সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৫ই বৈশাখ ১৪৩১


পুরো বাংলাদেশকে করোনা ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা, বাড়ছে মৃত ও আক্রান্তের সংখ্যা


প্রকাশিত:
১৭ এপ্রিল ২০২০ ২১:৫৯

আপডেট:
১৯ এপ্রিল ২০২৪ ০৪:০৭

ফাইল ছবি

 

প্রভাত ফেরী: করোনা ভয়াবহ আকার ধারণ করায় পুরো বাংলাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ ঘোষণা দেওয়া হয়। এদিকে প্রথম করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত হওয়ার পর বাংলাদেশে ৩৮ দিনের মাথায় মৃত ও আক্রান্তের সংখ্যা সর্বাধিক সংখ্যা ছাড়াল। বিপর্যয় শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত একদিনে এত মৃত-আক্রান্ত শনাক্ত আর হয়নি। একদিনেই ১০ জনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৬০। ২৪ ঘণ্টায় আরও ৩৪১ জনের অর্থাৎ রেকর্ডসংখ্যক লোকের করোনাভাইরাস পজিটিভ পাওয়া গেছে। মারা যাওয়াদের মধ্যে সাতজন পুরুষ ও তিনজন নারী। ৫ জনের বয়স ৬১ থেকে ৭০-এর মধ্যে আর ৩ জনের বয়স ৫১ থেকে ষাটের মধ্যে। বাকি দুজনের একজনের বয়স  ৭১ থেকে ৮০’র মধ্যে এবং আরেকজনের বয়স ২১ থেকে ত্রিশের মধ্যে। নতুন মারা যাওয়া ১০ জনের মধ্যে ৬ জনই ঢাকায় মারা গেছেন। নতুন করে আর কেউ সুস্থ হয়নি। এ পর্যন্ত মোট ৪৯ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন।

এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি করোনাভাইরাস আক্রান্ত মানুষ শনাক্ত হয়েছে ঢাকায়। এরপরই রয়েছে নারায়ণগঞ্জ, যেই অঞ্চলকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের এপিসেন্টার মনে করা হচ্ছে। ৪৪টি জেলায় করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্তের খবর জানায় আইইডিসিআর। বৃহস্পতিবার করোনাভাইরাস সংক্রান্ত অনলাইন স্বাস্থ্য বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা এ তথ্য জানান।

অন্যদিকে দেশে যে পরিমাণ করোনা শনাক্তের পরীক্ষা হচ্ছে, তা সন্তোষজনক নয় বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এতে আক্রান্তের ঝুঁকি বাড়ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরীক্ষা বেশি হলে রোগ ছড়ানোর আগেই রোগী চিহ্নিত করা সম্ভব। এতে সংক্রমণ রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতেও সুবিধা হবে। পরীক্ষাকেন্দ্রগুলোর লোকবল ও মানেও ঘাটতি রয়েছে। নমুনা সংগ্রহ মানসম্মত না হলে সঠিক ফল পাওয়া যাবে না।

বাংলাদেশে শুরুর দিকে মানুষের মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণ কম হলেও গত কিছুদিনে ওই হার বেড়েছে বলে স্বাস্থ্য বুলেটিনে জানান অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা। তিনি বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ সংখ্যক নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। একই সঙ্গে পরীক্ষাও করা হয়েছে। এ সময়ে পরীক্ষা করা হয়েছে ২ হাজার ১৯ জনের। এর মধ্যে ৩৪১ জনের পজিটিভ পাওয়া গেছে করোনাভাইরাস। এ নিয়ে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫৭২ জনে।

পরীক্ষা করার সংখ্যা এবং নমুনা সংগ্রহের হার আগের দিনের চেয়ে বেড়েছে বলে জানান নাসিমা সুলতানা। তিনি বলেন, নমুনা সংগ্রহের হার আগের দিনের চেয়ে চার শতাংশ বেশি। একই সঙ্গে নমুনা পরীক্ষার হার ১৬ শতাংশ বেশি। তিনি আরও বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় আইসোলেশনে এসেছেন ৩৭ জন। এ নিয়ে বর্তমানে আছেন ৪৬১ জন। এ ছাড়া এ সময়ে আইসোলেশন থেকে ছাড়া পেয়ে ফিরে গেছে ৯ জন। এ নিয়ে মোট ছাড়পত্র পেল ৪৭১ জন।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের অনেক ক্ষেত্রেই সময়মতো শনাক্ত করা যাচ্ছে না। যখন শনাক্ত করা হচ্ছে, তখন তার অবস্থা গুরুতর। সময়মতো রোগী শনাক্ত না হওয়াটাকে ভয়ের কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী প্রথম শনাক্তের ৩৮ দিনের মাথায় এ রোগে মৃত্যুর সংখ্যা, সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়া রোগীর সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে।

 

প্রথমত, রোগীরা মৃদু উপসর্গ থাকলেও গোপন করছেন। দ্বিতীয়ত, কন্টাক্ট ট্রেসিং ঠিকমতো হচ্ছে না। একজন রোগী শনাক্ত হওয়ার পরই তিনি যার যার সংস্পর্শে এসেছেন সবারই পরীক্ষা করা উচিত। সেটা হচ্ছে না। হলে পরীক্ষার সংখ্যা এত কম হতো না। শনাক্ত হওয়া দুই শতাধিক রোগী হাজার খানেক মানুষের সংস্পর্শে আসতে পারে। তাদের পরীক্ষা করা হলে নিয়মিত পরীক্ষার সংখ্যা আরও বাড়ত।

 

দেশে প্রতি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে গড়ে ৮০ জনের কোভিড-১৯ শনাক্তকরণের পরীক্ষা হচ্ছে। মোট জনসংখ্যার অনুপাতে যা একেবারেই কম। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশের তুলনায় এ রোগের পরীক্ষায় বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে। আর বেশি শনাক্ত হয়েছে বিশ্বের এমন দেশগুলোয় পরীক্ষার হার প্রতি ১০ লাখে ১০ হাজারের ওপর।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরীক্ষার ওপর জোর দিয়ে আসছে। সংস্থাটি প্রকাশিত সর্বশেষ করোনাভাইরাস প্রতিরোধ বিষয়ক কৌশলপত্রে বলেছে, এখন পর্যন্ত এ রোগের কোনো টিকা বা সুনির্দিষ্ট ওষুধ নেই। পরীক্ষার মাধ্যমে দ্রুত রোগী শনাক্ত করা এবং তার সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা গেলে এ ভাইরাসের দ্রুত সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব হবে। তাই সাধারণ জনগণের মধ্যে করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা করতে দেশগুলোকে সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

বর্তমানে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে মোট ১৭টি ল্যাবরেটরিতে কোভিড-১৯ শনাক্তকরণের পরীক্ষা হচ্ছে। এসব ল্যাবরেটরিতে দিনে সাড়ে চার হাজারের বেশি নমুনা পরীক্ষা করার সক্ষমতা থাকলেও এখন পর্যন্ত একদিনে সর্বোচ্চ পরীক্ষা হয়েছে ২ হাজার ১৯টি। ফলে বিদ্যমান ল্যাবরেটরিগুলোর সক্ষমতার অর্ধেকের বেশি অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা শনাক্তকরণের পরীক্ষা বাড়লে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যাও বাড়বে। পর্যাপ্ত পরীক্ষা না হওয়ায় করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি আইসোলেশনে না থেকে সাধারণভাবে চলাফেরা করে। এতে একজনের মাধ্যমে আরও অনেকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে।

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) দেশে করোনাভাইরাস শনাক্তের পরীক্ষা শুরু করে। শুরুতে বিদেশফেরত এবং তাদের সংস্পর্শে না এলে পরীক্ষা করা হয়নি। গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হন। ৩০ মার্চ থেকে পরীক্ষাকেন্দ্রের আওতা বাড়ানো শুরু হয়।

ওয়ার্ল্ডোমিটারের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতি ১০ লাখে ৮০ জনের করোনার পরীক্ষা করা হচ্ছে। ওয়ার্ল্ডোমিটারের হিসাব অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি পরীক্ষা হচ্ছে মালদ্বীপে। দেশটিতে প্রতি ১০ লাখে পরীক্ষা ৫ হাজার ৩৬৩ জনের পরীক্ষা করা হচ্ছে। প্রথম রোগী শনাক্ত হয়েছিল ৭ মার্চ। এ পর্যন্ত মোট শনাক্ত রোগী ২১ জন। ভুটানে প্রতি ১০ লাখে ১ হাজার ৫১১, পাকিস্তানে ৩৩২, শ্রীলঙ্কায় ২২৩, নেপালে ২১৬ এবং ভারতে ১৭৭ জনের পরীক্ষা করা হচ্ছে। ভারতে প্রথম রোগী শনাক্ত হয়েছিল ৩০ জানুয়ারি। এ পর্যন্ত শনাক্ত মোট রোগী সাড়ে ১১ হাজার ছাড়িয়েছে।

আক্রান্ত শীর্ষ দেশগুলোয় করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সব দেশেই এক থেকে দেড় মাস পরে বড় ধরনের উত্থান ঘটেছে আক্রান্তের সংখ্যায়। দেশগুলো ব্যাপকভিত্তিক পরীক্ষার মাধ্যমে রোগী শনাক্ত করেছে। একই সঙ্গে সংক্রমণ প্রতিরোধে লকডাউন এবং সামাজিক দূরত্ব রক্ষায় জোর দেওয়াসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা জানিয়েছেন, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে আরও ১১টি নতুন পরীক্ষাকেন্দ্র চালু করা হবে। কেন্দ্রগুলো হলো কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, মুগদা মেডিকেল কলেজ, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ, কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ, দিনাজপুরের এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ ও বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ। পরীক্ষার সংখ্যা বাড়লে করোনা শনাক্তকরণ কিটের প্রয়োজন হবে।

সমগ্র বাংলাদেশকে সংক্রমণের ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা : করোনা ভয়াবহ আকার ধারণ করায় পুরো বাংলাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ ঘোষণা দেওয়া হয়।

সেখানে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারী আকারে বিস্তার লাভ করায় লাখো মানুষ আক্রান্ত ও মারা গেছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায়ও এ ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে। হাঁচি, কাশি ও পরস্পর মেলামেশার কারণে এ রোগের বিস্তার ঘটে। এখন পর্যন্ত বিশ্বে এ রোগের কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী এ রোগের একমাত্র প্রতিষেধক হলো পরস্পর হতে পরস্পরকে নির্দিষ্ট দূরত্বে অবস্থান করা এবং যেহেতু জনসাধারণের একে অন্যের সঙ্গে মেলামেশা নিষিদ্ধ করা ছাড়া সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব নয় এবং যেহেতু বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় এ রোগের সংক্রমণ ঘটেছে। সেহেতু সংক্রমক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মল) আইন, ২০১৮ (২০১৮ সালের ৬১নং আইন)-এর ১১ (১) ধারার ক্ষমতাবলে সমগ্র বাংলাদেশকে সংক্রমণের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করা হলো। সংক্রমিত এলাকার জনসাধারণকে নিম্নলিখিত নির্দেশনাবলী কঠোরভাবে অনুসরণ করার জন্য করা হলো।

* করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে জনগণকে ঘরে অবস্থান করতে হবে। অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হওয়া যাবে না।

* এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় চলাচল করতে নিয়ন্ত্রণ করা হলো।

* সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত কেউ ঘরের বাইরে যেতে পারবে না।

আদেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ওপরে বর্ণিত আইনে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ছাড়া স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রশাসন ও কর্তৃপক্ষের সহায়তা নিয়ে আইনের সংশ্লিষ্ট অন্য ধারাগুলো প্রয়োগ করার ক্ষমতা সংরক্ষণ করতে।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top