সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

‘বন্দি শিবির থেকে’ কাব্যগ্রন্থ : শামসুর রাহমানের যুদ্ধদিনের কড়চা : আবু আফজাল সালেহ


প্রকাশিত:
১৬ ডিসেম্বর ২০২১ ০৭:৫১

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ১৩:২১

 

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর, ১৯২৯--১৭ আগস্ট, ২০০৬) বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি। নতুন স্বপ্ন ও জাগরণের গল্প শুনি তাঁর কবিতায়। বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক সমস্ত গণআন্দোলন নিয়ে কলম ধরেছেন প্রকাশ্যে, কবিতার পরতে পরতে বিরুদ্ধচারীদের বিরুদ্ধে জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির মতো শব্দবর্ষণ। রক্তজবার মতো টুকটুকে লাল ও উজ্জ্বল উচ্চারণ তাঁর কবিতায়। তাঁর কবিতায় বাঙালি ও বাংলাদেশকে খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁর কবিতার প্রধান বিষয় ছিলো তাঁর সময়কার। সে সময়ের প্রবল প্রতিকূলতা ও বিষয় কবিতার উপাদান হয়ে ওঠে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সমগ্র পাকিস্তান আমলে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন-সংগ্রাম ইত্যাদি তাঁর কবিতার শব্দে যোগ হয়েছে। আবার প্রকাশিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের নানা সংকট ও গ্লানির চিত্র। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে তাঁর কবিতা ছিল সবাক, সংগ্রাম-মুখর।

১৯৬০ সালে শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়—‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’। প্রথম কাব্যগ্রন্থেই শামসুর রাহমানের মার্জিত ছন্দ ও চিত্রকল্পের উদ্ভাবন এদেশের কাব্য-আন্দোলনে অনুকূল সাড়া ফেলেছিল। এরপরে ‘বন্দী শিবির থেকে(১৯৭২)’ কাব্যগন্থ। এ কাব্যের কবিতাগুলোতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন অবস্থা, আবেগ ও প্রত্যাশা প্রাধান্য পেয়েছে। এ কাব্যের মাধ্যমে তিনি সর্বাধিক খ্যাতি অর্জন করেন। এ গ্রন্থের ৩৮ টি কবিতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : ‘‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’’, ‘‘স্বাধীনতা তুমি’’, ‘‘বন্দি শিবির থেকে’’, ‘‘প্রাত্যহিক’’ প্রভৃতি। এ কাব্যগ্রন্থকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ইতিহাসের কড়চা বলা যেতে পারে।

‘বন্ধুরা তোমরা যারা কবি,/ স্বাধীন দেশের কবি, তাদের সৌভাগ্যে/আমি বড় ঈর্ষান্বিত আজ।/... যখন যে শব্দ চাও, এসে গেলে সাজাও পয়ারে,/কখনো অমিত্রাক্ষরে, ক্ষিপ্র মাত্রাবৃত্তে কখনো বা/সে সব কবিতাবলি, যেন রাজহাঁস/...অথচ এ দেশে আমি আজ দমবন্ধ/ এ বন্দি বন্দি শিবিরে/মাথা খুড়ে মরলেও পারি না করতে উচ্চারণ/মনের মতন শব্দ কোনো।/...স্বাধীনতা নামক শব্দটি/ভরাট গলায় দীপ্ত উচ্চারণ করে বার বার/তৃপ্তি পেতে চাই। শহরের আনাচে-কানাচে(বন্দি শিবির থেকে)’। ১৯৭১ সালের ২১ জুলাই কলকাতার নন্দিত ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘মজলুম আদিব’ ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়। ‘মজলুম আদিব’ অর্থ নির্যাযিত কবি। বাঙালির সঙ্গে নিজেও স্বাধীনতা প্রত্যাশী হয়ে এ কবিতায় আরও লেখেন : ‘স্বাধীনতা নামক শব্দটি/ ভরাট গলায় দীপ্ত উচ্চারণ করে বারবার/ তৃপ্তি পেতে চাই। শহরের আনাচে কানাচে/ প্রতিটি রাস্তায়/অলিতে-গলিতে,/ রঙিন সাইনবোর্ড, প্রত্যেক বাড়িতে/ স্বাধীনতা নামক শব্দটি আমি লিখে দিতে চাই/ বিশাল অক্ষরে’। অক্ষরে অক্ষরে মিশে আছে আবেগ। সমস্ত বাঙালির আবেগ যেন তাঁর আবেগে রূপান্তরিত করলেন। স্বাধীনতার রূপ দেখলেন এভাবে : ‘স্বাধীনতা তুমি/ বাগানের ঘর, কোকিলের গান,/ বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা,/ যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা(স্বাধীনতা তুমি, বন্দি শিবির থেকে)’।

বাঙালির আবেগ যে কত উচ্চ ছিল তার বর্ণনা পাই এ কাব্যের অনেক কবিতায়। ‘স্বাধীনতা যে কত আকাঙ্খিত’ তা পাওয়া যায় এ গ্রন্থের ‘পথের কুকুর’ কবিতায় : ‘আমরা ক'জন শ্বাসজীবী--/ঠায় বসে আছি/ সেই কবে থেকে। অকস্মাৎ কুকুরের/শাণিত চিৎকার/কানে আসে, যাই জানালার কাছে, ছায়াপ্রায়। সেই/পথের কুকুর দেখি বারংবার তেড়ে যাচ্ছে জলপাইরঙ/একটি জিপের দিকে, জিপে/সশস্ত্র সৈনিক কতিপয়। ভাবি, যদি/অন্তত হতাম আমি পথের কুকুর’। সে সময়ের থমথমে অবস্থা বর্ণনা পাওয়া যায় এ কাব্যের আরও কবিতায়। কবিতাগুলো পড়লেই থমথমে, ব্যকুল ও ভয়ার্ত সে সময়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বা আবহ/পরিবেশ জানা যাবে। এমন কিছু কবিতাংশ তুলেই ধরি—তাহলে আমার কথার প্রমাণ পাওয়া যাবে।
(১) ‘ছাত্র নই, মুক্তিসেনা নেই কোনো, তবুও/হঠাৎ হ্যান্ডস্ আপ বলে/পশ্চিমা জোয়ান আসে তেড়ে/...জ্যোতির্ময় রৌদ্রালোকে বীরদর্পী সেনা/নিমিষেই হয়ে যায় লুটেরা, তস্কর।/... এদিকে বিষম/পানাসক্ত প্রেসিডেন্ট--ইনিও সৈনিক--/দিচ্ছেন ভাষণ/বেতার টেলিভিশনে, ঢুলু ঢুলু গলায় কেমন/গাইছেন গণ--/হত্যার সাফাই(প্রাত্যহিক, বন্দি শিবির থেকে)’।
(২) ‘প্রতিটি অক্ষরে/গোলা বারুদের/গাড়ির ঘর্ঘর,/দাঁতের তুমুল ঘষ্টানি,/প্রতিটি পঙ্ক্তিতে শব্দে প্রতিটি অক্ষরে/কর্কশ সবুজ ট্যাঙ্ক চরে, যেনবা ডাইনোসর।/...এখন আমার কবিতার/প্রতিটি অক্ষরে/বনবাদাড়ের গন্ধ, গেরিলার নিঃশ্বাস এবং/চরাচরব্যাপী পতাকার আন্দোলন(প্রতিটি অক্ষরে, বন্দি শিবির থেকে)’।
(৩) ‘আশেপাশে আছে গাছ-গাছালির শোভা।/পাতার আড়ালে জ্বলছে সে কার চোখ?( সান্ধ্য আইন, বন্দি শিবির থেকে)’।
(৪) ‘এ ব্যাপক কাঁটাতারে/জীবন ঝুলছে, যেন ক্রুশকাঠ;/ শহরে শহরে, ধু-ধু প্রান্তরে/কাঁটাতার, কাঁটাতার(কাঁটাতার, বন্দি শিবির থেকে)’।
(৫) ‘সমস্ত শহর আজ ভয়াবহ শবাগার এক। কোনোমতে/দম নিই দমবন্ধ ঘরে। জমে না কোথাও আড্ডা,/রেস্তোরাঁ বিজন। গ্রন্থে নেই মন, আপাতত জ্ঞানার্জন বড়/অপ্রয়োজনীয় ঠেকে।(উদবাস্তু, বন্দি শিবির থেকে)’।
(৬) ‘আমাদের মৃত্যু আসে ঝোপে ঝাড়ে নদী নালা খালে/আমাদের মৃত্যু আসে কন্দরে কন্দরে/আমাদের মৃত্যু আসে পাট ক্ষেতে আলে/গ্রামে গঞ্জে শহরে বন্দরে/আমাদের মৃত্যু আসে মাঠে/পথে ঘাটে ঘরে/আমাদের মৃত্যু আসে হাটে/সুডৌল ট্রাফিক আইল্যান্ডের ধু-ধু চরে(আমাদের মৃত্যু আসে, বন্দি শিবির থেকে)’।
(৭) ‘এরপরও আর ক’জন থাকবে টিকে?/ ক’জন পারবে মৃত্যুকে দিতে ফাঁকি?/ বিদ্বজ্জন দেশে নেই আর বাকি।/একি হত্যার তাণ্ডব চৌদিকে(এরপরও, বন্দি শিবির থেকে)’।
(৮) ‘আমার বাড়ির ছোট্ট এ প্রাঙ্গণে/বসত করে একটি ফুলের চারা।/... গেলাম চলে সুদূর গ-গ্রামে/ছোট্ট আমার চারাটিকে রেখে/গর্জে-ওঠা মেশিনগানের মুখে(পড়শি, বন্দি শিবির থেকে)’।

‘‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’’ কবিতায় কবি অবশেষে ঘোষণা করলেন, ‘পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত/ঘোষণার ধ্বনিপ্রতিধ্বনি তুলে,/নতুন নিশান উডিয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগবিদিক/এই বাংলায়/তোমাকেই আসতে হবে, হে স্বাধীনতা’। আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। কবির কথার সত্যতা পেয়েছি। ‘নির্যাতন করে বেশিদিন টিকে থাকা যায় না’ তার প্রমাণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়।

আবু আফজাল সালেহ
কবি ও প্রাবন্ধিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top