সিডনী রবিবার, ১৯শে মে ২০২৪, ৫ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১


হুইলচেয়ার : পার্থ তালুকদার


প্রকাশিত:
২৩ জুন ২০২০ ২১:৫৭

আপডেট:
২৩ জুন ২০২০ ২১:৫৮

 

পা দুইটা কেটে ফেলার জন্য শিকদার মিয়া অবশেষে রাজি হয়েছেন। ডাক্তাররা তাকে অভয় দিচ্ছেন এই বলে যে, পা কাটলেই জীবনটা নিশ্চিত বেঁচে যাবে। দু’পায়েই পচন ধরেছে তার। তিন বছর ধরে বিছানায় শুয়ে-বসে নির্মমভাবে সময় কাটছে। তার স্ত্রী এমন কঠিন সময়ে ধৈর্য ধরে সংসারের ঘানি টেনে চলছেন তবুও স্বামীর প্রতি কখনো মন বেজার করে কথা বলেননি, ঔদ্ধত্য আচরণ করেননি। সবকিছু ঠিকঠাক আগলে নিয়েছে তিনি। শহুরে ডাক্তার থেকে শুরু করে গ্রাম্য কবিরাজের নির্দেশনাও তিনি যথাযথভাবে পালন করছেন। তাদের পরামর্শে তিনি বন-জঙ্গল থেকে ওষধি গাছের লতাপাতা খুঁজে নিয়ে সিদ্ধ করে স্বামীর দু’পায়ে লেপন করেছেন কয়েকবার, তাতেও কাজ হয় নি। তাই শহরের এক হাসপাতালে আজ পা দুটি কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত হয়েছে।

প্রয়োজনীয় কাগজপত্রে স্বাক্ষর করেছেন শিকদার মিয়ার স্ত্রী সহেলী বেগম। তাদের একমাত্র ছেলে দেলোয়ার মিয়া তার বউ-বাচ্চা নিয়ে হাসপাতালে হাজির হয়েছে। সে বিয়ের পরপরই বউ নিয়ে আলাদা বাসায় থাকে। তাই শিকদার মিয়ার সংসারের সদস্য সংখ্যা তারা স্বামী-স্ত্রী মিলে দুজনই। তার ছেলে মাঝেমধ্যে তাকে দেখতে আসে তবে টাকাপয়সার বিষয়টা উঠলেই সে এড়িয়ে যায়। তাই সবকিছু সহেলী বেগমেরই সামলাতে হয়।

দুইটা ছেলে স্ট্রেচার নিয়ে শিকদার মিয়ার বেডের দিকে এগিয়ে আসে। তাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। শিকদার মিয়া স্ট্রেচার নিয়ে আসা ছেলে দুইটাকে বলেন, ‘তোমরা একটু পরে আসো। আমি আমার স্ত্রীর সাথে একটু কথা বলতে চাই’।

- শুনো দেলোয়ারের মা, তুমি যে কাগজপত্রে সাইন করেছো, তা বুঝেশুনে করেছ তো?
সহেলী বেগম বেশ চমকে উঠলেন। বললেন, হ্যাঁ, এখানে না বুঝার কী আছে!

সকালবেলা হাসপাতালের পরিবেশটা একটু শান্তই থাকে। কিন্তু দশটার পর থেকেই দর্শনার্থীরা দলে দলে হাসপাতালের গেইট দিয়ে প্রবেশ করে। তখন হাসপাতালের পরিবেশটা লোকারণ্য বাজারের মতো মনে হয়। যে দিকে চোখ যায় সেদিকেই শুধু মানুষ আর মানুষ। রোগী আর দর্শনার্থী মিলে গিজগিজ একটা অবস্থা।

এত মানুষের ভীড়েও শিকদার মিয়া আর সহেলী বেগম যেন একাকী, সবার থেকে বিচ্ছিন্ন। কারো মুখে কোনো কথা নেই। শিকদার তার স্ত্রীর হাতদুটি ধরে নিশ্চুপ বসে আছেন। কিছু একটা বলতে গেলে বুকের ভেতরটা গোল পাকিয়ে ওঠে। তবুও তার মনের কথাটা না বলে শান্তি পাচ্ছেন না। চোখদুটি তার জলে টলটল করছে।

‘বুঝলে দেলোয়ারের মা, এই পৃথিবীতে কারো কারো জন্মই হয় শুধু মানুষকে কষ্ট দিতে, মানুষকে জ্বালা যন্ত্রনা দিতে। আবার কারো জন্ম হয় পরকে সেবা করার জন্য। দেখো, আমাকে বিয়ে করে তুমি কী পেয়েছো। আজ ত্রিশটা বছর আমাদের সংসার। তুমি শুধু দিয়েই গেলে। আর আমি গাও-গেরাম চষে বেড়িয়েছি। আজ এখানে যাত্রাগান তো কাল সেখানে বাউলগান। আর এদিকে তুমি শুধু সেবা করেই গেলে। সংসার সেবা। বিনিময়ে কী পেলে বলো। একটা ছেলে ছিল সেও অন্যত্র সংসার বেঁধেছে। আর আমি বারো বাজার খেয়ে আজ পঙ্গু হয়ে বাক্সবন্দী।’

- এখন এসব বাদ দাও তো দেলোয়ারের বাপ। এই সময়ে চোখের পানি ফেলতে নেই। মনে জোর রাখো। আল্লা আল্লা করো।
- এক কাজ করলে কি হয় দেলোয়ারের মা। পা দুইটা না- কাটলে হয় না। তার চেয়ে বরং পচতে পচতে মইরা যাই।
- ও আল্লা, এ কী কও তুমি !
- তাইলে তুমি কও...তুমি আমারে কথা দাও, আমার পা দুইটা কাটা পড়লে আমাকে কখনো অবহেলা করবে না, অবজ্ঞা করবে না। আমি মারা যেতে রাজি আছি কিন্তু তোমার অবহেলা সহ্য করতে পারবো না। আমি যে তোমার ভালোবাসার কাঙ্গাল রে সহেলী, তোমার ভালোবাসার কাঙ্গাল।

কথা বলতে বলতে শিকদার মিয়ার গলা ধরে আসে। চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়তে থাকে। কাঁধের গামছা দিয়ে অবিরত চোখ মুছছেন তিনি। তার শৈশবের স্মৃতি চোখের পাতায় খেলা করছে যেন। ফুটবল, কাবাডি, কত ধরনের খেলা খেলতেন এই দু'পা দিয়ে!

স্ট্রেচার নিয়ে আসা ছেলে দুইটা একটু পরপর তাড়া দিচ্ছে। শিকদার মিয়ার খুব ধমক দিতে ইচ্ছে করছে তাদেরকে। কিন্তু পারছেন না। পা দুইটা একটু নড়তেই শরীরে যেন কাঁটা দিয়ে উঠল। অবশেষে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া হলো শিকদার মিয়াকে।

হাসপাতালের বারান্দায় লোহার গ্রীল ধরে সহেলী বেগম দাঁড়িয়ে আছেন। তার ছেলে আর ছেলের বউ খানিক আগে বিদায় নিয়েছে। সহেলী বেগমের সিক্ত চোখজোড়া রাস্তায় একটা দৃশ্যের মধ্যে আটকে গেল। একজন মহিলা হুইলচেয়ারে বসা একজন বৃদ্ধকে নিয়ে ভিক্ষা করছে। দৃশ্যটা দেখেই তার শরীরটা শিউরে উঠল। তার দু’পায়ে তিনি যেন আর ভর রাখতে পারছেন না। এইমুহূর্তে তিনি কারো কাঁধে একটু সময়ের জন্য একটি হাত রাখতে চান। কে আছে; যে তার পাশে দাঁড়াবে ? কেউ নেই, কোথাও নেই! তার মাথা ঘুরছে; তিনি হয়তো এক্ষুনি পড়ে যাবেন নির্দয়, নির্মম, অসাড় এই পৃথিবীর পৃষ্ঠে।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top