সিডনী বুধবার, ৪ঠা ডিসেম্বর ২০২৪, ২০শে অগ্রহায়ণ ১৪৩১


'ক্লেপটোম্যানিয়া' একটি মানসিক রোগ : শাহানারা পারভীন শিখা


প্রকাশিত:
৩১ আগস্ট ২০২১ ২১:১৯

আপডেট:
৩১ আগস্ট ২০২১ ২১:২৫

 

ঘটনা একঃ

মিলা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। হলে থাকে। গলার একটা স্বর্ণের চেইন আর কানের একজোড়া দুল নিয়ে আসছে। কোথাও ঘুরতে গেলে মাঝে মাঝে পরে।আজও পরেছিল।সন্ধ্যায় হলে ফিরে চেইন টা খুলে ওর টেবিলের ড্রয়ারে রেখে বাথরুমে চেঞ্জ হতে যায়। এরপর আর চেইন এর কথা ওর খেয়াল হয়নি।ঘুমাতে যাওয়ার সময় হঠাৎ মনে হওয়ায় উঠে ড্রয়ার খুলে দেখে চেইনটা নেই। ভালো করে খুঁজে পাইনা ও। লজ্জায় বড় আপুদের কিছু বলতেও পারে না।
পরের দিন ওর মন খারাপ দেখে রুমের এক আপু ওকে মন খারাপের কারণ টা জিজ্ঞেস করে।
"আপু আমার গলার চেইন টা কাল খুলে ড্রয়ারে রাখছি। কিন্তু আর পাচ্ছি না। "
দ্রুত রুমমেটরা চোখাচোখি করে নেয়।
এর আগেও এই একই ঘটনা ঘটেছে রুমে।
দিলুর একজোড়া কানের দুল হারিয়ে গেছে রুম থেকে। সন্দেহটা শীলার দিকে। কিন্তু বেশ বড়লোকের মেয়ে ও। কিভাবে সম্ভব। তবুও খচখচ করে ওদের মন।
একদিন পলি ইচ্ছে করেই ওর চেইনটা টেবিলে রেখে বারান্দায় যায়।তখন রুমে শুধু শীলা ছিল।
ফিরে এসে পলি ওর চেইনটা আর পায়নি।
ঘটনা জানাজানি হয়ে যায় দ্রুত। অনেক চাপাচাপি করে শীলার ড্রয়ার খুলতে বাধ্য করা হয়। ড্রয়ার থেকে হারানো সব সোনার গয়না সাজানো পাওয়া যায়। ফলশ্রুতিতে শীলাকে হল ছেড়ে চলে যেতে হয়।

ঘটনা দুইঃ

বেশকিছুদিন থেকেই হলের তিনতলার বিভিন্ন রুম আর বারান্দা থেকে নানা জিনিস চুরি যাচ্ছে। ব্যবহার করা বিদেশি সাবান, শ্যাম্পু, লোশন এমনকি মেয়েদের ব্যবহৃত ভেতরের ছোট পোশাকগুলো ও।
সবাই অস্থির। কেমনে ধরা যায়!
ঠিকই একদিন মেয়েটি ধরা পরে যায়।
জয়া ওর বিদেশি সাবানটা গোসল শেষে বারান্দায় রোদে শুকাতে দিয়ে রুমে যায়।
দরজা দিয়ে প্রিয়াকে নিজের রুমে যেতে দেখে।
চুরি হওয়ার ভয়ে সাবানটা আনতে যেয়ে দেখে সাবানটা নাই।
সন্দেহের তীর টা প্রিয়ার দিকে। কিন্তু..
সাহস সঞ্চয় করে কয়েকজন মেয়ে হল অথোরিটিকে জানায়।
ম্যাডাম রেগেমেগে অস্থির।
প্রিয়ার বাবা-মা সহ পরিবারের সবাই প্রায় বিদেশে থাকে। ওর এক বোনের পরিবার শুধু দেশে আছে। প্রিয়ার পড়াশোনা শেষ হলেই ওরা চলে যাবে।
যে মেয়ের পা থেকে মাথা পর্যন্ত বিদেশি জিনিস থাকে। সে কিনা অন্যদের জিনিস চুরি করবে। তাও আবার ব্যবহার করা জিনিস।
ধমক দিয়ে সবাই কে চলে যেতে বলেন।
পরের দিন প্রিয়া ক্লাসে যায়।
ওর রুমমেট শায়লা কি একটা খুঁজতে যেয়ে প্রিয়ার তোশক টা একটু উঠিয়ে দেখে।
ওর চোখ কপালে!
প্রিয়ার তোশকের নিচে সবার হারানো ভিতরের ছোট জিনিসগুলো দেখতে পাই পাটে পাটে সাজিয়ে রাখা।
নিমেষে খবরটা রোটে যায়। হল ম্যাডাম এসে লকারটা খুলেন। লকারের মধ্যে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা ব্যবহৃত সাবান, সেন্ট, লোশন।
তলব করা হয় প্রিয়ার বোনকে। লজ্জায় মাথা নীচু করে থাকে ওরা। বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয় ওদের। আদরের প্রিয় বোনটা জন্ম থেকেই বিদেশি জিনিসের মধ্যে বড় হয়েছে।
বোনকে নিয়ে হল ছেড়ে চলে যায় তারা।

ঘটনা তিনঃ

পোশাকের নামকরা একটা শোরুমে শোবিজ জগতের একজন আসে। বেশ পরিচিত মুখ। প্রায় এই আউটলেটে আসে। অনেকগুলো করে পোশাক কেনে।
আজও আসছে। হাতে বেশ বড় সাইজের হাত ব্যাগ ধরা।বেশ কয়েকটি পোশাক পছন্দ করতে থাকে।
কাউন্টারে বিল দেয়ার সময় একজন এসে তাঁকে অন্য একটা রুমে নিয়ে যায়। ব্যাগটা চেক করার কথা বলতেই চিৎকার করে ওঠে সে।
কিন্তু ওরা নাছোরবান্দা। মহিলা সিকিউরিটি দিয়ে অনেকটা জোর পূর্বক ব্যাগটা খুলে দেখা হয়।
বেশ কয়েকটি পোশাকের প্যাকেট পাওয়া যায় ওটাতে।
আসলে সিসিটিভি ক্যামেরাতে ধরা পরে মেয়েটির কাপড়ের প্যাকেটগুলো ব্যাগে ঢুকানোর দৃশ্য। পরিচিত মুখ এবং রেগুলার কাস্টমার হওয়ার কারণে সে যাত্রায় মেয়েটিকে ছেড়ে দেয়া হয়।

ঘটনা চারঃ

রানু বাসা পাল্টে চলে এসেছে বান্ধবী পলির বাসার কাছাকাছি।পলির দু মেয়ে। পলি প্রায় ওর ছোট মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে আসে রানুর বাসায়। ওর বড় মেয়েটার বয়স বার/ তের হবে। রানু বড় মেয়েটাকেও সাথে আনতে বলে।
পলির বড় মেয়েটা বেশ শান্ত স্বভাবের।
ওরা বেশ কয়েকবার আসার পর রানুর খেয়াল হয়, ওর বেডরুমের ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে বিভিন্ন জিনিস হারিয়ে যাচ্ছে। কখনো বিদেশি নেলপলিশ, লিপস্টিক,হেয়ারব্রাশ ইত্যাদি। কিন্তু ঠিক মেলাতে পারেনা রানু। ওর বান্ধবীরা বেশ বড়লোক।নিজেদের বিশাল বাড়িতে থাকে। পলির বড় মেয়েটাকে মাঝে মাঝে ওর রুম থেকে বের হতে দেখেছে। ছিঃ এসব কি ভাবছে সে।
যাক! সামান্য জিনিসই তো।
রানু সেদিন এতোটাই অবাক হয়েছিল! যেদিন ওর বান্ধবী বিমর্ষ আর আড়ষ্টভাবে ওর হাতে ওর হারিয়ে যাওয়া জিনিসগুলো তুলে দিল।কান্না জড়ানো কন্ঠে বল্ল, ওটা ওর মেয়ের একটা রোগ।লজ্জায় কোন ডাক্তার দেখাতে পারেনা। সেজন্য ওকে পারতপক্ষে কোথাও নিয়ে যায় না।
রানুর মনটা খারাপ হয়ে যায়। এতো লক্ষ্মী একটা মেয়ে। অথচ..

ঘটনা পাঁচঃ

এটা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা।
রোকেয়া হলে উঠেছি সবে। রুমে সবাই বড় আপু। সবাই আমাকে বেশ আদর করে।এর মধ্যে এক আপু ছিল খুব শান্ত আর খুব লক্ষ্মী। সারাক্ষণ মুখে হাসি লেগেই থাকতো।
ডাইনিং এ খেতাম তিন বেলা। আমার নিজস্ব বেড ছিলোনা তখন। আপুদের সঙ্গে শেয়ারে থাকতাম। খাটের নীচে আমার ব্যাগ রাখতাম। খেতে যাওয়ার আগে বড় ব্যাগে রাখা পার্সটা বের করে টাকা বের করে আবার রেখে দিতাম। কয়েকদিন পর রুমের এক আপু আমাকে একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে বলেন,তুমি রুমে ওর সামনে ( সেই শান্ত আপু) কখনো টাকা বের করবে না।আমরাও কখনো ওর সামনে টাকা বা টাকার ব্যাগ বের করি না। ওর একটা সমস্যা আছে। ও টাকা দেখলে নিজেকে সামলে রাখতে পারে না।
ও খুব ভালো একটা মেয়ে। ওর এই অসুখটা আমরা বন্ধুরা সবাই জানি। এভাবেই আমরা ওকে সাহায্য করি। তুমি নতুন তো তাই তোমাকে জানিয়ে রাখলাম।

আমি এই রোগটা সম্পর্কে হালকা পাতলা জানতাম আগে থেকেই। তবে এভাবে জানতাম না। একটু অবাক হয়েছিলাম তখন। তবে খুব ভালো লেগেছিল রুমের সেই আপুদেরকে। রুমমেট বন্ধুকে ঘৃণা নয় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। চমৎকার সেই আপুটার দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে আমি ভাবতাম, আসলেই কি এটা সত্যি! কত বিচিত্র মানুষের জীবন।

উপরে উল্লেখিত সব ঘটনায় আমাদের চারপাশ থেকেই নেয়া। অভিজাত পরিবার, অভিজাত জীবন। তবুও এই ধরনের ঘটনা ঘটছে তাদের জীবনে। বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়ে যায় তারা।
তবে এটা যে তারা সেচ্ছায় করে এমনটা নয়।
এটা একটা রোগ। চাইলেও এরা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
ক্লেপটোম্যানিয়া। একটি মানসিক রোগ।
এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি অন্যের জিনিস চুরি করে থাকে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা এদের পক্ষে সম্ভব হয় না। ফলে নানাবিধ সমস্যায় পড়ে যায়। সামাজিক ভাবে হেয় হতে থাকে। অনেকে আত্মহত্যার মতো ভয়ানক ঘটনা ঘটিয়ে থাকে।

এই রোগের চিকিৎসা তেমন ভাবে নেই। আবার সামাজিকতার ভয়েও অনেকে চিকিৎসকের কাছে যেতে চান না। আমাদের এই ভয় কাটিয়ে উঠতে হবে।
পরিবারে কারো মধ্যে এই প্রবণতা দেখা গেলে মনোচিকিৎসা নিতে হব। পরিবারের সবার ভুমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সর্বোপরি রোগীর থাকতে হবে প্রচন্ড ইচ্ছে শক্তি। তাহলে সম্ভব অনাকাঙ্ক্ষিত কোন ঘটনা থেকে পরিত্রাণের।

 

শাহানারা পারভীন শিখা
কবি ও লেখক 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top