সিডনী রবিবার, ৫ই মে ২০২৪, ২২শে বৈশাখ ১৪৩১


কাঠের পাখী, চারুলতা ও ছোট্ট পৃথিবী : অমিতা মজুমদার


প্রকাশিত:
৮ জুন ২০২০ ২৩:৩০

আপডেট:
১৩ জুন ২০২০ ২০:৫১

 

হঠাৎ কেমন আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেল। এই হেমন্তে যা একেবারেই কাম্য নয়। কিন্তু অপরাজিতার মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে উঠলো এই বিষণ্ণ মেঘলা দুপুরে। দুপুরটা তার একান্তই নিজের সময়। অনেক বছরের অভ্যাসে এই নির্জনতাটুকু উপভোগ করে সে। বিয়ের পর প্রথম যখন সৈকতের হাত ধরে আত্মীয় পরিজনহীন প্রবাস জীবন শুরু করে তখন বেশ কষ্ট হতো তার। প্রবাসই তো বলা যায় - সেই কোন অজ পাঁড়াগায়ের মেয়ে সে। সেখান থেকে একেবারে সোজা রাজধানী ঢাকায়। সৈকত বেশ ভালো চাকুরী করে। তাই প্রথমেই বলে নেয় তোমাকে কিছু করতে হবেনা। গুছিয়ে সংসার করো,আর ছেলে মেয়ে মানুষ করো।দ্বাদশ শ্রেণীর পরে তাই আর পড়াশুনা করা হয়নি। ছোটবেলা থেকে মা কাকীমার মুখে শোনা ভালো বৌএর যে রূপ মনে গেঁথে গেছে তাই হতে চেষ্টা করেছে। নিজের কোন ইচ্ছা অনিচ্ছার কথা আর ভাবা হয়নি। এক সময় ভুলেই গেছে তার কোন ইচ্ছা থাকতে পারে।

বিয়ের দুবছরের মাথায় কোল জুড়ে আসে শান্ত , তাকে নিয়েই কেটে যেতো বেশিরভাগ সময়। শান্তর বছর তিন বয়েস যখন তখন তিথির জন্ম। যাকে বলে সুখী পরিবার। সৈকত নিপাট ভালো মানুষ। চাকুরীতে উন্নতি করা, দুটো পয়সা বেশি উপার্জন করা, ছেলে মেয়ের, অপরাজিতার নিত্যপ্রয়োজনীয় দরকারগুলো ঠিকঠাক মতো পূরণ করার বাইরে কিছু ভাবতোনা সে।

অপরাজিতার দিনগুলোও স্বাভাবিক নিয়মেই কেটে যায়। ধীরে ধীরে ছেলে-মেয়ে দুটো বড় হয়ে যায় ওদের নিজেদের জগৎ গড়ে ওঠে। সৈকত ও আগের মতো ঘরে সময় দিতে পারেনা। এখন সে তার কর্মস্থলের প্রধান। তাই তার দায় দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে।

অপরাজিতা একেবারে একলা হয়ে গেছে তার আপন হাতে গড়া চেনা ভুবনে। একলা হতে থাকার শুরুতে অপরাজিতার বেশ মন খারাপ হতো। কিন্তু কখন যেন সেই সময়টুকুকে নিজের ভালো লাগার জগতে পাল্টে ফেলেছে তা আজ আর খেয়াল নেই। তাই আজকাল সে একাকী সময় কাটাতেই বেশি ভালোবাসে।

সকাল দশটার মধ্যে একে একে সবাই যার যার মতো বেড়িয়ে যায়। তখন এক কাপ ঘন দুধের চা আর লাল করে ভাঁজা পরোটা নিয়ে বসার ঘরে বসে। টিভিটা খুলে দেয়। রিমোটের বাটন ঘর বদল করে অপরাজিতার মনের ভাবনার চেয়েও দ্রুত। একই সাথে চায়ে পরোটা ডুবিয়ে খায়,দৈনিক কাগজেও চোখ বুলায়, টিভি দেখে আবার ছোট্ট পৃথিবী মানে মোবাইলে ফেসবুক সহ এদিক সেদিক দেখে।

এরকম চায়ে পরোটা ডুবিয়ে খেতে দেখলে তিথি তো রীতিমতো বকাঝকা করে। শান্ত আবার মিটিমিটি হাসে যা দেখলে কেমন অস্বস্তি হয়। আর সৈকত সেতো বলবে এতো বছরেও মানুষ হলেনা। তাই আজকাল ওদের সাথে নাস্তা করা বাদ দিয়েছে অপরাজিতা।

এই সময়টা নিজেকে কেমন স্বাধীন স্বাধীন লাগে তার। কেউ কোথাও নেই তাকে কিছু বলার। অনেক সময় টিভিতে সিরিয়ালে বউ -শাশুড়ির ঝগড়া বা উচ্চ শিক্ষিত দুই মেয়ের এক ছেলেকে নিয়ে টানাটানির বহর দেখে এক একাই শব্দ করে হেসে ফেলে। আজকাল নতুন এক অভ্যাস হয়েছে তার। তাই চা পর্ব শেষ হলে পানের বাক্স নিয়ে বসে। বেশ আয়েশ করে এক খিলি পান মুখে পুরে ফেসবুকে মনোনিবেশ করে। 

ফেসবুকে টুক করে একটা গল্প লিখে পোস্ট করে। আর অস্থির হয়ে দেখে কয়টা লাইক পড়েছে,কয়টা লাভ পড়েছে,কয়টা ওয়াও পড়েছে। কতজনা মন্তব্য করেছে।বেশ লাগে এই সময়টা তার একান্ত নিজের করে অনুভব করতে পারে বলে।

সেদিন একটা কবিতা লিখেছিল। হঠাৎ দেখে সেখানে মন্তব্য করেছে সৈকত। যদিও তার ফেসবুক আইডিটা অন্য নামে ছবিও দেয়া আছে ফুলের। তাই সৈকত জানেইনা এটা কার কবিতা।

দুপুরে তার তেমন কাজ থাকেনা। কারন দুপুরে বাসায় কেউ খায়না। তাই নিজের ইচ্ছেমতো যা হোক  একটা কিছু করে নেয় সে। নইলে আগের দিনের ভাত তরকারি যা থাকে তাই দিয়ে চালিয়ে নেয়। এরই মাঝে ঘরের কাজে সাহায্যকারী মাসি এসে ঘরদোর পরিষ্কার করে মুছে দেয়। কাপড়-আজকাল মেশিনেই দেয়। তাই কাপড় ধোঁয়ার পাট নেই। মাসি কাজকর্ম শেষ করে চলে গেলে সে  স্নান সেরে নেয়।তারপর মধ্যাহ্ন ভোজ সারে। সেও সেই সকালের নাস্তার মতোই রাজকীয় হালে। এবারে এক খিলি পান মুখে দিয়ে এসে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়। আর চোখ বুঁজে ভাবে -- ইশ এখন যদি সেই ছোটবেলার মতো সবার চোখ এড়িয়ে বন্ধুকে নিয়ে সারা গ্রামটা চষে বেড়ানো যেতো। এখন গ্রাম না হোক এই ঢাকা শহরে খোলা রিক্সায় চেপে এলোমেলো ভাবে ঘুরতে পারত ! এই হেমন্তে বিকেলের রোদের তাপ শরীর পোড়াতনা বরঞ্চ আরাম লাগতো । কোথাও রিক্সা থামিয়ে একটু ফুচকা খেতো বেশি ঝাল আর টক দিয়ে। নয়তো হাত ভরে রেশমী চুড়ি কিনত !   

একাকী সময় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। অগত্যা হাতে তুলে নেয় তার ছোট্ট পৃথিবী-- তারপরে মেসেঞ্জারে উঁকি মারে কার মাথার উপরে সবুজ আলো দেখা যাচ্ছে ! আঙ্গুলের কোমল পরশে চলে কথার পিঠে কথা বলা।কেউ হয়তো একেবারেই অচেনা,কেউ খানিকটা চেনা, দেখা হয়নি কখনো তাদের। তবু তারা বন্ধু হয়ে যায়। চলে সুখ দুঃখের আলাপ।

এ এক আশ্চর্য পৃথিবী !

গত বছর তার ভাগ্নী এসেছিল।দিন পনেরো ছিল। সেই তাকে ফেসবুকে একাউন্ট খুলে দেয়। কিভাবে লিখতে হয় শিখিয়ে দেয়। সেখান থেকেই একটু একটু করে এখন সে লিখতে শিখেছে। যখন কোথাও ঠেকে যায় ভাগ্নীকে মেসেজ করে। সে জানিয়ে দেয় কি করতে হবে।

এরপর থেকে সৈকতের সাথেও তার টুকটাক কথা হয়। এই যেমন তার লেখায় সৈকত মন্তব্য করে, সে তার উত্তর দেয়। মনে মনে তখন অপরাজিতা ভাবে,যে সৈকত তাকে মানুষ বলেই গন্য করেনা, সে হয়তো নিজের চোখে দেখলেও বিশ্বাস করবেনা তার মতো বারো ক্লাস পড়া কোন মেয়ে ,যে কিনা বিয়ের পর বই ছুঁয়েও দেখেনি সে এমন ঝরঝরে নির্ভুল বাংলায় গল্প কবিতা লিখে যাচ্ছে অনায়াসে!  

কখনো কখনো অপরাজিতার চারুলতার কথা মনে পড়ে। অমলের হাত ধরে তার লুকানো কবিতার খাতাখানা যেমন চলে গিয়েছিল ছাপাখানায়। তার লেখা গল্প কবিতা কি তেমন করে মলাটবন্দী করে কোনদিন তুলে দিতে পারবে সৈকত,শান্ত,আর তিথির হাতে ?

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top