সিডনী বুধবার, ২৪শে এপ্রিল ২০২৪, ১১ই বৈশাখ ১৪৩১

করোনার আবহে বাঙালির দীপাবলি উৎসব : ডঃ সুবীর মণ্ডল


প্রকাশিত:
৫ নভেম্বর ২০২১ ০১:১১

আপডেট:
৫ নভেম্বর ২০২১ ০২:২২

 

হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে দিওয়ালি বা দীপাবলি একটি বড় উৎসব। পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতজুড়ে এই উৎসব মহা ধুমধাম করে পালিত হয়। এইসময় চারিদিক আলোর রোশনাইয়ে সেজে ওঠে। আট থেকে আশি সকলে মেতে ওঠে খুশিতে। কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের অমাবস্যা তিথিতে দীপাবলী ও কালী পুজো দুই-ই পালিত হয়। দীপাবলীর দিন প্রদোষ কালে লক্ষ্মী পুজো করা হয়, আবার এই দিন মধ্যরাতেই মা কালীর আরাধনায় মাতেন বাঙালিরা। মূলত বাঙালি, অসমিয়া ও ওড়িয়ারা দীপাবলির সময় কালীপূজা করে থাকেন। আলোকসজ্জা ও আতসবাজির উৎসবের মধ্য দিয়ে সারা রাত্রিব্যাপী কালীপূজা অনুষ্ঠিত হয়।
এই উৎসব উপলক্ষে, প্রতি বছর কার্তিকের অমাবস্যার দিনে সবাই বাড়ি-ঘর আলো দিয়ে সাজায়, প্রিয়জনদের সঙ্গে উৎসবের আনন্দ ভাগ করে নেয়। এই দীপাবলি ও কালীপুজোতে অনেকেই আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবদের শুভেচ্ছা বার্তা প্রেরণ করেন ।

ধনতেরসের উৎস সন্ধানে :

ধন্বন্তরী নামে কাশীতে এক রাজা ছিলেন। তিনি তার রাজত্বের বাইরে গিয়েও আয়ুর্বেদ প্রচার করেন। তার প্রচারেই আয়ুর্বেদ আমাদের দেশে এতো প্রসিদ্ধ। তাই আয়ুর্বেদ ও মহৌষধের কথা উঠলেই বলা হয় ধন্বন্তরীর নাম। তিনি ত্রয়োদশী তিথিতে জন্ম গ্রহণ করেন, তাই তখন থেকেই আয়ুর্বেদ প্রেমিকরা তাঁর জন্ম তিথি ধন্বন্তরী ত্রয়োদশী হিসাবে পালন করে। হিন্দিতে এটাকে ধন্বন্তরী তেরস বা সংক্ষেপে ধনতেরস বলে। এর সাথে ধন বা অর্থের কোনো সম্পর্ক নেই। ব্যবসায়ীরা আমাদের এই অজ্ঞতাকেই মূলধন করে ব্যবসা করছে। ধনতেরস সোনার গয়না নয়, আয়ুর্বেদ ঔষধ কেনার দিন।ধন্বন্তরী জন্মেছিলেন ত্রয়োদশী তিথির শেষ লগ্নে। চতুর্দশীর শুরুতে। তাই ধন্বন্তরীর মতো আয়ুর্বেদাচার্য কে মর্যাদা দিয়ে চতুর্দশী তিথিতে বিশেষ চোদ্দটি পুষ্টি গুণযুক্ত শাক খেয়ে আপনার শরীরে এই শীতের শুরুতে প্রাকৃতিক ভ্যাক্সিন প্রবেশ করান।


তবে সনাতন ধর্মালম্বীরা এই দিনটিকে অত্যন্ত শুভদিন বলে ধরেন । এটি দীপাবলি উৎসবের প্রথম দিন। এই দিন ঘরবাড়ি পরিষ্কার করা হয়। অনেকে বাড়ি রঙ করে থাকেন।প্রথা মেনে এই দিনে নতুন কিছু কিনতে হয়। বেশির ভাগ মানুষ ধাতুর তৈরি কোন জিনিস কিনে থাকেন। অনেকে লক্ষী দেবী সম্পদের দেবী বলে, মূল্যবান ধাতু যেমন সোনা, রূপা বা মূল্যবান অলংকার কিনে থাকেন। এইদিন গাড়ি কিংবা গৃহের প্রয়োজনীয় কোন দ্রব্য কেনারও প্রথা আমাদের দেশে আছে। এই দিন রাত্রে লক্ষ্মী দেবীর উদ্দেশ্যে বাড়িতে মাটির দীপ প্রজ্জ্বলন করতে হয়। তুলসী তলাতে প্রদীপ দিতে হয়। এই প্রদীপ জালানো হয় মৃত্যুর দেবতা যমরাজের উদ্দেশ্যে। অনভিপ্রেত অকাল মৃত্যু প্রতিরোধ করাই এর উদ্দেশ্য।

বাঙালি জাতি ধনতেরাস দীপাবলির সময়ে শুভেচ্ছা জানায় কাছের মানুষদের । সন্ধ্যায় মাটির দীপ প্রজ্জ্বলন করতে দেখা যায়, এক অন্যভুবন গড়ে ওঠে বাংলার মাটিতে । একান্তভাবে হৃদয় দিয়ে অনুভব করে বাঙালি জাতি আলোর দীপাবলীতে। উজ্জ্বল হয়ে দেশের অর্থনীতি।কেটে যায় মনের সমস্ত অন্ধকার, অধর্ম। শক্তির আরাধনা, আলোর রোশনাই, হরেক রকম বাজির সমষ্টিই নিয়েই বাঙালির বর্ণময় দীপাবলী। আগামী ৪ঠা নভেম্বর শুভ দীপাবলী। ইতিমধ্যেই আলোর মালায় সেজে উঠেছে শহরতলির বিভিন্ন জায়গা। কোথাও আলোর মেলা তো কোথাও আবার বাজির তারতম্যে চক্ষু চড়কগাছ। কিন্তু দীপাবলীতে বাজির শব্দমাত্রা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের বেঁধে দেওয়া ৯০ ডেসিবেলই থাকছে। তাই শব্দদানবের জ্বালায় অতিষ্ট না হয়েই আলো ও শক্তির আরাধনাতেই মনোনিবেশ করতে চলেছে উৎসব প্রিয় জাতি বাঙালি । এ-বছর সুপ্রিম কোর্ট পরিবেশ বান্ধব বাজিতে ছাড় দিয়েছে। ফলে অল্প বয়সের ছেলে- মেয়েদের মধ্যে খুুশির আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে। করোনার আবহে স্বাস্হ-বিধি মেনে আলোর উৎসবে মেতে উঠবে আপামর জনসাধারণ।

তবে দেশের অন্যান্য প্রদেশের সঙ্গে বাঙালিদের দীপাবলী পালনের একটা পার্থক্য রয়েছে। দীপাবলীতে যেখানে দেশের পূর্বভাগে অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ, অসম ও ওড়িশার কিছু অংশ কালীপুজোয় মাতে সেখানে দেশের সর্বত্র ধন ও সিদ্ধির দেবদেবী লক্ষ্মী ও গণেশ ঠাকুরের পুজো করা হয়। কিন্তু দীপাবলীতেই কালীপুজো করা হয় কেন। কালীপুজোরও একটা ইতিহাস রয়েছে।

কালীপুজোর ইতিহাস
হিন্দু সমাজে যে সমস্ত পুজো হয়ে থাকে তা কিন্তু সবসময় শাস্ত্র মতে হয় না। যেমন বালগঙ্গাধর তিলক মহারাষ্ট্রে প্রথম গণেশ পুজার প্রচলন করেন। যা এখনও মহারাষ্ট্রে অত্যন্ত সাড়ম্বরে পালন করা হয়ে থাকে। একইভাবে অষ্টাদশ শতাব্দীতে নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র প্রথম মহাকালী পুজোর প্রবর্তন করেন। তাঁর বংশধরেরাই এই পুজোর ঐতিহ্য ধরে রাখেন।
প্রাথমিকভাবে শক্তির আরাধনায় মা কালীর পূজা শুধুমাত্র বিত্তশালী ও খ্যাত পৃষ্ঠপোষকদেরই কুক্ষিগত ছিল। যদিও বর্তমানে দুর্গাপুজোর পর জনপ্রিয়তার নিরিখে কালীপুজোই সার্বজনীন পুজোগুলির মধ্যে অন্যতম।

পুরাণ কাহিনী
মা দূর্গার মতো মা কালীরও একটি পুরাণ কাহিনী রয়েছে। কোনও এক সময় সুম্ভ ও নিসুম্ভ নামের দুই অসুর স্বর্গে ও মর্ত্যে আক্রমণ করে। তাদের আটকাতে দেবী দূর্গার কাছে প্রার্থনা করেন দেবতারা। সুম্ভ-নিসুম্ভকে আটকাতে মা দূর্গার কপাল থেকে জন্ম হয় মা কালীর। মহামায়ার চণ্ডাল রূপই হলেন মা কালী। এর পরই নিজের খাঁড়া দিয়ে অসুরদের বধ করতে শুরু করেন কালী। বধের সঙ্গে সঙ্গেই তাদের রক্তও পান করতে থাকেন দেবী। ফলে ক্রমশই রক্তের তৃষ্ণা বাড়তে থাকে। মৃত অসুরদের মেরে তাদের মুন্ডের মালা গলায় পড়ে নেন তিনি। এমতাবস্থায় কালীকে আটকানো কার পক্ষেই সম্ভব হচ্ছিল না। পথে কেউ এলেই তাকেও মেরে ফেলছিলেন। কালীর উন্মত্ততাকে আটকাতে তাঁর স্বামী শিব পথে শুয়ে পড়েন। উন্মত্ত অবস্থায় যখন মা কালীর স্বামীর গায়ে পা তুলে দেন, অনুশোচনায় তখন তাঁর জিহ্বা বেরিয়ে আসে। এবং ধীরে ধীরে শান্ত হন দেবী। মা কালীর এই রূপকেই পুজা করা হয়।

কালীপুজো মূলত মধ্যরাতে হয়ে থাকে। কার্তিক মাসের অমাবস্যার রাতে মা কালীকে পুজো করা হয়। আগেরকার দিনে যুদ্ধে যাওয়ার আগে জয় পাওয়া ও নিরাপত্তার জন্য মা কালীকে পুজো করা হতো। যদিও এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পেতে মহা কালীর পুজো করা হয়ে থাকে।

কলকাতাতে অত্যন্ত ধুমধাম করে পালিত হয় কালীপুজো। এখানকার ফাটা কেষ্টর কালীপুজো বিখ্যাত। তবে কলকাতাকে টেক্কা দিতে শহরতলীও উঠে আসছে ক্রমশ। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা জুড়ে কালী পুজোর আয়োজন এক কথায় অসাধারণ ও অতুনীয় দৃশ্য। বিশেষ করে উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার মধ্যমগ্রাম ও বারাসাতের কালী পুজো ভারতবর্ষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এছাড়া কলকাতা, উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাট ,বনগাঁ, হাসনাবাদ, টাকী, নিউ টাউন, দমদম,শিয়ালদহ কালীপুজোর জন্য বিখ্যাত। পশ্চিমবঙ্গের ২৩টি জেলায় মহাধুমধামের সঙ্গে কালীপুজো ও আলোর উৎসবে মেতে উঠতে চলেেছ ,চূড়ান্ত প্রস্তুতি চলছে জোর কদমে। বেশ কয়েক বছর ধরে বাঁকুুুুড়া জেলার খাতড়া খাতড়া মহকুমা শহর কালীপুজোয় নজির সৃষ্টি করে চলেছে। শহর জুড়ে নানান ধরনের থিমের পুুজো ইতিমধ্যেই আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
আধুনিক শহর বাঁকুড়ার খাতড়া । এখানে কালী পুজোর রমরমা। তাই মানুষ কালীর শহর নামেই একডাকে চেনে এই ছোট্ট নির্মল প্রকৃতির ছোঁয়ায় গড়ে ওঠা শহরকে । কার্তিক পুজোয় সোনামুখী শহর যেমন মেতে ওঠে আট থেকে আশির মানুষেরা,তেমনি খাতড়া মহকুমা শহর মেতে ওঠে কালীপুজো নিয়ে। বাঁকুড়া জেলার মানচিত্রে খাতড়া মহকুমা শহর কালীপুজোয় নজির সৃষ্টি করে চলেছে। মহকুমা প্রশাসনের অনুমোদনপ্রাপ্ত ১৯ টি বড় পুজো হলেও ভিন্নভিন্ন নামে প্রায় শতাধিক পুজো হয় এখানে। বাঁকুড়ার সোনামুখী শহরের কালী পুজো বেশ জনপ্রিয়। নানান ধরনের কালীপুজো অনুষ্ঠিত হয়। যেমন মাই- তো -কালী, রক্ষা কালী,ডাকাত কালী , ঘুঘু কালী, সার্ভিস কালী, জামাই কালী সহ কত কী। আর সব নাম করণেরই এক একটা ইতিহাস রয়েছে। যেমন দামোদর নদ পার্শ্ববর্তী এই শহরে বেশির ভাগ শিক্ষিত মানুষজন একসময় ডিভিসি সহ বিভিন্ন সংস্থায় চাকরি পান। তারপরই আনন্দে মেতে ওঠেন কালীর আরাধনায়। নাম দেন সার্ভিস কালী। সেরকমই সোনামুখির জামাইরা শুরু করেন জামাইকালী।

শেষকথা:

দীপাবলীর আলোর মালা, জাতি ধর্মের উদ্ধে সমস্ত মানুষের জীবনে সৌভাগ্যের দিশা হয়ে জ্বলতে থাকুক। শুভ দীপাবলিতে মনের সমস্ত অন্ধকার ঘুচে যাক। আলোর উৎসবে সবার জীবনও আলোতে ভরে উঠুক। শুভ দীপাবলি আপনাকে ও আপনার পরিবারকে জানাই শুভ দীপাবলির আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা। কালী পূজা ও দীপাবলি ভাল ভাবে কাটুক এই কামনা করি।দীপাবলীর পুণ্য লগ্নে সুখ-সমৃদ্ধিতে ভরে উঠুক সকলের জীবন। শুভ দীপাবলীর আলোয় ভুবন ভরিয়ে দে মা, ঘুচিয়ে দে মা যত কালোমনের আঁধার মুছিয়ে দে মা, মন আকাশে জ্বেলে আলো
আঁধার কেটে আলো আসুক প্রতিটা ঘরে। নিরাশা কেটে গিয়ে আশা আসুক। পৃথিবীতে সব ভাল জিনিসের জয় হোক। সকলকে জানাই দীপাবলির শুভেচ্ছা।এই কালীপুজোতে আপনার ও আপনার প্রিয়জনদের জীবন আনন্দে ভরে উঠুক। কালী মায়ের আশীর্বাদ সর্বদা আপনার উপর থাকুক। শুভ কালী পূজার আলোর উৎসব হয়ে উঠুক শান্তির। অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর হয়ে যাক। দীপাবলির খুশি ভাগ করে নিন আপনার কাছের মানুষজনের সঙ্গে। দীপাবলির শুভেচ্ছা জানাই শ্যামা মায়ের আরাধনায় সবার মন হয়ে উঠুক ভক্তিতে পরিপূর্ণ...মায়ের আশীর্বাদে আপনার জীবন থেকে দূরে চলে যাক সব বিপদ ও
দুঃখ...শুভ কালীপূজাআকাশে বাতাসে অনেক আলো, সবার জীবন কাটুক ভালো।

 

ডঃ সুবীর মণ্ডল
লোকগবেষক,প্রাবন্ধিক ,রম্যরচনা ও ছোটগল্প এবং ভ্রমণকাহিনীর লেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top