সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

ভিনদেশী হলেও তারা আমাদের পরম বন্ধু : অনজন কুমার রায়


প্রকাশিত:
২২ মার্চ ২০২২ ২২:২২

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ১৯:৪৫


মার্চ মাস, ১৯৭১ সাল- মনে হলেই হৃদয় কম্পিত হয়ে আসে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ছিল নির্মম গণহত্যার দিন। তাই, স্বাধীন বাংলাদেশের অনেক গল্প শুনেছি। শুনেছি; মানবিক বিপর্যয়ের কথা, নির্যাতীত মানুষের হাহাকার, বাস্তুহারা মানুষের বেদনাহত হৃদয়, ক্ষত-বিক্ষত শোষিত বাঙালীদের আর্তনাদ। একদিকে ভিয়েতনাম যুদ্ধ অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হয় নারকীয় গণহত্যা। প্রচুর মানুষ সীমানা পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। ভয়াবহ সাইক্লোনে পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণে খাদ্য সংকট দেখা দেয়। শরণার্থী শিবিরে খাবার এবং ওষুধের জোগান দিতে হিমশিম খেতে হয়, কলেরার প্রাদুর্ভাবে জনজীবন বিপর্যস্ত। তা সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের উপর হামলা অব্যাহত থাকে। তবে, তাতে বাঙালী দমে যায়নি। তার পেছনে ছিল এক আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন, যে স্বপ্ন অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে আস্তে আস্তে ডানা মেলেছিল। সে সময় যেমন বাঙালীরা দেশের জন্য লড়াই করেছেন তেমনিভাবে ভিনদেশী, ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষও বাংলাদেশকে নির্মোহভাবে সমর্থন দিয়ে গেছেন।
তাঁদেরই একজন অ্যালেন গিন্সবার্গ। তিনি ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতা লিখে পশ্চিম পাকিস্তানীদের নির্মমতা এবং বর্বরতার বাস্তব চিত্র তুলে ধরেন। যে কবিতায় বাস্তুহারা শরণার্থীদের টিকে থাকার লড়াইয়ে করুণ কাহিনী হাজারো মানুষের বিবেককে নাড়া দেয়।
বিশ্বের যে সকল মানবতাবাদী মানুষ বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার আদায়ে সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধে একাত্মতা পোষণ করেছিলেন তাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর অ্যাডওয়ার্ড কেনেডি অন্যতম। বাংলাদেশে গণহত্যার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। ভারতে এক কোটি শরণার্থীর দুর্দশা প্রত্যক্ষ করে জুডিশিয়ারী কমিটির কাছে রিপোর্ট করেছিলেন। এ রিপোর্টে কেনেডি পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যার কথা তুলে ধরেছিলেন মার্কিন প্রশাসনের সামনে।
তবে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ভয়াবহ নির্যাতন আন্তর্জাতিকভাবে প্রথম তুলে ধরেন আর্চার ব্লাড। তিনি ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত। গণহত্যার ভয়াবহতা জানিয়ে আর্চার ব্লাড ৬ এপ্রিল ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্টে তীব্র ভাষায় একটি টেলিগ্রাম পাঠান। এটি 'ব্লাড টেলিগ্রাম' নামে পরিচিত। শাস্তিস্বরূপ তাকে ঢাকা থেকে প্রত্যাহার করা হয়। আর্চার ব্লাড পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের জন্ম নিয়ে একটি বইও লিখেন। ২৫ মার্চ তারিখের ভয়াল রাতে তাঁর অনেক বন্ধু মারা যান। যে কারণে বইটি লিখতে গিয়ে তিনি মনোকষ্টে কেঁদে ফেলেন!
তখনকার সময়ে এত উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না, যেটুকু খবর পাওয়া যেত আকাশবাণী কলকাতা কিংবা বিবিসি’র কল্যাণে। আকাশবাণী কলকাতা থেকে প্রচারিত খবর যেন মুক্তিকামী মানুষের কথাই বার বার জানান দিয়েছিল। যিনি ভরাট কন্ঠে ‘আকাশবাণী কলকাতা’ থেকে আবেগমাখা খবর পড়তেন তিনি হলেন দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। এক স্বাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন, 'অদেখা পূর্ববঙ্গের অচেনা বঙ্গভাষীদের প্রতি নৈকট্যবোধে আমার মন আপ্লুত হয়েছে বার বার। আর কল্পনায় গড়ে তুলেছিলাম বাংলাদেশ নামের একটি মানসী মূর্তিকে'।
অর্থাভাবে দিন যাপন করে মানবিক কাজে উদ্বুদ্ধ হওয়া অত্যন্ত কঠিন কাজ। সেই কঠিন কাজটুকু করেছিলেন ভারতের শিবাজী রেল স্টেশনের মুচি সম্প্রদায়। নিত্যদিন স্বল্প আয়ে জীবন অতিবাহিত করেও তারা ঘোষণার মাধ্যমে একদিনের মজুরি বাংলাদেশের শরণার্থীদের দান করেছিল। সে কাজটি উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন সময়ে ভারতের একজন মন্ত্রী।
ভিন্ন দেশ, ভিন্ন সংস্কৃতি তারপরও বেদনার্ত হৃদয়ের মুর্ছনায় পÐিত রবি শঙ্কর এবং জর্জ হ্যারিসন আহ্বান জানান আমেরিকাবাসীদের। মেডিসন স্কয়ারে সেদিন তাঁরা প্রমাণ করেছিলেন, বুলেটের চেয়েও একটি গান বেশি শক্তিশালী। তারা নিখাদ মন থেকে বাঙালীদের ভালবাসতে শিখেছিলেন। তাই, গানের ভিতর দিয়েই সুরের মুর্ছনায় মানবতাবোধ জাগিয়ে তুলেছিলেন। জানান দিয়েছিলেন বাঙালীদের উপর নির্মম হত্যার প্রতিবাদ।
বস্তুত; ১৯৭১ সালে মানবিকবোধ সম্পন্ন মানুষগুলোর মাধ্যমে বিশ্ব শুনতে পেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে নির্যাতীত মানুষের হাহাকার। এদের কেউ বর্বরতার চরম পর্যায় দেখে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তেমন কাজটি করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ান ডাচ কমাণ্ডো অফিসার ওডারল্যাণ্ড। বুঝাতে চেয়েছিলেন হিংস্ত্রতা কিংবা অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে হলে ভিনদেশী মানুষ হলেও চলে। নির্যাতনের ছবি তুলেছেন ভারতীয় ফটোগ্রাফার কিশোর পারেখ। অন্যদিকে, ছবি তুলার পাশাপাশি কলম হাতেও গর্জে উঠেছিলেন দ্য টেলিগ্রাফের সাংবাদিক সায়মন ড্রিং ও মার্ক টালি। পাকিস্তানী সেনাদের নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেন সায়মন ড্রিং। যুদ্ধ বিধ্বস্ত কোন এক সময়ের অবস্থা সাংবাদিকদের প্রতিকূলে যায়। প্রতিকূল অবস্থায়ও অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে তিনি দায়িত্ব পালণ করেন। তাঁর ক্যামেরায় ধারণ করা ছিল পূর্ব পাকিস্তানে নির্যাতনের হৃদয় বিদারক ছবি। সেগুলো নিয়ে জীবন বাজি রেখে চলে যান ব্যাংককে। বিশ^বাসীর সামনে নিয়ে আসেন বাংলাদেশের যুদ্ধ ও নির্মম বাস্তবতাকে। যার ফলে বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছিল। সেখান থেকে প্রকাশ করেছিলেন ‘ ট্যাঙ্কস ক্রাশ রিভল্ট ইন পাকিস্থান’।
বাংলাদেশের নিরীহ জনগণের নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার কাজ করেছিলেন পল-কনেট দম্পতি। মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দান, বাংলাদেশে খাদ্যসামগ্রী এবং ওষুধ পাঠানোর জন্য “ অপারেশন ওমেগা” নামক সংস্থা গঠন করেন।
যারা নিজের জীবনকেও অতি তুচ্ছ মনে করে মানবতাবোধে জেগে উঠেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন বেলজিয়ান নাগরিক মারিও রয়ম্যান্সস এবং ফরাসী নাগরিক জ্যঁ ক্যুয়ে। মারিও রয়ম্যান্সস বেলজিয়ামের ফাইন আর্টস প্যালেস থেকে 'লাভ লেটার' নামে একটি বিখ্যাত চিত্রকর্ম চুরি করেন। ২০০ মিলিয়ন বেলজিয়ান ফ্রাঁ' র বিনিময়ে চিত্রকর্মটি ফিরিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ওই ২০০ মিলিয়ন বেলজিয়ান ফ্রাঁ দাবি করেছিলেন বাংলাদেশের শরনার্থীদের সহায়তার জন্য, নিজের জন্য নয়। ফলে, পুরো বেলজিয়াম জুড়ে তাঁর সমর্থন ছড়িয়ে পড়ে। যদিও বেলজিয়াম সরকারের পক্ষ থেকে দাবিটি মানা হয়নি। অন্যদিকে, জ্যঁ ক্যুয়ে ফ্রান্সের আর্লি বিমান বন্দরে পাকিস্তান এয়ারওয়েজে পিস্তল দিয়ে পুরো বিমান জিম্মি করে রাখেন। বিমানটি পাকিস্তানী নাগরিকে ভর্তি ছিল। তাঁর দাবি ছিল পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধরত মানুষ এবং শরণার্থীদের জন্য ২০ টন ওষুধ এবং ত্রাণ পাঠাতে হবে।
পশ্চিম পাকিস্তানের নির্যাতন এবং হামলার শিকার হয়ে প্রতিবেশি দেশ ভারতে পালিয়ে অবস্থান নেয় প্রায় এক কোটি বাঙালী। তখন বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ভারতে আশ্রয় নেওয়া প্রায় এক কোটি শরণার্থীদের খাদ্য ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন। পাশাপাশি বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তুৃলেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘুরে ঘুরে জনমত গড়ার মতো কঠিন কাজটুকু একনিষ্ঠভাবে সম্পন্ন করেছিলেন। বুঝাতে চেয়েছিলেন ‘যা হচ্ছে তা অমানবিক, বর্বরোচিত হামলা ’।
বহু পথ পেরিয়ে শোষণমুক্ত হয়ে আমরা স্বাধীনতা লাভ করি। যে মানুষগুলো আমাদের দেশের নন তারাও এ দেশের স্বাধীনতা অর্জনে অবদান রেখেছেন। তারা দেখিয়েছিলেন, ইচ্ছা থাকলেই মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায়। তাদের শক্তি আমাদের রণাঙ্গনে যোদ্ধাদের সাহস সঞ্চার করেছিল। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ভিনদেশীদের এ সকল মানবিক উদ্যোগ ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।

 

অনজন কুমার রায়
 ব্যাংকার ও লেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top