সিডনী মঙ্গলবার, ২৩শে এপ্রিল ২০২৪, ১০ই বৈশাখ ১৪৩১

দেশনায়ক নেতাজির খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাস: ডঃ সুবীর মণ্ডল


প্রকাশিত:
২৫ জানুয়ারী ২০২২ ০২:২০

আপডেট:
২৩ এপ্রিল ২০২৪ ২৩:৪৪

ছবিঃ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু

 


যিনি অথবা যাঁরা অনন্য সাধারণ-- তাঁরা চিরকালই সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থেকে যান! সাধারণ মানুষ তাঁদের গভীরভাবেই ভালবাসেন, শ্রদ্ধা করেন। প্রতিবছর তাঁদের  জন্মদিন কিম্বা মূত্যুদিবসে তাঁদের জীবনের একটি দুটি অবিচ্ছেদ্য ঘটনার স্মৃতিচারণ করেন। তার বেশি কিছুই নয়। সেই অসাধারণ মানুষের প্রতি তাঁরা যতোই সম্মান প্রদর্শন করুন না কেন, তাঁদের আদর্শের রূপায়ণ নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে কোনও চিন্তাভাবনা দানা বাঁধতে পারে না। কিন্ত্ত যাঁদের আমরা সাধারণ মানুষের সংজ্ঞার ঊর্ধ্বে স্হান দিতে অভ্যস্ত তাঁদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা আর একটু বেশি।

দেশনায়ক সুভাষচন্দ্রের জন্মতিথি স্বতঃস্ফূর্ত উদযাপনের মাধ্যেমে তাঁর স্বপ্ন ও আদর্শবাদ রূপায়নের জন্য দেশবাসী শপথ গ্রহণ করে। পৃথিবীর মধ্যে কোনও মহানায়কের জন্মতিথিই এমন স্বতঃস্ফূর্তভাবে এবং আন্তরিকতার সঙ্গে উদযাপিত হয় না। অন্যান্য নেতাদের জন্ম জয়ন্তী সরকারিভাবে বা গুণমুগ্ধদের উদ্যোগে শুধুই উদযাপিত হয়। কিন্ত্ত নেতাজি জন্মজয়ন্তী দেশের সকল শ্রেণীর নাগরিক সোৎসাহে উদযাপিত করে। বীর নায়ক নেতাজির জন্মদিন উদযাপনের সময় কেবলই এ- কথাই মনে হয়, দেশবাসী নেতাজির আদর্শবাদ কতটুকু গ্রহণ করতে পেরেছে? আবেগ ও উচ্ছ্বাসময়। উদযাপন এক জিনিস আর জাতীয় জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে তাঁর মহান আদর্শ রূপায়ণ আর এক জিনিস। 

আগামী  রবিবার সারা দেশজুড়ে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে যাচ্ছে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রবাদপুরুষ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৫তম জন্মজয়ন্তী। ভারতের মানুষের কাছে নেতাজি এক জীবনদর্শনের নাম। যার অন্তর্ধান আজও রহস্য ভারতের মানুষের কাছে। বীর নেতাকে শ্রদ্ধা জানাতে বিশেষ সম্মানের সঙ্গে দেশজুড়ে পালিত হচ্ছে তাঁর জন্মবার্ষিকী।
জন্মদিনের দুদিন আগেই বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে  কেন্দ্রীয় সরকার। দেশনায়ক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৫ তম জন্ম জয়ন্তী উপলক্ষে দিল্লির ইন্ডিয়া গেটে গ্রানাইট পাথরের তৈরি নেতাজির একটি পূর্ণবয়ব মূর্তি বসাতে চলেছে কেন্দ্রীয় সরকার। টুইটে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী লিখেছেন, “যখন সারাদেশ নেতাজির জন্মজয়ন্তী উদযাপনের কথা ভাবছে, তখনই অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে আমি জানাচ্ছি, দিল্লির ইন্ডিয়া গেটে গ্রানাইটে তৈরি নেতাজির বিশাল একটি পূর্ণবয়ব মূর্তি বসানো হবে। ভারত যে নেতাজির কাছে ঋণী, সেই প্রতীক হিসেবে মূর্তিটি সেখানে থাকবে”।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার টুইট বার্তায় নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেছেন, ভারতকে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত করতে নেতাজির অবদান অনস্বীকার্য। প্রধানমন্ত্রির পাশপাশি অন্যান্য রাজনীতিকরাও তাঁদের শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন।

ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম নায়ক ছিলেন নেতাজী। তাকে নিয়ে ভারতবাসী ও বাঙালির মনে আজও রয়ে গেছে বহু কৌতূহল। কল্পজগতের থেকেও অবিশ্বাস্য অবাধ যাঁর বিচরণ। সেই মানুষটার খাদ্যাভাস কেমন ছিল? কি খেতে ভালোবাসতেন নেতাজি? এই প্রশ্ন আমাদের অনেকের মনেই হয়ত জাগে।
সাধারণ বাঙালির মত ভাত, ডাল, তরকারি ছিল তাঁর খুব পছন্দের। ডালের মধ্যে সোনা মুগ ডাল ছিল তাঁর খুব প্রিয়। ভাতেভাত ও খিচুড়িও বিশেষ পছন্দ ছিল নেতাজীর। প্রথমে সকল আমিষ খাবার খেলেও পরে মাছ ছাড়া অন্য কোন আমিষ খাবার খেতেন না তিনি। খাবার শেষ পাতে থাকত টক দই আর বিভিন্ন মিষ্টি। মিষ্টির মধ্যে রসগোল্লা, সন্দেশ, চমচম ছিল তাঁর পছন্দের। এছাড়াও ভালোবাসতেন নারকেলের তৈরী মিষ্টি এবং গ্রামবাংলার তৈরী মিষ্টি। চিনির পুলি, মনোহরা, নারকেল নারু, রসকরা, ছাতুর বার্ফি, মুরির নারু, মোয়া, তিলের নারু এবং তিলের চাকতি ইত্যাদি বিশেষ প্রিয় ছিল নেতাজীর।
তাঁর সব থেকে প্রিয় পানীয় ছিল চা। নানান তথ্যসূত্র  থেকে জানা যায় তিনি দিনে ২০-২৫ বার চা খেতেন। তবে সিঙ্গাপুরে থাকাকালীন কফি- র প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ছিলেন যথেষ্ট। এছাড়াও লেবুর শরবত খেতে ভালোবাসতেন তিনি। গরম জলে বিটলবন দিয়ে লেবুর রস মিশিয়ে তিনি প্রায়ই খেতেন। ফলের মধ্যে আঙুর, কলা খুব পছন্দ ছিল নেতাজীর। প্রচন্ড সুপারি খেতেন নেতাজি। এমনকি ব্যাডমিন্টন খেলার সময়ও তিনি সুপুরি খেতেন। পরে অবশ্য সুপারি সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়ে হরিতকি খেতেন।
স্বাধীনতার সংগ্রামের কাজের জন্যে তিনি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়াতেন। এই কাজ করতে গিয়ে একবার তাঁর শরীর খুব ভেঙে যায়। ১৯৩৭ সালে তিনি স্বাস্থ্য পুনরোদ্ধার করতে যান হিমাচল প্রদেশের ডালহৌসিতে। শোনা যায় সেখানকার একটি জলাশয় বা বাউলির জল খেয়ে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। সেই জায়গা আজও সুভাষ বাউলি নামে পরিচিত।
'লক্ষীনারায়ণ সাউ এন্ড সন্স 'দোকানের তেলেভাজা খুব প্রিয় ছিল নেতাজীর। দোকানের আশেপাশেই নানা ডেরায় গোপন মিটিং বসত স্বদেশীদের। তেমনি কোনো এক মিটিঙে এক সময়ে এসেছিলেন স্বয়ং সুভাষচন্দ্র বসু। সেদিন তেলেভাজা নিয়ে আসা হয় ওই দোকান থেকে। শোনা গেছে তেলেভাজা খেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন নেতাজী। ১৯৪২ সাল থেকে প্রতি বছর নেতাজির জন্মদিনে, ২৩ জানুয়ারি, বিনামূল্যে তেলেভাজা বিতরণ শুরু করেন দোকানের মালিক খেঁদু সাউ। সেই ট্র্যাডিশন এখনো চলছে। নেতাজীর জন্মদিনে সকাল সাতটা থেকে বেলা তিনটে অবধি চলে এই বিনামূল্যে তেলেভাজা বিতরণ।
"পারামাউন্টের" ডাবের শরবত খুব পছন্দ ছিল নেতাজীর। তাছাড়াও কলকাতার 'কফিহাউসেও' প্রায়ই যেতেন নেতাজী। প্রেসিডেন্সিতে পড়ার সময় সূর্যসেন স্ট্রিটের' ফেভারিট কেবিনে ' যেতেন নেতাজী। বসতেন ৪ নম্বর টেবিলে। আজও ৪ নম্বর টেবিল শ্রদ্ধার বিষয় এখানেও। ওখানে বসেই তিনি শুনতেন নজরুলের গান। ওখানে রান্নাঘরের পাশের ঘরেই বসত বিপ্লবীদের গোপন বৈঠক। 'স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেলেও 'যেতেন নেতাজী। এখানে নিজের হাতে শতরঞ্চি পেতে বন্ধুদের নিয়ে এক আনায় দুবেলা ভরপেট মাছ ভাত খেয়েছেন নেতাজী বহুবার। এছাড়াও ভীমচন্দ্র নাগের সন্দেশও খুব পছন্দ ছিল নেতাজীর।
নেতাজির প্রিয় খাদ্য প্রতিষ্টানগুলোর মধ্যে বেশ কিছু এখনো বর্তমান।
(১) লক্ষীনারায়ণ সাউ এন্ড সন্স :

হাতিবাগানের এই তেলেভাজার দোকানটা ২৩ শে জানুয়ারীর দিন সবাইকে বিনামূল্যে তেলেভাজা বিতরণ করে ওনার স্মৃতিতে। শোনা যায় নেতাজি ওনার জন্মদিন পালন করেছিলেন এই দোকানে।

 (২) প্যারামাউন্ট :

বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রিটের এই শরবতের দোকানটি ছিলো ওনার খুব প্রিয়।

(৩) ইন্ডিয়ান কফি হাউস :

আড্ডাজগতের মক্কা হিসেবে প্রখ্যাত এই প্রতিষ্ঠানের ৪ নম্বর টেবিল এখনো বিখ্যাত নেতাজির স্মৃতিতে।

(৪) ফেভারিট কেবিন :

সূর্য সেন স্ট্রিট অঞ্চলে আজও ৪ নম্বর টেবিল শ্রদ্ধার বিষয় এখানেও।

(৫) স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেল :

এখানে নিজের হাতে শতরঞ্চি পেতে বন্ধুদের নিয়ে এক আনায় দুবেলা ভরপেট মাছ ভাত খেতেন নেতাজি বহু বছর। কলেজ স্ট্রিটের কাছেই ৮/২ ভবানী দত্ত লেন-এ এখনো স্বমহিমায় চলছে স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেল।

(৬) La Tour d'Argent :

প্যারিসের ১৫ 15 quai de la Tournelle এ অবস্থিত এই রেস্টুরেন্টটি আজ বিখ্যাত। ১৯৪১ সালে নেতাজির সাথে তৎকালীন ফরাসি প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক আলোচনার প্রেক্ষাপট হিসেবে। এখানেই ওনারা লাঞ্চ মিটিং-এ দেখা করেছিলেন।

 

শিক্ষাবিদ ও নেতাজির পরিবারের অন্যতম সদস্য ডঃ কৃষ্ণা বসু উল্লেখ করেছেন নেতাজির বিদেশের খাদ্যাভ্যাসের রোমাঞ্চকর ঘটনার কথা-- "এবার বলি নেতাজির আর এক মুসলিম সহযোগী আবিদ হাসানের কথা। আবিদ ছিলেন আমাদের একান্ত আপনজন। কত বার যে তিনি আমার অতিথি হয়েছেন! তাঁর মুখে নেতাজির কথা, আজাদ হিন্দ ফৌজের কথা কত যে শুনেছি! নেতাজি আবিদকে ডেকে বললেন, ভারতীয়েরা পরস্পর দেখা হলে সম্ভাষণ করতে পারে এমন একটা সম্ভাষণ খুঁজে বার করো। আবিদ দুষ্টুমি করে বললেন, ‘‘পেয়ে গিয়েছি, আমরা পরস্পর দেখা হলে বলব হ্যাল্লো।’’ নেতাজি রাগ করে বলেন, ‘‘আমি একটা সিরিয়াস বিষয়ে কথা বলছি।’’ আবিদ দেখলেন রোজ ব্যারাক থেকে বার হলেই সামনে বসে থাকা রাজপুত রাইফেলস-এর সৈনিকেরা তাঁকে বলে ‘‘জয় রাম জি-কি’’। আবিদের কানে খুব মিষ্টি লাগে। রাতের পর রাত জেগে তিনি ‘‘জয় রাম জি-কি’’ বলতে থাকেন, ভাবলেন ‘‘জয় হিন্দুস্তান কি’’ কেমন হয়? বা ছোট করে যদি বলা যায় ‘জয় হিন্দ-কি’? পর দিন সকালে সেনারা যখন ওঁকে ‘‘জয় রাম জি-কি’’ বলল, তিনি বললেন, ‘‘ওটা তো আগেকার দিনের। এসো আমরা জয় হিন্দ-কি বলি।’’ সেনারা মহা উৎসাহে বলে উঠল ‘‘জয় হিন্দ-জয় হিন্দ’’। আবিদ হাসান দৌড়লেন নেতাজির কাছে: পেয়ে গিয়েছেন। নেতাজি এবং অন্য অফিসারদের খুব পছন্দ হল।

সাবমেরিন যাত্রার গল্প শুনেছি ওঁর কাছে। সাবমেরিনের রান্নাঘরে দেখলেন একটু চাল আর ডাল আছে। নেতাজির জন্য অল্প খিচুড়ি বানালেন। খাবার টেবিলে নেতাজি জার্মান নাবিক অফিসারদের সঙ্গে ভাগ করে খিচুড়ি খেলেন। আবিদ আমাকে বলেছিলেন, নেতাজিকে নিয়ে আর পারি না। সামান্য চাল-ডাল সকলে মিলে খেলে দু’দিনেই শেষ হয়ে যাবে। সেই বিপজ্জনক সমুদ্রযাত্রার মধ্যে নেতাজি শান্ত ভাবে নিজের কাজ করতেন, আবিদ হাসানকে ডিকটেশন দিতেন। ইম্ফল থেকে রিট্রিট করার সময় তার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথাও তাঁর কাছে শুনেছি। আবিদ এক বার ভাবলেন, আমরা কেন মন্দির, মসজিদ, গির্জায় আলাদা ভাবে যাব? তিনি দুনিয়া কি মালিক-এর উদ্দেশে সকলে মিলে পাঠ করার এক প্রার্থনা লিখলেন। নেতাজির কাছে বকুনি খেয়েছিলেন। নেতাজি বলেছিলেন, ‘‘আবিদ ধর্ম আর রাজনীতি কখনও একসঙ্গে মিশিয়ে ফেলবে না। প্রত্যেকে তাঁর নিজের ধর্ম যেমন ইচ্ছা পালন করবেন। সবার উপরে আমরা ভারতীয়। আমরা ভারতের জন্য সংগ্রাম করছি।’’
নেতাজিকে শেষ দেখার দিনটির কথা বলতেন। সায়গল বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে আছেন, পাশে আছেন আয়ার-সহ আরও চার জন সঙ্গী। নেতাজিকে নিয়ে বিমান আকাশে উড়ে গেল। যত ক্ষণ দেখা যায়, একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন, ভেবেছিলেন সাবমেরিন যাত্রার মতো এই যাত্রায় নেতাজি ওঁকে সঙ্গী করবেন। কিন্তু নেতাজি বেছে নিলেন হবিবুর রহমানকে। মনের মধ্যে গভীর শূন্যতা, কবে দেখা হবে। নেতাজি বলে গিয়েছেন, শিগগিরই ওঁদের ডেকে নেবেন।"

 


শেষকথা

দেশের বরেণ্য নেতা সুভাষচন্দ্র বসুর অন্তর্ধান রহস্য দেশবাসীকে ভাবায়। এ নিয়ে বহু কমিশন বসেছে, প্রশ্নের মীমাংসা সূত্র পাওয়া যায়নি, বিভিন্ন তথ্য ও দৃষ্টান্ত সমস্যাকে আরো জটিল করে তুলেছে, দেশবাসী আরো আলোড়িত হয়েছে। আজও নেতাজীর যথার্থ মূল্যায়ন হয়নি। তাঁর  জীবনাদর্শ আজও  রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রয়োগ হয়নি,  কিন্তু একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, তার মৃত্যুঞ্জয় উপস্থিতি যুগ হতে যুগান্তরে মুক্তিসংগ্রামী মানুষের মনে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু -- নামেই এক অপার শ্রদ্ধা, এক প্রাণ গর্ব আমাদের। তাঁর জন্য অহঙ্কারের শেষ নেই আপামোর বাঙালির।আর যেখানেই তিনি পদার্পণ করেছেন, সেই জায়গা যেন তীর্থভূমি হয়ে গিয়েছে আমাদের কাছে ।  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুভাষচন্দ্রকে 'দেশনায়ক'  আখ্যা দিয়ে তাসের দেশ নৃত্যনাট্যটি তাঁকে উৎসর্গ করেন। উৎসর্গপত্রে লেখেন: " স্বদেশের চিত্তে নূতন প্রাণ সঞ্চার করবার পূণ্যব্রত তুমি গ্রহণ করেছ, সেই কথা স্মরণ করে তোমার নামে ‘তাসের দেশ’ নাটিকা উৎসর্গ করলুম ।" আজাদ হিন্দ ফৌজের অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলেও, সুভাষচন্দ্রের শৌর্য ও আপোষহীন রণনীতি তাঁকে ভারতব্যাপী জনপ্রিয়তা দান করে। নেতাজির জন্মদিন বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে একটি রাষ্ট্রীয় ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। স্বাধীনতার পর কলকাতার একাধিক রাস্তা তাঁর নামে নামাঙ্কিত করা হয়। বর্তমানে কলকাতার ইন্ডোর স্টেডিয়াম নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম তাঁর নামে নামাঙ্কিত। নেতাজির জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে দমদম বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তিত করে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রাখা হয়। তাঁর নামে কলকাতায় স্থাপিত হয় নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও নেতাজি সুভাষ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং দিল্লিতে স্থাপিত হয় নেতাজি সুভাষ ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি। কলকাতা মেট্রোর দুটি স্টেশন বর্তমানে নেতাজির নামাঙ্কিত: "নেতাজি ভবন" (পূর্বনাম ভবানীপুর) ও "নেতাজি" (পূর্বনাম কুঁদঘাট)।

দেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে ভারতভূখণ্ডের মুক্তিপুরুষ নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ঐক্যবদ্ধ ভারতীয় জনগণের সাম্রজ্যবাদবিরোধি আন্দোলনের ও সমিজবাদপ্রতিষ্ঠার শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি। তাঁর অসামান্য জীবন জাতীয় আন্দোলনের অধ্যায় থেকে অধ্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত। সমকালীন ভারতবর্ষে সুভাষচন্দ্রের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি রহস্যময়়তার অন্তরালে অন্তর্হিত হলেও সমসাময়িক জীবনে তিনি এক যুগ-নায়কের আসনে   সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন। অনেকটা রূপকথার মত তাঁর জীবনের ও ভারতের মুক্তিসাধনার জন্য নিরিবিচ্ছিন্ন সংগ্রামের কাহিনী দেশের প্রায় ৭৫ বছরের ইতিহাসের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে। সঙ্গীতের জগৎ  তাঁকে দিয়েছে প্রার্থিত শক্তি ও মনোবল। সঙ্গীতের মধ্যেই তিনি  শুনেছেন মৃত্যুর ভয়াল-ভয়ঙ্ক গর্জন, এবং বজ্রের মধ্যে শুনেছেন বাঁশির সুর অশান্তির অন্তরেই তিনি দেখেছেন শান্তি সুমহান। তিনি ছিলেন আজন্ম আশাবাদী বর্ণময় মানুষ। প্রখ্যাত আইরিশ কবি জর্জ রাসেলের একটি কবিতা ছিল তাঁর জীবনের মহামন্ত্র স্বরূপ-- 'And even when the crushed jewels drop and fade,' -- আপোষহীন সংগ্রামের মহানায়ক সুভাষচন্দ্রের  মুক্তি ও বিপ্লবের মন্ত্র ছিল সঙ্গীত ও কবিতা যা জীবনের প্রেরণার মন্ত্র। এসো তুমি,ঝলসিত সূর্য কিরণ দূর--বহু দূরের পথঅতিক্রম করে কোটি কোটি মানুষের বেদনার্শ্রুবিমথিত জয় পতাকা হাতে নিয়ে। মানুষের মনে যাঁরা চিরস্থায়ী পদাঙ্ক এঁকেছেন, তাদের জীবনের উদয় ও অস্ত  দুটি তারিখ ই  ইতিহাসে থাকে;জন্মোৎসব ও মরণোৎসব   সম্পন্ন করে উত্তরপুরুষ তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে। নেতাজি আজ  স্বাধীন ভারতে যে আলোকে প্রকাশিত তাতে রাজনৈতিক সংশয়ের  কোনও আবিলতা নেই, দৃপ্ত মধ্যদিনে  তাঁর পরিচয় সুস্পষ্ট। বহু সংগ্রাম, নিঃস্বার্থপরতা,মানবিকতা বোধ,প্রাণময়তা ও অভিজ্ঞতা আত্মসাৎ করেই  সুভাষচন্দ্র এই অজেয় জীবনীশক্তি লাভ করেছিলেন। মানবিক ও মানসিক শক্তির কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে  চিত্তকে  প্রসারিত করতে পেরেছিলেন বলেই নেতাজি তাঁর দৃষ্টিকে নিয়ে যেতে  পেরেছেন স্বদেশের সীমা অতিক্রম করে ইতিহাসের দূর বিস্তৃত ক্ষেত্রে। কোন  পরাভবকেই তিনি অন্তিম সত্য বলে  কোনোদিন মেনে নিতে পারেননি। তাই সুভাষচন্দ্রের চারিত্রিক শক্তিকে আজ স্বাধীন দেশের অন্তরের  মধ্যে সঞ্চারিত করে দেবার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। আগামী প্রজন্মের তরুণদের আদর্শ হোক তাঁর অমলিন জীবনাদর্শ।

তথ্যসূত্র আনন্দবাজার পত্রিকারআর্কাইভ ও বিভিন্ন ধরনের গবেষণামূলক গ্রন্থ, নেতাজি রিচার্স ব্যুরো।

 

ডঃ সুবীর মণ্ডল
লোকগবেষক, ছোটগল্প, প্রাবন্ধিক ও ভ্রমণ কাহিনীর লেখক 
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top