সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

মোহন মাঝি : শাহানারা পারভীন শিখা


প্রকাশিত:
১২ নভেম্বর ২০২১ ০১:৪৯

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ১১:৫৮

 

-কি নাম তোমার?
- মোহন মাঝি।
উপস্থিত সবার মধ্যে কিঞ্চিৎ চঞ্চলতা।
- তোমার পুরো নামটা বলো?
- স্যার জন্ম থেকে তো এই নামই লিখে আসছি।
- বাবার নাম?
- পরান মাঝি।
- এটা আবার কেমন পদবি তোমাদের!
- স্যার আমার আব্বা তো খেয়া নৌকা চালান। তাই সবাই আমাদের কে এই নামেই ডাকেন।
ছোটখাটো গড়নের ছেলেটার সারা মুখেই আনন্দ ছড়িয়ে আছে। ভীষণ ছটফটে বোঝায় যাচ্ছে। মোহন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। অসহায় ছাত্র ছাত্রীদেরকে শিক্ষা বৃত্তি দিয়ে থাকে এমন একটি জায়গায় এসেছে আজ। প্রচুর ছেলেমেয়েদের জটলা সেখানে। সবার চেহারায় টেনশন ঘিরে আছে। কিন্তু মোহনের চেহারায় কোন টেনশন নেই। যদিও এখানে আসতে বেশ দেরি হয়ে গেছে। দৌড়ে এসেছে অনেকটা পথ।
এসেই তার নামটা শুনতে পায়।
- মোহন মাঝি। আপনার সিরিয়াল একজনের পরেই। দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে থাকেন।
ওর নামটা শুনে অনেকেই ঘুরে তাকায় ওর দিকে। মোহনের সেদিকে খেয়ালই নেই। একজনের কাছ থেকে একটু পানি খেয়ে নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে। ভীড়ের মধ্যে কেউ একজন বলে, তুমি কি নৌকার মাঝি? জবাব দেয়ার আগেই ভেতরে ডাক আসে। ভয়হীন হাসিমুখে ভেতরে ঢুকে যায় মোহন।

- যদি কিছু মনে না করো, তাহলে তোমাকে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবো?
- কোন অসুবিধা নাই স্যার।
কড়া মেজাজের একজন জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা তুমি তো দেখছি ভীষণ মেধাবী। সরকারি বৃত্তি পেয়েছো দেখছি। তুমি কি জানোনা যে এখানে একটা বৃত্তি পেলে সে এই বৃত্তির অযোগ্য বিবেচিত হবে।
- জানি তো স্যার!
- তাহলে দরখাস্ত করেছো কেন?
- তোমার একটা বৃত্তির টাকা দিয়েই তো কমের মধ্যে চলে যাওয়ার কথা।

মাথা নিচু করে থাকে সে। ভয় পেও না। সত্যি কথা বলো। দেখি কোন সহযোগিতা করা যায় কিনা!

- স্যার! এই বৃত্তির টাকাটা আমার খুব দরকার। এটা পেলে আমার বোনের পড়াশোনাটা চলতে পারবে। না হলে ওর পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাবে। ওর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন শেষ হয়ে যাবে। এখন ইঞ্জিন চালিত নৌকার যুগ। তেমন কেউ আর হাতে চালানো ছোট নৌকায় চড়তে চায় না। এলাকায় ঘুরতে গেলে দু, চারজন থেকে যা রোজগার হয় তাতে মায়ের ঔষধ কিনতেই শেষ হয়ে যায়। সংসার চালাতে আব্বার হিমসিম অবস্থা। তাছাড়া আব্বার বয়সও হয়ছে। চোখে ও সমস্যা হয়ছে। আমি চাইনা আব্বা নৌকা চালাক। এতোদিন তো আমি চালাতাম পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে আব্বার পাশাপাশি। এখন তো সেটাও বন্ধ। আমি আমার পরিবারকে বাঁচাতে চাই স্যার। আমার বোনটা খুবই মেধাবী। আগামী বছর ও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেবে। আমার বিশ্বাস বোনটা আমার চান্স পাবেই।

পিনপতন নীরবতা। কারো কারো চোখের কোনায় পানি জমেছে।
- আচ্ছা তুমি যে ঠিক কথা বলছো। এটা জানতে তোমার আব্বার সাথে একটু কথা বলতে চাই আমরা। তোমার আব্বার ফোন নাম্বার টা দাও।

হেসে ওঠে মোহন। এতক্ষণে ওর ভয় অনেকটাই কেটে গেছে।
- আমার আব্বা ফোন পাবে কোথায় স্যার! তবে আমার বোনের একটা ছোট ফোন আছে। কিন্তু ও তো এখন কলেজে। আব্বা তো নৌকার ঘাটে। বোনের নাম্বার টা দিই স্যার?
- না না। ঠিক আছে দরকার নেই।
- আচ্ছা মোহন! আমরা তোমার জীবনের গল্প শুনতে চাচ্ছি? তুমি কি বলবে আমাদের?
- জ্বী স্যার বলবো।আমার কোন লজ্জা লাগেনা নিজের পরিচয় দিতে।
এরমধ্যে টেবিলে চা বিস্কিট চলে আসে। মোহনের সামনে ও দিতে বলেন। স্যারদের সাথে কিভাবে খাবে সে। কিন্তু খুবই ক্ষিধেও পেয়েছে ওর। হাত শুন্য বলে খুব সাবধানে খরচে চলতে হচ্ছে। সকালের নাস্তা টা তাই আজ করা হয়নি ওর। স্যাররা আবারও খাবার কথা বলেন। এবার সে এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ফেলে ওর প্লেটের নাস্তা। তারপর বলতে শুরু করে,

- আমার আব্বা পরান মাঝি। কিন্তু মাঝি বংশের না কিন্তু আমরা। দাদাজান মারা যাওয়ার পর সহজ সরল আমার আব্বার জায়গা জমি দখল করে নেয় আমার চাচারা। সংসার চালাতে বৈঠায় হাত রাখেন আব্বা। আব্বা নৌকায় করে স্কুলের ছেলেমেয়েদেরকে পারাপার করে দিত।আমি প্রায় আব্বার নাওয়ে চড়ে এপার থেকে ওপারে যেতাম। স্কুলের ছেলেমেয়েদেরকে দেখে আমারও খুব স্কুলে যাওয়ার সখ হইতো। আব্বাকে একদিন সাহস করে বলি, আব্বা আমিও স্কুলে যামু তোমার নাওয়ে চড়ে। আব্বা আমারে ধমক দিয়া কইলো, চুপ থাক তুই! মাঝির পোলা! লেখাপড়া শিখে সাহেব হবি! ল,বৈঠা টা ধর। আমি একটু চা খায়ে আসি। বাসায় ফিরে আব্বা আম্মারে ডাইকা কইলো, শুনছো মোহনের মা। তোমার পোলা লেখাপড়া শিখে সাহেব হইবো! ওসব মাথা থেকে সরাইতে কও। আমার সাথে ও নৌকা চালাইবো। অল্প লেখাপড়া জানা আমার আম্মার মনেও ছিল গোপন স্বপ্ন ছেলেমেয়েদের কে মানুষ করবে। সাহেব হবে। সাহেব। আম্মা জোর করে আমাদের দু'ভাইবোনকে নিয়ে সেই স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে আসে। বাবার নৌকার বৈঠা তুলে নিই হাতে। চলতে থাকে পড়াশোনা আর নৌকা চালানো। নৌকা চালিয়ে নিজের খাতা কলমের খরচ টা আসতো। খুব ভালো ছাত্র ছাত্রী ছিলাম বলে স্কুলে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন স্কুলের হেডস্যার আমাদের দু'ভাইবোনকে। ইন্টারমিডিয়েটে জিপিএ ফাইভ পাই। এলাকার চেয়ারম্যান খুশি হয়ে কিছু টাকা আমাকে দেন। সেই টাকা দিয়েই ফর্ম কিনে আপনাদের এই খানে পরীক্ষা দিই। আর আমি চান্স পায়ে গেছি স্যার। টাকা ছিল না বলে কোচিং করতে পারিনি।

রুমে বৃত্তির দ্বায়িত্বে থাকা প্রধান জন মোহনকে একটু থামিয়ে দেন। বলেন, ধরে নাও তোমার বৃত্তিটা হয়ে গেছে।আমরা আমাদের সভাপতি মহোদয়কে বিশেষ ভাবে জানাবো তোমার কথা।
- একটা কথা জিজ্ঞেস করি তোমাকে? তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করে কি করতে চাও।
- আমি সরকারি বড় অফিসার হতে চাই। আমাদের গ্রামের ছেলেমেয়েদেরকে এখনও নৌকায় চড়ে স্কুলে যেতে হয়। গেল বছর নৌকা ডুবে কজন ছেলেমেয়ে ডুবে মরছে স্যার। আমি ওই এলাকায় ব্রীজ বানানোর জন্য সরকারের লোকজন রে বলবো। মাঝির ছেলের কথা তো কেউ শুনবে না এখন। বড় অফিসার হইতে পারলে সবাই আমার কথা শুনবে। দোয়া করবেন স্যার আমাদের দু'ভাইবোনের জন্য। আমরা দুজন মিলে যেন আমার আব্বা আম্মার জীবনে সুখ আনতে পারি। আম্মা জেদ না করলে আর আব্বার নাওয়ে চড়ে স্কুলে না গেলে তো আমাকে সারাজীবন মোহন মাঝি হয়েই জীবন কাটাতে হতো।
- ঠিক আছে এখন তুমি যাও। তোমার ফোন নাম্বারটা দিয়ে যাও।
সালাম দিয়ে ফাইলটা নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। চলে যেতে যেয়েও ঘুরে দাঁড়ায় মোহন। চুপ করে দাড়িয়ে থাকে কিছুসময়। তারপর করুন আর্তীর স্বরে বলে ওঠে, স্যার সত্যি বলছি। বৃত্তিটা আমার খুবই দরকার।
চোখ মুছতে মুছতে দ্রুত বের হয়ে যায় মোহন।

বোর্ডে উপস্থিত সবার চোখেই পানি। ওর নামের পাশে টিক চিহ্ন দিয়ে রাখে প্রতিটি সদস্য।

আট বছর পর। মোহন এখন সরকারি অফিসার। বোনটাও চাকুরীতে ঢুকেছে। ওর বাবা মায়ের জীবনে শুধুই শান্তি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বৃত্তি ছাড়াও সেই দিন বোর্ডে উপস্থিত সকলেই কোন না কোন ভাবে মোহনকে সাহায্য করেছে। একজনের সুপারিশে ছোট নদীটার উপর সাঁকো তৈরি হয়েছে। সবাই এখন ওদেরকে বেশ সম্মান দেয়।
এক ছুটিতে মোহন তার সেই কজন স্যার ম্যাডামকে তাদের গ্রামে বেড়াতে নিয়ে আসে। নদীর ঘাটে খেয়ানৌকার বৈঠা তুলে নিয়ে মোহন চেঁচিয়ে বলে ওঠে, স্যার উঠে আসেন নৌকায়। আপনাদের কে নৌকায় ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।

- তুমি কি পারবে?
- খুব পারবো স্যার। আমার নাম যে মোহন মাঝি।

 

শাহানারা পারভীন শিখা
কবি ও লেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top