুধু তার জন্য কেউ আসত না। তার খুব শৈশবে কার আক্সিডেন্টে চলে গেছিলেন তার বাবা মা। আহা! এতো মিষ্টি নিস্পাপ টায়রা নামের ছোট্ট মেয়েটি, সে ও কি তার শিশু মনে বয়ে বেড়ায় এক জলভরা মেঘ?

চেয়ার ছেড়ে উঠে টায়রার পাশের চেয়ারে বসে পড়লেন আম্রপালী। তারপর স্নেহের হাত দিয়ে টায়রাকে কোলের কাছে এনে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন"আজ থেকে আমি তোমার বন্ধু। তোমার সব কথা শুনব। তোমার যা যা বলতে ইচ্ছে করে সব আমায় বলবে। কেউ কিচ্ছু বলবে না, কেমন? "
টায়রা বড় বড় চোখ মেলে ডাক্তার আন্টির দিকে তাকালো। এই আন্টিটা ঠিক অন্যদের মত নয়, বরং উলটো।  তার সাথে গল্প করতে চায়। অনেকদিন পর তার মনের মধ্যে একটা আরামবোধ এলো। সে হাসিমুখে বললো" জানো বাড়িতে কেউ আমার সাথে গল্প করতে চায় না, আমার কথা শুনতে চায় না। তাই তো  আমার ভয় করে, মনে হয় স্কুলেও  যদি কথা বললে কেউ শুনতে না চায়। তাই আমি চুপ করে থাকি।"
"আচ্ছা। সেইজন্য যখন তোমার কথা বলতে ইচ্ছে হয় তুমি একা একাই কথা বলো। গাছের সাথে কথা বলো।"
" হ্যাঁ, গাছ নয় ওর নাম গাছবন্ধু। ও খুব ভালো। আমার সব কথা শোনে। আমার সাথে গল্প করে।"
"তাই বুঝি। তুমি শুনতে পাও গাছবন্ধুর কথা? "
"হ্যাঁ। আমি তো ওকে খুব ভালোবাসি, তাই ওর সব কথা বুঝতে পারি, শুনতে পাই।"
"বাহ! খুব ভালো।" টায়রার পিঠে হাত বুলিয়ে তাকে উৎসাহ দিল আম্রপালী। খুশীতে ডগমগ টায়রা খুলে দিল তার মনের ঘরের দরজা জানালা। কত কথা তার সেই মনের ঘরে। তাদের কত রকমের রং। দু:খের কথাগুলির রং ঠিক বর্ষার আকাশের কালো মেঘের মত, খুশীর কথারা  ঝকঝকে হলুদ রঙের জামা পড়ে থাকে। উদাস কথাগুলি হাওয়ার মত। ওরা কোনো রং মাখে না। তাদের বাগানের গেটের কাছে পিঁপড়েরা বাসা করেছে। রোজ গর্ত থেকে লাইন দিয়ে তারা বেরোয় ঠিক যেভাবে টায়রাদের স্কুলে টায়রারা প্রেয়ার করতে যায়। কাঠবাদাম গাছে দুটো কাঠবিড়ালী বাসা বেঁধেছে। সারাদিন তারা খেলা করে, কিচকিচ করে ঝগড়া করে। কখনো বা জানালায় বসে থাকা টায়রার হাত থেকে বিস্কুট নিয়ে খায়। আর আছে কাকেশ্বর কাক। ঠাকুমার খুব রাগ ওর উপর। ছাদে ঠাকুমা আচার, বড়ি শুকোতে দিলে মুখ দিয়ে তছনছ করে দেয়। ভুলো নামে তাদের হুলো বিড়ালটা খাওয়া হয়ে গেলেই পাঁচিলে লেজ ঝুলিয়ে বসে থাকে। এইসব কত কথা.... গল্পেরা... সব ডানা মেলে বেরিয়ে আসে টায়রার ভিতর থেকে ডাক্তার আন্টিকে শোনাবার জন্য।
ডাক্তার আন্টি খুব মন দিয়ে হাসিমুখে টায়রার সব কথা শুনছিলেন। এবার টায়রার পিঠে হাত দিয়ে বললেন" এই যে তুমি সারাদিন এত কিছু লক্ষ্য করো, সবকিছু নিয়ে ভাবো, এই সব কথা তুমি রোজ রাতে ঘুমোবার আগে একটা খাতায় লিখে রাখবে| যেদিন আমার কাছে আসবে খাতাটা নিয়ে আসবে। আমি সব পড়বো। তারপর দুজনে মিলে অনেক গল্প করবো। আর হ্যাঁ, স্কুলে বন্ধুদের সাথে কথা বলবে, খেলবে। ওরা তো তোমার বন্ধু তাই না? তোমার কোনো ভয় নেই।"
 

তিনঃ


অফিসে এসেও প্রতীক বারবার আনমনা হয়ে যাচ্ছিল। কাল রাতে গৈরিকা আর সে প্রায় বিনিদ্র রজনী অতিবাহিত করেছে টায়রাকে নিয়ে। ডাক্তার আম্রপালী দে তাদের পরিস্কারভাবে জানিয়েছেন টায়রার মনে  কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু এইভাবে চললে আগামী ভবিষ্যতে মানসিক সমস্যা হতেও পারে।"দেখুন প্রতীকবাবু বিভিন্ন মানুষের শারীরিক গঠন যেমন এক নয়, কেউ একটু বেশি সবল, কেউ  স্বাভাবিক. কেউ বা আবার দুর্বল। মানুষের মনের গঠনেও বৈচিত্র‍্য রয়েছে। কেউ একটু নরম মনের, কেউ বাস্তবজ্ঞান সম্পন্ন, কেউ একটু কল্পনা প্রবণ। টায়রা একটু কল্পনা প্রবন এক্সপ্রেসিভ স্বভাবের শিশু। কিন্তু যখনই ও কিছু বলতে চাইছে আপনারা ওকে থামিয়ে দিচ্ছেন  ব্যস্ততা দেখিয়ে। মানছি আপনারা দুজনেই খুব ব্যস্ত মানুষ, কিন্তু চেষ্টা করুন প্রতিদিন নিয়ম করে ওর সাথে কোয়ালিটী টাইম কাটাতে। ওর সাথে গল্প করুন, ওর সব কথা শুনুন|  এছাড়াও পারলে এমন একজনকে বাড়ীতে নিয়ে আসুন যে ওকে সবসময় সঙ্গ দেবে। তা না হলে আগামী ভবিষ্যতে ব্যাপারটা সমস্যার দিকে যেতে পারে।" তারা স্বামীস্ত্রী দুজনেই আই. টি অফিসে কাজ করে। স্যালারী প্যাকেজ ভালো হলেও খাটিয়ে নেয় প্রচুর। হাক্লান্ত হয়ে বাড়ী ফিরে সত্যিই মেয়েটাকে একদম সময় দিতে পারে না। এবার রোজ অফিস থেকে ফিরে দুজনেই ঠিক করেছে মেয়ের সাথে সময় কাটাবে। কিন্তু তাতেও তো সমস্যা মিটছে না। সারাটা দিন টায়রার সাথে কে সময় কাটাবে? বাবামা দুজনেই যথেষ্ট বয়স্ক মানুষ। তারা দুজনেই অফিসে বেরিয়ে যায় বলে সংসারের যাবতীয় ঝামেলা এখনো তাদেরকেই সামলাতে হয়। তাদের উপর আর কোনো প্রেসার দেওয়া ঠিক নয়। অথচ মেয়েটার একজন সারাক্ষণের সঙ্গী চাই। চিন্তায় দিকভ্রান্ত হয়ে প্রতীক কিউবিকল ছেড়ে কান্টিনের দিকে এগোল কফির জন্য। কফির কাপ নিয়ে টেবিলে বসতেই বিপ্লব, ওর কলিগ এগিয়ে এলো।" কিরে প্রতীক, সব ঠিক আছে তো? আজকে অফিসে লক্ষ্য করছিলাম তুই একটু ডিস্টার্বড আছিস| কি হয়েছে?"
"একটা সমস্যা হয়েছে টায়রাকে নিয়ে।"
"টায়রা...কি হয়েছে তোর মেয়ের? শরীর খারাপ?
" না.. আসলে সমস্যাটা অন্য। মেয়েটা একদম কথা বল তে চায় না। কাল আমরা ওকে নিয়ে মনোবিদের কাছে গেছিলাম। উনি সব শুনে বললেন ওকে সবসময় আটেনশন দিতে হবে। আপনারা ওর সাথে কোয়ালিটী টাইম কাটান আর বাড়ীতেও এমন কাউকে নিয়ে আসুন যে ওকে সবসময় সঙ্গ দিতে পারে। সেইটাই প্রব্লেম। কাকে এখন পাই সবসময়ের জন্য।"
"হুম... বুঝলাম। সবসময়ের সঙ্গী... শোন আজ অফিস ছুটির পর আমার বাড়ি চল। মনে হচ্ছে একটা সুরাহা হবে। আসলে আমার ছেলেটাও তো একটা সন্তান। ওর ও খুব একা লাগতো। এখন আর লাগে না।"
"মানে... কিভাবে সুরাহা হবে? "
"আরে চলই না আমার বাড়ীতে। গেলেই বুঝবি।"
আজ সারা দুপুর ধরে টায়রার মন খুব খারাপ। দুপুরে সে কিচ্ছু খায়নি। দাদু, ঠাম্মি অনেক সাধাসাধি করেছে। কারন জানতে চেয়েছে। টায়রা কাউকে কিছু না বলে শুধু কেঁদে যাচ্ছে। দাদুর উপর অভিমানে তার বুক ভরে আছে। কেন দাদু দুপুরে ঠাম্মিকে বলল যে ভাবছি আর একটা ঘর বানাবো। কাঠবাদাম গাছটাকে কেটে ফেলে ওখানে দিদিভাইয়ের জন্য একটা ঘর করবো। টায়রা শোনামাত্র একটা আর্তচীৎকার করে খাটে শুতে পড়েছে আর সমানে কেঁদেই যাচ্ছে। গাছবন্ধু না থাকলে কার কাছে টায়রা খুলে দেবে মনের দরজা? কেই বা চুপ করে শুনবে তার যত কথা? একরাশ সবুজ পাতা নিয়ে কেই বা টায়রাকে খুশীর হাওয়া ছড়িয়ে দেবে? বড় মানুষেরা কেন এত নিষ্ঠুর হয়?
কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল কখন টায়রা। হঠাৎ  কে যেন ঘরের আলোটা জ্বালিয়ে দিল। চোখ মেলে টায়রা দেখল বাবা মা দাঁড়িয়ে, সাথে দাদু ঠাম্মি। দু একদিন হলো আজকাল বাবা মা একটু তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরে আসছে। টায়রাকে উঠতে দেখে বাবা কাছে এসে উদ্বিগ্ন মুখে  জিজ্ঞাসা করলো" কি হয়েছে মামনি, তোমার চোখে জল, সারাদিন তুমি কিছু খাওনি, কি হয়েছে? "
"দাদু বলেছে গাছবন্ধুকে কেটে নতুন ঘর বানাবে।"
"সেকি বাবা! তুমি কাঠবাদাম গাছটা কেটে দেবে? এই বাড়ি হওয়ার আগে থেকে গাছটা আছে। এই জমির উপর ওর অধিকার আমাদের থেকে বেশি। তাছাড়া ও টায়রার গাছবন্ধু। তাকে কি কেটে ফেলা যায়?"
দাদু কাছে এসে টায়রার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন "দিদিভাই, আমার বড় ভুল হয়ে গেছে। সত্যিই তো, যে তোমার বন্ধু তাকে কি কেটে ফেলা যায়?"
বাবা বললেন "শুধু তাই নয়, আরো একজন এসেছে তোমার বন্ধু হতে। বিপ্লব আঙ্কেলের বাড়ী থেকে। তুমি কি ওর সাথে বন্ধুত্ব করবে মামণি? "টায়রা অবাক হয়ে দেখল মায়ের কোলে ছোট্ট একটা সোনালি রোমের তুলতুলে কুকুর বাচ্চা। একজোড়া কালো চোখ ভালোবাসা মাখানো। টায়রা হাত বাড়াতেই ঝাঁপিয়ে কোলে চলে এলো। আনন্দে ভেসে যেতে যেতে টায়রা বলল “বাবা ওকে কি নামে ডাকব?”

একটা খুশীর ঝাড়লন্ঠন ক্রমশ: সোনালি আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে তার মেয়ের মুখে। সেইদিকে তাকিয়ে  প্রতীক গাঢ় স্বরে বলল "খুশি"।
টায়রা আর খুশীর গল্প এখানেই শেষ করে দেওয়া ভাল, নাহলে পাতার পর পাতা  ফুরিয়ে যাবে গল্প শেষ হবে না| টায়রা এখন অনেক কথা বলে আর স্কুলেও তার অনেক বন্ধু। কিন্তু তার সবচেয়ে বড় বন্ধু খুশী। খুশি এসে শুধু টায়রা নয় পাল্টে দিয়েছে তাদের বাড়ীর সবাইকে।

সমাপ্ত

 

নবনীতা চট্টোপাধ্যায়
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top