সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ১৮ই এপ্রিল ২০২৪, ৫ই বৈশাখ ১৪৩১

ডাব বাবা : সিদ্ধার্থ সিংহ


প্রকাশিত:
১৭ নভেম্বর ২০২১ ০১:৫৭

আপডেট:
১৮ এপ্রিল ২০২৪ ১৪:০৬

 

তখন মধ্যদুপুর। স্টেশন থেকে বেরিয়েই একটা টাঙা নিয়ে নিয়েছিল অহিতাগ্নি। যত দূর চোখ যায়, এসে, দূরে আঙুল দেখিয়ে টাঙাওয়ালা বলেছিল, এই মাঠের উপর দিয়ে সোজা চলে যান, ডাব বাবার ডেরা পেয়ে যাবেন।

এই ইন্টারনেটের যুগে সারা পৃথিবীতে খবর ছড়াতে যে মাত্র কয়েক মুহূর্তই যথেষ্ট, সেটা প্রমাণ হয়ে গেছে বহু বছর আগেই। কোথায় কোন পাথরের গণেশ নাকি দুধ খাচ্ছে, চাউড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চার দিকে গণেশকে দুধ খাওয়ানোর ধুম পড়ে গিয়েছিল। পাড়ায় পাড়ায়, অলিতে-গলিতে, যেখানেই গণেশ বাবাজির মূর্তি, সেখানেই দুধ খাওয়ানোর জন্য মা, মাসি, পিসি, ঠাকুমাদের সে কী লম্বা লাইন। সবাই স্নানটান করে পাথরের বাটি, কাঁসার বাটি, স্টিলের বাটি, কেউ আবার কাচের পাত্র করেও দুধ নিয়ে এসে হাজির। যে দেশের লক্ষ লক্ষ শিশু এক ফোঁটা দুধের জন্য ছটফট করে, দুধ জোটাতে না পেরে বাবা-মায়েরা জঙ্গল থেকে শটি তুলে এনে, সেদ্ধ করে খাওয়ায়, সে দেশেই সে দিন যে কত লক্ষ কোটি লিটার দুধ নর্দমা দিয়ে বয়ে গিয়েছিল, তার কোনও হিসেব নেই। তবে জানা গিয়েছিল, শুধু এ দেশেই নয়, পৃথিবীর সর্বত্র--- সে আমেরিকাই হোক, মিশরই হোক বা আলাস্কাই হোক, যেখানে ভারতীয়, সেখানেই নাকি গণেশকে দুধ খাওয়াবার হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। এবং এখানকার এ পাড়া ও পাড়ায় রটার আগেই নাকি সারা বিশ্ব জেনে গিয়েছিল এই খবর। এবং তা জেনেছিল মূলত ইন্টারনেটের মাধ্যমেই।
তবে না, এই ডাব বাবার খবর ইন্টারনেটের মাধ্যমে নয়, অহিতাগ্নি পেয়েছে তার বাড়ির কাজের মাসির কাছ থেকে। যেখানে ডাব বাবার আবির্ভাব হয়েছে, তাঁর এক ধর্মভাই নাকি সেই গ্রামেই থাকে। কী একটা দরকারে কলকাতায় এসে তাঁর বাড়িতে দু'দিন ছিল। অত দূর থেকে কলকাতায় এসেছে অথচ কালীঘাটে পুজো দেবে না, চিড়িয়াখানায় ঘুরবে না, অন্তত বাইরে থেকে এক ঝলক ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখবে না, তা হয়?
কথায় কথায় দ্বিতীয় দিন সেই ধর্মভাই কাজের মাসিকে বলেছিলেন, এই ডাব বাবার কথা। এই ডাব বাবার নাকি অসীম ক্ষমতা। অসাধ্যসাধন করতে পারেন। যে কোনও অসুখ একদিনে সারিয়ে দিতে পারেন। দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা মামলা-মোকদ্দমার নিষ্পত্তি করে দিতে পারেন মাত্র কয়েক দিনেই। যে কোনও বিপদ কাটিয়ে দিতে পারেন মুহূর্তে। মোদ্দা কথা, সব সমস্যা সমাধানের মন্ত্র আছে তাঁর কাছে।
কাজের মাসির কাছে ডাব বাবার কথা শুনে অহিতাগ্নি জিজ্ঞেস করেছিল, উনি কি তান্ত্রিক?
সঙ্গে সঙ্গে জিভ বার করে নিজের নাক-কান মুলে তিনি বলেছিলেন, না না, তান্ত্রিক কি গো? উনি তো তান্ত্রিকের বাবা।
--- তান্ত্রিকের বাবা! ও, তার মানে ওনার ছেলে তান্ত্রিক?
--- না না, আমি তা বলিনি। আমি বলছি, এক হাজার তান্ত্রিক অনেক সাধ্য সাধনার পরেও যা করতে পারেন না, উনি তা এক নিমেষেই করে দিতে পারেন। বড় বড় তান্ত্রিকেরা তো ওনার পায়ের কাছে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে গো...
--- ও, উনি বুঝি খুব ছোটবেলা থেকেই সাধনা করতেন, না?
--- না না, সাধনা-সাধনা নয়, উনি নাকি ওই গ্রামের একজন খুব সাধারণ মানুষ। কী যেন নাম! কী যেন নাম! ও হ্যাঁ, রাঘব। ওনার নাম রাঘব ঘড়াই। তা, আমার ধর্মভাই তো বলল, উনি নাকি আগে পাতকুয়োর কাজ করতেন। কিন্তু কুয়োর কাজ তো আর রোজ রোজ পাওয়া যায় না। কাজ না পেলে খাবে কী? তাই কারও কোনও দামি গয়না, সে গলার হারই হোক বা নাকের নাকছাবি, পুকুর বা কুয়োয় পড়ে গেলে, এক ডুব দিয়ে উনি সেটা ঠিক তুলে নিয়ে আসতেন। এ কাজে ওনার খুব নামডাক ছিল। তাতে উনি যা পেতেন, ওনার সংসার কোনও মতে চলে যেত। সংসার আর কী, বিয়ে-থা তো করেননি। উনি আর ওনার মা।
--- সে ঠিক আছে। কিন্তু উনি ডাব বাবা হয়ে উঠলেন কী করে?
--- সেটাই তো বলছি। একদিন গ্রামের এক গভীর কুয়োতে কার নাকি একটা পেতলের বালতি দড়ি ছিঁড়ে পড়ে গিয়েছিল। যৌতুক হিসেবে বিয়েতে আর যা যা তিনি পেয়েছিলেন, রেডিও, সাইকেল, ঘড়ি--- সবই নাকি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। শুধু বেচে ছিল ওই পেতলের বালতিটা। তাই ওটার জন্য তাঁর যত না আফসোস, তাঁর বউয়ের আফসোস তার দ্বিগুণ। সে তো প্রায় কেঁদেকেটে একশা --- একে একে সবই গেছে। কিছুই তো আর অবশিষ্ট নেই। যে ভাবেই হোক, তুমি আমাকে ওটা তুলে এনে দাও। ওটা আমার মায়ের শেষ স্মৃতিচিহ্ন।
কিন্তু তুলে এনে দাও বললেই তো আর তুলে এনে দেওয়া যায় না। অত গভীর কুয়োয় নামবে কে? অগত্যা ডাক পড়ল সেই রাঘব ঘড়াইয়ের। যে কোনও হারানো জিনিস এক ডুব দিয়েই যিনি তুলে আনতে পারেন। তিনি ওই কুয়োতে যে দিন নামলেন, সে দিন যেন আর উঠতেই চান না। অনেকক্ষণ পর যখন উঠলেন, তখন ওই বালতি তো আনলেনই, সঙ্গে আনলেন সেই বালতি ভর্তি করে হিরে-জহরত, মণি-মাণিক্য, সোনাদানা। যারা কুয়োর পাড়ে দাঁড়িয়ে ভিড় করে মজা দেখছিল, তারা তো একেবারে থ। তবে না, অত ধনরত্ন দেখেও কেউ হামলে পড়ল না। শুধু তাদের মধ্যে থেকে কে যেন তাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি এগুলো কোথা থেকে পেলে?
না, উনি নাকি কোনও উত্তর দেননি। যে বালতিটা তোলার জন্য উনি ওই কুয়োয় নেমেছিলেন, সেটা যার বালতি, তাকে দিয়ে পারিশ্রমিকও নেননি। সোনাদানা, হিরে-জহরতগুলো গামছায় বেঁধে চুপচাপ বাড়ি চলে গিয়েছিলেন।
লোকটাকে অত হিরে-জহরত কুয়ো থেকে তুলতে দেখে পাড়ে দাঁড়ানো অনেকেরই চোখ চকচক করে উঠেছিল। কারও কারও মনে হয়েছিল, বালতি ভরে যখন নিয়ে এসেছে, তার মানে ওখানে আরও আছে। তাই অন্য কেউ ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই, গ্রামেরই এক মাতব্বর, তারক নাকি সঙ্গে সঙ্গে দড়ি বেয়ে ঝটপট কুয়োয় নেমে গিয়েছিল। দশ মিনিট গেল। পনেরো মিনিট গেল। আধ ঘণ্টাও পার হয়ে গেল। কিন্তু কুয়ো থেকে তাকে উঠতে না দেখে আশপাশের লোকেরা ভয় পেয়ে গেল। ফের খবর দেওয়া হল রাঘবকে। তিনি যখন কুয়ো থেকে তাকে তুললেন, তার সারা গায়ে সবুজ শ্যাওলা আর ঝাঁঝরি-গাছে মোড়া। পেট ফুলে গেছে। কোনও হুঁশ নেই। এ আসে। ও আসে। সে আসে। নানা পরামর্শ দেয়। টোটকা বলে। কিন্তু কিছুতেই আর জ্ঞান ফেরে না তার। তখন রাঘবই নিজে থেকে বললেন, একটা ডাব আনো তো দেখি...
সঙ্গে সঙ্গে তারকের বড় ছেলে তরতর করে গাছে উঠে একটা ডাব পেড়ে আনল। ডাবটার মুখ কেটে দিলেন একজন। রাঘব সেই ডাবের মুখের কাছে মুখ নিয়ে বিড়বিড় করে কী একটা বলে, বাঁ হাতের তালুতে কয়েক ফোঁটা ডাবের জল ঢেলে, ডাবটা উপুড় করে বাকি জলটা কুয়োর মধ্যে ফেলে দিলেন। তার পর বাঁ হাতের তালুর সেই জল তারকের মুখে ছিটিয়ে দিতেই কয়েক পলকের মধ্যে সে চোখ মেলে তাকাল। আস্তে আস্তে করে বলল, আমি কোথায়? এত লোক ভিড় করে আমাকে দেখছে কেন? কী হয়েছে আমার?
সে সব প্রশ্নের উত্তর কেউ দিল না। সবাই ধন্য ধন্য করতে লাগল। ছোট্ট একটা ডাব দিয়ে যে মরণাপন্ন লোকের জীবন ফিরিয়ে দিতে পারে, সে তো যে সে লোক নয়। তাঁর বিশাল ক্ষমতা।
অনেক সাধুবাবা দেখেছি জীবনে, কিন্তু এ রকম ডাব বাবা এই প্রথম দেখলাম। কথাটা কে যেন বলেছিল কে জানে, তার পর থেকেই রাঘবকে সবাই ডাব বাবা বলে ডাকতে শুরু করল। শুধু ডাব নয়, ডাবের সঙ্গে কুয়োরও একটা সম্পর্ক আছে, তাই মৃত্যুর একেবারে দোরগোড়া থেকে ফিরে আসা তারক আর তার ছেলের উদ্যোগেই চাঁদা তুলে কুয়োর পাশে দরমা-টরমা দিয়ে একটা চালাঘরও বানিয়ে দিল গ্রামের লোকেরা। উনি এখন সেখানেই থাকেন। কারও কোনও সমস্যা হলেই, একটা ডাব নিয়ে চলে আসে তাঁর কাছে। তিনি সেই একই ভাবে মন্ত্র পড়ে বাঁ হাতের তালুতে কয়েক ফোঁটা ডাবের জল নিয়ে বাকি জলটা উপুড় করে ঢেলে দেন কুয়োয়। তার পর তালুতে ঢালা জলটা ছিটিয়ে দেন তার মুখে, ব্যস।
শুধু এ গ্রামেই নয়, আশপাশের সব গ্রামে তো বটেই, বহু দূরে দূরেও ছড়িয়ে পড়ল এ খবর। প্রথম প্রথম শনি-মঙ্গলবার, অমাবস্যা পূর্ণিমায় উনি বসতেন। এখন প্রত্যেক দিন এত ভিড় হচ্ছে যে, সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। রোজই বসতে হচ্ছে। নিজের জন্য আর সময় পাচ্ছেন না তিনি। তাই সকাল আর সন্ধ্যায় টাইম বেঁধে দিয়েছেন। এত ডাব লাগছে যে, এলাকায় আর কোনও গাছে ডাব নেই। মুচি হতে না-হতেই ডাব বাবার কাছে চলে আসছে। আমদানি করতে হচ্ছে বাইরে থেকে। সেগুলোরও দাম আকাশছোঁয়া।
লোকেরা বলছে, এমনি রোগ তো কোন ছার, ডাক্তার-কবিরাজ ফেল পড়ে গেছে, সে রোগও ভাল হয়ে যাচ্ছে। ডাক্তার জবাব দিয়ে দেওয়া মৃত্যুপথযাত্রীও এখানকার মন্ত্রপূত ডাবের জলের ছিটে নেওয়ার পরেই ব্লাড টেস্ট, এক্সরে, আলট্রাসোনোগ্রাফি, এমনকী বায়োপসি করেও দেখেছে, ক'দিন আগে টেস্ট করা রিপোর্টের সঙ্গে কিছুই মিলছে না। সব কিছুই নাকি ঠিকঠাক আছে। পুরো সুস্থ। নতুন রিপোর্ট দেখে ডাক্তাররাও থ। অনেকেই বলছে, এখানে যখন কোনও চাকরিপ্রার্থীর মুখে ডাব বাবা ডাবের জলের ছিটে দেন, তখন নাকি কোনও না কোনও কোম্পানিতে তার নামে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার লেখা হতে থাকে। কেউ কেউ বলে, এখানকার ডাবের জলের ছিটেয় নাকি ভাঙা সংসার শুধু জোড়াই লাগে না, সুখে-শান্তিতে ভরে ওঠে।
কাজের মাসি এ সব গল্প করলেও অহিতাগ্নির যেন কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। আজকের দিনে আবার এ রকম হয় নাকি! তাই ডাব বাবার কেরামতি দেখার জন্য সে উসখু্স করতে লাগল। কী ভাবে ডাব বাবার কাছে যাওয়া যায়! কাজের মাসির কাছে বলতেই, তাঁর ধর্মভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে সেই গ্রামে যাওয়া এবং থাকার সব ব্যবস্থা করে দিলেন তিনি। সেই সুবাদেই তার এখানে আসা।

ফাঁকা ধু ধু মাঠ। যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। হু হু করে হাওয়া দিচ্ছে। তালগাছের শুকনো পাতা একটার সঙ্গে একটার ঘষা লেগে খড়খড় খড়খড় আওয়াজ হচ্ছে। উড়তে উড়তে ডাক দিয়ে যাচ্ছে এক-আধটা নাম না জানা পাখি। আলপথের দু'ধারে সদ্য ধান কাটা মাঠে ঘুঘুপাখিরা কী যেন খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। ক'হাত দূর দূর এ পাশে ও পাশে ছোট ছোট ডোবা। হঠাৎই এ পাশ থেকে আলপথের ও পাশে এঁকেবেঁকে চলে গেল মস্ত বড় একটা দাঁড়াশ সাপ।
কতটা এসেছে সে, খেয়াল নেই। দূর থেকেই চোখে পড়ল ডাবের পাহাড়। এখানে এত ডাব আসবে কোত্থেকে! না, ওগুলো নিশ্চয়ই ডাব নয়। ডাবের খোল। তার মানে সে ঠিক জায়গাতেই এসে পড়েছে। হ্যাঁ, ওই তো সেই চালাঘর। যে চালাঘরের কথা সে তার কাজের মাসির কাছে শুনেছিল। পায়ে পায়ে কাছে গিয়ে দেখে, চালাঘরের দরজা হাট করে খোলা। ও সেখানে উঁকি মেরে দেখে, ভিতরে একটা চৌকির ওপরে একজন প্রৌঢ় বসে আছেন। ওর বুঝতে অসুবিধা হল না, এই-ই সেই ডাব বাবা। ও মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, ভেতরে আসব বাবা?
--- কে?
--- আমি।
--- আমি কে?
--- অহিতাগ্নি।
--- অহিতাগ্নি কী?
--- পুরকায়েত
--- কী চাই?
--- আপনার সঙ্গে একটু দরকার ছিল।
---আমি এ সময় কারও সঙ্গে কথা বলি না। এখন আমার বিশ্রামের সময়। সন্ধের পরে কিংবা কাল সকালে এসো।
--- আমি বহু দূর থেকে এসেছি বাবা।
--- তো? আমি কী করব?
--- রোদের মধ্যে অনেকটা পথ হেঁটে এসেছি বাবা, ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে। একটু জল পাওয়া যাবে?
--- জল? জল তো আমি খাই না।
--- তা হলে কী খান?
--- ডাবের জল।
--- তাই-ই দিন।
--- ঠিক আছে, দাঁড়া। বলেই, খাটের ও দিকে একটু ঝুঁকে নীচ থেকে একটা ডাব বার করে আনলেন তিনি। মুখটা কাটা। চামচের পেছনের দিকটা গায়ের জোরে গেঁথে দিয়ে এক পাক ঘোরাতেই খানিকটা চলটা উঠে এল। তার পর ডাবটা অহিতাগ্নির দিকে এগিয়ে দিলেন তিনি। অহিতাগ্নি বলল, দিলেনই যখন, একটু মন্ত্র পড়ে দিন না...
--- মন্ত্র? ও বুঝেছি। তুইও নিশ্চয়ই কোনও মনোবাঞ্ছা নিয়ে এসেছিস, না?
--- আপনার কাছে কী আর লুকোবো বাবা? আপনি তো অন্তর্যামী।
--- আমি কেউ নই রে, আমি কেউ নই। সব তেনারা...
তেনারা! বড় খটকা লাগল অহিতাগ্নির। তেনারা আবার কী! লোকেরা তো বললে বলে, আমি কেউ নই রে, সব তিনি। তিনি মানে ঈশ্বর। দেবতা। ভগবান। আর ভূত-পেত্নীর গল্প পড়তে পড়তে ও যতটা জেনেছ, তাতে তো তেনারা মানে--- ভূত। তবে কি ওনার যা ক্ষমতা, তার মূলে রয়েছে ভূত! সবটাই ভৌতিক!
মাথার মধ্যে হাজার রকম প্রশ্ন জট পাকাতে লাগল অহিতাগ্নির। কী জট, ডাব বাবা জানেন না। তিনি বললেন, আশা করে যখন এসেছিস, চল বেটা, চল।তোর মুখে যখন ডাবের জল ছেঁটাব, তুই যা চাস, সেটা মনে মনে চাইবি, কেমন? তা হলেই হবে। চল বেটা, চল।
ঘর থেকে বেরিয়েই ডান হাতে কুয়ো। বুক অবধি পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। তার সামনে দাঁড়িয়ে ডাবের কাটা মুখের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে কী সব বললেন ডাব বাবা। তার পরে কাত করে বাঁ হাতের তালুতে কয়েক ফোঁটা ডাবের জল নিয়ে, বাকি জলটা উপুড় করে ঢেলে দিলেন কুয়োয়। খালি খোলটা পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে জমে থাকা খোলগুলোর দিকে ছুড়ে ফেললেন। তার পরে অহিতাগ্নির মুখে জলের ছিটে দিতেই অহিতাগ্নি মনে মনে বলল, কুয়োয় নামার পরে এমন কী ঘটেছিল যে, একজন অতি সাধারণ ছাপোষা মানুষ রাঘব থেকে ডাব বাবা হয়ে উঠলেন, সেটা আমার এক্ষুনি জানতে ইচ্ছে করছে বাবা।
ডাব বাবা ওর মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললেন, আয়, ভেতরে আয়। বলে, নড়বড়ে একটা টুল এগিয়ে দিলেন তিনি। বললেন, বস। ও তাতে বসল। উনি উঠে গেলেন চৌকির ওপরে। আসনপিঁড়ি হয়ে বসে দু'মিনিট চোখ বন্ধ করে বললেন, এতই যখন জানার ইচ্ছে তা হলে শোন--- সে দিন কুয়োর দেয়ালের খাঁজে পা রেখে রেখে নামছি। বুঝতে পারিনি নীচের দিকের দেয়ালে এত শ্যাওলা ছিল। হঠাৎ পা হড়কে পড়ে গেলাম নীচে। ছপাৎ করে উঠল জল। কোমরে খুব জোর লাগল। বুঝতে পারলাম, এই কুয়োর জল তলানিতে এসে ঠেকেছে। দাঁড়িয়ে দেখি, হাঁটুর নীচে জল। মাথার উপরে তখন চিঁ চিঁ করে ডানা ঝাপটাচ্ছে ঝাঁক ঝাঁক চামচিকে। একেতেই অন্ধকার। যেটুকু আলোর রেশ আসছিল, সেটুকুও ওদের ডানায় ঢেকে গেল। তারই মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে যখন ওই লোকটার পেতলের বালতিটা খুঁজছি, কে যেন নাকি সুরে বলে উঠল, বাঁলতি নিঁচ্ছ নাঁও। জঁল কিঁন্তু এঁক ফোঁটাও নিঁও নাঁ।
আমি ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করি না। মুহূর্তের জন্য মনে হল, কেউ বুঝি মস্করা করছে। কিন্তু তার পরেই আবার মনে হল, এখানে, এই কুয়োর মধ্যে মস্করা করতে আসবে কে! তাই বললাম, কুয়ো থেকে লোকে জল নেবে না তো কি মণিমাণিক্য নেবে?
ফের সেই গলা নাকি সুরে বলল, কেঁন? নিঁলে অঁপরাঁধ কোঁথায়? মঁণি-মাঁণিক্য যাঁ চাঁও দিঁতে পাঁরি। কিঁন্তু বাঁপু, এঁক ফোঁটাও জঁল দিঁতে পাঁরব নাঁ। আঁমাদেঁর এঁখানে এইঁটুকুঁনিই আঁছে।
--- তার মানে তোমাদের এখানেও জলের অভাব?
--- অঁভাব মাঁনে? মঁহাঅঁভাব। কেঁউ যঁদি আঁমাদেঁর এঁক কাঁপ কঁরেও রোঁজ জঁল দেয়, তাঁ হঁলে তাঁকে আঁমরা সোঁনাদাঁনা দিঁয়ে মুঁড়ে রাঁখতে পাঁরি।
--- সোনা দিয়ে? চমকে উঠলাম আমি। হঠাৎ আর একটি গলা পাশ দিয়ে বলে উঠল, শুঁধু সোঁনা কেঁন? সোঁনাদাঁনা হিঁরে-জঁহরঁত মঁণিমাঁণিক্য যাঁ চাঁইবে, তাঁই দিঁতে পাঁরি। আঁমাদেঁর শুঁধু এঁকটু জঁলের ব্যঁবস্থা কঁরে দাঁও। জঁলের জঁন্য আঁমাদেঁর বুঁক শুঁকিয়ে যাঁচ্ছে। গঁলা শুঁকিয়ে যাঁচ্ছে। জিঁভ শুঁকিয়ে কাঁঠ। জাঁনি নাঁ, আঁর কঁ'দিঁন পঁরে কীঁ হঁবে...
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই আর একটি গলা ভেসে এল, সেঁ এঁকবাঁর খেঁয়েছিঁলাম বঁটে, ডাঁবের জঁল। আঁমার মাঁসতুঁতো বোঁনপো থাঁকত ডাঁব গাঁছের মাঁথায়। আঁমাদেঁর এঁখানে বেঁড়াতে আঁসার সঁময় কঁ'টা ডাঁব নিঁয়ে এঁসেছিঁল। আঁহা, কীঁ তাঁর স্বাঁদ! কীঁ তাঁর গঁন্ধ! এঁখনও যেঁন জিঁভে লেঁগে আঁছে।
--- ডাবের জল! হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। যে ভাবে গ্রামেগঞ্জেও পলিউশন ছড়িয়েছে, তাতে ওটাই এখন একমাত্র পরিশুদ্ধ জল।
--- নাঁ নাঁ নাঁ। সেঁ আঁগে ছিঁল। আঁজ থেঁকে কঁয়েক দঁশক আঁগেও ছিঁল। কিঁন্তু তোঁমাদেঁর মোঁবাইঁল আঁর ইঁন্টারনেঁটের ঠেঁলায় সেঁটাও গেঁছে। আঁগের মঁতো সঁবুজ মঁসৃণ গাঁ-ওঁয়ালা ডাঁব কিঁ আঁর এঁকটাঁও দেঁখতে পাঁও? দেঁখবে, মাঁথা কুঁটলেঁও পাঁবে নাঁ। সঁব কঁ'টার গাঁয়েই কেঁমন জ্বঁলে যাঁওয়া পোঁড়া পোঁড়া দাঁগ।
--- হ্যাঁ, তাই তো!
--- তঁবু, ওঁটা মঁন্দের ভাঁল। ওঁই জঁল যঁদি দিঁতে পাঁরো, তাঁ হঁলে তুঁমি যাঁ চাঁইবে, সঁব দেঁবো। সঁব।
আমি বললাম, সব নিয়ে আমি কী করব! আমার তো ছেলেপুলে নেই। সংসার বলতে আমি আর আমার মা। দুজনের জন্য আর কত কী লাগে! কথা শেষ হল না। আবার সেই নাকি সুরে কথা ভেসে এল, কেঁন? তোঁমার গাঁয়ের লোঁকেরা বুঁঝি তোঁমার আঁপনজঁন নঁয়? প্রিঁয় লোঁক নঁয়?
আমি বললাম, কিন্তু তাদের জন্য আমি কী করতে পারি?
--- যাঁরা রোঁগে ভোঁগে তাঁদের রোঁগ দূঁর কঁরতে পাঁরো। যাঁদের অঁভাব অঁনটঁন আঁছে, তাঁদের অঁভাব মেঁটাতে পাঁরো। যাঁরা দুঁঃখী, তাঁদের মুঁখে হাঁসি ফোঁটাতে পাঁরো...
আরও অনেক কিছু বলে যাচ্ছিল ওরা। আমি বললাম, কী ভাবে?
তখন ওদের মধ্যে থেকেই একজন বলল, এঁকটা কাঁজ কঁরো, যাঁরা তোঁমার কাঁছে সঁমস্যা নিঁয়ে আঁসবে, তুঁমি তাঁদের এঁকটা কঁরে ডাঁব আঁনতে বঁলবে। সেঁই ডাঁবের মুঁখ কেঁটে, তাঁর কাঁছে মুঁখ নিঁয়ে তুঁমি শুঁধু এঁকটা মঁন্ত্রই উঁচ্চারণ করবে--- হেঁ ভূঁতরাঁজ, এঁ যাঁ চাঁয়, সেঁটা যেঁন পাঁয়। বঁলেই, ডাঁবের জঁলটা বাঁ হাঁতের তাঁলুতে দুঁ-তিঁন ফোঁটা ঢেঁলে নিঁয়ে বাঁকি জঁলটা আঁমাদেঁর কুঁয়োর উঁপরে উঁপুড় কঁরে ঠেঁলে দেঁবে। তাঁর পঁর বাঁ হাঁতের জঁলটা তাঁর মুঁখে ছিঁটিয়ে দেঁবে, ব্যঁস। তাঁ হঁলে তুঁমিও তোঁমার প্রঁতিবেঁশী, আঁত্মীঁয়স্বঁজনদেঁর সেঁবা কঁরতে পাঁরবে আঁর আঁমরাঁও ডাঁবের জঁল পেঁয়ে তৃঁপ্ত হঁব... বলেই, উধাও হয়ে গেল ওরা। বালতি তুলতে গিয়ে দেখি, সোনাদানা, হিরে-জহরতে ভর্তি। ওরা ভালবেসে দিয়েছে। আমি তো ফেলে দিতে পারি না। তাই নিয়ে নিলাম। আসার সময় ওদের কাউকে দেখতে পেলাম না। তবু ওদের শুনিয়েই চিৎকার করে বলে এলাম, যা দিয়েছ, দিয়েছ। আমাকে আর কখনও এ সব দিয়ো না। তোমরা যে মন্ত্র আজকে আমাকে দিলে, তা যদি সত্যিই কাজ করে, তা হলে গোটা পৃথিবীর সব ধনরত্ন এক জায়গায় জড়ো করলেও তার কাছে নস্যি হয়ে যাবে...
--- সেই হিরে-জহরতগুলো কোথায়?
--- ওগুলো দিয়ে আমি কী করব! তা ছাড়া ওগুলো বাড়িতে থাকলে সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে। কখন চোর আসে! ডাকাত আসে! দু'দণ্ডের জন্যও নিশ্চিন্ত হতে পারব না। তাই পর দিন খুব ভোরে কাক-পক্ষী ওঠার আগেই আমি ওগুলো সেই কুয়োতেই ফেলে দিয়ে এসেছিলাম। যাতে কেউ টের না পায়। পেলেই গণ্ডগোল। ফেলার পরে সে কী শান্তি!
--- তার পর?
--- তার আবার পর কী? ওই ভাবেই চলছে।
--- আর কত দিন চলবে?
মাথা নামিয়ে ধীরে ধীরে ডাব বাবা বললেন, আর একদিনও নয়। আজই সব শেষ হয়ে গেল।
--- সব শেষ হয়ে গেল মানে?
--- ওরা বলেছিল, এই ঘটনাটা আমি যেন কাউকে কোনও দিন না বলি। বললেই নাকি আমার এই মন্ত্রের গুণ সঙ্গে সঙ্গে নষ্ট হয়ে যাবে।
--- তা হলে বললেন কেন?
--- কোনও উপায় ছিল না।
--- মানে?
--- ওদের সঙ্গে কথা হয়েছিল, আমি যখন ডাবের কাটা মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলব, হে ভুতরাজ, এ যা চায়, সেটা যেন পায়। তার পর ডাবের জল কুয়োয় ঢেলেই যার মুখের উপরে বাঁ হাতের তালুতে রাখা ডাবের জলটা ছিটিয়ে দেব, সে তখন মনে মনে যা চাইবে, তা-ই পাবে। এমনকী, আমার মৃত্যু কামনা করলে, আমার মৃত্যুই ঘটবে। আর তুমি তো জানতে চেয়েছিলে, কুয়োয় নামার পরে এমন কী ঘটেছিল যে, একজন অতি সাধারণ ছাপোষা মানুষ রাঘব থেকে ডাব বাবা হয়ে উঠলেন। তাই না? ফলে বলতে বাধ্য হলাম।
--- তা হলে এখন কী হবে?
--- ও কুয়োয় শুধু ডাবের জল কেন? ঝর্নার জল, তালশাঁসের জল, মিছরির জল, এমনকী ঘড়া ঘড়া লস্যি ঢাললেও আর কোনও দিনই কোনও কাজ হবে না। আমাকে মেরে ফেললেও না। তোমাকে বলার সঙ্গে সঙ্গেই আমার যাবতীয় কেরামতি নষ্ট হয়ে গেছে...
কথাগুলো বলার সময় ছলছল করে উঠল ডাব বাবার চোখ। এ রকম যে হতে পারে, তা কল্পনাও করতে পারেনি অহিতাগ্নি। একদম বাকরুদ্ধ হয়ে গেল সে। মনে মনে বলল, এ আমি কী করলাম! এ আমি কী করলাম!


সিদ্ধার্থ সিংহ
কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top