সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

সান্তা ক্লজ: কিংবদন্তীর আড়ালে এক দেবদূত : নবনীতা চট্টোপাধ্যায়


প্রকাশিত:
২২ ডিসেম্বর ২০২১ ০৩:৩৯

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:২১

 

তিনি আসছেন লাল পোশাকে, লাল টুপি, ধবধবে সাদা চুল আর সাদা দাড়ি, পিঠে ঝোলাভর্তি উপহার নিয়ে। শীতের হিমেল হাওয়ায়... ঝরে পরা তুষারের ভিতর দিয়ে... রাত্রির শেষ প্রহরে মৃদুভাবে ছুটছে তাঁর স্লেজ গাড়ি। আটখানা বল্গাহরিণ অবিশ্রান্ত ভাবে টেনে যাচ্ছে সেই গাড়ি। এই গাড়ি তো আজ নিশীথে থামবে না। পেরিয়ে যাবে মাইলের পর মাইল... প্রান্তরের পর প্রান্তর... দেশের পর দেশ। পৃথিবীর সব শিশুরা আজ ঘুমিয়ে রয়েছে এক তীব্র মধুর প্রতীক্ষায়। আজ তাদের প্রিয় ভালোবাসার জন সান্তা ক্লজ আসবেন। বিছানার পাশে, ফায়ার প্লেসের ধারে রেখে দেওয়া মোজায় তাদের জন্য উপহার দিয়ে যাবেন। আর প্রভাত হলে ঘুম ভেঙে প্রতিটি শিশু ছুটে যাবে উপহার দেখতে। তাদের সবার মুখে ফুটে উঠবে এক খুশীর আলো। আলো নয়.... আসলে কুচি কুচি হীরের দানা।
প্রভু যীশুর পরেই বড়দিনের তুমুল জনপ্রিয় চরিত্র সান্তাক্লজ। তিনি যেন বড়দিনের প্রতীক। এই বিশেষ দিনটিতে একরাশ ভালোবাসা আর কল্পনার মধ্যে ঘুরে বেড়ান স্থুলকায় হাস্যমুখর সান্তাক্লজ নামের দেবদূত। তাঁকে ঘিরে রয়েছে অজস্র কিংবদন্তি, গল্প। সেইসব কিংবদন্তি অনুসারে সান্তা ক্লজ বাস করেন সুদূর উত্তরে চির তুষারাবৃত দেশে। আমেরিকার লোকগাথা অনুসারে তিনি বাস করেন উত্তর মেরুতে। আবার ইওরোপের অনান্য দেশের লোকগাথা অনুযায়ী সান্তাক্লজের নিবাস ফিনল্যান্ডের ল্যাপল্যান্ড প্রদেশের কোরভাটুনটুরি পার্বত্য অঞ্চলে। সেখানে সান্তাক্লজ, তাঁর স্ত্রী মিসেস ক্লজ, জাদুকর এলফ এবং আটটি বল্গাহরিণ বাস করেন। যে আটটি মেরুহরিণ টেনে নিয়ে যায় তাঁর স্লেজ গাড়ি, তাদের নাম হল ড্যাশার, ডান্সার, প্র‍্যান্সার, ভিক্সেন, কমেট, কিউপিড, ডনর, ও বিল্টজেন। সারা বিশ্বের শিশুদের নামের তালিকা তৈরী করা থাকে তাঁর ঝোলায়। আচরণ অনুযায়ী তাদেরকে তিনি দুষ্টু ও লক্ষী এই দুইভাগে ভাগ করেন। তারপর প্রতিটি ২৪শে ডিসেম্বেরের রাতে তিনি লক্ষী ছেলেমেয়েদের জন্য খেলনা, চকোলেট আর অনান্য প্রয়োজনীয় উপহার দেন আর দুষ্টু ছেলেমেয়েদের জন্য রেখে দেন কয়লা আর বোতাম। কিন্তু কে ছিলেন এই সান্তাক্লজ? রূপকথার এই মানুষটির সত্যিই কি ছিলো কোনো বাস্তব অস্তিত্ব? কোথা থেকে তিনি এলেন? কেনই বা ঘুরে ঘুরে গভীর নিশীথে উপহার বিতরণ করেন শিশুদের? কেনই ভা তিনি লাল পোশাক পরে থাকেন? ইতিহাস কী বলছে তাঁর সম্বন্ধে?
ইতিহাসের তথ্য অনুযায়ী সান্তা ক্লজ চরিত্রটির সৃষ্টি সেন্ট নিকোলাসের আদলে। তিনি ছিলেন চতুর্থ শতকের এক ধর্মযাজক। এশিয়া মাইনর অঞ্চলের তুরস্কের কাছাকাছি সমুদ্র উপকূলবর্তী গ্রাম পাতারাতে তাঁর জন্ম হয়েছিল। তাঁর পিতা ছিলেন ধনী ব্যক্তি। কিন্তু অল্প বয়সেই তিনি পিতৃহীন হয়ে অনাথ আশ্রমে প্রতিপালিত হয়েছিলেন। পরবর্তী জীবনে তিনি মায়রার বিশপ হয়েছিলেন। সেন্ট নিকোলাস ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু। পিতার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া তাঁর সব ধনসম্পদ তিনি গরীব দু:খীদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, যে কোনো মানুষ বিপদে পড়লে তিনি অকাতরে সাহায্য করতেন। দু:স্থ পীড়িত, বিপদগ্রস্ত মানুষদের সাহায্যের জন্য তিনি এক দেশ থেকে অন্য দেশে ঘুরে বেড়াতেন। ধীরে ধীরে তিনি সারা ইওরোপে গরীব দীন দুখী মানুষজন ও শিশুদের বন্ধু হিসাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ঐতিহাসিক গবেষকদের মতে চারের শতকে জন্ম নেওয়া এই ধর্মযাজক এতটাই লোকপ্রিয় ছিলেন যে রোমান সম্রাট ডায়োক্লেসিয়ান তাঁকে কারারুদ্ধ করে রাখেন। পরবর্তীকালে রোমান সম্রাট কনস্টানটাইনের আমলে তিনি কারামুক্ত হয়েছিলেন। ৩৪০খৃ: ৬ই ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়। এই দিনটি আজো অনুগামীদের কাছে একটি পবিত্র দিন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে (তাঁর মৃত্যুর বহু পরে) মার্কিন সংস্কৃতিতে সেন্ট নিকোলাসের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়। সান্তা ক্লজ নামটির উৎপত্তি নিকোলাসের ওলন্দাজ নাম 'সিন্টার ক্লাস' থেকে। ১৮০৯ খৃ: প্রখ্যাত সাহিত্যিক ওয়াশিংটন আরভিং তাঁর রচিত গ্রন্থ 'নিউইয়র্কের ইতিহাসে' সিন্টার ক্লাস কে নিয়ে গল্প লেখেন যা পরবর্তী কালে সান্টা ক্লজ নামে জনপ্রিয় হয়।
তাঁকে নিয়ে ঘুরপাক খায় অনেক প্রশ্ন, কৌতুহল, রহস্য। কেন তিনি গভীর রাত্রে এসে সন্তর্পণে মোজার মধ্যেই উপহার রেখে যান? কেন কারো চোখের সামনে তিনি কখনো আসেন না? সেন্ট নিকোলাস সম্বন্ধে ইতিহাস খুব বেশি তথ্য পায়নি। কিন্তু অজস্র কিংবদন্তি... লোকগাথা... এই প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর রেখেছে। মোজা কাহিনীর পিছনে রয়েছে এক গল্প। এক দরিদ্র বৃদ্ধের তিনটি বিবাহযোগ্যা কন্যা ছিল। তাদের বিবাহের যৌতুক দেওয়া বৃদ্ধের পক্ষে অসম্ভব ছিল। চিন্তাগ্রস্ত অকূলপাথারে পড়া এই বৃদ্ধের সমস্যার কথা জানতে পেরে সেন্ট নিকোলাস গভীর রাত্রে স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে বৃদ্ধের বাড়ি যান। নি:শব্দে চিমনি দিয়ে সেই বাড়ীতে প্রবেশ করে তিনি দেখলেন বৃদ্ধের তিনকন্যা ফায়ারপ্লেসের পাশে তাদের মোজাগুলি শুকোতে দিয়েছে। নিকোলাস ঐ মোজাগুলির ভিতরে স্বর্ণমুদ্রা রেখে যান। সকালে উঠে বৃদ্ধ তো হতবাক। ধূমধাম করে বৃদ্ধের পরপর দুই কন্যার বিবাহ হয়ে গেল। তৃতীয় কন্যার বিয়ের আগে বৃদ্ধ মোজা রেখে লুকিয়ে রইলেন ঈশ্বরকে দেখার জন্য। গভীর রাত্রে তিনি ধর্মযাজক সেন্ট নিকোলাসকে দেখে ফেললেন মোজায় মোহর রাখতে। সেন্ট নিকোলাস বৃদ্ধকে পুরো বিষয়টি গোপন রাখতে অনুরোধ করলেন। তিনি চাইতেন না তাঁর দানের কথা প্রচারিত হোক। কিন্তু বিষয়টি ছড়িয়ে গেল। এরপর থেকে সবাই মোজা রেখে গোপনে উপহার পেতে লাগল। শিশুরা ক্রিসমাসের রাতে নিজেদের মোজা রেখে দিত উপহার পাবে বলে। এইভাবে তৈরী হলো তাঁকে ঘিরে নানা কাহিনি যার প্রতিটির মূলে রয়েছে এক অসম্ভব দয়ার্দ্র নরম মনের দেবদূতের কথা।
আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগে ধর্মযাজক সেন্ট নিকোলাসের পক্ষে লাল পোশাক পরিধান করা অসম্ভব ছিল যা এখন আমরা সান্তা ক্লজকে পরতে দেখি। এই পোশাক পরিকল্পনা এসেছে ১৮২২ সালে ক্রিসমাস ডে উপলক্ষে আমেরিকার বিখ্যাত লেখক ক্লেমেন্ট ক্লার্ক মুরের লেখা 'এ ভিসিট ফ্রম সেন্ট নিকোলাস' কবিতাটি থেকে। লাল পোশাক পরা একজন সন্ত আটটি হরিণে টানা গাড়িতে করে উড়ে উড়ে বাচ্চাদের উপহার দিচ্ছেন এই চিত্র সর্বপ্রথম এই কবিতা থেকে পাওয়া যায়। তার আরো পরে থমাস নাস্ট নামে একজন আমেরিকান কার্টুনিস্টের আঁকা ছবিতে আজকের সান্তা ক্লজের রূপায়ন ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৩১ সালে কোকোকোলা কোম্পানীর নরম পানীয়ের বিজ্ঞাপনের জন্য হ্যাডন সন্ডব্লুম লাল জোব্বা পরিহিত সান্তা ক্লজের ছবি আঁকেন এবং এই ছবি এতটাই জনপ্রিয় হয় যে এরপর থেকে যত শিল্পী সান্তা ক্লজের ছবি এঁকেছেন সব এই লাল পোশাকেই।
তাঁকে নিয়ে যতই কথা... রূপকথা.... কাহিনী... ইতিহাস থাকুক, এই সবের আড়ালে সান্তা ক্লজ বা সেন্ট নিকোলাস এক দেবদূত যিনি শান্তি ও আনন্দের উপহারের ডালি নিয়ে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে যান|শিশুদের নিস্পাপ নরম অন্তরে তিনি আজো এক দৃঢ বিশ্বাসের সিংহাসনে সুপ্রতিষ্টিত। তাই মিথ হলেও তারা বিশ্বাস করে তিনি আছেন... তিনি আসবেন... প্রতিটি ২৪শে ডিসেম্বর রাতে তাদের খুশীর উপহার দিতে।

 

নবনীতা চট্টোপাধ্যায়
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top