সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

‘দেড় নম্বরি’ প্রকৃতি, পরিবেশ, মানুষ এবং সর্বোপরি জীবনকে দেখার এক অনবদ্য আয়না : মোঃ ইয়াকুব আলী


প্রকাশিত:
১৪ এপ্রিল ২০২২ ০০:৪৪

আপডেট:
১৯ এপ্রিল ২০২৪ ০৬:১৭

ছবিঃ কিযী তাহনিন

 

কিযী তাহনিন এর নতুন বই 'দেড় নম্বরি' প্রকাশ পেয়েছে অমর একুশে গ্রন্থমেলার ২০২২ এর একেবারে শেষের দিকে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলাম কবে সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে আমার হাতে এসে পৌঁছাবে। অবশেষে সিডনির একমাত্র বইয়ের দোকান 'প্ৰশান্তিকা বইঘর' এনে দিলো সেই সুযোগ। বইটা হাতে পেয়েই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটা কথা লিখেছিলামঃ "প্রকৃতি, মানুষ এবং জীবনের প্রতি অসীম ভালোবাসা নিয়ে 'দেড় নম্বরি' এখন সিডনিতে।" এই বইয়ের জন্য কথাটা অক্ষরে অক্ষরে সত্য।
শুরুতেই বইটার ফ্ল্যাপের দিকে নজর দেয়া যাক। দেড় নম্বরি'র নয়টি গল্পে প্রেম এসেছে নানা ছুতোয়, অলগলি পথ ধরে। জীবনের মতন করে। কখনো পুরোনো দেয়ালের শ্যাওলার মতন, নাছোড়বান্দা। ডিমের কুসুমের এক কোণেও শামুকের মতন প্রেম জন্মে। লোভী দাঁতগুলো টকটক করে ওঠে নরম মাংসের ভালোবাসায়। করোও কাছে প্রেম শীতকালের মতন, গুটিশুটি আদুরে বেড়াল, মটরশুটির দানা। কখনো প্রেম শকুন্তলা দেবীর একান্ত, সেই প্রেমের সুতোয় টান দিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে রোজিনা। প্রেম এসেছে খেলার পুতুল হয়ে, এসেছে সবুজ নেইলপলিশের ঝিকমিকে কৌটায়, শেষটুকু দেখার আশায়। যতবার জীবন এসেছে, প্রেম কি আসেনি? বিষাদ হয়ে, অপেক্ষা হয়ে?
এইবার একটু বইটির গল্পগুলোর দিকে নজর দেয়া যাক। গল্পগুলোর নাম খুবই চমকপ্রদ। নামগুলো পড়ার পরই মনের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হয় গল্পের বিষয়বস্তু কি হতে পারে সেটা নিয়ে। আবার মনেহয় এমন শিরোনাম দিয়েও গল্প লেখা যায়? কিন্তু গল্পটা শেষ করার পর মনের মধ্যে বিস্ময় কাজ করে। লেখন কি সুনিপূণভাবেই না গল্পের নামের প্রতি সুবিচার করেছেন। প্ৰত্যেকটা গল্পই খুবই সাধারণ চেনা জীবনের গল্প? আসলেই কি তাই? গল্পগুলো সাধারণ হলেও লেখকের নিজস্ব উপমারগুণে লেখাগুলো হয়ে উঠেছে হৃদয়গ্রাহী। আর উপমা দিতে যেয়ে উনি কোন কঠিন শব্দের আশ্রয় না নিয়ে একেবারে দৈনন্দিন জীবনের সব বাস্তব রূপক ব্যবহার করেছেন।
আর একটা বিষয় অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। সেটা হলো প্রত্যেকটা ঘটনার বা দৃশ্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ। বিবরণ পড়তে যেয়ে মনেহয় এমনভাবেও কি কোন ঘটনার বিশ্লেষণ সম্ভব। যেখানে প্রায় সব লেখায় লেখকের কল্পনার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। কিন্তু ঐ বাড়তি বিবরণটুকুই কিযীকে করে তুলেছেন অন্যদের চেয়ে আলাদা। গল্পগুলো পড়ার পর মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন তৈরি হয়। একজন লেখক আসলে কতটা কল্পনা করতে পারেন? একজন লেখক আসলে কতটা স্বপ্নবান হন? আমরাও তো স্বপ্ন দেখি কিন্তু ঘুম ভেঙে যাওয়ামাত্রই কিন্তু আমরা স্বপ্নের কথা গুলিয়ে ফেলি বা ভুলে যায়। এছাড়াও দৈনন্দিন জীবনে আমাদের চারপাশে কতশত ঘটনায় তো ঘটে। আমরা তার কয়টায় বা খেয়াল করি বা করতে পারি? একজন সাধারণ মানুষের সাথে একজন লেখকের বোধহয় এখানেই তফাত।
এইবার আসা যাক গল্পের বিষয়বস্তু এবং বিবরণের দিকে। লেখাটা বড় হয়ে যাচ্ছে কিন্তু বিবরণের কিছুটা ঝলক আপনাদের দেখানোর সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইছি না। বইয়ের শেষ গল্প 'দেড় নম্বরি'র নাম বইটার নামকরণ। আমি যখন বইটার নাম প্রথম শুনি খুবই অবাক হয়েছিলাম। এমনও কি কোন গল্পের বইয়ের নাম হতে পারে কিন্তু দেড় নম্বরি গল্পটা পড়ার পর মনেহলো এটাই তো স্বার্থক নাম। সৈয়দপুরের বড়বাজারের এক দোকানির এবং তার প্রেমের গল্প দেড় নম্বরি অথবা মফস্বল একটা শহরের জীবপ্রবাহের গল্প। কারণ এই গল্পে প্রেমের পাশাপাশি এসেছে সামাজিকতা, সামাজিক দায়বদ্ধতা, জীবিকার টানাপোড়েনসহ জীবনের অনেক খুঁটিনাটি বিষয়।
পাঠকের বোঝার সুবিধার জন্য আমি কিছু কিছু উপমা এবং বিবরণ তুলে দিচ্ছি। লেখক মনোহারি ফেরিওয়ালার হাতের বাক্সের বর্ণনা দিয়েছেনঃ কাচের ঢাকনাওয়ালা কাঠের পাতলা বাক্সে জিনিস ভরে, মঙ্গল আর শুক্রবার হাটে, আর বাকি দিনগুলো গ্রামের এ-বাড়ি ও-বাড়ি ঘুরে ঘুরে বিক্রি করে ফেরিওয়ালা। গ্রামীণ জীবনপ্রণালীতে মানুষের জীবন খুবই ধীরস্থির। সেটার বর্ণনা দিতে যেয়ে লিখেছেনঃ 'পূজার পর একটু আস্তে ধীরে সময় যাচ্ছে। প্রতিবছরই এমন যায়। ফেরিওয়ালা আর পাতি ব্যবসায়ীরা এসময় একটু শুয়ে বসে গড়িয়ে নেয়। যাদের টুকরো জমিজমা আছে, ধান চাষ করে। কেউ জমি বর্গা নেয়।' গ্রামীণ অধিপতিদের কথাবার্তাকে বলা হয়েছে। 'পানের পিকের মতন ছিটিয়ে দেয় ফাঁকা ন্যায়ের বুলি।' এতো কিছুর মধ্যেও এগিয়ে চলে একটা প্রেমের গল্পঃ 'কিন্তু আমরা দুইজন তাকাই দুজনের দিকে, সেই প্রথম প্রেমের মতন, আবার।'
বইয়ের প্রথম গল্পের নামঃ 'এখানে হৃদয় ঝালাই করা হয়।' প্রথম কটা লাইন তুলে দিচ্ছি - 'এখানে হৃদয় ঝালাই করা হয়। হলুদের মধ্যে সাদা লেখা, পাশে চ্যাপ্টা সবুজ হৃদয় আঁকা এক সাইনবোর্ড।' এখানে একটা দৃশ্যের বর্ণনা লেখক লিখেছেনঃ 'গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি শেষে ফুরফুরে চারপাশ। থেকে থেকে ঠান্ডা বাতাস ঝাপটা দেয়। কাবাব খাওয়ার জন্য এক মখুনে সময়। পাঁচ টুকরো গরুর কাবাব, শসা আর মুলা মাখানো সালাদ আর হলুদ আপেলের রস কিনে প্রতিবারের মতন ওই বেঞ্চিতে বসলাম।' হৃদয়ের কবিরাজের একটা কথা আছে এমন - আপনার হৃদয়ের ভেতরটা নিয়ে কাজ করি, ডাক্তাররা তো ওটার শরীর কাঁটাছেড়া করে। ষাটোর্ধ বয়সের প্রেম নিয়ে কিছু কথা এমন - 'আমারও যে যাওয়ার ইচ্ছা নেই তা তো না। শুধু মনে হচ্ছিল একটা ধাক্কা দরকার।'
'নীল রং বেনারসি' গল্পের একটা বিবরণ এমন - 'বুড়িগঙ্গার পাশঘেঁষা আলমগঞ্জের একটা পুরোনো বাড়ি আমাদের। একদম বাতাসার মতন। বাইরে দেখতে জমিদার বাড়ি যেন। কিন্তু ভেতরটা ফাঁপা।' একজন পৌঢ়ের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে এইভাবেঃ 'স্বাধীন দেশে আমার নানী রয়ে গেল এ বাড়ি জুড়ে। স্বাধীনতা যেমন আছে, আমার নানীও রয়ে গেছে এ দেশের প্রতিদিনের মানুষ হয়ে।' পৌঢ় বয়সের উত্তেজনা নিয়ে লেখক লিখেছেনঃ 'থমকে যাওয়া রোদের দিনের পর বিকেলে একটু বাতাস পেলে, বটগাছের পাতা যেমন করে দোলে, তেমন। নানী দুলে বিছানা থেকে উঠে বসে।'
উপহার গল্পের প্রথম লাইনগুলো এমন - 'কোন মানুষ কাঁদলে তাকে এত সুন্দর লাগে, আমার ভাইকে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। টসটস করে যেন চোখ থেকে ঝরছে পাকা লিচুর রস।' ঢাকা শহরের অলিগলিতে কত রকমের মানুষের বসবাস। এটা তুলে ধরতে যেয়ে লেখক লিখেছেনঃ 'কিন্তু বড় এলাকার ভেতরে ছোট ভাঁজগুলোতে আরও অনেক রকম মানুষ থাকে।' আবার তাদের জীবনযাপনের প্রণালী সম্মন্ধে লিখেছেনঃ 'এক ঈদে আমরা নতুন কাপড় কিনি। আমাদের দুই ভাই বোনের জন্মদিনে আর ঈদের দিন এক বেলা পোলাও রান্না হয় আর মুরগির কোর্মা।'...'আমাদের আশেপাশের মানুষগুলো আমাদের থেকে তেমন আলাদা নয়। আমাদের মতনই চাওয়া-পাওয়ার জোড়াতালিতে কাঁথাসেলাই করে করে চলে।'
'শকুন্তলা দেবী কিংবা রোজিনা' গল্পের একটা মুহূর্তের বর্ণনা এমন - 'আমার সামনে বসে থাকা শকুন্তলা কোন বেদিতে নয় বরং পুরনো কাঠের ঘুণে ধরা, আমসত্ত্ব চেহারার একখানা পিঁড়ির ওপর বসে বঁটিতে রুই মাছ কাটছেন।' নাকফুলের উপর ছুটে পড়া মাছের রক্তকে লেখক দেখছেন এইভাবে - 'সবুজ পাথরের সোনার নাকফুল লাল রক্তজবা রং, কেমন কবিতার মতন সব।' বন্ধুত্বের স্বরূপ বুঝাতে যেয়ে লেখক লিখেছেনঃ 'সেই কত বছর আগের হারানো গুনগুন তিন মাসের প্রেম, আজকের ঘন গাঢ় বড়বেলার প্রেম, সব হারিয়ে যে আমি কুলহারা হয়ে যাচ্ছি। শ্রাবন্তীকে তুলে দিচ্ছি ডাঙায়। আমরা যে এমন করেই বন্ধু।'
'সাত পেটে পুতুলেরা' গল্পের প্রথম লাইনটা এমন - 'ধর, তোর-আমার এই যে সম্পর্ক, সেটা শেষ হবে বিচ্ছেদে।' জীবনের বোধ সম্মন্ধে এই গল্পে বলা হয়েছে - 'মানুষ তো খেলে মিথ্যা নিয়ে। সত্য নিজেই এত দাপুটে, তাকে নিয়ে খেলবে কে?' সংসার জীবনকে তুলনা করা হয়েছে সাত পেটে পুতুলের সাথে। এই পুতুলের একটার পেটের মধ্যে যেমন অন্য একটা পুতুল থাকে আবার তার পেটের মধ্যে অন্য একটা তেমনি সংসারের সবচেয়ে বড় পুতুলটা মনেহয় বাবা তারপর মা তারপর একে একে সকল সন্তানাদি। এখানে সবাই সবাইকে জড়িয়ে থাকে। সবাই সবার যত্ন নেয়।
'মানুষওয়ালা বাসা' গল্পটার প্রথম কিছু লাইন এমন - 'আমরা একটা বাসা কিনেছি, সাথে সাথে দুজন মানুষ পেয়েছি। ঠিকঠাক করে বলতে গেলে, দুজন মানুষসহ একটা বাসা কিনেছি।' আমাদের পিতামারা কেন প্রবাসী হতে চান না তার ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়েছে - 'এই ৬০-এর মাঝামাঝি বয়সে এসে অন্য দেশে ডালপালা ছড়িয়ে বসা সম্ভব না, আম্মা তাই যেতে চায় না।' এই গল্পে ফ্ল্যাট এবং বাসার একটা সূক্ষ্ণ ব্যবধান টানার চেষ্টা করে লেখক লিখেছেনঃ 'ফ্ল্যাট কেমন গ্রিলে ঠাসা, মানুষের শরীরের মতন জবুথবু ক্লান্ত শোনায়। বাসা বললে মনেহয় খোলা জানালার এলোমেলো পর্দা, মানুষের ভাবনার মতো বাধাহীন।' আনন্দের আতিশয্যে মানুষের আনন্দের বহিঃপ্রকাশকে লেখক তুলনা করেছেন 'চুলায় খিচুড়ির গলে গলে ফুটে ওঠা টগবগে ডালের মতন, আম্মার ঠোঁট চোখ কেমন কেঁপে কেঁপে ওঠে।' সম্পর্কের রসায়ন নিয়ে লেখক লিখেছেনঃ 'আমি আম্মার সাথে বেশিদিন এই বাড়িতে থাকবো না, মন কেমন সুতার মতন কেটে কেটে যায়।...আম্মা আর শাহিনা পারভীনের টুকরো ছিঁড়ে যাওয়া সম্পর্ক এ কদিনে আবার কেমন বুনে বুনে রুমাল হয়ে ওঠে। তারা কেমন এক হয়ে জড়াজড়ি সময় কাটায়।'
'ডিমের কুসুম' গল্পে মানুষের স্বপ্নকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকার গল্প। লেখকের ভাষায় - 'স্বপ্নটা নতুন। শফিকুলের জীবনের নতুন যা কিছু এসেছে, তা খুব সুখের হয়নি। নতুন এ স্বপ্নটা বড্ড ভারী লাগছে।' 'শীতকালের গল্প' শুরু হয়েছে একটা খাপছাড়া কবিতা দিয়ে -
'মটরশুঁটি ফুটছে তেলে
রোদ নেমেছে গঙ্গাজলে।'
এই কবিতা নিয়ে বলা হয়েছে - 'আছে খসখসে শীতে ছোট হয়ে আসা কুঁচকে যাওয়া দিনের দিনের দাপটহীন আলোর মতন সত্য।' এই গল্পে কিছু চিরায়ত বাংলাদেশের কথা উঠে এসেছে। যেমনঃ আব্বা বললেন - ''মাইর একটাও মাটিতে পড়বে না।সম্পর্ক তৈরির একটা উদাহরণ এমন - 'কিন্তু উনার দেবরের বড় জ্যাঠাশের ননদের জামাইয়ের এক ভাগ্নির সাথে আমার বিয়ের কথা চালালেন।' আর অবশ্যম্ভাবী হয়ে এসেছে শীতকালের সবচেয়ে বড় অনুষঙ্গ 'জমে যাওয়া নারিকেলে তেল।' লেখকের ভাষায় - 'দাদির হাতে বানানো খাঁটি নারিকেল তেল শীত আসলেই কেমন মোমের মতন সাদা হয়ে যেত।...তবুও বয়সের গুণে, হাঁপানি উলের গোলা, জমাটি নারিকেল তেলের চিটচিটে বিড়ম্বনাময় এক শীতে, আমার মনের শুকনো পাতার গাছে বসন্তরঙা টুকটুকে ডালিম জন্ম নিল।'
পরিশেষে এক কথায় বলা যায় - দেড় নম্বরি একটা সুখপাঠ্য বই। প্রকৃতি, পরিবেশ, মানুষ এবং সর্বোপরি জীবনকে দেখার এক অনবদ্য আয়না। হয়তোবা সেই আয়নায় আপনি নিজের ছবিও খুঁজে পেতে পারেন। আমি ইচ্ছে করেই প্রতিটা গল্পের প্রেমের প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেলাম। লেখকের ভাষায় - 'আমি জানি আমার পাঠকেরা আমার চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিমান, ভাবতে জানে। আমি নিশ্চিত তারা সে প্রেমও খুঁজে নেবে গল্পে, যাকে আমি আড়াল করে রেখেছি।'

 

মো: ইয়াকুব আলী

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top