সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব তেইশ) : কাজী মাহমুদুর রহমান


প্রকাশিত:
১২ অক্টোবর ২০২১ ২১:০৯

আপডেট:
২৬ এপ্রিল ২০২৪ ০৩:১৩

 

ছবি রিভিউয়ের কাজ শুরু করার আগে প্রথম মনে হয়েছিল এ আর এমন কঠিন কি কাজ! ছবি দেখব। আমার পর্যবেক্ষণ, ভাবনা-চিন্তায় যা মনে হবে তাই আট দশ লাইনের মধ্যে লিখে দেব। কিন্তু কাজ শুরু করতে গিয়ে দেখি এটা অত্যন্ত দুরুহ কাজ। ছবিটা আসল না নকল, ছবিটা রিয়েলিস্টিক না সুরিয়ালিস্টিক, অ্যাবস্ট্রাক্ট না কি সেমি অ্যাবস্ট্র্যাক্ট, শিল্পী কোন ভাবনাতে ছবিটা মূর্ত করতে চেয়েছেন, তুলির মোটা বা সুক্ষ্ম আঁচড়ে, রং এর ব্যবহারে তার পরিমিতি বোধের পরিচয় দিতে পেরেছেন কিনা সবকিছুই আমাকে মাইক্রোসকোপিক দৃষ্টিতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে হয়। তারপর সিদ্ধান্ত নিয়ে রিপোর্ট লিখতে হয়। দিনে দুটো ছবিতো দূরের কথাএকটা ছবিতেই আমার দিন কেটে যায়। প্রথম সপ্তাহান্তে পাঁচটা ছবির রিপোর্ট দানের সম্মানী হিসাবে আমাকে পাঁচশো ফ্র্যাঁ দেওয়া হল কলেজের হিসাব শাখা থেকে। এই টাকায় কলেজের ক্যান্টিন থেকে আমার সাতটি দিনের ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার সবকিছুই গরিবি হালে নমো নমো করে সারতে হচ্ছে। বাবাকে প্রতিমাসেই কিছু কিছু করে টাকা পাঠিয়ে আমার ব্যাংক একাউন্ট তলানিতে এসে ঠেকেছে। আয় বাড়াতে না পারলে মুশকিল। যেহেতু আমার রিভিউ রিপোর্টগুলি সম্পর্কে এ যাবত কোনো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাইনি তাতে আমার নিজের ওপর আস্থা ফিরে এল। আমি প্রতিদিন দুটো করে ছবি পর্যবেক্ষণ ও রিভিউ রিপোর্ট দেবার কাজ শুরু করে দিলাম। এতে করে আমার আয় দ্বিগুন হল বটে কিন্তু আমার আনন্দ খুঁজে পেলাম না। কারণ আমি নিজে অন্যের ছবি দেখে একটা কম্প্যারেটিভ স্টাডিতে হয়তো কিছু জানছি, বুঝছি কিন্তু নিজে কোনো ছবি আঁকার সময়, সুযোগ পাচ্ছি না। আসলে কিছু কিছু হতাশা, অতৃপ্তি মনের মধ্যে সব সময়ই ফুটে থাকে গোলাপ কাঁটার মতো।

সোফির সঙ্গে আজকাল তেমন একটা দেখা হয় না। তার জব পাবলিক রিলেশনস ডিপার্টমেন্টে অন্য ভবনে। আর আমার কাজকর্ম পিকচার গ্যালারি সংলগ্ন একটি পিকচার স্টোরে। আমি লাঞ্চ টাইম কখনো কখনো টিচিং স্টাফ ও অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসের জন্যে নির্ধারিত ক্যানটিনে যাই। ওখানেই মাঝে মধ্যে সোফির সঙ্গে দেখা হয়। মৃদু হাসি বিনিময়ের সাথে দু চারটে কথা বুজর, ভূজালে বীয়াঁ বা কমতালে ভূ, জ ভে বীয় মেরসি, এভূ? কমসি কমসো-এই সব মামুলি কথা, কুশল জিজ্ঞাসার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। সারাদিন অন্যদের ছবি নিয়ে ব্যস্ত থাকায় অন্য কোনো সহকর্মী বা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমার আলাপ পরিচয়ের সুযোগ হয় না। নিজেকে বড় নিঃসঙ্গ মনে হয়। সন্ধ্যায় প্যারি শহরের একটা মানচিত্র নিয়ে একা একা পথে হেঁটে নদীর কাছে বেড়াতে যাই। কখনো বাসে চড়ে সিয়েনে নদীর কাছে বেড়াতে যাই। নদীর তীরে সুশোভিত পার্কে একা একা হাঁটি। আলোকিত নদীর ঝলমলে স্রোতধারা দেখি। ভাবি, সোফির মতো একটা মেয়ে আমার প্রেমিকা নয়, শুধু বন্ধু হিসাবে যদি আমার পাশে থাকত?

 

প্রতিদিন বিকেলে বা সন্ধ্যায় আমার আসা যাওয়ার পথের ধারে মধ্যবয়সী অন্ধ, শীর্ণ কৃষ্ণবর্ণ মানুষকে দেখি বেহালা বাজাতে। তার মাথার হ্যাটটা থাকে তার পায়ের কাছে। অন্ধ ভিক্ষুকটি বেহালা বাজায়। চলতি পথের কোনো দয়ার্দ পথচারী হয়তো তার হ্যাটের মধ্যে দু এক ফ্র্যাঁ ছুঁড়ে দেয়। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার বাজনা শুনি, তার ছড়াটানার কলা-কৌশল গভীর দৃষ্টিতে লক্ষ করি।

লক্ষ করি সে কীভাবে বেহালা বাজায়, সুরের মাধুর্য তোলে? আমি তাকে প্রায় দু’এক ফ্র্যাঁ দিয়ে তার সাথে কথা বলি, ভাব জমাবার চেষ্টা করি। সে কখনও আমাকে পাত্তা দেয়, কখনও দেয় না। একদিন তার হাতে পাঁচ ফ্র্যাঁ গুজে দিয়ে তার বেহালাটা একটু বাজাবার অনুমতি চাইলাম। অন্ধ ভিক্ষুকটি আপত্তি করল না। আমি তো আমি এককালে সৌখিন গায়ক ছিলাম। এই অন্ধ ভিক্ষুকের হাতে বেহালার তারে তার ছড়াটানার কলা কৌশলও আমি লক্ষ করেছি। বেহালাটা হাতে নিয়ে অপটু হাতেই আমি তারে ছড়া টানবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ব্যর্থ হলাম। অন্ধ ভিক্ষুকটা হাসল। বলল, হে যুবক, এ সব বাদ্য বাজনা চট করেই শেখা যায় না। এর জন্যে সাধ্য সাধনা করতে হয়। আমি বললাম, তা ঠিক। আমি চট করেই বেহালা হাতে নিয়ে তোমার মতো বেহালা বাদক হতে পারব না। আমি একটা গানের সুর গাই, কথা বুঝবে না। কিন্তু সুরটা ধরতে পারবে। ঐ সুরটা তুমি কীভাবে বেহালাতে বাজাও তা আমি দেখতে চাই।

বেহালাটা আমি ওর হাতে দিয়ে গাইলাম, ‘পদ্মার ঢেউরে- মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা-যারে ...।

অন্ধ বেহালা বাদক নিবিষ্ট মনে আমার গাওয়া গানটি শুনল। তারপর বলল, আবার গাও। আমি গাইলাম। লোকটি এবার বেহালায় ছড় টেনে সুরটি তুলল নিখুঁতভাবে। আমাকে বলল, আমি যেভাবে বাজালাম তুমি কি তেমনিভাবে বাজাতে পারবে?

আমি বললাম, না তোমার মতো পারব না। তবে চেষ্টা করে দেখতে পারি।

ও আমার হাতে বেহালাটি দিল। আমি এবার চেষ্টার করলাম, এবার হয়তো কিছুটা পারলাম। তবে ওর মতো নয়।

অন্ধ ভিক্ষুকটি বলল, সুরটি সুন্দর। মনে হচ্ছে এটা নদীর স্রোতের মতো বয়ে যাওয়া কোনো বিরহীর কান্নার সুর। এই সুরে আমি এখন প্রায়ই বেহালা বাজাব। তোমার কণ্ঠ ভালো। কিন্তু হাত অন্যভস্ত। তোমার কি বেহালা আছে?

- না, নেই।

নিজের বেহালা না হলে অন্যের বেহালায় এভাবে পথে ঘাটে আমার বেহালা বাদ্য শুনে তুমি কিছুই শিখতে পারবে না। একটা বেহালা কিনে ফেল।

- কিনব যদি তুমি আমাকে শেখাও।

- শেখাতে পারি যদি তুমি আমার ভিক্ষা কার্যে ব্যঘাত না ঘটাও।

- আমি কোনোভাবেই বিরক্ত করব না। তুমি বাজাবে আমি শুনব, আমি বাজাব তুমি শুনবে। তুমি আমার ভুল ত্রুটি ধরিয়ে দেবে। তুমি আমার গুরু।

- ও. কে. ম্যান। শেখাব। প্রতি সন্ধ্যায় দশ ফ্র্যাঁ দেবে?

- দেব। কিন্তু কোথায় তোমাকে পাব?

- আমি পথের মানুষ। পথেই পাবে।

আমার নিঃসঙ্গতা কাটাতে বেহালা বাজানো শিখতে হবে। বেহালা কিনতে হবে। কিন্তু বাদ্যযন্ত্র কোথায় কোন মিউজিক স্টোরে সস্তায় পাওয়া যাবে তা আমার জানা নেই। কারো সাহায্য নিতে হবে।

এক দুপুরে ক্যান্টিনে দেখা হল সোফির সাথে। আমার লাঞ্চ ট্রে নিয়ে ওর টেবিলে বসবার অনুমতি চাইলাম। ও হেসে বলল, বসো। তুমি ভালো আছ?

- হ্যাঁ ভালো।

- কাজকর্ম কেমন চলছে? মানে ছবি গবেষণা?

- আমার মতো কাজ করে যাচ্ছি। রিপোর্ট দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু ভালো না মন্দ সে বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া পাচ্ছি না।

- প্রতিক্রিয়া তখনই পাবে যখন তোমার কাজটা তাদের মনোঃপুত না হবে।

- শুনে খুশি হলাম।

- থ্যাংকস।

- সোফি, তুমি আমাকে অনেক হেল্প করেছ আর একটা হেল্প করবে?

- কী?

- আমাকে একটা পুরোনো বেহালা কিনতে সাহায্য করবে?

সোফিয়া কৌতুহলী দৃষ্টিতে ভ্রু কোঁচকাল।

- হঠাৎ বেহালার সখ?

- আমার একজন সঙ্গী দরকার। বেহালা হবে আমার সঙ্গী।

- ও তা-ই? বেশতো। কিন্তু আমার তো জানা নেই পুরোনা বেহালা কোথায় কত দামে বিক্রি হয়।

-তুমি একটু খোঁজ খবর নিয়ে যদি আমাকে জানাও এবং পুরোনো বাদ্যযন্ত্র যে সব দোকানে বিক্রি হয় সেখানে আমাকে নিয়ে যেতে পার আমি কৃতজ্ঞ থাকব।

 

সোফি খেতে খেতে কয়েক মুহূর্ত ভাবল। তারপর বলল, ওকে ম্যান, আগামীকাল ফ্রাইডে বিকেলে ছুটির পর উই উইল হান্ট ফর অ্যান ওল্ড ভায়োলিন ফর অ্যান ইয়াংম্যান।

আমি হেসে উঠলাম। বললাম, থ্যাংক ইউ সোফি। থ্যাংক ইউ।

পরদিন শুক্রবার বিকেলে পাঁচটার আগেই ডিন মশিঁয়ে দানিয়েলের কক্ষে আমার রিভিউ রিপোর্ট জমা দিতে গিয়ে আমি বিস্ময়াহত। মাদাম জুলিয়াঁ ডিনের সম্মুখে বসে কফি পান করছে। আমাকে দেখে জুলিয়াঁ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠল, হে আমার নীল পাখি, অবশেষে তুমি উড়ে এসেছ তোমার স্বপ্নের আইফেল টাওয়ারের চূড়োয় বসতে! আমার আজ কী যে আনন্দ হচ্ছে তোমাকে দেখে!

আমি আনন্দের ভানে বললাম, ধন্যবাদ জুলিয়াঁ। আমিও আনন্দিত। তোমার খোঁজ করেছিলাম। কিন্তু পাইনি।

জুলিয়াঁ বলল, আমি তোমার সব খবরই জানি। কিন্তু দেশের বাইরে থাকায় তোমার সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি। আজ তোমার সঙ্গে দেখা করতেই আমি এখানে ছুটে এসেছি। আমি মশিঁয়ে দানিয়েলকে তোমার সম্পর্কে সব কথাই বলেছি। বলেছি, এমন একটা প্রতিভাকে তোমরা হারিয়ে যেতে দিয়ো না। ইফ ইউ ইউজ হিম হি উইল বি অ্যান অ্যাসেত ফর ইয়োর আর্ত কলেজ। দানিয়েল, অ্যাম আই রাইত?

দানিয়েল মৃদু হেসে মাথা নাড়লেন।

আমি বললাম, ধন্যবাদ জুলিয়াঁ আমাকে এত প্রশংসা করার জন্যে। এরা আমাকে সযতেœই রেখেছেন। এদের সাহায্য আর সহযোগিতা না পেলে আমাকে হয়তো হারিয়ে যেতে হত।

জুলিয়াঁ প্রবলভাবে মাথা নেড়ে বলল, না না এদের মতো হৃদয়বান মানুষ থাকতে তুমি হারিয়ে যাবে তা কি হয়? দানিয়েল, তুমিই বলো?

দানিয়েল বোধহয় বিব্রত। আমারও অস্বস্তি। দানিয়েল তাকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বললেন, নিশ্চয়, নিশ্চয়। আমরাই তো তাকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছি। মশিঁয়ে তাইমুরকে আমরা একটা আশ্রয় দিয়েছি, ছবি রিভিউ সংক্রান্ত সম্মানজনক কাজ দিয়েছি।

জুলিয়াঁ হাসতে হাসতেই প্রশ্ন করল, সম্মানজনক কাজের জন্যে সম্মানজনক সম্মানীও নিশ্চয়?

দানিয়েল বিব্রতভাবেই বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়। কিন্তু ক্রমে ক্রমে ধাপে ধাপে।

জুলিয়াঁর এবার আমার প্রতি দৃষ্টিদান। বলল, তাইমুর তিন বছর পর তোমার সাথে আমার এই প্রথম দেখা। আমি আশা করছি আজ সন্ধেয় তুমি আমার সঙ্গে থাকবে। আমার গাড়িতে তুমি আমার সঙ্গে বেড়াবে, রাত্রে আমার সঙ্গে ডিনার করবে।

আমি ইতস্তত কন্ঠে বললাম, কিন্তু আজ যে আমি একজনকে অনুরোধ করে রেখেছি তিনি আমাকে একটা বেহালা কিনতে সাহায্য করবেন।

- যাকে কথা দিয়েছ তাকে বলে দাও, আজ নয়, অন্যদিন। তাছাড়া আজই যদি বেহালা কিনতে হয় তাহলে আমিই তোমাকে বেহালা কিনে দেব। এটা কোনো সমস্যাই নয়। মশিঁয়ে দানিয়েল, আমি কি মশিঁয়ে তাইমুরকে নিয়ে যেতে পারি?

দানিয়েল বললেন, নিশ্চয়, নিশ্চয়।

আমি নিরুপায়। দানিয়েলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জুলিয়াঁর সঙ্গে বাইরে এলাম। রিসেপশন লাউঞ্জে সোফি আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল। আমাকে দেখেই ও উঠে এল। জুলিয়াঁ তাকে দেখেই অনুমান করতে পারল এই সোফির সঙ্গেই আমার বেহালা কিনতে যাবার কথা। সোফি কিছু বলার আগেই জুলিয়াঁ বলল, প্রিয় সোফি, কিছু মনে করো না। আমার এই পুরাতন বন্ধুটির সঙ্গে প্রায় তিন বছর পর দেখা। আমি ওকে নিতে এসেছি। আজ সন্ধেয় সে আমার অতিথি। তোমার কোনো আপত্তি নেই তো?

সোফি হেসে বলল, না না আপত্তি কিসের? মশিঁয়ে তাইমুরের অনুরোধেই আমি তাকে একটা পুরোনো বেহালার দোকানে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। এটা ভালোই হল যে আপনি সেই দায়িত্ব নিলেন। আমি দায়িত্বমুক্ত হলাম। আপনাদের সান্ধভ্রমণ আনন্দময় হোক।

সোফি চলে গেল। আমি যেন একটা সাত বছরের শিশুর মতো জুলিয়াঁর গাড়িতে উঠলাম।

গাড়ি চালাতে চালাতে জুলিয়াঁ আমাকে নিশ্চুপ দেখে জিজ্ঞাসা করল, আমরা এখন কোথায় যেতে পারি?

আমি বললাম, সে তো তুমিই ভালো জানো।

- আমরা সিয়েনে নদীর পাড়ে পার্কে যেতে পারি। খুব সুন্দর জায়গাটা। তুমি কি কখনো গেছ ওখানে?

- হ্যাঁ গেছি। বেশ কয়েবার।

- তাহলে কোথাও যাওয়া যায়?

- আমি জানি না।

- তোমাকে খুব একটা আনন্দিত মনে হচ্ছে না। তোমার কি মন খারাপ?

- না, কেন?

- সোফির সঙ্গে যেতে পারনি বলে?

আমি হাসলাম। বললাম, না।

জুলিয়াঁ বলল, আমি বুড়ি হয়ে যাচ্ছি। সোফি মেয়েটি ইয়াং অ্যান্দ অ্যাত্রাকতিভ। তুমি কি ওর প্রেমে পড়েছ? নাকি ও তোমার প্রেমে?

আমি বললাম, সোফি আমার ভালো বন্ধু। ও চট করে কারো প্রেমে পড়ার মতো মেয়ে নয়। আর আমিও এখন এমন একটা দুঃসময়ের মধ্যে আছি যে ছবি ছাড়া আমি কোনো রক্ত মাংসের জীবন্ত নারীর প্রেমে পড়বার কথা ভাবতেই পারি না।

- আমাদের সেই পুরোনো দিনের একটি সন্ধ্যার কথা কি মনে পড়ে? জুলিয়াঁর কৌতূহলী প্রশ্ন।

 

আমি বললাম, মনে পড়লেও যা অতীত তা অতীত এবং মৃত। তুমি বিয়ে করেছ, সংসারী হয়েছ, সো দ্য চ্যাপ্টার ইজ ক্লোজড।

জুলিয়াঁ ম্লান হেসে বলল, ক্লোজদ অ্যান্দ ক্লোজদ। স্বামী মার্তিন্স এর সাথে আমার চ্যাপ্টার ক্লোজদ। উই আর নাউ সেপারেতেদ।

আমি বিস্মিত কণ্ঠে বললাম, এ কী বলছ? বিয়েরমাত্র এক দেড় বছরের মধ্যেই সেপারেশন? হোয়াই?

জুলিয়াঁ চলমান গাড়িটি অন্য রাস্তায় বাঁক নিতে নিতে বলল, ফরগেত ইত। আই দোন্ত লাইক তু দিসকাস মাই পারসোনাল তপিকস। এখন চল, তোমাকে আগে কোনো মিউজিক স্টোরে নিয়ে যাই। তোমাকে একটা বেহালা কিনে দেব। এ গিফত ফ্রম মি।

আমি বললাম, প্লিজ জুুলি, আজ বেহালা কেনা থাক। তোমার সঙ্গে বেড়াতে বেরিয়েছি। টেক মি এনি হয়ার ইউ লাইক।

প্রায় দেড়ঘন্টা জুলিয়াঁ আমাকে নিয়ে রাত্রির আলোকিত উজ্জ্বল প্যারি শহরে নিয়ে ঘুরে বেড়াল, কিছু কিছু দর্শনীয় স্থান দেখাল। নানা জায়গায় ঘোরাঘুরির পর আমাকে নিয়ে গেলে একটি রেস্তোরাঁয়। একটি টেবিল নিয়ে দুজনে রেস্তোরাঁর এক প্রান্তে বসলাম। মেনু দেখতে দেখতে জুলিয়াঁ প্রশ্ন করল, কী খাবে বল, শ্যাম্পেন অর রেডওয়াইন?

- আমি জীবনে কখনোই মদ স্পর্শ করিনি।

- জীবনে কি কোনো নারীকেও স্পর্শ করনি? তুমি কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে তুমি চিরকুমার? ক্যান ইউ সে ব্রেভলি দ্যাত ইউ দিদন্ত তাচ এনি ওমেন, ইউ দিদন্ত কিস, ইউ দিদন্ত হ্যাভ সেক্স উইথ এনি গার্ল?

জুলিয়াঁর এই প্রশ্নে আমার বুকের মধ্যে একটা পাহাড় ধসের শব্দ হল। এই উত্তর দেবার সত্য সাহস আমার নেই। জুলিয়াঁ মৃদু হেসে বলল, ও. কে. আই দোন্ত ওয়ান্ত তু ফোর্স ইউ। শ্যাম্পেন, রেডওয়াইন কোনো কড়া মদ নয়। আঙুরের রস মাত্র। নাথিং রঙ্ উইথ ইত।

আমাকে নিরুত্তর দেখে জুলিয়াঁ আবার বলল,

তাইমুর, মাই লাভিং ইয়াং বার্ড,তোমাকে বুঝতে হবে তুমি এখন ঢাকায় নও। তুমি আনন্দের শহর প্যারিসে। প্যারিসের এইসব পানীয়ের স্বাদ থেকে যে নিজেকে বঞ্চিত রাখবে সে প্যারিসের জীবন থেকেই ছিটকে পড়বে। তুমি যদি সাধু-সন্তের জীবন যাপন করতে চাও তাহলে ঢাকায় ফিরে যাও। আর যদি প্যারিতে থাকতে চাও, বড় শিল্পী হতে চাও তবে ঢাকার খলিল চাচার রিকশা পেইন্টার নয়, চেষ্টা কর প্যারির পিকাসো হতে। বলো, তুমি কী চাও?

 

আমি একটু প্রগলভ সুরে উত্তর দিলাম, রেড ওয়াইন উইথ লুচি অ্যান্ড তরকারি। খাওয়াতে পারবে হে প্যারির সুন্দরী?

ক্যান্টিনে লাঞ্চ টাইমে সোফির সঙ্গে প্রায়ই দেখা যায়। দৃষ্টি বিনিময়, সৌজন্যমূলক মৃদু হাসি বিনিময় হয়। কিন্তু কথা হয় না। অন্য সহকর্মী বেষ্টিত টেবিলে ও বসে। আমি ওর টেবিলে বসা বা কথা বলার সুযোগ পাই না। মনে হয় ও ইচ্ছাকৃত ভাবেই আমাকে এড়িয়ে চলে।

জুলিয়াঁ ভার্সেই সিটিতে থাকে। মাঝে মধ্যে ছুটির দিনে কিংবা বিকেলে আসে। আমাকে নিয়ে বিভিন্ন আর্টশপ, শিল্পীপল্লি সুন্দর মনলোভা বারবিজনে নিয়ে যায়। আমাকে বলে, যদি তুমি ভাগ্যবান হও, অগাধ টাকার মালিক হও তাহলে একদিন এই শিল্পীপল্লিতে তোমারও একটা সুন্দর বাড়ি হবে। আমি তো তখন বুড়ি হয়ে যাব। তুমি সোফির মতো একটা সুন্দরী মেয়ে নিয়ে সেই বাড়িটাতে অ্যাডাম আর ইভ হয়ে বসবাস কোরো।

আমি হাসি। বলি, প্রিয় জুলিঁ তুমি আমাকে অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছ। এবার থামো, আর স্বপ্ন নয়।

জুলিয়াঁর টাকায় প্রায় রাত্রেই কোনো না কোনো বারে বিয়ার, রেডওয়াইন বা শ্যাম্পেইন, কোনো ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁয় কাবাব, রুটি খেতে খেতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। আমার জড়তা, লজ্জা শরম কেটে যাচ্ছে প্যারিসের মানুষ হিসাবে নিজেকে তৈরি করতে। জুলিয়াঁ আমাকে প্রায়ই তাগাদা দিচ্ছে ছুটির দু’একটা দিন ভার্সেইতে তার বাড়িতে নিয়ে যেতে। আমি নানা অজুহাতে যাওয়াটা এড়িয়ে যাচ্ছি। কারণ আমি তো বুঝি জুলিয়া কেন আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে যেতে চায়।

নৈশকালীন ভ্রমণ ও ডিনার শেষে জুলিয়াঁ আমাকে কলেজ অব আর্টস এর ডরমিটরিতে ড্রপ করে দিয়ে যায়। গাড়ির মধ্যেই বিদায়ী চুম্বন। এটা আমি প্রত্যাখান করতে সাহস পাই না। কারণ, প্রত্যাখান মানেই এটা ওদের কালচারে অভদ্রতা ও চরম অপমান। সুতরাং জুলিকে আহত করতে মন সায় দেয় না।

জুলিয়াঁ যেদিন আসে না আমি সেদিন কিছুটা একা একা পথ হাঁটি। কোনোদিন সন্ধ্যায় সেই অন্ধ বেহালা বাদকের দেখা পেয়ে যাই। আমি নিঃশব্দে তার পাশে দাঁড়িয়ে তার বেহালা বাদন শুনি, তারে তারে তার ছড়া টানা আর আঙুলের কারুকাজ গভীরভাবে লক্ষ করি। অন্ধদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। জানি না সে কীভাবে যেন টের পায় আমার উপস্থিতি। বলে, যুবক, তুমি এখনো তোমার বেহালা কেননি?

আমি বলি, না এখনো কিনিনি। তোমার হাতের কারুকাজ দেখে শিখছি।

ও বলে, তোমার সেই গাওয়া গানটার সুর অনেক বাজিয়েছি, মনে হয় লোােক বেশ পছন্দ করেছে। বেশি বেশি ফ্র্যাঁ পাচ্ছি। তুমি কি আমাকে আজ অন্য একটা গানের সুর তুলে দেবে? তুমি তোমার ভাষাতে গাও, আমি শুনব, তারপর সুরটা তুলে নেব।

ওর অনুরোধে আমি খালি গলায় লালন সাঁইয়ের ‘যেজন গুরুর ভাব জানে না, তার সাথে নাই লেনা দেনা ...’ এই গানের মুখটাই বার বার গাই। অন্ধ ভিক্ষুকটি ঐ সুর অনুসরণ করে বার কয়েক চেষ্টা করে নিখুঁতভাবে তা বেহালায় তুলে ফেলে। এরপর শুরু হয় আমাদের যুগল সংগীত। আমি তালে তালে কিছুটা বাউলি নৃত্য ভঙ্গিতে পুরো গানটা গাইতে থাকি, আর অন্ধ ভিক্ষুকটি সেই সুর, সেই তাল মিলিয়ে বেহালা বাজাতে থাকে। আমাদের এই যুগল সংগীত শুনতে চারিদিকে পথচারীদের ভিড় জমে যায়। ফ্র্যাঁতে ফ্র্যাঁতে অন্ধ বেহালা বাদকের হ্যাট প্রায় ভরে ওঠে। এক সময় আমি অপরিসীম তৃপ্তি, আনন্দ নিয়ে ওর কাছ থেকে বিদায় নিই। ভাবি, বেহালা আমাকে কিনতেই হবে।

এক দুপুরে লাঞ্চ টাইমে এক টেবিলে মুখোমুখি আমি আর সোফি। সোফি নীরবে খাচ্ছে। কিন্তু একই টেবিলে এমন নীরবতা আমার কাছে অস্বস্তিকর। প্রশ্ন করলাম,

- সোফি তুমি ভালো আছ?

- হ্যাঁ।

- আজকাল তোমার সঙ্গে আমার দেখাও হয় না, কথাও হয় না।

- তাতে কী? মাদামে জুলিয়াঁ তো প্রায়ই তোমাকে সঙ্গ দিচ্ছেন, বারে, রেস্তোঁরায় তোমাকে বিয়ার, রেড ওয়াইন, শ্যাম্পেইন পানের তালিম দিচ্ছেন এবং তুমি তা বেশ এনজয় করছ।

- হ্যাঁ, আমি প্যারির মানুষ হবার চেষ্টা করছি।

সোফি হাসল। বলল, মাঝে মধ্যে পাগলামিও করছ।

- কেমন পাগলামি? আমার প্রশ্ন।

- এই যে প্রায়ই দেখি তুমি এক অন্ধ বেহালা বাদকের সঙ্গে জুড়ে গেছ। তুমি নেচে নেচে তোমাদের ভাষায় বাংলা গান গাইছ, আর ঐ অন্ধ ভিক্ষুক তোমার গানের তালে, সুরে বেহালা বাজাচ্ছে। পাবলিকের দারুণ ভিড় জমে গেছে।

- তুমি দেখেছ?

- হ্যাঁ দেখেছি, ভেরি ইন্টারেস্টিং। তা বেহালাটা এখনও কেনোনি কেন?

- তোমার অপেক্ষায়।

- মানে?

- তুমি যেদিন আমাকে সঙ্গে নিয়ে কিনে দেবে সেইদিন কিনব।

সোফি হেসে উঠল। সেটা বিদ্রুপের হাসি কিনা বুঝতে পারলাম না। বলল, স্যরি, তাহলে তোমার কোনোদিনই বেহালা কেনা হবে না। আমার অপেক্ষায় না থেকে তুমি মাদাম জুলিয়াঁকে অথবা ঐ অন্ধ ভিক্ষুককে সঙ্গে নিয়ে যেও। ওরা তোমাকে চমৎকার বেহালা কিনতে সাহায্য করবে।

বলে সোফিয়া উঠে চলে গেল।

 

 

আমার ছয় মাসের মেয়াদ প্রায় শেষ। গত আড়াই মাস যাবত আমি প্রায় পঁচাত্তরটি ছবির রিভিউ রিপোর্ট দিয়েছি। কিন্তু মশিঁয়ে দানিয়েলের কাছ থেকে আমি ইতিবাচক বা নেতিবাচক কোনো প্রতিক্রিয়া পাইনি। আমার ভেতরে একটা অস্থিরতা। প্যারিসে থাকার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমি যদি ভিসার মেয়াদ না বাড়াতে পারি, ওয়ার্ক পারমিট না পাই তাহলে দেশে ফিরে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। দেশ থেকে বাবা, জয়ী মা, নাজু বার বার আমাকে চিঠি লিখছে দেশে ফিরে যেতে। কিন্তু আমি চিঠির উত্তর  দিচ্ছি না। কী লিখব ওদের?

মানসিক অস্থিরতা নিয়ে আমি চেয়ারম্যান মশিঁয়ে আতোঁয়ান আর ডিন মশিঁয়ে দানিয়েলের সঙ্গে দেখা করলাম। অনুরোধ করলাম আমার সম্পর্কে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে। বললাম, মশিঁয়ে, হয় তোমরা আমাকে লাথি মেরে তাড়াও অথবা এই প্যারিস কলেজ অব আর্টস এ কিছুটা সম্মানের সঙ্গে থাকতে দাও। আমাকে ছবি আঁকা-আঁকির সুযোগ দাও।

আমার অস্থিরতা ও কথায় ওরা হাসলেন। বললেন, তোমার রিভিউ রিপোর্টগুলি নব্বইভাগ সন্তোষজনক। সুতরাং আমরা তোমাকে লাথি মেরে তাড়াতে চাই না। তুমি আমাদের কলেজেই থাকবে বটে তবে আরো কিছু কঠিন কাজের দায়িত্ব দেওয়া হবে।

আমি বললাম, দায়িত্ব পালনে আমার অনীহা বা ভয় নেই। তবে আমি এ দেশে থাকার আইনানুগ নিশ্চয়তা চাই।

ওরা বললেন, তা তুমি অবশ্যই পাবে। তুমি বাংলাদেশ এমব্যাসিকে একটি আবেদনপত্র লেখ। সেই সঙ্গে তোমার পুরস্কার প্রাপ্তির সনদ, এ যাবৎ প্যারিসের পত্র-পত্রিকায় তোমার সম্পর্কে যে সকল সচিত্র প্রতিবেদন বেরিয়েছে তার কপি আমাদের কাছে জমা দাও। আমরা বাংলাদেশ এমব্যাসি ও আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এই মর্মে সুপারিশপত্র লিখব যে তোমাকে প্যারিস কলেজ অব আর্টস এ চিত্রশিল্প বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সুতরাং তাকে এই দেশে ওয়ার্ক পারমিট মঞ্জুর করা হোক। আমরা নিশ্চিত জানি ওরা আমাদের এই সুপারিশপত্র গুরুত্বের সঙ্গেই বিবেচনা করবে।

ওদের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ এবং যথেষ্ট দৌড়ঝাপের মধ্য দিয়ে দু’সপ্তাহের মধ্যেই আমি আপাতত দু’বছরের জন্যে টেম্পরারি রেসিডেন্ট পারমিট ও ওয়ার্ক পারমিট পেলাম।

চলবে

 

লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব এক)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব দুই)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব তিন)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব চার)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব পাঁচ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব ছয়)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব সাত)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব আট)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব নয়)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব দশ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব এগার)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব বার)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব তের)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব চৌদ্দ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব পনের)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব ষোল)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব সতের)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব আঠারো)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব উনিশ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব বিশ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব একুশ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব বাইশ)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top