সিডনী মঙ্গলবার, ২৩শে এপ্রিল ২০২৪, ১০ই বৈশাখ ১৪৩১

মাটির ব্যাংক : মোঃ ইয়াকুব আলী


প্রকাশিত:
১০ নভেম্বর ২০২১ ০২:০৬

আপডেট:
২৩ এপ্রিল ২০২৪ ১৮:৫০

ছবিঃ উত্তরখান মাজারের মেলা থেকে ফিরছেন লেখক ও তাঁর কন্যা

 

গ্রামের মানুষদের স্বল্প আয়ের জীবনযাত্রায় দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহ করে খুব কম অর্থই বাচে জমানোর জন্য। নদী ভাঙনের পর আমাদের জীবনযাত্রা অনেকটা ‘দিন আনি দিন খায়’ এর মত অবস্থায় চলে গিয়েছিল। আয়ব্যয় এর হিসাব মেলানোর পর তেমন কোন টাকা-পয়সা থাকতো না। তবুও আমার মা পাঁচ পয়সা, দশ পয়সা, চার আনা, আট আনা করে জমাতেন। এখনতো আর সেই মুদ্রাগুলো নাই, হয়তো যাদুঘরে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে। কিন্তু তখনকার দিনে ঐ মুদ্রাগুলো দিয়ে অনেক কিছুই কিনে ফেলা যেতো।
এখন এই খুচরা পয়সাগুলো রাখা হবে কোথায়? মাটি, ছন, বাশের তৈরি ঘরে খুটি হিসাবে বাশ ব্যবহার করা হত। এই খুটিগুলার মধ্যে যে খুটিটা একটু হৃষ্ট-পুষ্ট তার কোন এক অংশকে নির্বাচন করা হত ব্যাংক হিসাবে। তারপর দুই গিরার মাঝের অংশের উপরের দিকের অংশে যাতে শুধু পয়সা ঢুকে এমন আকারের উপবৃত্তাকার ছিদ্র করা হত। তারপর সেই ছিদ্র দিয়ে ভেতর পয়সা ফেলা হত। এভাবে ফেলতে ফেলতে একসময় সেটা ভরে যেতো। আর সেটা বোঝা যেত পয়সা ফেলার পর তার শব্দের মাত্রা শুনে। কারণ উপর থেকে পয়সা পড়লে জোরে শব্দ হবে আর যদি কাছাকাছি পড়ে তাহলে কম শব্দ হবে।

 
ছবিঃ উত্তরখান মাজারের মেলা

তবে ঐ বয়সে তো আর আমরা সেটা বুঝতাম না, তাই মা’র এই দক্ষতাটাকে আমার যাদুকরি শক্তি মনে হত। এরপর সেই ব্যাংক এর একেবারে তলার দিকে আবার ঠিক একই সাইজের একটা ছিদ্র করা হত এবং কাঠি দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে পয়সাগুলো বের করে আনা হত। কখনই ছিদ্র দুইটা বড় করে তৈরি করা হত না, কারণ তাতে আবার খুটির শক্তি কমে যাবে। এভাবে জমানো টাকা দিয়ে আমাদের মা সংসারের অনেক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতেন।
এর বাইরে ছিল মাটির তৈরি বেলন আকৃতির পাত্র যেটাকে গ্রামের ভাষায় ব্যাংক বলা হত। কখনও মেলা বা কোন হাটে গেলে আব্বা, মায়ের জন্য একটা মাটির ব্যাংক কিনে আনতেন। কুষ্টিয়াতে সবচেয়ে বড় মেলা হতো দুই রথের মেলা। একটাকে আমরা বলতাম রথের মেলা, অন্যটা ছিলো উল্টো রথের মেলা। এইসব মেলা থেকেই সাধারণত মাটির ব্যাংক কেনা হতো। সোজা রথের মেলায় আব্বা ভুলে গেলেও মা উল্টো রথের মেলায় বারবার মনেকরিয়ে দিতেন। আর আমরা সাথে গেলে আমাদেরও বলে দিতেন আব্বাকে মনে করিয়ে দিতে।


ছবিঃ উত্তরখান মাজারের মেলা

এরপর মা বাঁশের খুঁটির ব্যাংকের মতো মাটির ব্যাংকেও ঠিক একইভাবে পয়সা জমাতেন। মায়ের জমানো পয়সা আমরা তিন ভাই পালা করে সেই ব্যাংকে ফেলতাম। ব্যাংকে পয়সা ফেলাটা ছিলো একটা মহা আনন্দের কাজ। কে আগে পয়সা ফেলবে এটা নিয়ে মাঝেমধ্যে মারামারি পর্যন্ত লেগে যেতো আমাদের ভাইদের মধ্যে। তাই মা ছোট থেকে শুরু করে সবাইকে সুযোগ দিতেন। পয়সা ফেলার পর প্রতিবার আমরা মাটির ব্যাংকটা ঝাকিয়ে শব্দ শুনতাম। মাটির ব্যাংকে কাঁচা পয়সার শব্দ মনের মধ্যে এক ধরণের শিহরন জাগাতো। এরপর সেই মাটির ব্যাংকও কোন এক বিপদের দিনে সেটা ভেঙে ফেলা হতো।


ছবিঃ উত্তরখান মাজারের মেলা

আমাদের ভাইদের অবশ্য অবশ্য অন্য রকমের একটা ব্যাংক ছিলো যেটার কথা শুধু আমরাই জানতাম। সেটা ছিলো আমাদের ছনের ঘরের চালের ভিতর। ঘরের চালের ছন ফাঁকা করে তার ভিতরে আমরা টাকা বা পয়সা লুকিয়ে রাখতাম। আর পাশে কোন একটা চিহ্ন ঠিক করে রাখতাম যাতে পরের বার খুজে পাওয়া যায়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঐ লুকানো টাকাগুলা আমরা আর খুজে পেতাম না কারণ ছনের চালা নিচ থেকে দেখতে সব জায়গা একইরকম লাগতো। বিশেষ করে তখন নতুন নতুন এক টাকা বা দুই টাকার নোট জমানোর প্রতি আমার আমাদের আগ্রহ বেশি ছিল। এভাবে আমরা অনেক টাকা হারিয়েছি লাম।
এরপর একসময় নিজে সন্তানের পিতা হলাম। ভাবলাম আমাদের শৈশবের সেই অনাড়ম্বর আনন্দগুলো ওদের মধ্যে ফিরিয়ে আনি। আমাদের মেয়ে তাহিয়া প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার পর ওর নানার কাছ থেকে একটা করে দুই টাকার নোট নিতো। ওর নানা অফিস থেকে আসার পর মানিব্যাগটা পকেট থেকে বের করে রাখার সঙ্গে সঙ্গে সে ওখান থেকে একটা দুই টাকার নোট সরিয়ে রাখতো। তারপর সেই দুই টাকার নোট সে তার নিজস্ব ছোট্ট একটা পার্সে নিয়ে রাখতো। এভাবে বেশ অনেকগুলো টাকা জমাও হয়ে গেলো।
এখানে একটা ব্যাপার লক্ষনীয় ছিলো সে কখনই আমার কাছ থেকে টাকা নিতো না। একবার ওর নানা ওকে জিজ্ঞেস করেছিল তুমি তোমার বাবার কাছ থেকে টাকা নেও না কেন? সে বলেছিল, তাহলে বাবার টাকা কমে যাবে না? কি লক্ষ্মী মেয়ে আমার! এরপর ঈদে বেশ কিছু টাকা সালামীও পেল, তখন বায়না ধরলো, বাবা একটা মাটির ব্যাংক কিনে দাও। আমি প্রায় প্রতিদিনই ভাবি অফিস থেকে ফেরার পথে ওর জন্য একটা মাটির ব্যাংক নিয়ে যাবো ভাবতাম এবং প্রতিদিনই ভুলে যেতাম আর ওর কাছে বকা খেতাম।
এরপর একদিন উত্তরখান মাজারের মেলা থেকে ওর জন্য মাটির ব্যাংক কিনে আনলাম। উত্তরখান মাজারে প্রতিবছর একবার করে ওরশ হয়। তখন আশেপাশের এলাকায় সাজসাজ রব পরে যায়। সপ্তাহব্যাপী চলা এই মেলা এলাকার মানুষদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্যের সঞ্চার করে। আমি প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরেই তাহিয়াকে কাঁধে নিয়ে সেই মেলায় হাজির হতাম। আমরা তেমন কিছুই কিনতাম না কিন্তু ঘুরেঘুরে দোকান, আয়োজন সব দেখতাম। মানুষের মুখরিত কোলাহল আমাদের খুব ভালো লাগতো।
এরপর সে তার দুই টাকার নোটগুলো সেই ব্যাংকের মধ্যে রাখা শুরু করলো। এরপর একদিন বেশ কিছু টাকা জমা হয়েও গেলো। তখন ঠিক আমার মায়ের মতো তাহিয়ার মা'ও সেটা ভেঙে ওর জন্য একটা কাজে লাগিয়েছিলো। এভাবেই আমরা চাইলেই আমাদের পরবর্তি প্রজন্মকে একটা চমৎকার শিক্ষা দিতে পারি। যেটা একইসাথে আনন্দময়। খুচরা পয়সা দিয়ে এমনিতে কোন কিছু কেনা যায় না কিন্তু সেগুলো একত্র করলে অনেক বড় কিছু করা সম্ভব। এরপর প্রবাস জীবনে এসেও আমরা এই অভ্যাসটা ধরে রেখেছি। অবশ্য এখন মাটির ব্যাংকের জায়গা নিয়েছে টিনের কয়েন বক্স আর খুচরা পয়সার জায়গা নিয়েছে ডলার আর সেন্টের কয়েন।

 

মোঃ ইয়াকুব আলী
মিন্টো, সিডনী, অস্ট্রেলিয়া

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top