সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

অন্য রূপে : সংঘমিত্রা রায়


প্রকাশিত:
৩ ডিসেম্বর ২০২১ ০৪:৫৬

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ০৭:৩০

 

একঃ

এমন একটা জায়গায় গাড়িটা খারাপ হবে ভাবেননি শিবনাথ। রাত প্রায় দেড়টা হবে। চারপাশে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার, খুব ঠান্ডা বাতাস বইছে, বৃষ্টিও কয়েক ফোঁটা পড়ে গেছে। এখনই হয়ত ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি নামবে। চারপাশে শুধু নিশাচররা ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের বিভিন্ন আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। একে তো বাজে রাস্তা, তার উপর আশেপাশে কোনো বাড়িঘরও নেই। কেমন যেন একটা ভুতুড়ে পরিবেশ মনে হচ্ছে।
কলকাতা থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে বোনের বাড়িতে একটা অনুষ্ঠানে মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে গিয়েছিলেন অধ্যাপক শিবনাথ গাঙ্গুলী। উনার বয়স চুয়ান্ন, পঞ্চান্ন হবে।নিজের গাড়ি, নিজেই ড্রাইভ করে গিয়েছিলেন। এত রাতে আসতে ওখানকার সবাই বারণ করেছিল। কিন্তু শ্রেয়া রাজী হয়নি। কাল মহালয়া সকালবেলা বন্ধুদের সঙ্গে বেড়ানোর অনেক প্ল্যান করেছে সে। কিন্তু মাঝরাস্তায় গাড়ি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় হয়তো কিছুই আর হবে না। টেনশনে শ্রেয়া, শিবনাথবাবু দুজনেই গাড়ি থেকে নেমে এলেন। স্বাগতা দেবী গাড়ির ভিতরে বসে আছেন। তার খুব ঘুম পেয়েছে।
"এবার কি হবে বাবা, গাড়িটা ঠিক করার জন্য এতো রাতে কাকে পাব ?"- শ্রেয়া বলল।
"কি করব রে মা বুঝতে পারছি না।এমন একটা জায়গায় গাড়িটা নষ্ট হল, এতো রাতে কাউকে পাব বলে মনে হচ্ছে না।"
"তাহলে কি হবে এবার?"
"দেখি আমি একবার চেষ্টা করে। যদি কিছু করতে পারি।"
"দেখ তাড়াতাড়ি। এই ভুতুড়ে জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে ভীষণ ভয় করছে।"
"কি হল ? গাড়ি ঠিক হয়েছে । তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে ঘুমিয়ে পরব। বড্ড ঘুম পেয়েছ।" গাড়ির ভিতর থেকে স্বাগতা দেবী বললেন ।
"তুমি এখানেই ঘুমিয়ে পড়। তোমার জীবনে খাওয়া আর ঘুম ছাড়া আর কি আছে। এমন পরিস্থিতিতে উনার ঘুম আসছে। তোর মাকে একবার দেখ মামনি। ভগবান কি দিয়ে যে গড়েছিলেন এই মহিলাকে !" - রাগের সুরে শিবনাথ বাবু বললেন।
"চুপ কর। তোমার কারণেই এমনটা হয়েছে। বারবার বলেছি ড্রাইভারকে নিয়ে আস, না উনি নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করবেন।"
"কেন ড্রাইভার আসলে কি গাড়ি খারাপ হতো না ? আজব কথা।"
"ঝগড়া থামাও তোমরা ! ঔ দেখ বাবা একটা লোক আসছে মনে হচ্ছে। তার কাছ থেকে হয়ত কিছু জানা যাবে।"
যে লোকটা আসছে সে সম্ভবতঃ মাতাল। দূর থেকেই দেশী মদের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। এলোমেলো ভাবে এক লাইন গান গাইছে।
"মন তোর এতো ভাবনা কেনে।"
লোকটা সামনে আসতেই শিবনাথ বাবু বললেন, "দাদা এখানে কোন গ্যারেজ পাওয়া যাবে ?"
লোকটা একটু সময় শিবনাথ বাবুর দিকে তাকিয়ে রইল। গাড়ির আলোতে দেখা গেল লোকটার কাপড়ে কাদা মাখা। এত মদ খেয়েছে ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছে না। টলতে টলতে বলল, "গেরেইজ এই গেরামে কই পাইবেন। বিষ্টি অখনই নামব। একখান ভূতের বাড়ি আছে। ওখানেই রাতটা কাটাইয়া লন। সকালে সামনের বাজারে মেকানিকস পাইয়া যাইবেন। আমি যাই। বউটা আমার পথ চাইয়া বইসা আছে।"
"বাড়িটা কোথায় দাদা ?"
"রাস্তার ডাইনদিকে একটু হাটলেই একখান বাড়ি পাইবেন। দেখেন ভূত আপনারে সাহায্য করে কিনা। আমি এখন চলি।"
লোকটা গান গাইতে গাইতে চলে যায়।
শিবনাথবাবু শ্রেয়াকে বললেন, "চল রে মা। দেখি ঔ বাড়িতে গিয়ে, কেউ যদি একটু জায়গা দেয়।"
"তাই চল। বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে গেছে ।"
"তোমাদের কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। লোকটা কি বলে গেল শুনলে না। ওটা একটা ভুতুড়ে বাড়ি। ওখানে তোমরা যাবে।" - গাড়ি থেকে স্বাগতা দেবী বললেন।
"তুমি গাড়িতেই ঘুমিয়ে থাক। আমরা ভূতের বাড়িতেই যাচ্ছি। ভুত বলে কিছু আছে নাকি !"
কোন উপায় না দেখে স্বাগতা দেবী গাড়ি থেকে বেরিয়ে ওদের পিছু পিছু হাঁটতে লাগলেন ।
মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে একটু হাঁটতেই বাড়িটার কাছে চলে এলেন তারা।

দুইঃ

বাড়িটা বেশ বড় মনে হচ্ছে । কিন্তু কারো কোন সাড়া শব্দ নেই। কোন আলোও নেই। তাহলে কি সত্যিই এটা ভুতুড়ে বাড়ি !
শিবনাথ বাবু বলতে লাগলেন, "কেউ আছেন নাকি ! একটু আশ্রয় দেবেন। বড় বিপদে পড়েছি।"
কোন সাড়া শব্দ নেই ।
শ্রেয়া এবার বলল, "আমাদের ভয় পাবেন না। আমরা খারাপ মানুষ নই।"

"ঔ দেখ বাবা একটা আলো নিয়ে কে যেন আসছে !"
"একেবারে ভূতের সিনেমার মতো। ভুত নয় তো। রাম রাম রাম রাম রাম
"চুপ করো তো মা। দেখি কে আসছে।"
একটা লণ্টন হাতে নিয়ে নিয়ে একজন মহিলা এসে দাঁড়াল। মুখ ভালো করে দেখা যাচ্ছে না।
"কি ব্যাপার ? আপনারা কি কোন বিপদে পড়েছেন ?"
"দেখ আমাদের বিপদের কথা জেনে বসে আছে । এ নিশ্চয় ভুত !"
"ভুত নই দিদি। বিপদে না পড়লে কেউ এতো রাতে এখানে আসে।"
শিবনাথ বাবু বললেন, "হ্যাঁ দিদি । রাস্তায় গাড়িটা খারাপ হয়ে গেছে। কলকাতায় বাড়ি আমাদের। এতো রাতে দুজন মেয়ে মানুষকে নিয়ে কোথায় যাব বলুন।"
"আসুন আমার সঙ্গে।"
মহিলার পিছু পিছু তিনজনই কয়েকটা ঘর পেরিয়ে একটা ঘরে গেলেন। ঘরটা বেশ বড়। কিন্তু আসবাবপত্র কিছুই নেই। একটা চৌকির উপর মাদুর বিছিয়ে মহিলা বললেন, "শুধু বালিশ দিয়ে দিচ্ছি। এখানেই কষ্ট করে রাতটা কাটিয়ে নিন। খাওয়ার জন্য কিছু দিতে পারব না।"
"আমরা খেয়ে এসেছি। শুধু রাতটুকু থাকার জায়গা পেয়েছি তার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।"
"আচ্ছা আমি তাহলে আসি।"
লণ্ঠনটা রেখে মহিলা চলে গেলেন। তিনজনই ক্লান্ত। তাই ঘুমে চোখ জড়িয়ে এল।

সকালে তাদের ঘুম ভাঙল বাচ্চাদের সমবেত কণ্ঠে দুর্গা বন্দনা শুনতে শুনতে। এমন একটা জায়গায় এতো সকালে দূর্গা বন্দনা কারা গাইছে।
ঘর থেকে বাইরে বের হলেন শিবনাথ বাবু, সঙ্গে শ্রেয়াও। স্বাগতা দেবী তখনও ঘুমাচ্ছেন।
বাড়িটা বেশ বড়। পর পর অনেকগুলো বড় বড় ঘর। বড় উঠোন, চারপাশে প্রচুর জায়গা আর ছোট বড় গাছ আছে বাড়িটাতে। তবে বাড়িটা অনেক পুরানো ।ঘরের দেওয়ালে শেওলা পড়ে আছে, মেঝের অনেক জায়গায় ছোট ছোট ফাটল ধরেছে। জানালা-দরজা গুলো নড়বড়ে। একদিকে টিনের একটা ঘর বাকিগুলো ছাদ ঢালাই করা। টিনের চালে অজস্র ছিদ্র দেখা যাচ্ছে।
একটা ঘরের বারান্দায় বসে কতকগুলো বাচ্চা দুর্গা বন্দনা গাইছে। তাদের সঙ্গে কাল রাতের মহিলাও গাইছেন।

দূর্গে দূর্গে দুর্গতিনাশিনী
মহিষাসুর মর্দিনী জয় মা দূর্গে।
দূর্গে দুর্গে দুর্গতিনশিনী
মহিষাসুর মর্দিনী জয় মা দূর্গে।।

দেবী দূর্গে জগত জননী
তুমি মা মঙ্গলকারিনী ।
দেবী দূর্গে জগত জননী
তুমি মা মঙ্গলাকারিনী।।

দূর্গে দূর্গে ...............

দশভুজা দশশস্ত্রশালিনী
মধুকৈটভ সংহারানী।
দশভুজা দশশস্ত্রশালিনী
মধুকৈটভ সংহারিনী ।।
অদ্বিতীয়া তুমি অনন্যা
অদ্বিতীয়া তুমি অনন্যা
ভবানী মা দুঃখাহারিনী।
দূর্গে দূর্গে ...................

অসাধারণ ! কি সুন্দর গাইছে ওরা। একটা শব্দও উচ্চারণে ভুল নেই।
শ্রেয়া, শিবনাথ বাবু এগিয়ে গেলেন। তখন প্রায় ওদের দুর্গা বন্দনা গাওয়া শেষ।
"কি সুন্দর দুর্গা বন্দনা গাইল আপনার বাড়ির বাচ্চাগুলো ! কে শেখাল ওদের এই বন্দনা গাওয়া ?" শিবনাথ বাবু বললেন।
"আমি। আপনারা উঠে গেছেন। রাতে খুব কষ্ট হয়েছে আপনাদের।"
"না না একি বলছেন। এত রাতে একটা অচেনা জায়গায় একটু আশ্রয় পেয়েছি তার জন্য সারাজীবন আমরা আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। আপনার বাড়ির লোকজনেরা কোথায় ? তাদের সঙ্গে আলাপ হল না।"
"এ বাড়িতে আমি আর এই বাচ্চাগুলো ছাড়া আর কেউ থাকে না। আজ মহালয়া। ওদের আমি টিভিতে বা রেডিওতে মহালয়া দেখাতে বা শুনাতে পারিনি। তাই ওদের দুর্গা বন্দনা শিখিয়ে দিয়েছি। ওরা তাই গাইছিল আপনারা বসুন। আমি চা নিয়ে আসি।"
মহিলার বয়স পঞ্চাশ এর কাছাকাছি। গায়ের রং ফর্সা তবে এখন অনেকটাই ঝলসে গেছে। মাথায় কাঁচাপাকা চুল, উচ্চতা শরীর মাঝারি গোছের। কিন্তু মুখে শরীরে অনেকগুলো আঘাতের চিহ্ন।
মহিলা ভিতরে চলে গেলে শ্রেয়া বলল, "বাবা এই মহিলাকে কোথায় যেন দেখেছি। আশ্চর্য ব্যাপার এত বড় বাড়িতে বাচ্চাগুলোকে নিয়ে মহিলা থাকেন। আশেপাশে বাড়ি ও নেই। অন্য বাড়িগুলো বেশ দূরে দূরে। এটা কি কোন আশ্রম। কেমন যেন রহস্যময় !"
"আমারও তাই মনে হচ্ছে। মহিলাকে আমিও যেন কোথায় দেখেছি।"
"খবরের কাগজে দেখেছেন।" দুটো কাঁচের গ্লাসে লিকার চা আর দুবাটি মুড়ি নিয়ে এসে মহিলা বললেন।
"ঠিক বলেছেন খবরের কাগজেই দেখেছিলাম। কিন্তু কেন বলুন তো !"
"চোর-ডাকাত কিছু কিছুই আমি নই। কয়েক বছর আগে ডাইনির অভিযোগে এক মহিলাকে গ্রামবাসীরা পুড়িয়ে মেরেছিল সেই মহিলা হলাম আমি। "
"হ্যাঁ মনে পড়ছে। বর্ধমান এর একটা গ্রামের ঘটনা খবরের কাগজে পড়েছিলাম। কিন্তু আপনি এখানে এলেন কি করে।"
"সে অনেক কথা। এসব শুনে কি করবেন ভাই আপনি।"
"ভাই বললেন আর ভাইকে নিজের জীবনের কথা বলতে পারবেন না বোন।"
"একটু বসুন দাদা। আমি বাচ্চাগুলোকে মুড়ি দিয়ে আসছি। আপনারা চা খান।"
দুজনে চা - মুড়ি খেতে লাগলেন। একটু পরে মহিলা চলে এলেন। শিবনাথ বাবু বললেন, "এবার বলুন আপনার জীবনের কথা।"
"বর্ধমানের একটা গ্রামে আমার শ্বশুরবাড়ি। আমার স্বামী ওরা দুই ভাই। ওদের প্রচুর সম্পত্তি ছিল। আমাদের কোন সন্তান নেই। আমার দেওরের আমাদের সম্পত্তির লোভ ছিল। প্রায়ই আমার স্বামীকে নানা বিষয়ে জ্বালাত সে। এরপর একদিন আমার স্বামী দুর্ঘটনায় মারা যান। আমার দেওর চারদিকে রটাতে থাকে আমি ডাইনি। তাই আমার বরকে খেয়েছি। এতে আমার একমাত্র ভাইও যোগ দিয়েছিল। আমার মা-বাবা, শ্বশুর-শাশুড়ি কেউ তখন বেঁচেছিলেন না। আমার ভাই আর দেবর মিলে আমাকে মারধোর করত। ভয়ে কিছু বলতাম না। চারদিকে নানা আজব ঘটনা ঘটাতে থাকে তারা। আর রটাতে থাকে ডাইনিকে গ্রাম ছাড়া না করলে গ্রামের খুব বিপদ হবে। একদিন রাতে গ্রামবাসীরা আমাকে মেরে ফেলার জন্য আমার ঘরে আগুন ধরিয়ে দিল। এক পুরানো চাকর হরিপদর সাহায্যে আমি আমার দশভরি সোনা নিয়ে কোন রকমে পালিয়ে এসেছিলাম।"
মহিলা একটু থামলেন। কথা বলতে বলতে কেমন যেন বিধ্বস্ত লাগছে তাকে।
শ্রেয়া বলল, "আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে ?"
"না না আমি ঠিক আছি । যখন আমার ঘর আগুনে পড়ছিল তখন আমি দুরে দাড়িয়ে একটা গাছের আড়াল থেকে দেখছিলাম আমার স্বামীর সব স্বপ্ন, স্মৃতি, আমার সাধের ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে।কেউ একফোঁটা জল ফেলছে না আগুন নেভানোর জন্য। বরং তার উল্টোটা হচ্ছে ওখানে। সারা গ্রামের পুরুষ-মহিলারা আনন্দে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে আমার ঘরের চারপাশে নাচছে ;সঙ্গে আমার দেবর আর ভাইও আছে ।ডাইনিকে মারতে পেরে সবাই খুব খুশি।"
"তারপর কি হল বোন? "শিবনাথ বাবু বললেন।
"তারপর পাগল সেজে কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছি বেশ কয়েকমাস ।সারাক্ষণ কালিঝুলি মেখে ছেড়া কাপড় পরে ঘুরে বেড়াতাম। সঙ্গে একটা বড় কাপড়ের পুঁটলি থাকত যাতে আমার সোনাগুলো ছিল। পাগল হওয়ার জন্য কেউ আমাকে খেয়াল করেনি। এরপর একদিন বস্তিতে আমার একজনের সঙ্গে দেখা হল। লোকটা ভবঘুরে ।আসানসোলে বাড়ি ছিল। মা, বাবা আর বউ নিয়ে তাঁর সংসার ছিল। হঠাৎ দু মাসের ব্যবধানে তার মা-বাবা দুজনেই মারা যান। এর একবছর পর বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে উনার স্ত্রী, বাচ্চা মারা যায়। এরপর থেকে তিনি ভবঘুরে হয়ে গেছেন। বাড়ি, ব্যবসা সব বিক্রি করে সব টাকা ব্যাঙ্কে রেখে দেন।"
"তারপর কি হল ?"
"একদিন বৃষ্টি পড়ছিল। উনি কলকাতার বস্তির একটা ভাঙা ঘরে কয়েকটা অনাথ বাচ্চাকে বেশ যত্ন করে পড়াচ্ছিলেন। আমি ঔ ঘরটার বারান্দায় বসেছিলাম।
হঠাৎ উনি বলে উঠলেন, তুমি তো পাগল নও ।পাগল সেজে কেন নিজেকে আড়ালে রাখছ।
আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে বললাম, না না আমি পাগল। আপনি মিথ্যে বলছেন।
উনি হেসে উঠলেন। বললেন, আমি তোমাকে চিনি। আমি একা, তুমিও একা আমাদের পিছনে দেখার মতো কিছু নেই। এই বাচ্চাগুলোও অনাথ। আমরা দুজনে মিলে যদি এই বাচ্চাগুলোর দায়িত্ব নেই তাহলে হয়ত এরা বেচে যাবে। যদি এদের নিজের সন্তান মনে করি তাহলে এরা মা-বাবা পেয়ে যাবে আর আমাদেরও নিঃসন্তান হওয়ার দুঃখ ও যাবে।'
আমার সম্পর্কে আপনি এতো কিছু জানলেন কি করে ?
হরিপদকে আমি চিনি। সে তোমার একটা ফটো আমাকে দিয়েছিল আর সবকিছু বলেছিল। তাই আজ তোমায় খুঁজে পেলাম।"
এরপর থেকে আমি উনার সঙ্গে থাকি। উনার নাম অরূপরতন সরকার ।আমার নাম অপর্ণা চৌধুরী।
দেখতে দেখতে প্রায় ত্রিশটি বাচ্চার দায়িত্ব আমরা নিয়েছিলাম। এদের মধ্যে কয়েকজন প্রতিবন্ধী। আমি আমার সব সোনা বিক্রি করে টাকা ব্যাঙ্কে রেখে দিই। উনার টাকা আর আমার টাকা দিয়েই বাচ্চাগুলোর খাওয়া পড়াশোনা চলছিল।"
"এখানে কিভাবে এলে ?"
"কলকাতায় এতগুলো বাচ্চার থাকার জন্য বড় জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল না। দু -এক জায়গা পেয়েছিলাম কিন্তু সেখানে ভাড়া অনেক। শেষে উনি এই এই বাড়ির সন্ধান পেলেন। এই বাড়িটা অনেক দিন থেকে খালি পড়ে আছে । এখানে কোন এক নিঃসন্তান দম্পতি নাকি একসঙ্গে আত্মহত্যা করেছিল। এরপর থেকে এই বাড়িতে কেউ থাকে না। এলাকার লোকেরা এই বাড়িকে 'ভূতের বাড়ি' বলে চেনে। এ দিকটায় কেউ খুব একটা আসে না। প্রায় পনেরো বছর হল আমারা এ বাড়িতে আছি। এখন সত্তর জন ছেলে-মেয়ে আছে। এই গ্রামের স্কুলেই তারা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করে। পড়াশোনার পাশাপাশি আমারা ওদের বিভিন্ন হাতের কাজও শিখাই। আমাদের অনেক ছেলে-মেয়ে এখন স্বাবলম্বী। কেউ চাকরি করছে, কেউ ব্যবসা করছে, কেউ আরও অন্য কোনো কাজ করছে। সব বাচ্চারা আমাকে 'মা 'বলে ডাকে আর অরূপবাবুকে 'বাবা 'বলে ডাকত।"
"অরূপবাবু কোথায় বোন ?"-শিবনাথ বাবু বললেন।
"দু মাস হল তিনি মারা গেছেন।"
"ও এখন তাহলে তুমিই আশ্রম চালাও?"
"হ্যাঁ "
"এতগুলো বাচ্চার খরচ চলে কিভাবে?"
"ব্যাঙ্কে আমাদের যে টাকা আছে সেখান থেকে টাকা তুলে আনি, মাঝে মাঝে কেউ টাকা দান করে, কোন এন, জি, ও থেকে আমাদের সাহায্য করে। তাছাড়া আমাদের বাচ্চারা পড়াশোনার পাশাপাশি খুব ভাল হাতের কাজও করে। আমি আর অরূপবাবু দুজনে মিলে ওদের নানা ধরনের কাজ শিখিয়েছি। এদের কেউ কেউ বাঁশ দিয়ে, কেউ মাটি দিয়ে, কেউ পাট দিয়ে নানা ধরনের জিনিস তৈরী করে। বড় মেয়েরা কিছুদিন হল কাঁথা সেলাই দিয়ে অনেক কিছু বানাচ্ছে। আমাদের ছেলে-মেয়েদের তৈরি জিনিস দেশের বিভিন্ন জায়গায় যায়। এসব থেকে ও আয় হয়।"

"এখানে তুমি আর বাচ্চাগুলো ছাড়া আর কে কে থাকে ?"
"রান্নার জন্য একজন আর বাজার করা, আরও কিছু কাজ করে আরেকজন ।ওরাও আমাদের মতোই। ওদেরও কেউ নেই ।চলুন দাদা আমাদের আশ্রম দেখবেন।"
"মামনি তুইও চল।"
একটা লম্বা বারান্দায় সব বাচ্চাগুলো পড়তে বসেছে ।কোন ঝামেলা নেই এদের মধ্যে ।বড়রা মাঝে মাঝে ছোটদের সাহায্য করছে ।বাচ্চাদের হাতের কাজ দেখে মুগ্ধ শিবনাথ বাবু, শ্রেয়া। ধন্যবাদ জানালেন তারা অপর্ণা দেবীকে ।
শিবনাথ বাবু বললেন, "আমি তোমার আশ্রমের জন্য দুই লাখ টাকা দান করব। আমার অধ্যাপক জীবনের এটাই প্রথম মহৎ কাজ। শুনেছিলাম মা দুর্গার অনেক রূপ। আজ মা দুর্গাকে অন্য রূপে দেখলাম।"

সমাপ্ত

 

সংঘমিত্রা রায়
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top