সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

ব্যাঘ্রভূমির বন্যজীবন : রীনা ঘোষ


প্রকাশিত:
৫ জানুয়ারী ২০২২ ০২:১৩

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ০৫:১২

ছবিঃ রীনা ঘোষ

 

"হেঁতাল গেওয়া আর গরানের বন,
সিঁদুরে মৌটুসি তার বন্য জীবন।"

শহুরে জীবন হোক বা গ্রাম্য - প্রকৃতির মাঝে, প্রকৃতির সাজে থাকতে আমরা কে না ভালোবাসি। আমাদের দেশে কাজের জায়গা আর মানব জাতির বসবাস একই স্থানে। এক্ষেত্রে কিছু সুবিধা আমরা ভোগ করলেও প্রকৃতির গায়ের সুমধুর গন্ধ থেকে আমরা বরাবরই বঞ্চিত হই। নিজেদের স্কুল কলেজ অফিস আদালত - এসবের সুবিধার্থে সবুজের দেশ ছেড়ে আমরা সর্বদাই ধূসর ধোঁয়ার রাজ্যের স্থায়ী অধিবাসী। তুলনামূলক আমরা যদি পশ্চিমের দেশগুলোর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করি, তাহলে দেখব ওখানে শহরাঞ্চল শুধুমাত্র কাজের জন্য ব্যবহৃত হয় আর বসবাসের জন্য country side - ই তাদের কাছে যোগ্য আবাসস্থল। যেহেতু আমরা ধূসর রাজ্যের বাসিন্দা তাই সুযোগ পেলেই চলে যাই সবুজের সমারোহে। কিন্তু প্রকৃত সবুজের মাহাত্ম্য বুঝতে গেলে আমাদের জনজীবনকে মিশিয়ে দিতে হবে বন্যজীবনের সাথে। ঠিক যেমন মিশে আছে সুন্দরবনের মানুষ।

বাংলাদেশের বেশ কিছু এলাকা এবং ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দুই জেলা - উত্তর চব্বিশ পরগনা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জুড়ে বিস্তার লাভ করে আছে বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময়ের অন্যতম স্থান সুন্দরবন। বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী এই অঞ্চল গঙ্গা, মেঘনা আর ব্রহ্মপুত্র - ত্রিনদীর অববাহিকায় বদ্বীপ এলাকায় অবস্থিত এই অপরূপ বনভূমি। দশ হাজার বর্গকিলোমিটার জুড়ে অবস্থিত বিশ্বের সর্ববৃহৎ অখণ্ড বনভূমির প্রায় চার হাজার বর্গকিলোমিটার অংশ রয়েছে ভারতের মধ্যে। নিকটবর্তী শহর বলতে কাকদ্বীপ, ক্যানিং, কলকাতা, গোসাবা ও সন্দেশখালি।

ছোটোবেলায় রহস্য গল্পে অতিরিক্ত আকর্ষণের সুবাদে হাতে আসে একটি বিখ্যাত লেখকের গোয়েন্দা গল্পের বই। সেখানে একটি গল্পে গোয়েন্দা জুটির কাকদ্বীপ ভ্রমণ এবং সেখানকার প্রাকৃতিক বর্ণনা আমায় মুগ্ধ করে। মানুষের সাথে প্রকৃতির এক অদৃশ্য মেলবন্ধন, বন্য ভয় , গভীর রাতে জলের শব্দ - সবকিছু মিশিয়ে এক মোহময় আবহের সৃষ্ট করে। আর এর ফলস্বরূপ সুন্দরবনকে জানার আগ্রহ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। বন্যপশু আর দুপায়ের মানব জাতিকে কিভাবে প্রকৃতি এক আকাশের নিচে, দুই বাহুতে বেঁধে রেখেছে। বিস্তীর্ণ জলাভূমি আর সমভূমির আন্তরিক মেলবন্ধনের মতই মানুষ, বন্যপশু, হাজারো বর্ণের পাখি আর চেনা অচেনা গাছেদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে সুন্দরবনের বন্য জীবন।

সুন্দরবন নামকরণের ব্যাখ্যা নিয়ে বেশ কিছু মতভেদ লক্ষ্য করা যায়। কারোর মতে আক্ষরিক অর্থে বনভূমিটি সুন্দর দেখতে হওয়ায় এর নাম হয়েছে সুন্দরবন। আবার কেউ বলে এর নাম 'সমুদ্রবন' বা 'চন্দ্র - বান্ধে'। তবে বেশিরভাগ যে ব্যাখ্যাটি  সকলে মেনে চলে সেটাই হল এই অঞ্চলের সুন্দরী গাছের আধিক্য থেকেই নাম হয়েছে সুন্দরবন। নির্ভয়ে বাঘেদের বসবাসের জন্য কখনো আবার একে বা 'Tigerland' ব্যাঘ্রভূমিও বলা হয়।

তবে সুন্দরবন বনভূমি হলেও মোট ১০২ টি দ্বীপের মধ্যে ৫৪ টি দ্বীপেই মানুষ বসবাস করে। সমুদ্রের লবণ জলে সিক্ত এই দ্বীপগুলোতে মাটির অম্লতা ৭.৫ থেকে ৮.৫ এর মধ্যে। মাটিতে লবণের আধিক্যের সাথে সাথে এখানকার মাটি  ক্ষারযুক্ত এবং গঙ্গার পলি মাটিও মিশ্রিত। নানান প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়েও বিজ্ঞান সম্মত  উপায়ে এখানে চাষ করা হয়। ধান , বিভিন্ন জাতের ডাল ছাড়াও আলু, পেঁয়াজ, ওল, লঙ্কা, আদা প্রভৃতি সব্জির চাষ হয়। দুধ উৎপাদনের জন্য বাড়িতে গরু প্রতিপালনের ঝোঁক বেড়েছে। বিভিন্ন পতিত জমিকে কৃষিযোগ্য করে তোলার জন্য চলছে আপ্রাণ চেষ্টা। কিন্তু কৃষিকাজের সাথে সাথে এই অঞ্চলের মানুষ বনের উপরও ব্যাপক ভাবে নির্ভরশীল। কারণ তাদের প্রাচীন সংস্কার অনুযায়ী বন ছাড়া তারা যেন অন্ধ। বসবাসের আদিকাল থেকে এই বনই তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। এটি তাদের বিশ্বাস যে এই বনভূমি তাদের জীবিকা-দাত্রী। বন আছে বলেই তাদের জীবন আছে, তারা বেচেঁ আছে।

প্রাচীনকালে অর্থাৎ পুরাণের যুগে দেখা যেত বিভিন্ন প্রাকৃতিক দেবদেবীরা পূজিত হতেন। মানুষ যাতে প্রাকৃতিক শক্তির রোষানলে দগ্ধ না হয় সেই জন্য বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তিকে এক একটি রূপ দান করে সেই রূপের অর্চনা করত। যেমন - ঝড় থেকে রক্ষা পেতে পবনদেব, জমিতে ভালো ফলনের জন বৃষ্টি ও  বজ্রের থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ইন্দ্রদেব, আগুনের জন্য অগ্নিদেব, জমি ভর্তি উৎকৃষ্ট ও অধিক ফসলের দেবী অন্নপূর্ণা , এছাড়াও অন্যান্য প্রাকৃতিক শক্তির প্রকোপ থেকে বাঁচার জন্য ও সেইসব দেবতাদের নিজেদের উপর সহায় করার জন্য এইরকম পূজার্চনা করত । ঠিক যেমন এই সুন্দরবনের মানুষজন জঙ্গলের বাঘের কবল থেকে রক্ষা পেতে ' দক্ষিণরায়' রূপকে দেবতা জ্ঞানে পুজো করে। নদীতে জল আনতে গিয়ে কুমিরের কবল থেকে রক্ষা পেতে এবং পরিবারের লোকেদের সুরক্ষার জন্য বাড়ির মেয়েরা কুমির ব্রত পালন করে। তাছাড়া 'বনবিবি' কে জঙ্গলের দেবী হিসাবে মানে এরা। এদের বিশ্বাস এই ' বনবিবি ' - ই রক্ষা করে সমস্ত সুন্দরবনের পশু পাখি আর মানুষদের অর্থাৎ গোটা বন্যজীবনকে। এখানে উল্লেখ্য যে এই অঞ্চলের হিন্দু - মুসলিম  নির্বিশেষে সকলেই এই 'বনদেবী' বা 'বনবিবি'- র ঐশ্বরিক ক্ষমতাকে 'বেদ' বা 'কোরান' এর মতই পবিত্র এবং সত্য বলে মানে। তাদের আশা ভরসা এবং  নিরাপদ বিশ্বাসের জায়গা এটি। এই বিশ্বাসের জোরেই এখানকার বাঘে মানুষে এক ঘাটে জল খায়। আর এই বিশ্বাসের জোরেই টিকে আছে এই বন। চারিদিকে যখন গাছ কাটার ধুম তখন এই অঞ্চলের বনভূমি এখানকার মানুষের খাদ্য জোগায় । এখানকার মানুষ বট, পিপুল আর নিম গাছকে দেবতা জ্ঞানে পুজো করে। এরা মাথা উচুঁ করে বেচেঁ আছে এই মানুষগুলোর সাথে, বিশ্বাসে এবং বাস্তবে আগলে রেখেছে এই অঞ্চলের সমস্ত প্রাণীকুলকে।

বিজ্ঞানের ভাষায় খাদ্য খাদক শৃঙ্খলার সুষ্ঠু এবং সঠিক নিদর্শন দেখা যায় এই অঞ্চলে। ঠিক যেমন পুকুরের ছোটো মাছেদের খেয়ে জীবন ধারণ করে রাঘব বোয়ালের মত বড়ো মাছেরা, এখানেও উদ্ভিদ থেকে চিত্রা হরিণ, বুনো শুয়োর থেকে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, বুনো হাঁস, পানকৌড়ি, কাঁকড়া, বিভিন্ন রঙের ব্যাঙ, সাপ - খাদ্য খাদকের উৎকৃষ্ট উদাহরণ বলা যেতে পারে। এর মধ্যে আবার মানুষও পড়ে। প্রথমদিকে জলদস্যু আর ডাকাতের আক্রমণ, তাছাড়া চাষযোগ্য জমির অভাব, জলে কুমির ডাঙায় বাঘ ও জঙ্গলে সাপ। তবুও এখানকার মানুষ টিকে আছে, বেচেঁ আছে এদেরই সাথে।

প্রথমেই বলেছি জঙ্গল এদের কাছে রক্ষাকর্ত্রী দেবী বা মায়ের মত। তাই একটা শিশুর যেমন মায়ের প্রতি বিশ্বাস থাকে , মাকে অবলম্বন করে যেমন সে ছোটো থেকে বেড়ে ওঠে সেই রকমই এই জঙ্গলই এদের কাছে ছিল আশা ভরসা ও  অবলম্বন। জঙ্গলের এই অবারিত দ্বারে তাদের অনায়াস যাতায়াত। বনের মধু সংগ্রহ করে তা শহরে বিক্রি থেকে শুরু করে গাছের শুকনো পাতা ও ডালপালা কুড়িয়ে তা জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা। খিদে মেটাতে বনের ফল এবং অর্থ উপার্জনের জন্য মোম সংগ্রহ। বনভূমির উপকারিতা আর অবদান বলে শেষ করার মত নয়।

এই অঞ্চলে গাছ আর মানুষ একে অপরের অপরিহার্য অঙ্গ। জীবন ধারণের জন্য কাঠ কুড়াতে গিয়ে বা মরা গাছের কাঠ কাটতে গিয়ে হাঁপিয়ে গেলে তারা সেই গাছের ছায়ায় আশ্রয় নেয়। গাছের পাতার ঝিরঝিরে আর সুমধুর বাতাসে মন প্রাণ জুড়িয়ে যায় এবং ক্ষিদে পেলে   সেই গাছের ফল খেয়েই পেটের জ্বালা জুড়ায়। অন্যান্য অঞ্চলের গাছেদের থেকে এই অঞ্চলের গাছের বৈশিষ্ট্য কিছু ভিন্ন। সমুদ্রের উপকূলবর্তী হওয়ায় প্রতিদিন জোয়ারের জলে প্লাবিত এই অঞ্চলের গাছগুলি মূলত লবণাম্বুজ, অর্থাৎ লবণ জলের গাছ। এই প্রকৃতির গাছেদের শ্বাসমূলমূলমূল দেখা যায়, যা আসলে ছড়ানো মূলের ঊর্ধ্বমুখী শাখা। জলের উপরে জেগে থাকে বা বাতাস থেকে অক্সিজেন জোগাড় করে শ্বাসকার্য চালায়। তাছাড়া এই সকল গাছ জরায়ুজ প্রজনন ঘটায়। এদের বীজ খসে পড়ার আগেই ফলের মধ্যে অঙ্কুরিত হয় এবং মাটিতে পড়েই তা সরাসরি মূল বিস্তার করে। এই গাছগুলির লবণ জলে বেচেঁ থাকার জন্য মাটি থেকে লবণ বাদ দিয়ে জল ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান শোষণ করার বিশেষ প্রক্রিয়া আছে। এরা মাটির উপরিভাগ থেকে জল ও পুষ্টি সংগ্রহ করে বলে গাছের শিকড় মাটির গভীরে পৌঁছয় না। যার ফলস্বরূপ গাছের ভীত দুর্বল হয় এবং গাছ লম্বা হওয়ার জন্য যে মজবুত শিকড়ের দরকার হয় তা না থাকার জন্য এই অঞ্চলের গাছ খাটো প্রকৃতির হয়। এইসকল বৈশিষ্ট্য ছাড়াও ফল - পাতা - ফুল - সবেতেই যেন এক আলাদা মাধুর্য্য বজায় রেখেছে সুন্দরবনের এই গাছগুলো।

সুন্দরী গাছের গাঢ় লাল বর্ণের শক্ত কাঠ খুবই মূল্যবান। লবঙ্গের পাতার মত ছোটো পাতা এবং হলুদ বর্ণের ফুল শিশুদের খেলার যথার্থ উপযোগী।  মোট পুরু রাবার গাছের মত পাতা , বক ফুলের আকার বিশিষ্ঠ ফল আর ছোটো ফুলে সেজে ওঠে গর্জন গাছ। ফুলের বৃন্ত লাল কাঁকড়ার পায়ের মত দেখতে হওয়ায় একে কাঁকড়া গাছও বলা হয়। এছাড়া বাইন, কেউড়া, পশু - প্রভৃতি গাছ সাজিয়ে তুলেছে সুন্দরবনকে। এই অঞ্চলের বন্যজীবনে গেওয়া গাছের ফল খেয়ে জীবন ধারণ করে এই বনের হরিণ দল। সুন্দরবনের দক্ষিণাঞ্চলে ঝাড়ের মত বেড়ে ওঠা গরানের বন বাঘেদের খুব প্রিয় এবং নিরাপদ আবাসস্থল। কেওড়া গাছের মুখরোচক ফল চাটনি হিসাবে বেশ সুস্বাদু। এই গাছের উপর জঙ্গলের হরিণ ও বানরের দল অনেকাংশে নির্ভরশীল। হেঁতাল বা হেন্দাল গাছের ফুল থেকে মৌমাছিরা মধু সংগ্রহ করে , যা অবশ্য পরোক্ষভাবে মানুষেরই কাজে লাগে। নিপাপাতা বা গোলপাতা গাছের ফল ফুটবলের মত বড়ো এবং তালশ্বাসের মত হওয়ায় এটি খেতে খুব সুস্বাদু। এর পাতা দিয়ে ঘর ছাওয়ার কাজও করে এলাকাবাসী। টাইগার ফার্ন গাছের ঝোঁপ বাঘেদের গা ঢাকা দেওয়ার যোগ্য জায়গা। এছাড়া এই অঞ্চলে হরগোজা, পরশপিপুল, ধুন্দুল প্রভৃতি গাছ দেখা যায়, যা সুন্দরবনের মানুষ ও পশুদের সমানভাবে প্রয়োজনে আসে। তাইতো এই বনই ওই অঞ্চলের বন্যজীবনের ধারক ও বাহক।

এই নিয়েই গড়ে ওঠে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার জাতীয় উদ্যান। বনজ সম্পদের বিপুল পরিমাণ লক্ষিত হয় এই অঞ্চলে, যা এই এলাকার মানুষের নিত্য ব্যবহার ও অর্থ উপার্জনের পরেও অক্ষত থাকে। বর্তমান অবস্থা ভিন্ন । বিভিন্ন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের এই বন্যজীবন আর বন্যসম্পদ। বিশেষ করে অসাধু ব্যবসায়ীদের উৎপাতে সুন্দরবন এখন সঙ্কটে। তবুও ১০০র বেশি প্রজাতির গাছ জন্মায় এই জলাজঙ্গলে এবং ২৮ টিরও  বেশি প্রজাতির প্রকৃত ম্যানগ্রোভ দেখা যায় এই বাস্তুতন্ত্রে। পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য হওয়ায় এটি 'world heritage site' হিসাবে বিশ্বে পরিচিত এবং এরই সাথে একে প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য হিসাবেও মানা হয়।

সুন্দরবনের বন্যজীবন আলোচনা করতে গেলে  এখানে অন্যতম প্রধান হিসাবে রাখতে হবে এই অঞ্চলের অগণিত বন্য পশুদের। বাইরের মানুষের কাছে এরা বন্য বা হিংস্র হলেও এই বনই তাদের ঘর, এখানকার তারা স্থায়ী বাসিন্দা। আর এখানে তারা বাস করে একটি নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে, একটি নির্দিষ্ট শৃঙ্খলার মধ্যে। এখানে বাংলার বাঘ অর্থাৎ রয়েল বেঙ্গল টাইগার থেকে শুরু করে বন বিড়াল, চিত্রা হরিণ, লাল বানর, ছোট ভোঁদড়, বুনো শুকর, শেয়াল, মেছো বেড়াল, রাজ গোখরো প্রভৃতি বন্য জীব দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গের গোটা এলাকায় জরিপ অনুযায়ী ৯৬ টি বাঘ রয়েছে। এখানকার সজনেখালি, লুথিয়ান দ্বীপ ও হ্যালিডে দ্বীপের প্রত্যেকটিতে রয়েছে একটি করে অভয়ারণ্য। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলায় একটি জাতীয় উদ্যান, ব্যাঘ্র প্রকল্প ও বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ রয়েছে। ভারতের সুন্দরবনে আড়াই হাজার কিলোমিটার ব্যাঘ্র প্রকল্পের অন্তর্গত এবং বাকি দেড় হাজার কিলোমিটার জুড়ে রয়েছে বনভূমি অঞ্চল। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য যেমন রয়েছে সাধারণ মানুষ, বনদপ্তর ও সরকারের যৌথ প্রচেষ্টা তেমনি কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষও তাদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য চালাচ্ছে আপ্রাণ চেষ্টা। তাই তাদের থেকে বন্যজীব এবং বন্য সম্পদ রক্ষার তাগিদে পশুদের এই নিরাপদ আবাসস্থল।

মনে পড়ে যায় ছোটোবেলায় পড়া বিখ্যাত সেই লাইন - " বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।" ভয়ংকর সুন্দর এই সুন্দরবনের এটাই হয়তো সেরা সৌন্দর্য্য। তারা থাকে তাদের মত। এই অঞ্চলে বন্যদের সাথে তাদের সন্তানদের দেখা যায় মাতৃস্নেহের নরম চাদরে খেলা করতে। আঞ্চলিক লোকেদের চোখে এই দৃশ্য বিরল নয়। রাজকীয় ভঙ্গিতে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চলন সত্যিই দৃষ্টি আকর্ষণ করার মত। তবে বাংলার এই বাঘ যেমনি সুন্দর দেখতে , তেমনি ভয়ংকর তার স্বভাব। অতন্দ্র প্রহরী এই প্রাণীই কিন্তু সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য, খাদ্যখৃঙ্খল ও পরিবেশ চক্রের প্রধান নিয়ন্ত্রক। আগে অবশ্য এখানে চিতা বাঘ ও ওল বাঘ দেখা যেত গোলপাতার বনে সদর্পে ঘুরে বেড়াতে কিন্তু এখন আর তাদের দেখা পাওয়া যায় না। দেখা যায় দলে দলে চিত্রা হরিণ। শিংহীন স্ত্রী হরিণ এবং তিন শাখা বিশিষ্ট শিঙের অধিকারী পুরুষ চিত্রা হরিণ। এরা আবার বাঘের প্রিয় খাবার। ওই যে খাদ্য খাদক শৃঙ্খলের সুষ্ঠ উদাহরণ। মায়াহরিণ ও দেখা যায় এই অঞ্চলে কিন্তু খুবই অল্প পরিমাণে। ছাগলের মত দেখতে বাদামি বর্ণের এই হরিণ বনের ভিতর একা চলে বেড়ায়। তাই এদের বন ছাগলও বলা হয়। সুন্দরবনের প্রাণীদের তালিকায় হরিণের সাথে সহাবস্থানকারী বানরের দেখা মেলে। গাছের উপরে বানর এবং গাছের নীচে হরিণ। এদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের সুবাদে বাঘের আগমনের খবর বানর আগে থেকেই বন্ধু হরিণকে দিয়ে দেয়। এই বনে ভোঁদড় দেখা যায়। যার আরেক নাম উদ্বিড়াল। এটি দেখতে অনেকটা বেজির মত এবং গায়ের রং কালচে সাদা। এর সাথে সাথে সুন্দরবনে দেখা যায় শুকর। বাড়িতে পোষমানা শুকরের থেকে যার আয়তন বেশ বড়ো এবং দেখতে অনেকটা ভল্লুকের মত। লাল কালোর মিশ্র বর্ণের এই প্রাণী আপাত শান্ত স্বভাবের হলেও এর পুরুষ শ্রেণী খুবই হিংস্র প্রকৃতির হয়। সুন্দরবনের মত জলা জায়গায় সাপ থাকবে না এটা তো হতে পারে না। এখানে সাপের রাজা অজগর থেকে শুরু করে শঙ্খচূড়, গোখরো, বেড়া, ফনিমনসা , গেছো প্রভৃতি বিভিন্ন জাতের সাপ দেখা যায়। যাদের বিষ থেকে শুরু করে গায়ের রং সবই ভিন্ন। দেখা যায় ৫-৭ মিটার লম্বা কুমির । ঠাকুমার ঝুলির গল্পের মত যারা শীতকালের রৌদ্রজ্জ্বল দিনে ডাঙায় এসে রোদ পোহায়। কমবেশি ১২০ টি প্রজাতির মাছ, ৪২ টি প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ টি সরীসৃপ এবং ৮টি উভচর প্রাণী লক্ষ্য করা যায়।খাদক গোষ্ঠীর মধ্যে পাওয়া যায় - বিভিন্ন প্রকার পতঙ্গ,  খরগোশ, গিরগিটি, সাপ, ঈগল, বাজপাখি, শৃগাল, বন্যশূকর, বাদর ও বাঘের মত প্রাণীদের।  বাঙালির গর্ব বিভূতি ভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের "চাঁদের পাহাড়"-এ আফ্রিকায় জঙ্গলে বন্যদের মোহময় সৌন্দর্য্যের থেকে কিছু কম নয় আমাদের এই সুন্দরবনের প্রাণীদের অকৃত্রিম রূপ।

বনের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধিতে ফুল এবং পাখি উভয়ের অবদানই কিন্তু প্রায় সমান সমান। আমাদের এই সুন্দরবনেও সেই ধারা অক্ষত আছে। ৪২৮ প্রজাতির পাখির আবাস পশ্চিমবঙ্গের এই বদ্বীপ অঞ্চলে, যা বর্তমানে ভারতে প্রাপ্ত পাখির মোট এক তৃতীয়াংশ। এর মধ্যে সামান্য কিছু পরিযায়ী পাখি থাকলেও বিরাট একটা অংশ কিন্তু আমাদের স্থানীয় বা আবাসিক পক্ষী কুল। পাখি বিষয়ক পর্যবেক্ষণ, পাঠ ও গবেষণার ক্ষেত্রে পাখি বিজ্ঞানীদের জন্য এই স্থান যথার্থই স্বর্গের সমান।

শীতকালের শুরুতে বিভিন্ন জায়গা থেকে পরিযায়ী পাখিরা এসে ভিড় করে সুন্দরবনের পাখিরালয় জঙ্গলে। শীত গরম বর্ষা সবসময়ই এই জঙ্গলে পাখির সমাগম দেখা যায়। কিন্তু তুলনামূলক শীতকালে পাখিদের আনাগোনা বেড়ে যায়। বায়ু দূষণের মাত্রা অনেক কম হওয়ায় এখানে পাখিরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারে। তাছাড়া প্রচুর খাদ্যের সম্ভার, অগণিত গাছ গাছালি এবং জনমানব কম থাকায় এই অঞ্চল পাখিদের খুবই প্রিয়। তাইতো ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার সুন্দরবনে সজনেখালি নামের এই জায়গাতে গড়ে উঠেছে বিখ্যাত পাখিরালয়। যার আয়তন প্রায় ৩৬২ বর্গকিমি । বঙ্গোপসাগরের কাছে সপ্তমুখী নদীর মোহনায় অবস্থিত লোথিয়াল দ্বীপে রয়েছে বন্যদের অভয়ারণ্য, এটিও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার অন্তর্গত।

সুন্দরবনে যে পাখিগুলো দেখা যায় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল - মদনটেক, মাছরাঙা, কানাকুয়ো, তিলানাগ ইঙ্গল, টুনটুনি, চিল, বক , সারস ইত্যাদি। জলাজায়গায় অবস্থিত হওয়ায় এই অঞ্চলের পাখিরা বেশিরভাগই মৎস্য ভোজী। এখানে দেখা যায় কালোমুখ প্যারাপাখি বা সুন্দরী হাঁসকে। যেটি দেখতে পানকৌড়ির মত। স্থানীয় ভাষায় একে হাঁস পাখি বলে। এই অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায় বিভিন্ন প্রজাতির মাছরাঙা , যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল খয়রাপাখা মাছরাঙা। সিঁদুরের মত টুকটুকে লাল রঙের এক পাখি দেখা যায় , যার নাম সিঁদুরে মৌটুসি। এই পাখিকে নানান ফুলে ঘুরে ঘুরে তার মধু খেতে দেখা যায়। সুন্দরবনের নদী - নালা , খাল- বিলের উপর দিয়ে মাছ শিকার করতে দেখা যায় শঙ্খচিলকে। গাছের পোকামাকড় খেয়ে জীবন ধারণ করে আর একটি সুন্দর পাখি, যার নাম কালোকপাল বনমালী। সুন্দরবনের আকাশে উড়ে বেড়াতে দেখা যায় ধবধবে সাদা বকের দলকে। নিজের ডানার শ্রী-তে সুন্দরবনের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধিতে সাহায্য করে বাদামীডানা পাপিয়া। এর সাথে যোগ দেয় সবুজ ঠোঁট মালকোয়া বা বন কোকিল। গভীর সুন্দরবনের নীরবতা ভাঙে লাল রঙের বনমোরগের কর্কশ ডাকে।

এছাড়া বিশেষ সময়ে দেখতে পাওয়া যায় শাহিন বাজ, দৈত্য বক ও সাইবেরিয়ান থ্রাশের মত পাখি । স্থানীয় পাখিরাও কম নয় - দুর্গা টুনটুনি, চশমা পাখি, ফটিকজল, সুনিয়া, হরিয়াল, দোয়েল - পাখিদের সম্ভারে সেজে আছে আমাদের একান্ত আপন সুন্দরবন।

নানান প্রজাতির গাছের সমারোহে, পশু - কীট - সরীসৃপের আনাগোনায় এবং পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত হয় নিস্তব্ধ এই সুগভীর জঙ্গল। তার মাঝে নিজেদের পরিবার নিয়ে বাস করে কিছু মানুষ। প্রকৃতির মাঝে তারা গড়ে তুলেছে নিজেদের জগৎ বা বলা যায় জঙ্গলের এই আবেশময় জগতে তারা স্বইচ্ছায় নিজেদের মাতিয়ে রেখেছে। এই বনভূমির গাছেদের মত , এখানকার পশু-পাখিদের মত একই সাথে এই মানুষগুলো প্রজন্মের পর প্রজন্ম জন্মগ্রহণ করে, জীবন অতিবাহিত করে এবং শেষে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে। পুবের সূর্যের মত, নব কিশলয়ের মত, ছোট্ট শাবকের মত এরাও প্রথম শ্বাস গ্রহণ করে প্রকৃতির কোলে, লালিত পালিত হয় কাঁদা- মাটি আর জঙ্গলের গভীরতা মেখে। হৃদ্যতা গড়ে ওঠে পশুদের সাথে, গাছেদের সাথে। সুন্দরবনের এই বন্য জীবনকে এরা মিলেমিশে বাঁচিয়ে রেখেছে, রেখেছে তরতাজা করে। প্রতিবন্ধকতা আছে এবং থাকবেও। থাকবে চোরা শিকারী, লোভী ও স্বার্থপরের দল কিন্তু এরই মাঝে টিকে থাকবে  সুন্দরবনের এই বন্যজীবন, যেখানে গাছপালা ও পশু পাখির সাথে মানুষও এই বন্য জীবনের বাসিন্দা। তারা বেচেঁ থাকে, বাঁচার উপকরণ জোগাড় করে এই বনভূমি থেকে । সবচেয়ে বড় কথা এরা ভালোবাসে এই সুন্দরবনের জঙ্গলকে, এই বন্যজীবনকে।

সমাপ্ত

 

রীনা ঘোষ
কলকাতা, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা


বিষয়: রীনা ঘোষ


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top