সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

করোনার আবহে বাংলার বর্ণময় ছট পুজো : ডঃ সুবীর মণ্ডল


প্রকাশিত:
১২ নভেম্বর ২০২১ ০১:২১

আপডেট:
১৯ এপ্রিল ২০২৪ ১২:৩৮


বাঙালির উৎসবের মরশুম শেষ হয়ে আসছে। চারপাশে বিষণ্ণতা। এর মাঝেই শেষ গানের রেশ নিয়ে চলে এল ছট পুজো। ছট পুজো মূলত বিহারিরা শুরু করেছিলেন বহু বছর আগে। ছট মানে ছট মাইয়া। সূর্যের আরেক নাম। সূর্যকেই পুজো করা হয় ছট পুজোয়। কার্ত্তিক মাসের অমাবস্যার পর ষষ্ঠীতে এই পুজো হয়।
পুজোর নিয়ম মেনে প্রথম দিন মহিলারা একবার কুমড়োর সবজি দিয়ে ভাত খেয়ে ১২ ঘণ্টা উপবাসে থাকবে। তারপর খাবার খেয়ে ২৪ ঘণ্টা উপবাসে থাকবে, তারপর আবার খাবার খেয়ে ৩৬ ঘণ্টা উপবাসে থেকে জলাশয় অথবা নদীতে গিয়ে আবক্ষ জলে দাঁড়িয়ে সূর্য দেবতার কাছে নিজের মনের চাহিদা জানাতে হবে। ছট পুজোর কোনও মন্ত্র নেই। যার যে ভাষায় সূর্যের কাছে মনবাসনা জানানোর ইচ্ছে, তিনি সে ভাষাতেই বলবেন মনে মনে।
রামায়ণ এবং মহাভারত দুয়েতেই ছট পুজোর উল্লেখ রয়েছে। সূর্য বংশের সন্তান হওয়ার কারণে শ্রীরামচন্দ্র নিয়মিত ছট পুজো করতেন। বনবাস কাটিয়ে অযোধ্যা ফেরার সময় রাম ও সীতা সূর্য দেবের উদ্দেশ্যে পুজো ও উপবাস করেন। সেই থেকেই ছট পুজোর সূচনা বলে মনে করা হয়। আবার মহাভারত অনুযায়ী সূর্যদেব ও কুন্তীর পুত্র কর্ণ। কথিত, কর্ণ এই সময় সূর্যের আলোয় আবক্ষ জলে দাঁড়িয়ে দরিদ্রদের মধ্যে প্রসাদ বিতরণ করেছিলেন। আবার নিজেদের রাজ্য ফিরে পাওয়ার জন্য দ্রৌপদী ও পাণ্ডবরাও এই পুজো করেছিলেন বলেও কথিত রয়েছে।
এখন কিন্তু ছট পুজো উদযাপন শুধু বিহারি সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সারা দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায় এবং ধর্মের মানুষ এখন এই উৎসবকে আপন উৎসব হিসাবেই গ্রহণ করেছেন।
ছট পুজো (Chhath Puja 2021) মানেই চার দিন ব্যাপী ধুমধাম আর নানা রকম সুস্বাদু খাবারের সমাহার। এই পুজোর সব খাবারই তৈরি করা হয় ঘি দিয়ে। ছটপুজোর অন্যতম খাবার হল ঠেকুয়া। এই উৎসব পূর্ব ভারতের বিহার, ঝাড়খণ্ড, পূর্ব উত্তরপ্রদেশ এবং নেপালের তরাই অঞ্চলে পালিত হয় ছট পুজো। বিহার, ঝাড়খন্ডের ঐতিহ্যবাহী খাবার এই ঠেকুয়া (Thekua)। ছট পুজো আসলে সূর্যদেবের আরাধনা ৷ বছরে দু’টি ছট হয়, একটা হয় চৈত্র মাসে, অন্যটা কার্তিক মাসে ৷ ত্রেতাযুগে শ্রীরামচন্দ্র ও সীতাদেবী শুক্ল ষষ্ঠীর দিনেই সূর্যের আরাধনা করেছিলেন। দ্বাপরে সূর্যপুত্র কর্ণ তিনিও সূর্যদেবের পুজো করেন ৷ দীপাবলীর ঠিক ৬ দিনপরে কার্তিক মাসের শুক্লা ষষ্ঠীতে এই পুজো করা হয়। তাই এর নাম ছট পুজো (Chhath Puja)।
আবার অনেকের মতে, সূর্যদেবের ছোট স্ত্রী ঊষাকে এই পুজায় 'ছোটি মইয়া' হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। সেখান থেকেই ছট পুজার নামটি প্রচলন হয়েছে। ছট পুজোর মহাপ্রসাদ বলা হয় ঠেকুয়াকে (Thekua)। পুজোর সময় মরশুমি ফলের সঙ্গে দেবতাকে ঠেকুয়া দেওয়া হয়। পূণ্যার্থীরা পুজোর দিনগুলোয় বাড়িতেই ঠেকুয়া (Thekua) তৈরি করেন। এই ঠেকুয়া সুস্বাদুও বটে। ছটে কোনও মূর্তি পূজা করা হয় না সূর্য এই পুজোর আরাধ্য দেবতা।
প্রতি বছর কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ তিথিতে পালিত হয় এই পবিত্র উত্‍সব।এটি সবচেয়ে কঠিন উপবাসগুলির মধ্যে একটি হিসাবে বিবেচিত হয়। বিশেষ করে বিহার এবং উত্তর প্রদেশের লোকেরা উদযাপন করে। ছট পুজোর নিয়ম এদিক থেকে ওদিক হলেই অমঙ্গল ঘটবে বিশ্বাস করেন
সবচেয়ে কঠিন উপবাসগুলির মধ্যে একটি হিসাবে বিবেচিত হয়। লোকপর্ব ছট আসলে বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত একটি উৎসব, যেখানে ছট মাইয়া এবং সূর্য দেবের পূজা করা হয়। প্রথমে স্নান,তারপর খরনা এবং তৃতীয় দিনে অস্তগামী সূর্যকে অর্ঘ্য নিবেদন করা হয়।দীপাবলির ৬ দিন পর অর্থাৎ কার্তিক মাসের ষষ্ঠ দিনে মহাপর্ব ছট পালিত হয়। স্নান এবং ৩৬ ঘন্টা উপবাস এবং সূর্য দেবতা ও ছঠি মাইয়া পূজার মাধ্যমে উৎসব শুরু হয়। এই উৎসবটিকে সবচেয়ে কঠিন উৎসবগুলির মধ্যে একটি হিসাবে বিবেচনা করা হয় যাতে ভুল করেও যদি কোনও ভুল হয়ে যায় তবে উপবাসের নিয়ম ভঙ্গ করা হয়।
প্রতি বছর কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ তিথিতে পালিত হয় এই পবিত্র উত্সব। এটি সবচেয়ে কঠিন উপবাসগুলির মধ্যে একটি হিসাবে বিবেচিত হয়। বিশেষ করে বিহার এবং উত্তর প্রদেশের লোকেরা উদযাপন করে।এই দিনে পূর্ণ আচার-অনুষ্ঠান ও কঠোর নিয়মের সঙ্গে ছঠি মাইয়া পূজা করা হয়। ছট উৎসবের প্রথম দিনে স্নান এবং দ্বিতীয় দিনে খরনা পালিত হয়। যেখানে ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় অর্থাৎ তৃতীয় দিনে অস্তগামী সূর্যকে অর্ঘ্য নিবেদন করা হয় এবংপরদিন চতুর্থ দিন সকালে উদীয়মান সূর্যকে অর্ঘ্য নিবেদনের মাধ্যমে ছট উৎসবের সমাপ্তি হয়। বিশ্বাস করা হয় যে ছট উপবাসের ফলে সন্তান ধারণ সম্ভব হয় ও সন্তান না হওয়ার যাবতীয় সমস্যা দূর হয়। তবে এর কোনও বৈজ্ঞানিক কারণ নেই। ছট পূজার গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম
প্রসাদ তৈরি করার সময় পবিত্র বজায় রাখা অপরিহার্য- ছঠি মায়ার প্রসাদ তৈরিতে ব্যবহৃত শস্য ঘরেই ধুয়ে, পিষে ও পিষে তৈরি করা হয়।এর বিশুদ্ধতার জন্য বিশেষ যত্ন নেওয়া হয়। এ সময় পাখি যেন শস্য নোংরা না করে সেদিকেও বিশেষ খেয়াল রাখা হয়।যদি কেউ ভুলবশত শস্যের উপর পড়ে, তবে এটি একটি অশুভ লক্ষণ হিসাবে বিবেচিত হয়। ঘরে কোনও ময়লা থাকা উচিত নয়-পুজোর সময় মিথ্যা পাত্র, নোংরা কাপড় স্তূপ করা উচিত নয়। যে জায়গায় প্রসাদ তৈরি হচ্ছে সেখানে সাধারণ খাবার তৈরি করা হয় না।এছাড়াও,সেই স্থানে খাওয়াও নিষিদ্ধ।
নতুন উনুন ব্যবহার করা উচিত-ছঠি মাইয়া নৈবেদ্য দেওয়ার সময় পবিত্রতার প্রতি সর্বোচ্চ যত্ন নেওয়া হয়। এর জন্য, এটি সর্বদা এমন একটি উনুন তৈরি করা হয়। বাড়িতে মাটির উনুন তৈরির একটি ঐতিহ্যবাহী নিয়ম রয়েছে। যদি গ্যাস ব্যবহার করতে হয়,তবে একটি নতুন আভেন ব্যবহার করা হয়,যা প্রতি বছর শুধুমাত্র ছটের দিনেই বের করা হয়।এটি একটি নিয়ম যে ছট প্রসাদ আগে থেকে তৈরি উনুন তৈরি করা হয় না।
বিছানায় ঘুম নিষিদ্ধ-উপবাসকারীকে ছট পূজার চারদিন উপোস রাখতে হয় এবং বিছানায় বা বিছানায় ঘুমানো নিষিদ্ধ। এমতাবস্থায় তিনি মাটিতে মাদুর বিছিয়ে ঘুমাতে পারেন এবং কম্বল ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারেন।
প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে-পুজোর জন্য শুধু বাঁশের তৈরি ঝুড়ি ব্যবহার করতে হয়।ছট পুজোর সময় কখনই স্টিল বা কাঁচের পাত্র ব্যবহার করবেন না।প্রসাদও খাঁটি ঘি দিয়ে তৈরি করা হয় এবং শুধুমাত্র ফল ব্যবহার করা হয়।
কাম, ক্রোধ, বস্তু, লোভ থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন-মনে রাখতে হবে যে, সারা সপ্তাহ উপবাসের সময় উপবাসকারী যেন মিথ্যা কথা, বাসি জিনিস, কাম,ক্রোধ, লোভ, ধূমপান ইত্যাদি মনেও না আনেন। ছট উৎসবের চার দিনই সম্পূর্ণ ব্রহ্মচর্য পালন করতে হয়।এ ছাড়া কঠোর ভাষা বা গালিগালাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
সাত্ত্বিক খাদ্য– ছট পুজোর সময় বাড়িতে শুধুমাত্র সাত্ত্বিক খাবার তৈরি করতে হয়।প্রসাদ বানানোর সময় ভুল করেও হাত দিয়ে লবণ স্পর্শ করা উচিত নয়।ব্রত এবং পরিবারের সদস্যরাও ছট পূজার সময় পেঁয়াজ, রসুন, মাংস এবং মাছ খেতে পারবেন না।

ব্রতীর সেবা ফলপ্রসূ- নারী বা পুরুষ যাঁরা ছটের সময় উপোস রাখেন, তাদের পরিবেশন করে আশীর্বাদ পাওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে, ছট পূজার উপবাস অত্যন্ত ধার্মিক বলে বিশ্বাস করা হয়, তাই উপবাস পালন করা ফলদায়ক বলে মনে করা হয়। হিন্দুরা তাঁর কাপড় ধোওয়া, পূজার সময় তাঁকে সাহায্য করা ইত্যাদিকে শুভ কাজ বলে মনে করে।
অর্ঘ্য দেওয়ার নিয়ম-বাড়ির বা পরিবারের অন্য লোকেরা যদি সূর্যকেঅর্ঘ্য নিবেদন করতে চায় তবে তার আগে কখনও খাবার গ্রহণ করবেন না। প্রথম ও দ্বিতীয় দিনে সূর্যকে জল নিবেদন করলেই ব্রতীরা খাবার গ্রহণ করেন।সকালে বা সন্ধ্যায় অর্ঘ্যের সময় তামার পাত্র ব্যবহার করা উচিত। তামার পাত্র থেকে সূর্যদেবকে অর্ঘ্য নিবেদন করলে বিশেষ কৃপা পাওয়া যায়।
নতুন পোশাক পরা প্রয়োজন-ছট উৎসবের চারদিনই উপবাসের সময় নতুন পোশাক পরতে হয়।মহিলারা শাড়ি পরেন এবং পুরুষরা ধুতি পরেন।

শেষকথা: পূজো উপলক্ষে ইতিমধ্যে নদী তিরবর্তী রাজ্যের বিভিন্ন পৌরসভার পক্ষ থেকে নানা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। হাওড়া কলকাতা, চন্দননগর, শিলিগুড়ি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন নদীর ঘাট পর্যবেক্ষণ ও পরিষ্কারের কাজ চলছে। গত বছর কোরোনা অবহওয়ে পুজোর কোনো রকমে হয়েছিল। এই বছর সংক্রমণ কম হলেও বিভিন্ন বিধি নিষেধ করা হয়েছে। ডিজে কিংবা শব্দ বাজি ওপর করা করি করা হয়েছে। সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখার নির্দেশ
করোনার আবহে স্বাস্থ্য বিধি মেনে পালিত হচ্ছে ছট পুজো।গত বছর সেই রকম ভাবে ছট পুজো উদযাপনের সুযোগ ছিল না। এ- বছর উৎসাহ- উদ্দীপনার মধ্যেই পালিত হচ্ছে গঙ্গার তীরবর্তী উওর চব্বিশ পরগনা,হুগলির বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। সেই সঙ্গেই কলকাতা, হাওড়া, আসানসোল, খড়্গপুর, চন্দননগরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে।মূলত বিহারীদের উৎসব হলেও বহু বাঙালিরাও এই পবিত্র উত্‍সবে সামিল হন। পরিবেশ দূষণের জন্য এ বছর রবীন্দ্র সরোবরে ছট পুজোর আয়োজন বন্ধ। গঙ্গার তীর জুড়েই চলছে বর্ণময় ছট পুজো। ছট মূলত বিহারীদের ও নারী সমাজের নিজস্ব উৎসব।উৎসব সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন-
"উৎসব একলার নহে। মিলনের মধ্যেই সত্যের প্রকাশ— সেই মিলনের মধ্যেই সত্যকে অনুভব করা উৎসবের সম্পূর্ণতা।"

 

ডঃ সুবীর মণ্ডল
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top