সিডনী মঙ্গলবার, ২৩শে এপ্রিল ২০২৪, ১০ই বৈশাখ ১৪৩১


দাবানলের পর : মোঃ ইয়াকুব আলী


প্রকাশিত:
১৭ এপ্রিল ২০২০ ২৩:৩৮

আপডেট:
২২ মে ২০২০ ১৫:০৬

হেলিকপ্টার থেকে ফেলা খাবার খাচ্ছে ক্যাঙ্গারু

 

স্যার আচার্য জগদীশ চন্দ্র বোস এক অদ্ভুত এবং আমার মতে অসম্ভব আবিষ্কার করেছিলেন সেটা হচ্ছে গাছেরও জীবন আছে। সেই অর্থে গাছের জীবনবোধের সকল প্রকার অনুভূতিও থাকার কথা এবং সময়ে সময়ে সেগুলো প্রকাশও করার কথা। আমি জানিনা ঠিক কিভাবে তারা সেগুলো প্রকাশ করে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা বুশ ফায়ারে অস্ট্রেলিয়ার অনেক বনের গাছ গাছালি থেকে শুরু করে বহু বন্যপ্রাণী হতাহত হয়েছে। এইবারের আগুনের প্রকোপ এতোই বেশি ছিলো যে সেটা বন ছাড়িয়ে মানুষের বাড়িতে হানা দিয়েছিলো এবং বহু বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে। মানুষ হতাহতের পরিমাণও একেবারে কম নয় তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে গাছেরা। গত বছরও বুশ ফায়ারে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিলো। সেবারই প্রথম গাছেদের পুনর্জীবনের ব্যাপারটা লক্ষ করেছিলাম। ট্রেনে করে অফিসে আসা যাওয়ার পথে বুশ ফায়ারে পুড়ে যাওয়া গাছগুলোকে দেখতাম আর মনে মনে হা পিত্যেশ করতাম। পরে হঠাৎ একদিন লক্ষ করলাম গাছগুলোর মধ্যে এক ধরণের পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। 

গত বছর এপ্রিলে গ্লেনফিল্ড আর হলসওয়ার্দির মাঝের বনে আগুন লেগেছিলো। এরপর ট্রেনে আসতে যেতে যে গাছগুলোকে সবুজ দেখতাম রাতারাতি সেগুলোকে কেমন যেন অদ্ভুত দেখাচ্ছিলো। একটাও পাতা অবশিষ্ট নেই। সারিসারি গাছ দাঁড়িয়ে আছে অনেকটা ভুখা নাঙ্গা শিশুর ভঙ্গিমায়। দেখে মনেহয় এ যেন যুদ্ধবিধস্ত ইয়েমেনের অপুষ্টির শিকার বাচ্চাগুলো কারণ গাছেরও জীবন আছে। এরপর সময় বয়ে যায়। ধীরেধীরে গাছগুলোতে পরিবর্তন আসতে শুরু করলো। হঠাৎ খেয়াল করে দেখি গাছগুলোর সারা শরীর থেকে পাতা গজাচ্ছে। সাধারণত কান্ডের যে সকল স্থান থেকে শাখা বা পাতা বের হয় সেরকম কোন নিয়ম মেনে বের হচ্ছে না। দেখে খুবই অবাক হলাম। ধীরে ধীরে গাছগুলোর সারা শরীর সবুজ পাতায় ঢেকে গেলো। ট্রেনে আসা যাওয়ার পথে ছবি তোলা সম্ভব না তাই শুধু দেখে গেলাম।

এরপর ধীরেধীরে গাছগুলো প্রায় স্বাভাবিক হয়ে গেছে। ছোট ছোট ডালপালা বেরিয়েছে। আগে যারা গাছগুলোকে দেখেনি তারা ধরেই নেবে এই গাছগুলো শুরু থেকেই এমন ছিলো। তবে কিছু গাছ আর প্রাণ ফিরে পায়নি বিশেষকরে শিশু গাছগুলো কারণ হয়তোবা তাদের শরীরের বেশির ভাগ অংশই পুড়ে গিয়েছিলো। এই গাছগুলোকে দেখলে রূপকথার গল্পে পড়া ফিনিক্স পাখির কথা মনেহয় যেটা আমি মোটেও বিশ্বাস করতাম না কিন্তু এখন মনেহয় সেই গল্পগুলো আসলেই সত্যি। ভাবছি একদিন আমাদের মেয়েটাকে গাছগুলো দেখাবো আর ফিনিক্স পাখির গল্পটা বলবো।

বুশ ফায়ার শুরু হবার পর থেকেই নিবেদিতপ্রাণ দমকল কর্মীরা তাদের জীবন বাজি রেখে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে গেছে। সেটা করতে যেয়ে বেশকজন নিহতও হয়েছেন। এছাড়াও সাধারণ মানুষ তাদের সাধ্যের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মী এবং বন্য প্রাণীদের পাশে দাঁড়াতে। এমনকি মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে কানাডা এবং আমেরিকা থেকে দমকল কর্মীরা তাদের বড়দিনের ছুটি ব্যাড দিয়ে এসে স্ট্রেলিয়ার দমকল কর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছে। মানুষ মানুষের বিপদের দিনে এভাবেই পাশে দাঁড়িয়ে আরো একবার মানব সভ্যতার জয়গান গেয়ে যায়। আগুন নিভে যাওয়ার পর দুর্গত এলাকার প্রাণীদের জন্য হেলিকপ্টার থেকে বিভিন্ন প্রকারের শাকসবজি এবং ফলমূল ছিটানো হচ্ছে যাতেকরে তারা টিকে থাকতে পারে। এছাড়াও সবাই তাদের বাসা বাড়ির বাইরে বাটিতে করে খাদ্য ও পানীয় রেখে দিচ্ছে যাতেকরে পাখিরা এসে সেখান থেকে খাবার সংগ্রহ করতে পারে।

আমরাও আমাদের বাসার পিছনে একটা বাটিতে পানি আর একটা বাটিতে চাল রেখে দিয়েছি। দু একদিন পর পর আবার সেগুলো বদলে দিই। এছাড়াও বাসার সামনের গাছতলায় চাল ও পানি রাখা আছে। প্রায়ই অনেক রকমের পাখি আসে তারমধ্যে শালিকই বেশি। অবশ্য একটা লাল ঠোঁটের ময়না পাখিও মাঝে মধ্যে দেখা যায়। আরো আছে কয়েকটা কোকিল আর মাঝেমধ্যে আসে কাকের দল। শালিক পাখিগুলোর মধ্যে দুটো পাখির জীবন সংগ্রাম দেখে আপনি জীবনে লড়ে যাওয়ার শক্তি পেতে পারেন। একটা পাখির বাম পা টা হাটুর নিচে হঠাৎ শেষ হয়ে গেছে তাই সে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে। আর অন্যটার গলা থেকে শুরু করে সারা মাথায় কোন পালক নেই অনেকটা প্রবাসী মানুষের সিম্বোলিক উপস্থাপন। তাহিয়া এই পাখিটাকে দেখে বলেছে এরা বোধহয় বুশ ফায়ার অঞ্চল থেকে এসেছে।

 

বর্তমান পৃথিবীতে শুধুমাত্র অস্ত্রের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য বিশ্বের একটামাত্র দেশ বিভিন্ন দেশের মধ্যে যুদ্ধ লাগিয়ে বেড়াচ্ছে কারণ তার রাজস্বের অনেক বড় অংশের যোগান আসে অস্ত্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। এভাবে যুদ্ধ চলতে থাকলে জানিনা পৃথিবীর ভবিষ্যৎ কোথায় যেয়ে দাঁড়াবে। তখন এই গাছগুলোকে দেখে আশান্বিত হয় যে একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেলেও সেখান থেকেও শুরু করা যায়। আর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের যে অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো আছে সেগুলো তাদের নিজস্ব সরকারই সমাধান করুক। সমাধান তাদের করতেই হবে। কতদিন আর অবজ্ঞা করে থাকবে কারণ নগর পুড়লে দেবালয়ও রক্ষা পায় না।

আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে সবাই যদি তাদের নিজ নিজ সামর্থ্যের মধ্যে থেকেই সবুজকে লালন করতে এবং ভালোবাসতে শিখে যায় তাহলে কিন্তু বিশ্বের চেহারা বদলে যাওয়া সময়ের ব্যাপার। যেমনঃ মনেকরেন তখন বিশ্বের সব নামকরা অস্ত্র ব্যবসায়ীরা তাদের কারখানায় অস্ত্র না তৈরি করে গাছের চারার বীজতলা তৈরি করবে। রাষ্ট্রগুলো সেখান থেকে অনেক রাজস্ব পাবে তাই তারা সেগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দিবে। এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রকে দমানোর জন্য আর অস্ত্রের ব্যবহার করবে না কিন্তু রূঢ় বাস্তবতা এর উল্টোটা। সাময়িক মুনাফার লোভে মানুষ আমাজনের মতো বনকেও উজাড় করে দিচ্ছে। বন রক্ষা আন্দোলনের কর্মীদের মাথায় গুলি করে মারছে। শুভ বুদ্ধির উদয় হবে রাষ্ট্র নায়কদের। শুভ বুদ্ধির উদয় হবে অস্ত্রের কারখানার মালিকদের।

 

গাছেদের পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া আবার সেখান থেকে বেঁচে উঠার প্রক্রিয়াটা আমাকে মানব জীবন সম্মন্ধে খুবই আশাবাদী করে। আমরাও প্রতিনিয়ত অনেক বিপৎসংকুল পথ পারি দেয়। আবার অনেকেই সেই পথ পারি দিতে যেয়ে ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে আত্মহননের মতো ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নেয়। গাছের কিন্তু সেটা করে না। তারা তাদের শেষ জীবনীশক্তিটুকু দিয়ে পুনর্জীবন লেভার চেষ্টা করে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাতে সফলও হয়। যদিও আগের কলেবর ফিরে পেতে বহু বছর লেগে যায় তবুও তারা চেষ্টা করাটা থামায় না মোটেও। এরমধ্যেই হয়তোবা আবার আগুন লেগে তাদের সেই সম্বলটুকু হারিয়ে যেতে পারে তখন আবার একেবারে নতুন করে শুরু করতে হয় কিন্তু তারা ক্লান্ত হয় না কখনওই। আমি তাই গাছেদের কাছ থেকে জীবন সংগ্রামের শিক্ষা নিই প্রতিনিয়ত। আপনারাও একটু অবসর পেলে বনে যেয়ে গাছেদের এই জীবন সংগ্রাম চাক্ষুষ দেখতে পারেন আর হতে পারেন উদ্যমী।   

 

মো: ইয়াকুব আলী

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top